×
এ প্রবন্ধে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, “যে ব্যক্তি রমযান মাসের সিয়াম পালন করার পরে শাওয়াল মাসে ছয় দিন সিয়াম পালন করল সে যেন সারা বছর সাওম পালন করল।” শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন সম্পর্কিত হাদীসের ফায়েদা আলোচনা করা হয়েছে।

    সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............

    এ প্রবন্ধে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, “যে ব্যক্তি রমযান মাসের সিয়াম পালন করার পরে শাওয়াল মাসে ছয় দিন সিয়াম পালন করল সে যেন সারা বছর সাওম পালন করল।” শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন সম্পর্কিত হাদীসের ফায়েদা আলোচনা করা হয়েছে।

    আবূ আউয়ূব আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ».

    “যে ব্যক্তি রমযান মাসের সিয়াম পালন করার পরে শাওয়াল মাসে ছয় দিন সিয়াম পালন করল সে যেন সারা বছর সাওম পালন করল।”[1]

    ১- শাওয়াল: হিজরী বছরের দশম মাস হলো শাওয়াল এবং এ মাসটি হজের মাসসমূহের প্রথম মাস। শাওয়ালকে এ নামে অভিহিত করার কারণ হলো এ সময় উট গর্ভবতী হওয়ার সময় হয় (তখন এর দুগ্ধ শুকিয়ে যায় এবং পেট উচুঁ হতে থাকে)। এর বহুবচন হলো شوالات [2]

    ২- দাহর: দীর্ঘ সময়ের সমষ্টিকে দাহর বলে। তবে এখানে দাহর বলতে চন্দ্র বছরের পূর্ণ এক বছরকে বুঝানো হয়েছে।[3]

    ৩- হাদীসে শাওয়াল মাসকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কেননা রমযানের সাওম পালনের পরে এ সময় পানাহার করতে মানুষ খুব আগ্রহী হয়। তাই এ সময় সাওম পালন অধিক কষ্টকর। সুতরাং এর সাওয়াবও অনেক বেশি।[4]

    ৪- সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি হওয়া যদিও সব ধরণের ফরয (রমযানের সাওম) ও নফল (শাওয়ালের ছয়টি সাওম) সাওমের জন্য সাব্যস্ত তথাপি ফরয সাওমের সাওয়াব নফল সাওমের চেয়ে অধিকহারে বৃদ্ধি পায়।[5]

    ৫- কতিপয় মানুষ শাওয়ালের অষ্টম দিনকে সৎকাজ পালনকারীদের ঈদের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন; কিন্তু এভাবে উক্ত দিনকে ঈদের দিন হিসেবে বিশ্বাস করা জায়েয নেই। কেননা শাওয়ালের অষ্টম দিনটি উম্মতের মুসলিমদের ঐক্যমতে ঈদের দিন নয় এবং এ দিনটি ঈদের কোনো শা‘আয়ির তথা নিদর্শনও নয়।[6]

    ৬- নির্দিষ্ট নফল সাওমের নিয়ত রাত্রি থেকেই করা ওয়াজিব। যেমন, শাওয়ালের ছয়টি সাওম, ‘আরাফাতের দিনের সাওম ‘আশুরার সাওম, সোমবার ও জুমু‘আবারের সাওম। রাত্রি থেকে নিয়ত না করলে কাঙ্ক্ষিত সাওয়াব পাওয়া যাবে না। তবে অন্যান্য সাধারণ নফল সাওমের নিয়ত দিনের বেলায় করলেও সহীহ হবে। শাইখ উসাইমীন রহ. এমতটি অগ্রাধিকার দিয়েছেন।[7]

    ৭- সৎপূর্বসূরী ও উত্তরসূরী জমহুর আলেম, বিশেষকরে ইমাম আবূ হানিফা, শাফে‘ঈ ও আহমাদ রহ. শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন করাকে মুস্তাহাব বলেছেন।[8]

    ৮- যে ব্যক্তি রমযানের সাওমের সাথে শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন করল সে যেন সারা বছর সাওম পালন করল। যেহেতু সৎকাজের সাওয়াব দশগুণ করে দেওয়া হয়, সেহেতু রমযানের একমাস সাওম পালন মানে দশ মাস সাওম পালন, আর শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন অবশিষ্ট দু মাস সাওম পালনের সমান। এভাবে পুরো বছর সাওম পালন পূর্ণ হয়ে যায়। তাই বান্দা আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানীতে বিনা কষ্টে সারা বছর সাওম পালনের সাওয়াব লাভ করে।[9]

    ৯- ঈদের দিনের পরের দিন থেকেই শাওয়ালের ছয়টি সাওম লাগাতর পালন করা আলেমগণ নিম্নোক্ত কারণে মুস্তাহাব বলেছেন:

    ক- কল্যাণের কাজে দ্রুত এগিয়ে আসা।

    খ- সাওমের কাজে দ্রুত এগিয়ে আসাতে সাওম পালন ও আনুগত্যের কাজে ব্যক্তির আগ্রহ ও উৎসাহ প্রকাশ পায় এবং এতে বিরক্তি থাকে না।

    গ- বিলম্ব করলে কোনো বিপদ আপতিত হতে পারে, যা তাকে সাওম পালনে বিরত রাখতে পারে।

    ঘ- রমযানের সাওমের পরপর শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন যেমন ফরয সালাতের পরে নফল সালাত আদায়ের মতো। সুতরাং রমযানের পরাপরই এ সাওম পালন করা উচিৎ।[10]

    ১০- উত্তম হলো ঈদের দিনের পরের দিন থেকেই ধারাবাহিকভাবে ছয়টি সাওম আদায় করা। তবে কেউ একাধারে পালন না করলে বা শাওয়ালের শেষের দিকে আদায় করলে উপরোক্ত সাওয়াব অর্জিত হবে।[11]

    ১১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, “শাওয়ালের ছয়টি সাওম” দ্বারা বুঝা যায় যে, উক্ত ছয়টি সাওম ধারাবাহিকভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবেও পালন করা জায়েয। শাওয়ালের শুরুতে বা মধ্যভাগে বা শেষভাগের যে কোনো সময় মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ সাওম পালন করা জায়েয।[12]

    ১২- ফরয সাওম দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও শাওয়ালের নফল সাওম পালন করার ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন। তিন ইমাম জায়েয বলেছেন। তারা ফরয সালাতের আগে নফল সালাত আদায় করার বৈধতার ওপর উক্ত মাসআলাকে কিয়াস করেছেন।[13]

    ১৩- শাওয়ালের ছয়টি সাওম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদায় করতে না পারলে তা কি কাযা করা যাবে? এ ব্যাপারে আলেমদের দু’টি মত রয়েছে। অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত হচ্ছে, কাযা করা যাবে না। কেননা এগুলো নফল সাওম যা তার নির্দিষ্ট সময়ের সাথে নির্ধারিত এবং সে সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।[14]

    আবার কতিপয় আলেম বলেছেন, শর‘ঈ ওযরের কারণে যেমন, অসুস্থতা, হায়েয ও নিফাস ইত্যাদি কারণে ছুটে গেলে শাওয়াল মাসের পরেও কাযা করা যাবে। শাইখ আব্দুর রহমান আস-সা‘দী ও শাইখ ‘উসাইমীন এ মতটি গ্রহণ করেছেন।[15]

    ১৪- শাওয়ালের ছয়টি সাওম শুরু করে পূর্ণ না করা জায়েয আছে, তবে শর‘ঈ ওযর ব্যতীত ভেঙ্গে ফেলা মাকরূহ। এটি শাফে‘ঈ ও হাম্বলী মাযহাবের অভিমত।[16]

    ১৫- শাওয়াল মাসের শুধু জুমু‘আর দিন সাওম পালন করা মাকরূহ। তবে জুমু‘আর দিনের আগের বা পরের দিন সাওম পালন করলে মাকরূহ হবে না। এটি শাফে‘ঈ, হাম্বলী ও কতিপয় হানাফী মাযহাবের অনুসারী আলেমগণের অভিমত।[17]

    ১৬- উপরোক্ত হাদীস দ্বারা সারা বছর সাওম পালন করার বৈধতার দলীল সাব্যস্ত হবে না। কেননা শাওয়ালের ছয়টি সাওমের সাওয়াব বাস্তবে সারা বছর সাওম পালনের অনুরূপ নয়। তাছাড়া সারা বছর সাওম পালন করা মাকরূহ। যেহেতু এতে শারীরিক দুর্বলতা ও সংসারত্যাগী হওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। আর শাওয়ালের শুধু ছয়টি সাওম পালনে এ সমস্যা হয় না।[18]

    ১৭- ইমাম কারাফী রহ. বলেছেন, ভালো কাজের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি হওয়া এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী,

    «مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ».

    “যে ব্যক্তি রমযান মাসের সিয়াম পালন করার পরে শাওয়াল মাসে ছয় দিন সিয়াম পালন করল সে যেন সারা বছর সাওম পালন করল।”[19] এ হাদীস রমযানের সাওম পালনের সাথে সাদৃশ। আর শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালন সারা বছর সাওম পালনের সমান- এটিও শুধুমাত্র এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য। কেননা ভালো কাজের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি হওয়া শুধু এ উম্মতেরই বৈশিষ্ট্য।[20]

    [1] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৪।

    [2] তাওদীহুল আহকাম, ৩/৫৩৩।

    [3] তাওদীহুল আহকাম, ৩/৫৩৩।

    [4] ফায়দুল কাদীর, ৬/১৬১।

    [5] আত-তানবীর শরহে জামে‘উস সাগীর, ৫/২৭০।

    [6] হাশিয়াতুর রাওদুল মুরবি‘, ৩/৪৪৯।

    [7] শরহুল মুমতি‘, ৬/৩৬০।

    [8] তাওদীহুল আহকাম,, ৩/৫৩৩।

    [9] তাওদীহুল আহকাম, ৩/৫৩৪।

    [10] তাওদীহুল আহকাম, ৩/৫৩৪।

    [11] শরহে মুসলিম, ইমাম নাওয়াবী, ৮/৫৬।

    [12] তাসহীলুল ইলমাম, সালিহ ফাওযান, ৩/২৪৪।

    [13] তাওদীহুল আহকাম, ৩/৫৩৪।

    [14] তাওদীহুল আহকাম, ৩/৫৩৪।

    [15] ফাতাওয়া সা‘দীয়া, পৃ. ২৩০; শরহুল মুমতি‘, ৬/৪৬৬।

    [16] আল-মাজমু‘ শরহিল মুহাযযাব, ৬/৩৯২; কাশশাফুল কিনা‘, ২/৩৪৩।

    [17] আল-মাজমু‘ শরহিল মুহাযযাব, ৬/৪৩৬; কাশশাফুল কিনা‘, ২/৩৪০; বাদায়ি‘উস সানাই‘, ২/৭৯।

    [18] শরহি বুলুগুল মারাম, ২/১৫৪।

    [19] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৪।

    [20] আল-‘আলাম বি ফাওয়ায়িদি উমদাতুল আহকাম, ৫/৩৪০।