×
মুসলিম উম্মাহ থেকে বিচ্যুত শিয়া মতাবলম্বীরা ইসলামের শুরুর যুগের কতক ঘটনাকে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বেছে নিয়েছে, তন্মধ্যে ফিদাকের ঘটনা একটি, ঘটনাটি তাদের দ্বারা অনেক বিকৃতি ও পরিবর্তনের শিকার হয়েছে, লেখক তার সুন্দর উত্তর দিয়ে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। পাঠক মাত্র প্রকৃত বিষয় বুঝতে সক্ষম হবেন আমাদের বিশ্বাস।

ফিদাক নিয়ে ফাতিমা ও আবূ বকরের মাঝে বিরোধের হাকীকত

www.alserdaab.org

অনুবাদক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ

সম্পাদনা : ড. আবূ বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

فدك وحقيقة الخلاف بين الصديق وفاطمة رضي الله عنهما

(باللغة البنغالية)

شبكة منهاج السنة

ترجمة: ثناء الله نذير أحمد

مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

সূচিপত্র

১. ফিদাক নিয়ে শিয়াদের গবেষণা... 3

২. ফিদাক ঘটনা নিষ্পত্তির উত্তম পন্থা... 5

৩. আবূ বকরের হাদীস আহলুস-সুন্নাহ ও শিয়া দু’পক্ষের নিকট সহীহ 7

৪. অত্র হাদীস ‘বিলায়াতুল ফকীহ’র পক্ষে খোমেনির দলীল.. 9

৫. নবীগণের নিজের সন্তানদের ওয়ারিশ বানানোর দলীলের অসারতা 12

৬. সুলাইমান পিতা দাঊদ কিসের ওয়ারিশ হয়েছেন?. 14

৭. নারীদের মিরাস সম্পর্কে শিয়া ইমামিয়াদের বিপরীত মুখী অবস্থান 16

৮. ফিদাক পৈত্রিক সম্পত্তি বা হেবা কোনটিই নয়.. 19

৯. ফিদাকের জমির ব্যাপারে আলী ও আবূ বকরের ঐকমত্য.... 22

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............

মুসলিম উম্মাহ থেকে বিচ্যুত শিয়া মতাবলম্বীরা ইসলামের শুরুর যুগের কতক ঘটনাকে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বেছে নিয়েছে, তন্মধ্যে ফিদাকের ঘটনা একটি, ঘটনাটি তাদের দ্বারা অনেক বিকৃতি ও পরিবর্তনের শিকার হয়েছে, লেখক তার সুন্দর উত্তর দিয়ে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। পাঠক মাত্র প্রকৃত বিষয় বুঝতে সক্ষম হবেন আমাদের বিশ্বাস।

ফিদাকের পরিচয়:

ফিদাক হিজাজ বা আরব উপ-দ্বীপের একটি গ্রাম বা জনপদ। এখানে ইয়াহূদীদের বসতি ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খায়বার প্রসঙ্গ নিষ্পত্তি করেন, আল্লাহ তাদের অন্তরে ভয় ঢুকিয়ে দেন, ফলে তারা ‘ফিদাকে’-এর জমির বিনিময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হয়। বিধি মোতাবেক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ফিদাকে’-এর নিজের মালিকানায় রাখেন, মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করেন নি। কারণ, সেটি অর্জন করার জন্য তাদের ঘোড়া ও জনবল কষ্ট করে নি।

ফিদাক নিয়ে শিয়াদের গবেষণা:

ফিদাকের জমি নিয়ে খলিফা আবূ বকর ও সায়্যেদাহ ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মধ্যকার মতপার্থক্য দ্বিপক্ষীয় দলীলের ওপর নির্ভর ছিল, তাদের কেউ পার্থিব মোহাবিষ্ট ছিলেন না, তবে অনেকের আবেগ ও অনুরাগ আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যক্তি সত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যে কারণে হিতে বিপরীত হয়, যা সাধারণত শিয়াদের পক্ষ থেকেই ঘটে।

আমরা যদি আবূ বকর ও ফাতিমার জায়গায় দু’জন শিয়া ফকীহ বা বিশেষ ব্যক্তিকে প্রতিস্থাপন করি, তাহলে শিয়ারা প্রত্যেককে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবেন দলীলের কারণে, কাউকে দোষারোপ করবেন না কিংবা কারও নিয়তকে অশুদ্ধ বলবেন না, দু’জনকে যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা করবেন, যদিও একপক্ষের দলীল অপরপক্ষ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী।

কিন্তু আবূ বকর ও ফাতিমার বিষয়টি তারা সেই দৃষ্টিতে দেখতে পারছেন না, কারণ আবূ বকর তাদের (শিয়াদের) শত্রু, তাই যত দোষ ও ভুল সব আবূ বকরের! এভাবে কি বিরোধপূর্ণ একটি বিষয়ের নিষ্পত্তি ও ফয়সালা হয়?! আবেগ কি ন্যায়দণ্ড হওয়ার যোগ্যতা রাখে? কখনো নয়। যে আবেগ বাদী ও বিবাদী দু’জনের মাঝে ন্যায়দণ্ড হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, সে আবেগ কিভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা ও শর‘ঈ সিদ্ধান্তের মানদণ্ড হয়?! অতএব, আবূ বকর ও ফাতিমার বিষয়টি আবেগ নয়, শর‘ঈ মানদণ্ডে যাচাই করা সমীচীন।

ফিদাক ঘটনা নিষ্পত্তির উত্তম পন্থা:

যিনি ইনসাফের ধারক, আবেগের অনুগামী নয়, বরং সত্য যে পক্ষে হবে গ্রহণ করেন, বিরোধের বিষয় প্রকৃত গবেষণার দৃষ্টিতে দেখেন, যেন অক্ষরের যথাস্থানে বিন্দুর ফোটা পতিত হয়। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, ফিদাকের জমির দু’টি অবস্থা: হয় ফাতিমার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাস অথবা দান বা হেবা, যা তিনি খায়বারের দিন ফাতিমাকে দিয়েছেন।

মিরাস কিনা একটু যাচাই করি, বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর ফাতিমা আবূ বকরের নিকট এসে ফিদাকের মিরাস, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খায়বারের অংশ ও অন্যান্য হক তলব করেন। আবূ বকর বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«إنّا لا نورّث، ما تركناه صدقة». وفي رواية عند أحمد: «إنّا معاشر الأنبياء لا نورّث».

“আমাদের মিরাস হয় না, আমরা যা রেখে যাই সব সদকা”। ইমাম আহমদের বর্ণনায় এসেছে: “আমরা নবীদের জামা‘আত, আমাদের মিরাস হয় না”। এ কথা শুনে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা অন্তরে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন, তিনি দলীল হিসেবে আল্লাহর বাণীর ব্যাপক অর্থকে করেন:

﴿يُوصِيكُمُ ٱللَّهُ فِيٓ أَوۡلَٰدِكُمۡۖ لِلذَّكَرِ مِثۡلُ حَظِّ ٱلۡأُنثَيَيۡنِۚ١١﴾ [النساء: 11]

“আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছেন: ছেলেদের জন্য নারীদের দ্বিগুণ”। সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১]

এখানে আমরা কিছু সময়ের জন্য নিরপেক্ষ হই এবং ভুলে যাই মিরাস তলবকারী নারীর বৈশিষ্ট্যকে, যিনি আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, মুহাব্বত ও সম্মানের পাত্র, আল্লাহর নিকটও সম্মানিত, যেরূপ তিনি উপযুক্ত, কারণ তিনি আমাদের নবীর মেয়ে। এসব বৈশিষ্ট্য রেখে ক্ষণিকের জন্য আমরা তাকে দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে দেখি, প্রথম পক্ষ আবূ বকর। আর মেনে নেই যে, সবার উপর থাকবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা। আবূ বকর যে হাদীস পেশ করেছেন যদি কোনোও হাদীস তার ন্যায় সহীহ হয়, সেটিই আমরা মাথা পেতে নিব, বাকি সব দেয়ালের পশ্চাতে নিক্ষেপ করব। এতে যদি একমত থাকি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসকে আঁকড়ে ধরে তার ওপর আমল করার কারণে আমরা কেন আবূ বকরকে অপবাদ দেই, কেন তাকে দোষারোপ করি?!

আবূ বকরের হাদীস আহলুস-সুন্নাহ ও শিয়া দু’পক্ষের নিকট সহীহ:

আহলুস-সুন্নাহ ও শিয়া উভয়ের নিকট আবূ বকরের হাদীস সহীহ। অতএব, একটি সহীহ হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করার কারণে আবূ বকর কেন নিন্দিত হবেন, উল্টো কেন তাকে অপবাদ দিবে যে, ফাতিমার মিরাস আত্মসাৎ করার জন্য তিনি হাদীসটি রচনা করেছেন? বলার অপেক্ষা রাখে না হাদীসটি আহলুস-সুন্নাহ’র নিকট সহীহ, ব্যতিক্রম হলেও সত্য শিয়াদের নিকটও হাদীসটি সহীহ। তাদের আলোচনা দেখুন, শিয়াদের ইমাম কুলাইনি ‘আল-কাফি’ গ্রন্থে আবূ আব্দুল্লাহ (অর্থাৎ শিয়াদের ষষ্ট ইমাম জাফর আস-সাদিক ৮০-১৪৮ হি.) আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«… وإنّ العلماء ورثة الأنبياء، وإنّ الأنبياء لم يورّثوا ديناراً ولا درهماً، ولكن ورّثوا العلم، فمن أخذ منه أخذ بحظ وافر».

“...আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ, নবীগণ টাকা-পয়সার ওয়ারিশ করেন না, তারা করেন ইলমের ওয়ারিশ, যে ইলম গ্রহণ করল সে সৌভাগ্যের বড় অংশ গ্রহণ করল”

আল-মাজলিসী ‘মিরআতুল উকুল’: (১/১১১) গ্রন্থে বলেন: “প্রথম হাদীসের (অর্থাৎ আমাদের আলোচিত হাদীসের) দু’টি সনদ রয়েছে, প্রথম সনদ মাজহুল, দ্বিতীয় সনদ হাসান বা নির্ভরযোগ্য, যা সহীহ থেকে কম নয়”। অতএব, এক সনদের ভিত্তিতে হলেও হাদীসটি হাসান ও দলীলের উপযুক্ত, তবে কেন অধিকাংশ শিয়া আলিম হাদীসটি ভুলে যান অথচ তাদের নিকটও প্রসিদ্ধ!!

অত্র হাদীস ‘বিলায়াতুল ফকীহ’র পক্ষে খোমেনির দলীল:

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ‘বিলায়াতুল ফকিহ’র পক্ষে খোমেনি ‘আল-হুকুমাতুল ইসলামিয়াহ’ গ্রন্থে (সাহীহাতুল কাদ্দাহ) শিরোনামের অধীন এই হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। অতএব, হাদীসটি তার নিকট সহীহ, যেমন খোমেনি বলেন, আলী ইবন ইবরাহীম নিজের পিতা ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি হাম্মাদ ইবন ঈসা থেকে, তিনি কাদ্দাহ (অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবন মায়মুন) থেকে, তিনি আবু আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من سلك طريقاً يلتمس فيه علماً، سهل الله له به طريقاً إلى الجنة … وإنّ العلماء ورثة الأنبياء، وإنّ الأنبياء لم يورّثوا ديناراً ولا درهماً، ولكن ورّثوا العلم، فمن أخذ منه أخذ بحظ وافر».

“ইলম অন্বেষণ করার জন্য যে কোনো পথ গ্রহণ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জান্নাতের রাস্তা তার জন্য সহজ করে দেন...আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ, নবীগণ টাকা-পয়সার ওয়ারিশ করেন না, তারা ওয়ারিশ করেন ইলমের, যে ইলম গ্রহণ করল সে সৌভাগ্যের বড় অংশ গ্রহণ করল”। এই হাদীস শেষে তিনি মন্তব্য করেন: “হাদীসের সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য, অধিকন্তু আলী ইবন ইবরাহীমের পিতা অর্থাৎ ইবরাহিম ইবন হাশিম হাদীস শাস্ত্রে নির্ভরযোগ্য বিশেষ ব্যক্তিত্বের একজন, নির্ভরযোগ্য তো অবশ্যই”

অতঃপর খোমেনি একই অর্থ প্রকাশকারী অপর হাদীসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা ‘আল-কাফি’ গ্রন্থে দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “এই মর্মার্থ সামান্য ব্যবধানে দুর্বল সনদের আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ হাদীসটি আবুল বুখতারি পর্যন্ত সহীহ, কিন্তু আবুল বুখতারি দুর্বল, হাদীসটি হচ্ছে: মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহইয়া থেকে বর্ণিত, তিনি আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ঈসা থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবন খালিদ থেকে, তিনি আবুল বুখতারি থেকে, তিনি আবূ আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম থেকে, তিনি বলেন:

«إنّ العلماء ورثة الأنبياء، وذاك أنّ الأنبياء لم يورّثوا درهماً ولا ديناراً، وإنما ورّثوا أحاديث من أحاديثهم …».

“আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ, কারণ নবীগণ টাকা-পয়সার ওয়ারিশ করেন না, বরং তারা ওয়ারিশ করেন তাদের হাদীসের...”

অতএব স্পষ্ট হলো যে, «إنّ الأنبياء لم يورّثوا ديناراً ولا درهماً، ولكن ورّثوا العلم». হাদীসটি সহীহ, যেমন খোমেনি বলেছেন, তারও পূর্বে সহীহ বলেছেন মাজলিসী। শিয়াদের নিকট আমাদের জিজ্ঞাসা এই সহীহ হাদীস কেন গ্রহণ করা হয় না অথচ শিয়া-সুন্নী সবাই একমত যে, দলীল থাকলে ইজতিহাদ করার সুযোগ নেই?! একই হাদীস ‘বিলায়াতুল ফকীহ’র ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়, ফিদাকের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় না কেন?! আবেগ ও পক্ষপাত সমাধান দিতে পারে কি?!

নবীগণের নিজের সন্তানদের ওয়ারিশ বানানোর দলীলের অসারতা:

শিয়াদের অনেকে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেছেন:

﴿فَهَبۡ لِي مِن لَّدُنكَ وَلِيّٗا ٥ يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنۡ ءَالِ يَعۡقُوبَۖ ٦﴾ [مريم: 5-6]

“আপনার পক্ষ থেকে আমাকে সন্তান দিন, যে আমার ও ইয়াকূবের পরিবারের ওয়ারিশ হবে”[সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫-৬] অত্র আয়াত বলে নবীগণের সন্তান সম্পদের ওয়ারিশ হয়, যেমন যাকারিয়া তার সন্তানকে ওয়ারিশ বানিয়েছেন। বস্তুতঃ আয়াতটি তাদের দলীল হিসেবে পেশ করা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, কোনোভাবে বিবেক তাতে সায় দেয় না, কয়েকটি কারণে:

প্রথমত: সাধারণ ভালো লোকের পক্ষেও সমীচীন নয়, সম্পদের মালিক হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট সন্তান প্রার্থনা করা, অতএব সেই প্রার্থনা একজন নবীর পক্ষে কীভাবে সম্ভব!? বরং যাকারিয়া আলাইহিস সালাম চেয়েছেন, আল্লাহ তাকে একটি সন্তান দান করুন যে তার পরবর্তী নবুওয়াতের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ধরবে এবং ইয়াকূবের বংশের প্রাচীন নবুওয়াতী ধারা অব্যাহত রাখবে।

দ্বিতীয়ত: প্রসিদ্ধি আছে যে, যাকারিয়া আলাইহিস সালাম গরীব ছিলেন, সুতার বা কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতেন। অতএব, তার নিকট কী সম্পদ থাকবে, যার সংরক্ষণের জন্য তিনি আল্লাহর নিকট ওয়ারিশ প্রার্থনা করবেন? অধিকন্তু নবীদের আদর্শ সম্পদ জমা কর নয়, বরং প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ সদকা করাই তাদের নীতি।

তৃতীয়ত: ইরস(الإرث) শব্দটি শুধু সম্পদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না, ইলম, নবুওয়াত ও রাজত্বের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ثُمَّ أَوۡرَثۡنَا ٱلۡكِتَٰبَ ٱلَّذِينَ ٱصۡطَفَيۡنَا مِنۡ عِبَادِنَاۖ﴾ [فاطر:32]

“অতঃপর আমাদের বান্দাদের থেকে যাদেরকে আমরা নির্বাচন করেছি, তাদেরকে আমরা কিতাবের ওয়ারিশ বানিয়েছি”[সূরা ফাতির, আয়াত: ৩২]

অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡوَٰرِثُونَ ١٠ ٱلَّذِينَ يَرِثُونَ ٱلۡفِرۡدَوۡسَ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ١١﴾ [المؤمنون : ١٠، ١١]

“তারাই প্রকৃত ওয়ারিশ, যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের ওয়ারিশ হবে, সেখানে তারা সর্বদা থাকবে”[সুরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ১০-১১]

চতুর্থত: আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, «إنّ الأنبياء لم يورّثوا ديناراً ولا درهماً ولكن ورّثوا العلم». “নবীগণ টাকা-পয়সার ওয়ারিশ করেন না, তারা ওয়ারিশ করেন ইলমের”। এ হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় নবীগণের সম্পদের ওয়ারিশ হওয়া বৈধ নয়, তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করার জন্য এতটুকু-ই যথেষ্ট।

 সুলাইমান পিতা দাঊদ কিসের ওয়ারিশ হয়েছেন?

পূর্বের আলোচনার সমার্থক আল্লাহ তা‘আলার নিম্নের বাণী,

﴿وَوَرِثَ سُلَيۡمَٰنُ دَاوُۥدَۖ١٦﴾ [النمل:16]

“দাঊদের ওয়ারিশ হয়েছেন সুলাইমান”[সূরা আন-নামাল, আয়াত: ১৬] উল্লেখ্য, সুলাইমান আলাইহিস সালাম দাঊদের সম্পদের ওয়ারিশ হন নি, বরং তিনি ওয়ারিশ হয়েছেন নবুওয়াত, হিকমত ও ইলমের দু’টি কারণে:

এক. প্রসিদ্ধ আছে যে, দাঊদ আলাইহিস সালামের একশত স্ত্রী ও তিনশত দাসী ছিল, তার সন্তানের সংখ্যা ছিল অনেক, তিনি কীভাবে শুধু সুলাইমান আলাইহিস সালামকে ওয়ারিশ করবেন, অন্য কাউকে করবেন না?!! অতএব, নির্দিষ্টভাবে সুলাইমানকে উল্লেখ করার কোনো কারণ নেই।

দুই. যদি সম্পদের ওয়ারিশ হওয়া উদ্দেশ্য হয়, আল্লাহর কিতাবে তার উল্লেখ করার কোনো অর্থ নেই। কারণ, স্বাভাবিকভাবে সন্তান পিতার ওয়ারিশ হয়। দ্বিতীয়ত: সম্পত্তির উত্তরাধিকার দাঊদ বা সুলাইমান কারো জন্যই প্রশংসনীয় নয়। কারণ, ইয়াহূদী বা নাসারা স্বস্ব সন্তানকে ওয়ারিশ করেন। অতএব, সুলাইমান তার পিতার ওয়ারিশ হবেন এতে নতুনত্ব কী?! অথচ আয়াতটি সুলাইমান আলাইহিস সালামের প্রশংসা ও তার বৈশিষ্ট্য বর্ণনার জন্যই উদ্ধৃত হয়েছে। অধিকন্তু সম্পদের ওয়ারিশ হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেমন খাওয়া, পান করা ও মৃতদের দাফন করা। নবীদের প্রসঙ্গে এ জাতীয় জিনিস বর্ণনা করা হয় না। কারণ, এতে কোনো উপকার নেই; বরং নবীদের জীবন থেকে তাই বর্ণনা করা হয়, যেখানে ফায়দা, উপদেশ ও নসিহত রয়েছে, অন্যথায় কেউ যদি বলে: “অমুকে মারা গেছে, ফলে তার ছেলে তার সম্পদের ওয়ারিশ হয়েছে” এ কথাটি অনেকটা এমন যেন কেউ মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে বলল: “তাকে দাফন করেছে” অথবা এমন যেন কেউ বলল: “তারা পানাহার করেছে ও ঘুমিয়েছে”। এ জাতীয় বিষয় কুরআনুল কারীমের ঘটনায় উল্লেখ করা মোটেও শোভনীয় নয়।

নারীদের মিরাস সম্পর্কে শিয়া ইমামিয়াদের বিপরীত মুখী অবস্থান:

এসবকে ছাপিয়ে অতি আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, যা অনেকের নিকট অজানা: শিয়া ইমামিয়াদের মাযহাব মোতাবেক নারীরা বাড়ি ও জমির কোনোও অংশ পায় না। অতএব, শিয়া ইমামিয়ারা কীভাবে ফিদাকের জমিতে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহার ওয়ারিশ হওয়ার স্বত্ত্বকে স্বীকার করেন, যদিও তারা নিজেদের মাযহাব মোতাবেক নারীদেরকে জমি ও বাড়িতে ওয়ারিশ করেন না?!!

কুলাইনি ‘আল-কাফি’ গ্রন্থে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করেছেন: “নারীরা জমির ওয়ারিশ হবে না” শিরোনাম দিয়ে, সেখানে তিনি আবূ জা‘ফর (অর্থাৎ শিয়াদের পঞ্চম ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকির ৫৭-১১৪ হি.) থেকে বর্ণনা করেছেন: «النساء لا يرثن من الأرض ولا من العقار شيئاً». “নারীরা জমি ও বাড়ির ওয়ারিশ হবে না”। শিয়া পণ্ডিত তুসি ‘তাহযিব’ গ্রন্থে ও মাজলিসী ‘বিহারুল আনওয়ার’ গ্রন্থে মায়সারাহ থেকে বর্ণনা করেছেন:

«سألت أبا عبد الله عليه السلام عن النساء ما لهن من الميراث؟ فقال: لهن قيمة الطوب والبناء والخشب والقصب فأما الأرض والعقار فلا ميراث لهن فيهما».

“আমি নারীদের সম্পর্কে আবু আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করেছি, মিরাসে তাদের অংশ কী? তিনি বললেন: তাদের জন্য রয়েছে ইট, লাকড়ি ও নির্মাণ বাবদ খরচ, তবে তারা জমি ও বাড়ির কোনোও অংশ মিরাস পাবে না”। মুহাম্মাদ ইবন মুসলিম থেকে বর্ণিত, তিনি আবু জাফর আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: «النساء لا يرثن من الأرض ولا من العقار شيئاً». “নারীরা জমি ও বাড়ির মিরাস পাবে না”। বর্ণনাকারী আব্দুল মালিক ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ অথবা ইমাম আবূ জাফর থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: «ليس للنساء من الدور والعقار شيئاً». “জমি ও বাড়িতে নারীদের কোনোও অংশ নেই”

ফিদাক পৈত্রিক সম্পত্তি বা হেবা কোনটিই নয়:

ফিদাক যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাস হয়, তাহলে নবীর নারীরা অবশ্যই তার অংশীদার হবেন। যেমন, আয়েশা বিনতে আবূ বকর, এবং নবীর মেয়ে যয়নাব ও কুলসুম, কিন্তু আবূ বকর নিজের মেয়েকে কিংবা নবীর কোনো স্ত্রীকে কিংবা নবীর কোনো মেয়েকে কোনো অংশ দেন নি হাদীসের নিষেধাজ্ঞার কারণে। অতএব, শিয়ারা মিরাসের হকদারদের ভেতর তাদের উল্লেখ করে না, শুধু ফাতিমার উল্লেখ করে কেন?!!

আমরা যদি মেনে নেই, ফিদাকের জমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাস, সেই সূত্রে ফাতিমার দাবি ছিল, তাহলে উপরের আলোচনা তার উত্তর। আর যদি ফিদাকের জমিকে ফাতিমার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হেবা বা দান মানি, যেমন শিয়া আলেম কাশানি স্বীয় তাফসীর গ্রন্থ ‘আস-সাফি’-তে বলেছেন, তাহলে আমাদের আরেকটি বিষয় দেখা প্রয়োজন:

যদি আমরা মেনেও নিই, হেবা বা দান করার বর্ণনা বিশুদ্ধ, বাস্তবে কিন্তু সুন্নীদের নিকট হেবা বা দান করার বিষয়টি স্বীকৃত নয়, তবে আমরা বলতে চাই হেবার বিষয়টি আরেকটি বিবেচনাকে আবশ্যক করে, আর সেটি হচ্ছে সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করার ইসলামের অবধারিত বিধান। যেমন, বাশির ইবন সাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলেন,

«يا رسول الله! إني قد وهبت ابني حديقة وأريد أن أُشهدك، فقال النبي صلى الله عليه وآله وسلم: أكُلّ أولادك أعطيت؟ قال: لا. فقال النبي صلوات الله وسلامه عليه: اذهب فإني لا أشهد على جور».

“হে আল্লাহর রাসূল, আমি আমার ছেলেকে একটি বাগান হাদিয়া করেছি, আমি আপনাকে তার সাক্ষী রাখতে চাই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার প্রত্যেক সন্তানকেই কি দিয়েছো? সে বলল: না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যাও, আমি যুলুমের ওপর সাক্ষী থাকি না”

এখানে দেখছি বণ্টনের ক্ষেত্রে এক সন্তানকে অপর সন্তানের ওপর প্রাধান্য দেওয়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুলুম বলেছেন। অতএব যে নিষ্পাপ নবী যুলুমের ওপর সাক্ষী থাকেন না, তিনি কীভাবে একই যুলুম করেন, শুধু ফাতিমাকে দেন সবাইকে বঞ্চিত করেন?!

যিনি আসমানের আমানতদার, তার সম্পর্কে চিন্তা করা যায় দুনিয়ার ব্যাপারে তিনি আমানতের খিয়ানত করবেন, শুধু ফাতিমাকে দিবেন, আর কাউকে দিবেন না?!! আমরা সবাই জানি যে, খায়বার সংঘটিত হয়েছিল হিজরী সপ্তম বছর অথচ জয়নাব বিনতে মুহাম্মাদ মারা গেছেন হিজরী অষ্টম বছর, আর উম্মে কুলসুম মারা গেছেন হিজরী নবম বছর। অতএব, কীভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমাকে দিবেন, উম্মে কুলসুম ও জয়নাবকে দিবেন না?! সুতরাং হেবার বিষয়টি সমর্থন যোগ্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে বিভিন্ন বর্ণনা প্রমাণ করে যে, ফিদাকের জমি আবূ বকরের নিকট ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা মিরাস হিসেবে তলব করেছেন, হেবায় পেয়েছেন হিসেবে তলব করেন নি।

ফিদাকের জমির ব্যাপারে আলী ও আবূ বকরের ঐকমত্য:

ফিদাকের জমি মিরাস বা হেবা কিছুই ছিল না, শিয়াদের প্রথম ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ মত পোষণ করতেন, যার ফলে ফাতিমার মৃত্যুর পর তিনি খলিফা হয়ে ফিদাকের জমি নিজের মাঝে ও সন্তানদের মাঝে বণ্টন করেন নি, যেমন স্বামী হিসেবে আলী এক-চতুর্থাংশ পেতেন, আর অন্যান্য সন্তান যেমন হাসান, হুসাইন, যয়নাব ও কুলসুম পেত অবশিষ্টাংশ। কারণ, আল্লাহ বলেছেন:

﴿لِلذَّكَرِ مِثۡلُ حَظِّ ٱلۡأُنثَيَيۡنِۚ١١﴾ [النساء: 11]

“পুরুষদের জন্য নারীদের দ্বিগুণ”[সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১] ফিদাকের জমি আলী নিজেও নেন নি, কাউকেও দেন নি -ইতিহাস থেকে এ কথাই প্রমাণিত। অতএব, যে কাজ আলী করেছেন সে কাজের জন্য আবূ বকরকে কেন দোষারোপ করা হয়?! বরং শিয়া বড় আলিম সাইয়্যেদ মুরতাদা “আল-শাফি ফিল ইমামাহ” গ্রন্থে ইমাম আলী থেকে বর্ণনা করেন:

«إنّ الأمر لمّا وصل إلى علي بن أبي طالب عليه السلام كُلّم في رد فدك، فقال: إني لأستحيي من الله أن أرد شيئاً منع منه أبو بكر وأمضاه عمر».

“শাসন ক্ষমতা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এলে ফিদাক ফিরিয়ে আনার আলোচনা হয়, কিন্তু তিনি বলেন: আল্লাহর নিকট আমার লজ্জা হয়, আবূ বকর যা দেন নি এবং উমার যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, সেটি আমি কীভাবে গ্রহণ করব”?

সমাপ্ত