ইহরাম-এর শিক্ষা
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
ইহরাম-এর শিক্ষা
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
মীর মন্জুর মাহমূদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
2014 - 1435
﴿ دروس وعبر من الإحرام ﴾
« باللغة البنغالية »
مير منظور محمود
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
2014 - 1435
ইহরাম-এর শিক্ষা
বিশ্বমানবতার চিরন্তন মুক্তি ও শাশ্বত কল্যাণ নির্দেশনার নাম ইসলাম। পরম করুণাময়ের অপার অনুগ্রহধন্য রহমাতুল্লিল আলামীনের মাধ্যমে প্রাপ্ত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আমাদের জীবন ব্যবস্থা। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ[1], পরিপূর্ণ, কালোত্তীর্ণ ও সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা। এককথায় অনন্য, অতুলনীয়। এর ব্যাপ্তি ও পরিসর মহাকালের সীমানাকে অতিক্রম করে মহান প্রভূর পরম সান্নিধ্যের সাথে যুক্ত হয়েছে। অনাগতকালের মানবতার জীবন সঞ্জীবনী সূধা হিসাবে এ বাণীকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।[2] আর হাজ্জ হচ্ছে সে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা। হাজ্জের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। সামর্থবান মুসলিমদের জন্য জীবনে একবার হাজ্জ পালন করা ফরয বা অত্যাবশ্যক। এটি ঐতিহাসিক ও পূণ্যময় স্মৃতিবিজড়িত একটি ব্যতিক্রম ইবাদাত-মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের মাধ্যম। এ মিলন মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, এ মিলন পরম মাবুদের সাথে তাঁর একান্ত প্রিয় বিরহ বিধুর গোলামের। এ যেন বন্ধু ইবরাহীম-এর সেই অনন্ত আহ্বানের ফসল[3], যা প্রতিবছর সারা দুনিয়ার স্রষ্টাপাগল মানুষকে দুর্নিবার গতিতে টেনে নিয়ে একত্রিত করে, মিলনের স্বাদ জাগাতে। খরস্রোতা নদীর দস্যিপনা আর বেয়াড়া পথপরিক্রমা যেমন শেষ হয় মহাসাগরের বুকে আছড়ে পড়ার মধ্যদিয়ে, তেমনি রূপ-রস-গন্ধে ভরা এ পৃথিবীর জীবন পথপরিক্রমায় একেবারে ভুলে যাওয়া বেপথু মানুষগুলো তার প্রভুর সান্নিধ্যে সাজদাবনত হয়-‘‘লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইকা’’ ধ্বনি দিয়ে। কবির ভাষায়- ‘‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনা’’- মানব মনের পরম আকুতি জানাতে এবং প্রকৃত আপনজনের খোঁজেই যেন হাজ্জ যাত্রীগণ ছুটে যান সারা দুনিয়া থেকে আরবের উষর মরুতে। তাই হাজ্জকে বলা যায়, আর্থিক, শারীরিক ও আত্মিক ইবাদাত। মুসলিম উম্মাহর বার্ষিক মিলন তথা বিশ্বময় ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা সৃষ্টির শর‘য়ী ব্যবস্থাপনা। এখানে আমাদের জাতীয় কবির একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘‘আমরা সেই সে জাতি, সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি’’। ইসলামী শরী‘আতের এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত পালনের ফরযসমূহের অন্যতম একটি ইহরাম।[4] ইহরাম ব্যতিরেকে হাজ্জ পালন সম্ভব নয়।
ইহরাম কি ও কেন: ইহরাম আরবী শব্দ। অর্থ নিষিদ্ধ করা বা হারাম করা। পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সালাতের মধ্যে আমরা যেমনভাবে তাহরীমা বেঁধে আনুষ্ঠানিকভাবে সালাত শুরু করি; ঠিক তেমনি হাজ্জের সকল পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ইহরামের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে হাজ্জ শুরু করা হয়। এটিকে হাজ্জের আনুষ্ঠানিক নিয়্যাতও বলা হয়। তাহরীমা ও ইহরাম একই ধাতু হতে নির্গত দু‘টি শব্দ যা একই অর্থবোধক। তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে সালাত আদায়কারী যেমন তার জন্য অন্য সকল বৈধ কাজকে সালাতরত সময়ের জন্য হারাম করে নেয়, তেমনি ইহরাম বাঁধার মধ্য দিয়ে একজন হাজ্জ পালনকারী তার জন্য বৈধ অনেক কাজকে ইহরাম অবস্থায় হারাম করে নেয়। ইহরামের মাধ্যমে হাজ্জের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় এবং হাজ্জের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে ইহরামের কাপড় খুলে ফেলতে হয়। একইভাবে ইহরাম বাঁধার পর একজন হাজ্জ পালনকারী নিজের ওপর হাজ্জ পালনকালে বৈধ যে সকল কাজকে নিষিদ্ধ করে নেন, তা আবার বৈধ হয়ে যায়। অর্থাৎ ইহরাম তার পরম স্রষ্টার ডাকে ছুটে আসা একজন হাজ্জ পালনকারীকে প্রভুর সান্নিধ্য ও নৈকট্য উপযোগী করে। ইসলামের এ সুমহান ইবাদাতের শিক্ষা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করা এবং তা গ্রহণ করার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে।
ইহরাম-এর নিয়মাবলী: আমরা জানি ইসলামের মৌলিক ইবাদাতের মধ্যে হাজ্জ অন্যতম।[5] এর রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী। ইহরাম বাঁধার পূর্বেই গোঁফ, বগল ও নাভীর নীচের ক্ষৌর কাজ সম্পন্ন করে, নখ কেটে, গোসল করে পবিত্র হতে হয়। এ সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব। মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইহরাম বাঁধার পূর্বে তাকে সুগন্ধি মাখিয়ে দিতাম’’।[6] এরপর সালাতের খেয়াল রাখা দরকার যেনো ইহরামটি কোনো (ফরয বা নফল) সালাতের পরে হয়; কোনো সালাতের পরে ইহরাম বাধা সুন্নাত। না পড়তে পারলেও কোনো অসুবিধা নেই।
ইহরামের পোষাক মূলত দু‘প্রস্ত সেলাইবিহীন সাদা কাপড়। এর একপ্রস্ত লুঙ্গির মত পরতে হয় এবং অপরটি চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে নিতে হয়। কাপড়গুলো সাদা ও নতুন হওয়া উত্তম।[7] ইহরাম বাঁধার সাথে সাথে ইহরামকারী তালবিয়া পাঠ করবেন এভাবে-‘‘লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শারীকা লাকা লাববাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা শারীকা লাকা’’ ‘‘হাযির হে আল্লাহ! তোমার সমীপে হাযির। আমি হাযির! তোমার কোনো শরীক নেই। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, সমস্ত নিয়ামত এবং রাজত্ব তোমারই, তোমার কোনো শরীক নেই।’’ তারপর উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করতে থাকা এবং আল্লাহর কাছে দু‘আ করা। ইহরামকারীর জন্য মাকরূহ ও বর্জনীয় কাজগুলোকে সযত্নে এড়িয়ে চলা। করণীয় কাজগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে আদায় করা।
ইহরাম-এর শিক্ষা: ইসলামের প্রতিটি ইবাদাতই উদ্দেশ্যপূর্ণ। অন্যতম মৌলিক ইবাদাত হিসাবে হাজ্জও তার ব্যতিক্রম নয়। ইসলামী শরী‘আতে ঈমান আনার সাথে সাথে প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করাকে ফরয করা হয়েছে, সাওম প্রতি বছর রমাযানে এক মাস পালন করা এবং যাকাত প্রতি বছরে আদায় করাকে ফরয করা হয়েছে। কিন্তু হাজ্জই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম; জীবনে একবার ফরয করা হয়েছে। ইবাদাত পালনের সংখ্যা বা বার গণনায় এটি কম হলেও এর প্রভাব জীবনব্যাপী এবং সুদূরপ্রসারী। মানব জীবনের আমূল পরিবর্তনকারী এই ইবাদাতের প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য এত গভীর ও ব্যাপক যা প্রবন্ধের এ সংক্ষিপ্ত কলেবরে আলোচনা করা অসম্ভবও বটে।
ইহরামের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করার প্রেক্ষাপট হিসাবে ইসলামের এ অন্যতম ইবাদাত হাজ্জ ও তার সুপ্রাচীন ইতিহাস নিয়ে দু‘একটি কথা এ পর্যায়ে আলোচনা করা জরুরী মনে করছি। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নির্মিত হওয়ার পর থেকেই অদ্যাবধি প্রতিবছর মানুষ হাজ্জের সময় এবং সারা বছরই এ ঘরকে যিয়ারাতের জন্য আসে-হাজ্জ ও ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে; তারা আসে হৃদয় ও চোখ দিয়ে মহিমাময় আল্লাহ তা‘আলার অপার করুণা ও নিদর্শন দেখতে, উপলব্ধি করতে। যুগ যুগ ধরে এ কাফেলা চলছে, রসদ আর আরোহী নিয়ে-সতত কল্যাণ ও করুণাসিক্ত হতে। মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী, লোকগাঁথা, উপাখ্যান যেন এখানেই মঞ্চস্থ হয়েছে- যা কালের সীমানা পেরিয়ে দেদীপ্যমান। পৃথিবীর ইতিহাসের এক পবিত্রতম সন্ধিক্ষণে যে মহান ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তা নিজ চোখে দেখতে পাবে না জেনেও কাল থেকে কালান্তরে ছুটে আসছে মানুষেরা তার স্মৃতিময় স্থানগুলোকে দেখতে, সে পবিত্র কার্যাদির অনুসরণ করতে। মহাকালের গর্ভে কত কিছু হারিয়ে গেলেও এর স্মৃতিগুলো রয়েছে অম্লান, চির ভাস্মর। তারা ভাল করেই জানে সাফা মারওয়া আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে নিজ নিজ স্থানে কিন্তু ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত সন্তানের জন্য উৎকন্ঠিত মা হাজেরা ও তাঁর অস্থির ছূটোছুটি নেই, শিশু ইসমাঈল আলাইহিস সালামের জন্য সৃষ্ট যমযম আছে কিন্তু সে পবিত্র শিশুকে কোথায় পাওয়া যাবে, মিনায় গিয়ে পাথর মেরে কিছুটা হলেও অভিশপ্ত শয়তানকে পরিত্যাগের বাসনা চরিতার্থ করা গেলেও সে মহান পিতা ও পুত্রের কুরবাণীর দৃশ্য কোথায় পাওয়া যাবে, আর প্রিয়তমা স্ত্রী এবং সন্তানকে রেখে অম্লান বদনে মুসলিম জাতির পিতা আল্লাহর নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ফিরে যাওয়ার স্মৃতি চিহ্নকে কি পাওয়া যাবে বালুকা বেলায়? স্রষ্টার প্রতি কী অপরিসীম আস্থা ও বিশ্বাস! পতিপরায়ণা স্ত্রীর এ জিজ্ঞাসায়-‘‘ইবরাহীম! তুমি আমাকে ও তোমার প্রাণাধিক এ শিশু সন্তানকে জনমাবনহীন তরুলতাবিহীন ঊষর মরুর বুকে রেখে যাচ্ছ, এটাকি আল্লাহর নির্দেশ? ইবরাহীম আলাইহিস সালামের হ্যাঁ সূচক জবাবে মা হাজেরা সাথে সাথে নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে, আল্লাহ আমাদেরকে না খাইয়ে মারবেন না।’’ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এ পরাকাষ্ঠা ইতঃপূর্বে পৃথিবী কী আর দেখেছে বা দেখবে? কা‘বাগৃহ নির্মাণে পিতা-পুত্রের সকল পূণ্যস্মৃতিই তো সেখানে মিশে আছে। রহমানুর রাহীম তাঁর প্রিয় বান্দা-বান্দীর গোনাহ মাফের ঘোষণাও তো দেন এখানে। হ্যাঁ, এ সকল দৃশ্যই যথাযথভাবে ধারণ করে রেখেছেন আল্লাহ রববুল আলামীন মহাগ্রন্থ আলকুরআনে। এতে রয়েছে একদিকে যেমন পিতা-পুত্র-জননীর অগ্নি পরীক্ষা, ত্যাগ ও কুরবাণীর গৌরবময় ইতিহাস ও সফলতার চিরজাগরূক স্মৃতি; অপরদিকে রয়েছে মহিমান্বিত স্রষ্টার অপার করুণার যমযম-এর অমীয় ধারার বাহ্যিক দৃষ্টান্ত। এখানে রয়েছে জীবনের চেয়ে প্রিয় সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী এবং স্রষ্টার মাঝে ভালোবাসার গভীরতা পরিমাপের অনুপম দৃষ্টান্ত- তারা কেউ কারো আসন দখল করেনি, প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ আসনে আসীন। মহাজ্ঞানী আল্লাহ হলেন পরীক্ষক, একই প্রশ্নে একই সাথে পরীক্ষা দিলেন পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, স্নেহময়ী মা ও প্রাণাধিক পুত্র। কেউ কারো থেকে পিছিয়ে নেই- স্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদনে আর পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসা, মায়া-মমতার দৃ্ষ্টান্ত স্থাপনে। তাঁরা সকলেই একত্রে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হলেন- সেটা ছিল তাঁদের জন্য মহান সফলতা আর অনাগতকালের মানুষের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কী নির্মল! কী পবিত্রই না ছিল সে পরীক্ষা এবং তার প্রশ্নোত্তর পর্ব! দিনক্ষণ ও সময়ও যেন ছিল দুনিয়াবী পরীক্ষার সাথে অনেকাংশেই সাদৃশ্যপূর্ণ। কারো যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট না হয় যে, ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল এ ধরাপৃষ্ঠে। আর ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও নেই কোনো ছন্দ পতন। সর্বাঙ্গ সুন্দর ঘটনাবলীকে চিরজাগরূক করা এবং শিক্ষণীয় বিষয়গুলো মানবতার অনুসরণের জন্যই ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য হাজ্জকে ফরয করেছে।
ইহরাম হাজ্জের অন্যতম একটি ফরয। সমগ্র পৃথিবীর মুসলিমদের জন্য অঞ্চলভেদে রয়েছে ইহরাম বাঁধার পৃথক পৃথক নির্দিষ্ট স্থান। এই স্থানগুলোকে বলা হয় মীকাত।[8] এই মীকাতই হলো ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট ও সর্বশেষ স্থান। একজন হাজ্জ পালনকারীর জন্য ইহরাম ব্যতীত মীকাত অতিক্রম করা নিষেধ। ইহরামের শিক্ষা বলতে আমরা ইহরামকালীন একজন হাজ্জ পালনকারীর এবং হাজ্জ সমাপনান্তে তার আবার স্বাভাবিক জীবনের জন্য কি শিক্ষা এতে রয়েছে সেটা আলোচনা করা। এ পর্যায়ে আমরা ইহরামের শিক্ষা নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চেষ্টা করব।
এক. ইহরামের সেলাইবিহীন দুই প্রস্ত কাপড় পরিধানের মধ্য দিয়ে হাজ্জ পালনকারী বাহ্যিকভাবে আড়ম্বরহীন একান্ত আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসাবে নিজকে মহান প্রভূর দরবারে পেশ করেন। এটি তাকে দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ এবং তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে শেখায়।[9] এ সময় সে সমগ্র দুনিয়ার প্রাপ্তি প্রত্যাশার চেয়ে প্রভূর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যকেই আরাধ্য জ্ঞান করে।
দুই. ইহরামের পোশাক তাকে কফিনের পোশাকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে সে জীবিত থেকেই যেন মহান প্রভুর সান্নিধ্যে যাওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। সাথে সাথে মৃত্যুচিন্তা যেন তাকে সকল অন্যায়-অবিচারমুক্ত ও আখিরাতমুখি করে।
তিন. হাজ্জ পালনকালে পৃথিবীর সকল মুসলিম একই পোশাক পরিধানের মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃত্ব, সমতা ও ঐক্যের শিক্ষালাভ করে। ফলে হাজ্জ পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার বন্ধন সৃষ্টি ও রক্ষা করা সহজ হয়। এখানে সকলের প্রার্থনার ভাষা এক ও অভিন্ন এবং উদ্দেশ্য লক্ষ্যেও নেই কোনো পার্থক্য- সেই আদি হতে অদ্যাবধি। ইহরাম একজন হাজ্জ পালনকারীর দেহ ও মনের ভাষাকে কত স্বার্থকভাবেই না একই সূত্রে গ্রথিত করেছে। পৃথিবীর কোন্ ধর্ম, কোন্ ইবাদাতে এমন দৃশ্যের অবতারণা করতে পেরেছে?
চার. হাজ্জ পালনকালে ইহরামের আড়ম্বরহীন পোশাক এবং এ সময়ের অনুশীলন তাকে জীবনের অবশিষ্ট সময়ে আল্লাহর স্মরণে একনিষ্ঠ হতে শেখায়। কালের শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রবৃত্তি সম্পর্কে বলেছেন, নিশ্চয়ই সকল মানুষ ক্ষতির মধ্যে[10] অর্থাৎ তাদের স্বাভাবিক গতি ধ্বংসমূখি। ইহরাম মানুষকে আল্লাহকে স্মরণে রাখার বাস্তব প্রশিক্ষণ ও অতীত নিদর্শন দেখিয়ে তাকে প্রস্তুত করে।
পাঁচ. দুনিয়ার মায়াজালে আক্রান্ত নানা ভোগবিলাসে লিপ্ত থাকা মানুষকে ইহরাম শুধু সাদামাটা পোশাকই পরতে শেখায় না; বরং তাকে হাজ্জ পালনকাল এবং তৎপরবর্তী সময়ে একই অনুভূতি নিয়ে জীবন যাপনে অঙ্গীকারাবদ্ধ করে। কারণ ভোগ-বিলাস মুমিনের জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। ইসলাম মানুষকে বাঁচার জন্য খেতে বলে, খাওয়ার জন্য বাঁচতে নয়। আজকের পৃথিবীতে মুসলিম উম্মাহর বিলাসী জীবন তাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও অনুভূতি থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। ইহরামের শিক্ষা আমাদেরকে সে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে শেখায়।
ছয়. দীনে হানিফের ইমাম সায়্যিদুনা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জীবনের পরীক্ষা ও সফলতার ইতিহাস হৃদয়াঙ্গম করার বাস্তব অনুশীলন করানোই ইহরামের অন্যতম উদ্দেশ্য। দুনিয়ার জীবনের দুঃখ-বেদনা, প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, গ্রহণ-বর্জন, সহজ ও কঠিন পরীক্ষায় যেন একজন বিশ্বাসী উত্তীর্ণ হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, ইহরামরত অবস্থায় ইবরাহীম, ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এবং মা হাজেরা- এর অগ্নি পরীক্ষা ও উত্তীর্ণের ইতিহাসকে পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
সাত. একত্ববাদের প্রতীক পবিত্র কা‘বার তাওয়াফ এবং হাজ্জের সংশ্লিষ্ট কার্যাদি সমাপনের মাধ্যমে তাওহীদের প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধির জন্য ইহরাম একজন হাজ্জ পালনকারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে।
আট. ইহরাম বাঁধার পর ‘‘লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা শারীকা লাকা লাববাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা শারীকা লাকা’’-এ তালবিয়্যা পাঠের মধ্যদিয়ে হাজ্জ পালনকারী আল্লাহকে নাজির তথা সর্বদ্রষ্টা জেনে এবং সবকিছুর সর্বজ্ঞানী বলে দীপ্তকন্ঠে এই ঘোষণা দেন যে-
1. হে আল্লাহ! আমি তোমার সমীপে উপস্থিত! অর্থাৎ প্রভূ হে! তোমার শাশ্বত আহ্বান ও নির্দেশনা আমায় দুনিয়ার সকল কিছু ছেড়ে তোমার ঘর পর্যন্ত আসার উৎসাহ যুগিয়েছে আর তুমি দিয়েছ সকল সামর্থ্য। আমার এ আগমন যেন একান্তই তোমাকে পাওয়ার জন্য হয়ে থাকে। তোমার ঘরকে দেখে তোমাকে দেখার ইচ্ছা এতই প্রবল থেকে প্রবলতর হয় যে, দিবারাত্রি অপলক নেত্রে চেয়ে থাকি সেদিকে-হৃদয় বিগলিত হয়, অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বুক ভাসায়, কখনও বলি, আমি তো ঘরের মালিক-এর খোঁজে এসেছি! চরম অস্থিরতা মেটাতে গেলাফকে কলিজায় ছোঁয়াতে চাই- সম্বিত ফিরে মনে করি, সম্বিত ফিরে বলি, এই তো আর ক‘টাদিন পরেই পরম প্রভুর সাথে মহামিলন, সেখানেই জান্নাতে যেন তাঁর দিকে চেয়ে থাকতে পারি অনন্তকাল ধরে! এ অবস্থার শেষ যেন কখনও না হয়! ভাবি আর বার বার সাজদাবনত হই তার ঘরকে সামনে রেখে। আল্লাহর বরকতময় তোমার এর ঘর ও অন্যান্য পবিত্র নিদর্শন যেন জীবনের অবশিষ্ট সময়েও বুকে ধারণ করি। ও আমার রব! তুমি প্রিয়তম একমাত্র প্রভূ! চরম সত্য এটিই যে, তোমার কোনো শরীক নেই অর্থাৎ তুমি একক ও অদ্বিতীয়। মানব জাতির মহান ইমাম আজ হতে শত সহস্র বছর আগে এ ঘরকে সামনে রেখেই তাওহীদের যে অমোঘ ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা আমার হৃদয়ে উত্থিত হচ্ছে, আমি মোহাবিষ্টের মত তোমাকে পাওয়ার জন্য কখনও তোমার ঘরের তাওয়াফ, কখনও সাফা-মারওয়ার মাঝে দৌড়াদৌড়ি, আবার আরাফায় গিয়ে হৃদয় নিঃসৃত আবেগে আমার মুখ ও বুকের ভাষাকে একীভূত দেখছি। আমার ইহরাম আমাকে মহান আরশের মালিকের কাছে এ মিনতিই করতে শেখায়- আমি উপস্থিত হে প্রভূ!
2. ইহরাম আমায় আরো স্মরণ করিয়ে দেয়- নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, সকল দয়া ও অনুগ্রহ এবং সারা জাহানের তুমিই একচ্ছত্র একমাত্র অধিপতি। ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের সকল প্রাপ্তি ও সুকৃতির প্রশংসা একমাত্র তোমার এবং বেঁচে থাকার জন্য ভোগকৃত সকল নিয়ামত ও অনুগ্রহও তোমারই দান। পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় মানুষ দুনিয়ায় আগমন করেই যাদের আদর যত্ন ও অপাত্য স্নেহে লালিত পালিত হয়, তাঁরা আল্লাহর কতবড় নিয়ামত তা কোনো মানব সন্তান কি আজো নির্ধারণ করতে পেরেছে? পিতার ভালোবাসা আর স্নেহময়ী মাকে আল্লাহর কোন্ নিয়ামতের সাথে তুলনা করবে এ মানবগোষ্ঠী? এর মধ্যদিয়ে মানব সন্তানের দুনিয়ার জীবনের যাত্রা শুরু হয় আর ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও দুনিয়ার ভোগবিলাসের সকল সামগ্রীরূপী অনুগ্রহ ও নিয়ামতের প্রশংসা বা কৃতজ্ঞতা কীভাবে করবে এ আদম সন্তানেরা। আর এগুলোর মালিকানাই বা কাকে দিবে? ইহরাম অবস্থায় একজন হাজ্জ পালনকারী এ সত্যের সাক্ষ্যই প্রদান করে থাকে তালবিয়্যা পাঠের মাধ্যমে।
3. আরাফার ময়দানে গিয়েও ঐ একই অবস্থা। ইহরামের পোশাক মানসিক ও শারীরিকভাবে পরিধান করে উপস্থিত, হে প্রভূ। তোমার প্রতিশ্রুতি গোনাহ মাফ করার, সেজন্যই এসেছি। যদি তুমি আমাদের ফিরিয়ে দাও, মাফ না কর! তবে বল কার কাছে যাব? আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, লা শারিকা লাকা তোমার কোনো শরীক নেই, তাই মানুষের জন্য আর কোনো স্থানও নেই।
নয়. ইহরাম যেমন মানুষকে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে তার জন্য বৈধ জিনিসকে সাময়িকের জন্য পরিত্যাগ করতে শেখায়, তেমনি হাজ্জ পরবর্তী সময়েও সে মানুষটি যেন দীন পালনের প্রয়োজনে বা স্বার্থে জীবনের সকল সূখ ও স্বাচ্ছন্দকে পরিত্যাগ করে হলেও সাড়া দিতে পিছপা না হয়। আর অবৈধ ভোগ-বিলাসে যেন আর লিপ্ত না হয় সে শিক্ষায় প্রদান করা হয়। কারণ হাজ্জের উদ্দেশ্য আর ইসলামী শরী‘আতে মানবজীবনের উদ্দেশ্যকে ভিন্ন করে দেখা হয় নি।
পরিশেষে বলা যায়, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাজ্জ একটি অনুপম ইবাদাত। মানবেতিহাসের পূণ্যময় স্মৃতি ও নিদর্শন দেখার মাধ্যমে হাজ্জ পালনকারীর দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর নৈকট্যলাভের অন্যতম উপায়। ইহরামরত অবস্থা অর্থাৎ হাজ্জ পালনকালীন অবস্থাকে জীবনের অবশিষ্ট সময়ে ধারণ করে সতত কল্যাণ ও সুন্দরের সাধনায় অতিবাহিত করার একটি বাস্তবমুখি প্রশিক্ষণ। আমাদের জীবনে ইহরামের প্রকৃত শিক্ষা ত্যাগ ও কুরবাণীর মানসিকতায় জীবনের সংকীর্ণতার সীমা অতিক্রমের অনুশীলনের সুযোগ এনে দেয়। বিশ্বমানবতাকে বিশ্বাস ও কর্মে সকল গোলামী মুক্ত হয়ে তাওহীদের শিক্ষার উপরে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখায়। মুসলিম জীবনে এই বিশ্বাসকে দর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, একজন মুসলিম দুনিয়াকে ভোগ নয় বেঁচে থাকার স্থান হিসাবে গ্রহণ করবে, কর্মহীন দুনিয়াত্যাগী বৈরাগ্যবাদ নয় এটিকে কর্মক্ষেত্র হিসাবে গ্রহণ করবে, জীবনের সকল কর্মসম্পাদনের উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি আর প্রক্রিয়া হবে তাঁর প্রিয় হাবিবের দেখানো পথ, ইহরামের শিক্ষা হবে তার জীবনের কর্মপ্রেরণার উৎস। সঙ্গত কারণেই ইসলামের এই সুমহান শিক্ষা ও তাৎপর্য সম্বলিত ইবাদাতটি পালনের পূর্বে মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক সদস্যকে ইহরামের শিক্ষার ধারক ও বাহক হওয়ার সুদৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে।
******* ড. মীর মন্জুর মাহমূদ[11]
[1]. ‘‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তা দান করেন।’’ সূরা জুম‘আ/৬২:৪।
[2]. ‘‘এবং তাদের মধ্য হতে অন্যান্যদের জন্যও, (এ রাসূলকে পাঠানো হয়েছে) যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি।’’ সূরা জুম‘আ/৬২: ৩।
[3]. ‘‘এবং মানুষের নিকট হাজ্জের ঘোষণা করে দাও; তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে, তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে।’’ সূরা হাজ্জ/২২:২৭।
[4] . হাজ্জের ফরয ৩ টি। যথা: ১.ইহরাম বাঁধা বা আনুষ্ঠানিক নিয়্যাত করা, ২. আরাফাতে অবস্থান (৯ জিলহাজ্জ তারিখে সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে ১০ জিলহাজ্জের ফযরের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময় মুহূর্তের জন্য হলেও ঊকূফ বা অবস্থান করা), ৩. তাওয়াফে যিয়ারাত (১০ জিলহাজ্জের ভোর থেকে ১২ জিলহাজ্জ পর্যন্ত যে কোনো দিন কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করা)। এই তিনটি ফরযের কোনো একটি ছুটে গেলে হাজ্জ বাতিল হয়ে যাবে এবং পরবর্তী বছর তা কাযা আদায় করতে হবে।
তবে কারও কারও মতে হাজ্জের আরও একটি রুকন রয়েছে আর তা হচ্ছে সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সা‘ঈ করা। তাদের মতও শক্তিশালী। সুতরাং কেউ যেন তাওয়াফে যিয়ারাতের পরে এ সা‘ঈটি ভুলে না যাই। [সম্পাদক]
[5]. ‘‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হাজ্জ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য।’’ সূরা আলে-ইমরান/০৩:৯৭।
[6]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।
[7]. হিদায়া।
[8].মীকাত সীমার বাইরের লোকদের জন্য মীকাত পাঁচটি। যথা: ১. যুল হুলায়ফা বা আবইয়ারে আলী, ২. যাতে ইর্ক, ৩. জুহ্ফা, ৪. যাতু কার্ন, ৫. ইয়ালামলাম- এটি ইয়ামানবাসী এবং বাংলাদেশ, ভারতীয় উপমহাদেশ তথা প্রাচ্য থেকে সাগর পথে আগত হাজ্জযাত্রীদের জন্য। তবে আমাদের দেশ থেকে বিমানযোগে গমনকারীদের জন্য বিমানে উঠার আগে অথবা নাজদবাসীদের মীকাতের স্থানে আসার ক্ষনিক আগে ইহরাম বেঁধে নিতে হয়।
[9]. মহিলাদের কাপড়ের সুনির্দিষ্ট বাধ্য-বাধকতা নেই। তবে তারা হাত মোজা এবং নিকাব পরতে পারবে না।
[10]. সূরা আল-আসর/১০৩:০১।
[11] . গবেষক, প্রাবন্ধিক। ই-মেইল: [email protected]