একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইলম অর্জন করা
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
- একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলম অর্জন করা
- ইলম হাসিলে নিয়ত খাঁটি করা
- ‘আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে।’ {সূরা আল-বাইয়িনাহ্, আয়াত : ০৫}
- ‘দুনিয়ার মধ্যে সবচে মূল্যবান বিষয় হলো ইখলাস। আমার অন্তর থেকে রিয়া বা লোক দেখানোর মানসিকতা তাড়াতে কত চেষ্টাই না করেছি; কিন্তু মনের সে নতুন রঙে গজিয়ে ওঠে।’ [1]
- ‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে ওই কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যা থেকে আমি তাওবা করেছি অতপর আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছি। আমি সেই বিষয়ের জন্য আপনার কাছে মার্জনা প্রার্থনা করছি যা আমার অন্তরে কেবল আপনার জন্যই স্থাপন করেছি অতপর তার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে পারি নি। আমি সেই বিষয়ের জন্যও আপনার কাছে মাফ চাইছি, যা কেবল আপনাকেই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছি বলে ধারণা করেছি, অতপর তার সঙ্গে আমার অন্তরে তা মিশে গেছে যা সম্পর্কে আপনি অবগত।’[2]
- প্রথমত : ইখলাসের তাৎপর্য
- ‘আমল (কবুল হবে) নিয়ত অনুযায়ী। প্রত্যেকে তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। অতএব যার হিজরত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের আশায় কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের অভিপ্রায়ে, তবে তার হিজরত যাকে উদ্দেশ্য করে তার জন্যই গণ্য হবে।[3]
- দ্বিতীয়ত : কেন আমরা ইলম শিখব? কেন আমরা ফিকহ অর্জন করব? কেন আমরা ইলম হাসিল করব?
- ‘যে ব্যক্তি আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য কিংবা অজ্ঞদের জব্দ করার উদ্দেশ্যে অথবা নিজের প্রতি মানুষের দৃষ্টি কাড়ার অভিপ্রায়ে ইলম শেখে, আল্লাহ তাকে (জাহান্নামের) অগ্নিতে প্রবেশ করাবেন।’[4]
- ‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করে অজ্ঞদের জব্দ করার উদ্দেশ্যে কিংবা আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য অথবা নিজের প্রতি মানুষের নজর কাড়ার অভিপ্রায়ে, সে (জাহান্নামের) অগ্নিতে থাকবে’ [5]।
- তৃতীয়ত : ইলম হাসিলের উপায় :
- ১. কিতাব :
- ২. শায়খ বা শিক্ষক :
- ‘যার কিতাবই হয় তার শিক্ষক, তার সঠিকের চেয়ে ভুলই হয় বেশি’।
- ‘এই ইলম একটি দীন স্বরূপ,
অতএব তোমরা কাদের কাছ থেকে তোমাদের দীন গ্রহণ কর তা খেয়াল রেখ[6]।’
- চতুর্থত. জ্ঞান অন্বেষণকারী কিভাবে তার নিয়ত সহীহ করবে ?
- ১. সঠিক নিয়ত :
- ‘আমল (কবুল হবে) নিয়ত অনুযায়ী। প্রত্যেকে তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। অতএব যার হিজরত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়ার লাভের আশায় কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের অভিপ্রায়ে, তবে তার হিজরত যাকে উদ্দেশ করে তার জন্যই গণ্য হবে’।[7]
- ‘তোমরা নিয়ত শিক্ষা কর। কারণ তা আমলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বলাবাহুল্য, বর্তমান প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে উম্মাহর বিপর্যয়ের রহস্য হলো নিয়তে ইখলাস না থাকা ? !!!
- ‘ইলম অন্বেষণের সুন্দর নিয়ত হলো, তা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তদনুযায়ী আমল, নিজের হৃদয়কে আলোকিত করা, অন্তর্লোককে সুসজ্জিত করা, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং তিনি যে এর অধিবাসীর জন্য নিজের সন্তুষ্টি ও বিশাল মর্যাদা প্রস্তুত রেখেছেন তার উপযুক্ত হওয়া ইত্যাদি।’
- ‘আমি নিজের জন্য নিয়তের চেয়ে কঠিন আর কিছুর চিকিৎসা আমি করি নি।’
- ২. আখিরাতকে লক্ষ্য বানানো :
- ‘নিশ্চয় রুহুল কুদুস (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম) আমার অন্তরে ফুঁ দিয়েছেন যে, কোনো প্রাণই তার আয়ু পূর্ণ না করে এবং তার রিযক শেষ না করে মৃত্যু বরণ করবে না। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় (রিযক) অন্বেষণ করো। আর রিযকের ধীর গতি যেন তোমাদেরকে তা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে তালাশে উদ্বুদ্ধ না করে। কারণ আল্লাহর কাছে যা আছে তা কেবল তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমেই অর্জন করা যায়’।[8]
- ৪. রিয়া থেকে দূরে থাক :
- ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্য আলমগুলোয় ইখলাস তালাশ করে আর সে তার উল্টো পীঠে সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখে তবে সে যেন অসম্ভব কিছু পাবার প্রত্যাশা করে। কেননা, ইখলাস হলো প্রাণভোমরা, যার ওপর তার হায়াত। আর রিয়া তাকে মেরে ফেলে।’
- ৭. আমল এবং আমল :
- ৮. সবর বা ধৈর্য-সহিষ্ণুতা :
- ৯. বিবাদ এড়িয়ে যাও, যদিও তুমি হও সত্যবাদী :
- ১০. ইলম হাসিল করতে গিয়ে শুধু এক ইলমে সীমাবদ্ধ না থাকা :
- ১১. গোঁড়ামি পরিহার করা :
- ১২. চিত্ত বিনোদনে ভারসাম্য রক্ষা করো :
- ১৩. নিজের জিহ্বাকে সংযত করো :
- পঞ্চমত : অন্তরে এসব রোগের অনুপ্রবেশ ঘটে কিভাবে ?
- ‘তুমি অল্প লোককেই তার ইলমে পরিতৃপ্ত এবং নিজের ইলমে অহংকারী দেখতে পাবে, তবে শুধু তাকেই পাবে এসব করতে যার ইলম সামান্য ও ত্রুটিপূর্ণ। কারণ সে কখনো নিজের অবস্থান ভুলে যায়। ধারণা করে সে বুঝি ইলম দরিয়ায় একটু বেশিই ঢুকে পড়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলমের ক্ষেত্রে অতৃপ্ত থাকে, আরও বেশি অর্জনে আগ্রহী হয়, সে তার লক্ষ্যের দূরত্বে এবং প্রান্ত স্পর্শে অক্ষমতা সম্পর্কে সজাগ থাকে। আর এটি তাকে আত্মতৃপ্ত ও অহংকারী হতে বাধা দেয়।’[9]
- ষষ্ঠত : কিভাবে আমার নিয়ত খাঁটি বানাবো ?
- ‘এক মুহূর্তের ইখলাস চিরকালের মুক্তি। কিন্তু ইখলাস বড় কঠিন’।
- কেউ কেউ নিজের আত্মাকে সম্বোধন করে বলতেন,
- ‘তুমি ইখলাস অর্জন করো তবে খালাস (মুক্তি) পেয়ে যাবে’।
- আরো বলা হয়েছে,
- ‘ওই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যার একটি পদক্ষেপ সঠিক হয়েছে যেখানে সে একমাত্র আল্লাহকে খুশি করতে চেয়েছে’।
- সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন,
- ‘আমার মা আমাকে বলতেন, হে আমার প্রাণপ্রিয় পুত্র, একমাত্র আমলের নিয়ত ছাড়া তুমি ইলম শিখ না, অন্যথায় তা কিয়ামতের দিন তোমার জন্য বিপদের কারণ হবে’।
- ‘যখন আল্লাহর আনুগত্যে সব চেষ্টা নিয়োগ করে এবং মানুষের কাছে মর্যাদা পড়ে যাওয়া পছন্দ করে।
- ইয়াহয়া ইবন মু‘আয রহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো বান্দা কখন মুখলিস হয় ? তিনি উত্তর দেন,
- ‘যখন তার স্বভাব হয় দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো; কে প্রশংসা করল আর কে ভর্ৎসনা দিল তার পরোয়া করে না’।
- ‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিল, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত’। {সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত : ২৪}
- সপ্তমত. ইখলাসের অন্তরায়সমূহ এবং সেসবের প্রতিকার :
- ১. লোভ-লালসা :
- ২. প্রশংসাপ্রিয়তা :
- ৩. রিয়া বা লোক দেখানো মানসিকতা :
- ৪. আত্মতুষ্টি :
- ৫. অন্যকে হেয় বা অবজ্ঞা করা কিংবা ছোট ভাবা :
- ‘যারা ছোট খাট দোষ-ত্রুটি ছাড়া বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে, নিশ্চয় তোমার রব ক্ষমার ব্যাপারে উদার, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত। যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রুণরূপে ছিলে। কাজেই তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। কে তাকওয়া অবলম্বন করেছে, সে সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত’। {সূরা আন-নাজম, আয়াত : ৩২}
- শেষ কথা :
- ‘আমরা এ ইলম শিখেছি গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়াও অন্য কারও উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ ইলমই কেবল আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোও জন্যে হাসিল হতে অস্বীকার করেছে।’[10]
- ‘আমরা এ ইলম শিখেছি, অথচ এতে আমার নিয়ত বড় কিছু ছিল না। অতপর আল্লাহ পরবর্তীতে আমাদেরকে ‘সহীহ নিয়তে’র তাওফীক দান করেছেন।’[11]
- একবার ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহিমাহুল্লাহকে বলা হলো,
- ‘এক দল লোক আছে যারা হাদীস সংকলন করে অথচ তাদের ওপর এর কোনো সুপ্রভাব দৃষ্টিগোচর হয় না। তাদের কোনো গাম্ভীর্য প্রকাশ পায় না। তিনি বললেন, হাদীস তাদেরকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাবে।’
- হাবীব ইবন আবী ছাবেত রহ. বলেন,
- ‘আমরা এ ইলম শিখেছি তখন আমাদের বড় কিছু নিয়ত ছিল না। অতপর পরবর্তীতে সহীহ নিয়ত এবং আমল যোগ হয়েছে।’
- অতএব বান্দার হার মানা উচিত নয়। বরং নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যদিও প্রথম দিকে এই শুদ্ধ করার কাজটিকে কঠিন মনে হবে। কারণ, শায়খ সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
- ‘আমি নিয়তে চেয়ে অন্য কিছু দেখি নি যা শুদ্ধ করা এত কঠিন।’
- অতএব জ্ঞান অন্বেষণকারীর কর্তব্য হলো, ইলম তলবে নিজের নিয়তকে সুন্দর বানাবে, ইখলাস রচনা করবে এবং তাওহীদকে খাঁটি বানাবে। সুতরাং যে ইলম অন্বেষণে নিজের নিয়তকে খাঁটি করবে এবং এ পথে কষ্ট-সহিষ্ণুতার মাধ্যমে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, তাকে অবশ্যই দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। তাহলে সে এর মাধ্যমে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার যোগ্য হয়ে উঠবে।
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলম অর্জন করা
﴿ إخلاص النية في طلب العلم ﴾
ইলম হাসিলে নিয়ত খাঁটি করা
যাবতীয় প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। তাঁর পরিবার, সকল সাহাবী ও ঈমানদার উম্মতের ওপর।
হামদ ও সালাতের পর কথা হলো, এটি জ্ঞান অন্বেষণকারী সম্পর্কিত ধারাবাহিক আলোচনার তৃতীয় কিস্তি। এতে আমি ইখলাস সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ﴾ [البينة: ٥]
‘আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে।’ {সূরা আল-বাইয়িনাহ্, আয়াত : ০৫}
পূর্বসুরী একজন মনীষী বলেন,
أعزّ شيءٍ في الدُّنيا الإخلاصُ ، وكم اجتهد في إسقاطِ الرِّياءِ عَنْ قلبي ، وكأنَّه ينبُتُ فيه على لون آخر.
‘দুনিয়ার মধ্যে সবচে মূল্যবান বিষয় হলো ইখলাস। আমার অন্তর থেকে রিয়া বা লোক দেখানোর মানসিকতা তাড়াতে কত চেষ্টাই না করেছি; কিন্তু মনের সে নতুন রঙে গজিয়ে ওঠে।’ [1]
পূর্বসুরী মনীষী ও বুযুর্গগণ তাদের দো‘আয় বলতেন,
اللهُمَّ إنِّي أستغفرُكَ ممَّا تُبتُ إليكَ منه، ثمّ عُدتُ فيه، وأستغفرُكَ ممَّا جعلتُهُ لكَ على نفسي، ثمَّ لم أفِ لك به، وأستغفركَ ممَّا زعمتُ أنِّي أردتُ به وجهَك، فخالطَ قلبي منه ما قد علمتَ.
‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে ওই কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যা থেকে আমি তাওবা করেছি অতপর আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছি। আমি সেই বিষয়ের জন্য আপনার কাছে মার্জনা প্রার্থনা করছি যা আমার অন্তরে কেবল আপনার জন্যই স্থাপন করেছি অতপর তার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে পারি নি। আমি সেই বিষয়ের জন্যও আপনার কাছে মাফ চাইছি, যা কেবল আপনাকেই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছি বলে ধারণা করেছি, অতপর তার সঙ্গে আমার অন্তরে তা মিশে গেছে যা সম্পর্কে আপনি অবগত।’[2]
নিয়তের এই গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা ভেবেই আমি আজ আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করেছি ইলম অন্বেষণে নিয়ত খাঁটি করা, এর স্তম্ভসমূহ, অবস্থাদি ও প্রতিবন্ধকতাসমূহ ইত্যাদি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এই ধারাবাহিকটি শেষ করার তাওফীক দান করেন। কারণ, আমার প্রত্যাশা, এটি সকলের জন্য উপকারী হবে আর তাদের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি আমাদেরকে তাঁদের মধ্যে শামিল করেন যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে এবং তার উত্তমটি অনুসরণ করে। যাদের কথাগুলো কর্মের মাধ্যমে সত্যে প্রতিফলিত হয়। তিনি আমাদেরকে সত্যবাদী ও মুখলিস মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এ পর্যায়ে আমরা মূল আলোচনা শুরু করতে পারি :
প্রথমত : ইখলাসের তাৎপর্য
অনেকে ইখলাস শব্দ শুনে ভাবেন ইখলাস বলতে বুঝায় এমন কিছু বলা যে, আমি আল্লাহর জন্য শেখার নিয়ত করেছি বা ইত্যাকার কিছু। আসলে এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ওই ক্ষুধার্থ ব্যক্তির ন্যায় যার সামনে খাবার উপস্থিত, আর সে বলে, আমি খাওয়ার নিয়ত করেছি। এমন বললে কি সেই ব্যক্তি তৃপ্ত হয়ে যাবেন? তার ক্ষুধা নিবারিত হয়ে যাবে? কিংবা ওই তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির ন্যায় যে বলে, আমি পান করার ইচ্ছা করেছি। এতে কি তার তৃষ্ণা উধাও হয়ে যাবে? শপথ আল্লাহর তা কখনো হবার নয়। তেমনি ইখলাসও তা কেবল বলার নাম নয়। বরং তা এক ভিন্ন জিনিস।
ইখলাস হলো, অন্তরকে কাঙ্ক্ষিত দিকে পুরো মাত্রায় অভিমুখী করা। কেউ বলেন, অন্তরের চক্ষুকে আল্লাহ ছাড়া অন্য সবার থেকে বন্ধ করে নেওয়া।
বলা হয়েছে, ইখলাস হলো, আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে এক গোপন ব্যাপার। কোনো ফেরেশতা তা জানতে পারেন না যে তিনি লিখবেন, কোনো শয়তানও নয় যে তা বিনষ্ট করবে কিংবা প্রবৃত্তিও নয় যে তাকে অন্য কোনো দিকে ধাবিত করবে। অতএব ইখলাস হলো কর্মকে মাখলূক বা সৃষ্টির পর্যবেক্ষণ থেকে পরিচ্ছন্ন রাখা। সুতরাং আপনি যখন ইবাদতে একমাত্র আল্লাহকেই একক দ্রষ্টা ও লক্ষ্য ঠিক করবেন এবং খালেক বা স্রষ্টার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মানুষের দৃষ্টির কথা একেবারে ভুলে যাবেন তখনই কেবল আপনার ইখলাস বাস্তব রূপ লাভ করবে।
ইমাম বুখারী তদীয় সহীহ গ্রন্থে ঈমান অধ্যায়ে উল্লেখ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ وَلِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ».
‘আমল (কবুল হবে) নিয়ত অনুযায়ী। প্রত্যেকে তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। অতএব যার হিজরত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের আশায় কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের অভিপ্রায়ে, তবে তার হিজরত যাকে উদ্দেশ্য করে তার জন্যই গণ্য হবে।[3]
দ্বিতীয়ত : কেন আমরা ইলম শিখব? কেন আমরা ফিকহ অর্জন করব? কেন আমরা ইলম হাসিল করব?
ইলম হলো ইবাদতসমূহের একটি। নেকীগুলোর অন্যতম। তা অর্জনে তাই নিয়ত শুদ্ধ হলে কবূল করা হয় এবং তা বৃদ্ধি করা হয়। তার বরকত বর্ধিত হয়। আর যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে ইলম শেখা হয় তবে তা নিক্ষেপ করা হয়। তা অকেজো হয়ে যায় এবং তার মূল্য কমে যায়।
ইমাম তিরমিযী তদীয় জামে গ্রন্থে বলেন, ইবন কা‘ব ইবন মালেক তদীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন,
«مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّارَ».
‘যে ব্যক্তি আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য কিংবা অজ্ঞদের জব্দ করার উদ্দেশ্যে অথবা নিজের প্রতি মানুষের দৃষ্টি কাড়ার অভিপ্রায়ে ইলম শেখে, আল্লাহ তাকে (জাহান্নামের) অগ্নিতে প্রবেশ করাবেন।’[4]
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ لِيُبَاهِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيَصْرِفَ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ فَهُوَ فِي النَّارِ».
‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করে অজ্ঞদের জব্দ করার উদ্দেশ্যে কিংবা আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য অথবা নিজের প্রতি মানুষের নজর কাড়ার অভিপ্রায়ে, সে (জাহান্নামের) অগ্নিতে থাকবে’ [5]।
এই গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো জ্ঞান অন্বেষণকারীকে এ মর্মে সতর্ক করে যে, সে যেন ইলম শিখতে নিজের নিয়তকে শুদ্ধ করে। অতএব একমাত্র আল্লাহর জন্য তা শিখবে। তাঁরই সন্তুষ্টি তালাশ করবে। তাঁর কাছেই নেকীর প্রত্যাশা রাখবে। মানুষের দৃষ্টিতে উঁচু হওয়া অথবা তাদের কাছ থেকে মর্যাদা লাভের নিয়তে ইলম শিখবে না।
তৃতীয়ত : ইলম হাসিলের উপায় :
ইলম অর্জনের স্বীকৃত দুটি উপায় রয়েছে :
১. কিতাব :
প্রত্যেক জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য এটি মেরুদণ্ড এবং ইলম হাসিলের মৌলিক মাধ্যম স্বরূপ। কিতাবের কিছু আদব আছে জ্ঞান অন্বেষণকারীর যা না জানলেই নয়। সম্ভব হলে আমরা এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
২. শায়খ বা শিক্ষক :
আপনি কি জানেন শায়খ কী? তিনি হলেন পিপাসার্তের জন্য ঠাণ্ডা পানির মতো। ডুবন্ত ব্যক্তির জন্য পরিত্রাণের রশি। তিনি ছাড়া ইলম হাসিল সঠিক হয় না। আগে বলা হত,
من كان شيخه كتابه كان خطؤه أكثر من صوابه.
‘যার কিতাবই হয় তার শিক্ষক, তার সঠিকের চেয়ে ভুলই হয় বেশি’।
অবশ্য জ্ঞান অন্বেষণকারীগণ পরবর্তী পর্যায়গুলোয় কিতাব থেকে বিদ্যা আহরণে নিজের ওপর নির্ভর করতে পারে। কারণ এ পর্যায়ে সে আমার দৃষ্টিতে মৌলিক বিদ্যাসমূহের চাবিগুলোর কর্তৃত্ব লাভ করে। তবে এ ক্ষেত্রেও তার জন্য একজন স্নেহপরায়ন শিক্ষকের উপস্থিতি শ্রেয়। যাতে কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলোয় সে তাঁর দিক নির্দেশনা এবং নির্দেশিকা গ্রহণ করতে পারে।
জ্ঞান অন্বেষণকারীর আরেকটি কর্তব্য, অধিক জ্ঞানী, মুত্তাকী ও পরহেযগার শিক্ষক গ্রহণ করা। কেননা ইবন সীরীন, মালেক ও প্রমুখ পূর্বতন মনীষীবৃন্দ বলেন,
إن هذا العلم دين فانظروا عمن تأخذون دينكم.
‘এই ইলম একটি দীন স্বরূপ, অতএব তোমরা কাদের কাছ থেকে তোমাদের দীন গ্রহণ কর তা খেয়াল রেখ[6]।’
জ্ঞান অন্বেষণকারীকে তার শিক্ষাগুরুর সঙ্গে কিছু অবশ্য পালনীয় মহৎ আদব ও শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আশা করছি এ বিষয়েও আমরা স্বতন্ত্র আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
চতুর্থত. জ্ঞান অন্বেষণকারী কিভাবে তার নিয়ত সহীহ করবে ?
একজন জ্ঞান অন্বেষণকারী যখন তার নিয়তকে পরিশুদ্ধ করতে চাইবেন তাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে :
১. সঠিক নিয়ত :
ইমাম বুখারী তদীয় সহীহ গ্রন্থে লিখেন, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ وَلِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ».
‘আমল (কবুল হবে) নিয়ত অনুযায়ী। প্রত্যেকে তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। অতএব যার হিজরত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়ার লাভের আশায় কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের অভিপ্রায়ে, তবে তার হিজরত যাকে উদ্দেশ করে তার জন্যই গণ্য হবে’।[7]
নিয়ত সম্পর্কে তোমার সাহায্য চাই হে আল্লাহ তোমার সাহায্য চাই। কেননা, অনেক ছোট আমল আছে যা তার নিয়তের বদৌলতে বড় হয়ে যায় আবার অনেক বড় আমল আছে যা তার নিয়তের দরুণ ছোট হয়ে যায়। যেমন ইয়াহইয়া ইবন আবী কাছীর বলেন,
تعلموا النية، فإنها أبلغ من العمل
‘তোমরা নিয়ত শিক্ষা কর। কারণ তা আমলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বলাবাহুল্য, বর্তমান প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে উম্মাহর বিপর্যয়ের রহস্য হলো নিয়তে ইখলাস না থাকা ? !!!
এখন তোমাদের সামনে যুক্তি তুলে ধরা যাক। অতএব ইলম শিক্ষা করার সময় যদি জ্ঞান অন্বেষণকারীর নিয়ত সঠিক হয় এবং সে তার নিয়তের বিশুদ্ধতা অটুট রাখে সেই অবধি যতদিন সে একজন গণ্যমান্য বিদ্বানে পরিণত হয়। লোকেরা যার শরণাপন্ন হয়। তখন তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে সত্য তুলে ধরেন। আল্লাহর কথা বলতে গিয়ে তিনি ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনার পরোয়া করেন না। এভাবেই যদি সব আলিমই এ পথ অবলম্বন করেন তবে শাসক আর রাষ্ট্রপরিচালকরা কি এমন কাউকে খুঁজে পাবেন যারা কি-না দীনের বিষয়ে এমন ফতোয়া প্রদান করেন যাতে রাব্বুল আলামীন সন্তুষ্ট হন না ? তবেই তো দীন বিজয়ী হবে। আর মুসল্লীদের কাছে তার কোনো কাজকে বিতর্কিত মনে হবে না।
আর শাসকগণের নিয়ত যদি ঠিক হয়ে যায় তবে তো তাঁরা মানবজীবনের কল্যাণ সাধনায় সকল চেষ্টা নিয়োগ করতেন। এতে করে কল্যাণ ও শান্তি ব্যাপক হতো। যেমন বলা হয়েছে, ‘যদি শান্তি না থাকত তবে মানুষ ধ্বংস হয়ে যেত।’
সন্দেহ নেই নিয়তই হলো প্রকৃত অনুঘটক ও চালিকাশক্তি যা তোমার বোধ ও উপলব্ধিতে সুপ্ত থাকে। তাই তুমি ছাড়া কেউ সে সম্পর্কে অবগত হতে পারে না। যেমন তুমি এখন ইলম অন্বেষণ করছো, বলতে পারো কোন জিনিস তোমাকে এতে উদ্বুদ্ধ করেছে? সামাজিক মর্যাদা অর্জনের উদ্দেশ্য? নাকি এ জন্য যে মানুষ তোমার ব্যাপারে বলবে, এ একজন অসাধারণ জ্ঞান অন্বেষণকারী, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফল হওয়ার জন্য, নাকি ওই সনদের জন্য যাকে তুমি শো কেসে সাজিয়ে রাখবে?
ইবনু জামা‘আ রহ. বলেন,
حسن النية في طلب العلم بأن يقصد به وجه الله تعالى والعمل به ، وتنوير قلبه، وتحلية باطنه، والقرب من الله تعالى يوم القيامة ، والتعرض لما أعد لأهله من رضوانه ، وعظيم فضله
‘ইলম অন্বেষণের সুন্দর নিয়ত হলো, তা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তদনুযায়ী আমল, নিজের হৃদয়কে আলোকিত করা, অন্তর্লোককে সুসজ্জিত করা, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং তিনি যে এর অধিবাসীর জন্য নিজের সন্তুষ্টি ও বিশাল মর্যাদা প্রস্তুত রেখেছেন তার উপযুক্ত হওয়া ইত্যাদি।’
সুফিয়ান ছাওরী রহ. বলেন,
ما عالجت شيئاً أشد عليَّ من نيتي
‘আমি নিজের জন্য নিয়তের চেয়ে কঠিন আর কিছুর চিকিৎসা আমি করি নি।’
সুতরাং নিয়তই আসল। আল্লাহ হলেন হিসাবগ্রহীতা ও পর্যবেক্ষণকারী। তিনি গোপন ও অন্তরগত বিষয়াদি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। কোনো গোপনই তাঁর কাছে গোপন নয়। কত আমলকেই তো দুনিয়ার আমলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় দুনিয়াবী আমল ধারণা করা হয়, অথচ তা সুন্দর নিয়তের কারণে আখিরাতের আমল হয়ে যায়। আবার কত আমলকেই তো আখিরাতের আমলের সঙ্গে মিল থাকায় আখিরাতের আমল বলে মনে করা হয়। অথচ নিয়তের অশুদ্ধির কারণে তা দুনিয়ার আমলে পরিণত হয়। অতএব খুব সতর্ক থেকো।
২. আখিরাতকে লক্ষ্য বানানো :
পার্থিব কোনো বস্তু অর্জনকে কখনো ইলমের হাসিলের উদ্দেশ্য বানানো যাবে না। যেমন নেতৃত্ব, পদ বা সম্পদ লাভ কিংবা সমবয়সীদের সঙ্গে গর্ব করা, মানুষের সম্মান লাভ করা কিংবা মসলিসের মধ্যে সভাপতিত্ব লুফে নেওয়া ইত্যাদি। তাহলে তা হবে শ্রেয়তরের বিনিময়ে নিম্নতন কিছুকে টার্গেট বানানো। অন্যথায় খারাপ জিনিসও ভালোয় পরিবর্তিত হবে।
আবূ ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বলেন,
يا قوم أريدوا بعملكم الله تعالى ، فإني لم أجلس مجلساً قط أنوي فيه أن أتواضع إلا لم أقم حتى أعلوهم ، ولم أجلس مجلساً قط أنوي فيه أن أعلوهم إلا لم أقم حتى أفتضح . فعليك أخي في الله أن تخلص نيتك ، وتطهر قلبك من الرياء ، وأن تقصد وجه الله بتوجهك فتكسب خيري الدنيا والآخرة ، و إلا فالخسار والدمار وخراب الديار
‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা ইলমের লক্ষ্য বানাও আল্লাহ তা‘আলাকে। কেননা আমি যে মজলিসেই বসেছি নিজেকে আল্লাহর কাছে বিনীত বানানোর উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে আমি উঠেছি তাদের মধ্যে সবচে মর্যাদাবান হয়ে। আর যে বৈঠকেই অংশ নিয়েছি নিজে মর্যাদাবান হবার নিয়তে সেখান থেকে কখনো লাঞ্ছিত না হয়ে উঠি নি। অতএব হে আমার ঈমানের ভাই, তোমার উচিত নিজের নিয়তকে খাঁটি বানানো, অন্তরকে রিয়া তথা লোক দেখানোর মানসিকতা থেকে মুক্ত করা এবং মনোযোগ কেবল দেয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতি। তাহলে তুমি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের কল্যাণ লাভ করতে পারবে। অন্যথায় কেবল ক্ষতি, ধ্বংস আর জনপদের বিলুপ্তি।
৩. আল্লাহর আনুগত্য।
কারণ ইলম এমন এক রিযক যা গুনাহ সমেত লাভ করা যায় না : আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إنّ رُوحَ القُدُسِ نَفَثَ في رُوعِي أنّ نَفْساً لنْ تَمُوتَ حَتّى تَسْتَكْمِلَ أجَلَها وَتَسْتَوْعِبَ رِزْقَها فاتّقُوا الله وأجْمِلُوا في الطَّلبِ ولا يَحْمِلنَّ أحَدَكُمُ اسْتِبْطاءُ الرِّزْقِ أنْ يَطْلُبَهُ بِمَعْصِيَةِ الله فإنّ الله تعالى لا يُنالُ ما عِنْدَهُ إلاّ بِطاعَتِهِ».
‘নিশ্চয় রুহুল কুদুস (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম) আমার অন্তরে ফুঁ দিয়েছেন যে, কোনো প্রাণই তার আয়ু পূর্ণ না করে এবং তার রিযক শেষ না করে মৃত্যু বরণ করবে না। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় (রিযক) অন্বেষণ করো। আর রিযকের ধীর গতি যেন তোমাদেরকে তা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে তালাশে উদ্বুদ্ধ না করে। কারণ আল্লাহর কাছে যা আছে তা কেবল তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমেই অর্জন করা যায়’।[8]
জেনে রাখ হে আমার ঈমানের ভাই, তুমি কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রাচুর্য প্রার্থনা করছো, আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা কেবল তাঁর আনুগত্যের মধ্য দিয়েই লাভ করা যায়।
৪. রিয়া থেকে দূরে থাক :
আবদুল্লাহ আনতাকী বলেন,
من طلب الإخلاص في أعماله الظاهرة ، وهو يلاحظ الخلق بقلبه ، فقد رام المحال؛ لأنَّ الإخلاص ماء القلب الذي به حياته ، والرياء يميته.
‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্য আলমগুলোয় ইখলাস তালাশ করে আর সে তার উল্টো পীঠে সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখে তবে সে যেন অসম্ভব কিছু পাবার প্রত্যাশা করে। কেননা, ইখলাস হলো প্রাণভোমরা, যার ওপর তার হায়াত। আর রিয়া তাকে মেরে ফেলে।’
অতএব ইখলাস ছাড়া আখিরাতে নাজাত লাভ, দুনিয়াতে ইলম দ্বারা উপকৃত হওয়া বা উপকার করা সম্ভব নয়। আল্লাহ আপনাকে আমাকে ইখলাস নসীব করুন। আমীন।
৫. নিফাক থেকে বেঁচে থাকা :
এমনভাবে মুনাফিক হওয়া থেকে সাবধান থাক যে তুমি জানতেও পারলে না। এমনভাবে দেখিয়ে কাজ করলে যে তুমি তা ঠিক জানতেও পারলে না। গোপন লিপ্সা থেকে সতর্ক থাক। কেননা অনেক জ্ঞান অন্বেষণকারীর পতন হয়েছে এই গোপন বাসনা সম্পর্কে উদাসীন হওয়ার কারণে। আর এটি আল্লাহর কাছে কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবত তা যিনা ও মদ পানের চেয়েও বড়। আর এই গোপন বাসনাগুলো জ্ঞান অন্বেষণকারী মাত্রকেই হামলা করে। চাই তিনি ছোট হোন বা বড় কিংবা খ্যাতিমান বা অখ্যাত। এটি তার আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। তার উদ্দেশ্যকে বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ আপনাদের আমাদের এ থেকে মুক্তি দান করুন।
আর গোপন বাসনা হলো, পদ-মর্যাদা ও প্রদর্শনপ্রিয়তার লিপ্সা, মানুষের সম্মান ও ভক্তি অর্জনের লিপ্সা, প্রশংসা অর্জন এবং লোকেরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সেই বাসনা। ইলম গ্রহণের বিপদ হলো তাকে জাগতিক স্বার্থগুলোর মধ্যে কোনো স্বার্থ উদ্ধারের উপায় বানানো। যেমন ব্যক্তিগত ইমেজ নির্মাণ, মানুষের মধ্যে বড় হবার বাসনা, অন্যদের চেয়ে নিজেকে বেশি সম্মানিত ভাবা, অন্যকে হীন জ্ঞান করা এবং অন্যের কুৎসা গাওয়া। নেতৃত্বপ্রিয়তা, মানুষ তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুক এবং তার অনুগত হোক সেই প্রবৃত্তি। অতপর পরিণাম হবে : বড়ত্ব, অহমিকা, বড়াই, আমিত্ব, স্বার্থপরতা, নফসের দাসত্ব, তার জন্য বিজয়ী হওয়া, তার জন্য রাগান্বিত হওয়া এবং প্রবৃত্তির গোলামী।
আর আল্লাহর শপথ, এসব হলো এমন বিপদ –আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- যদ্বারা তোমার ঈমানের আকাশ তার ভূমিতে পতিত হয়। ফলে আত্মার কোনো দৃঢ় ভিত থাকে না। আল্লাহর শপথ, এই আত্মার ব্যাধির নামগুলো গণনা করতেও হৃদয় কেঁপে ওঠে। আল্লাহ আপনাদের আমাদের এ থেকে মুক্তি দান করুন।
আল্লাহর শপথ, রিয়া এবং গোপন প্রবৃত্তির ব্যাপারটিই বড় ভয়ঙ্কর বিপদ, সবচে বড় মুসীবত। কেননা নিয়তের অশুদ্ধি রিয়া ও শিরক জন্ম দেয়। আর রিয়া হলো মুনাফেকীর প্রবেশদ্বার। আর গুনাহ হলো অপকর্মের দূত। আর এ দুটি হলো কুফুরির সুরঙ্গ।
৬. দম্ভ ও অহংকার থেকে বেঁচে থাকা :
আমি বারবার পুনরাবৃত্তি করছি কথাটা, দম্ভ ও অহংকার থেকে বেঁচে থাক। কারণ এটি জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য প্রাণ সংহারক বিষের মতো। আল্লাহর শপথ করে বলছি, যে জ্ঞান অন্বেষণকারীই বিনয়ী হয়েছে, আল্লাহ তার মর্যাদা বুলন্দ করেছেন। আর যে জ্ঞান অন্বেষণকারীই দম্ভ বা অহংকারে আক্রান্ত হয়েছে, আল্লাহ তার ইলমের বরকত উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহর শপথ করে আরো বলছি, এটি সর্ব যুগের সর্বকালের অভিজ্ঞতালব্ধ কথা। অতএব কথাটাকে হেলায় গ্রহণ করো না, তাহলে তুমি ধ্বংসপ্রাপ্তদের দলে চলে যাবে।
আর জেনে রাখ, (আল্লাহ তোমাকে কল্যাণের পথ দেখান) গর্ব ও অহংকার তোমাকে দাওয়াত এবং মানুষের হেদায়াতের পথ থেকে সরিয়ে সমবয়সীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেবে। যা থেকে পরস্পর হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতায় জড়িয়ে পড়বে।
৭. আমল এবং আমল :
আমল হলো উপকারী ইলমের সুস্বাদু ফলস্বরূপ। কেননা ইলমের সঙ্গে যদি আমল অর্জিত না হয় তবে তা হবে নিষ্ফল ইলম। অতএব উপদেশ হলো, নিয়ত ঠিক না করতে পারলে এই জ্ঞান অন্বেষণকারী অন্য আরেকটি জিনিসের জন্যই যাবে যার সুফল রয়েছে। যেমন ব্যবসা, এর প্রাপ্তি হলো মুনাফা ও সম্পদ। এটি হতে পারে তার জন্য ইলম হাসিলের চেয়ে বেশি লাভজনক হবে। বলাবাহুল্য, আমলের মধ্যে রয়েছে মন্দ সকল কাজ পরিহার এবং সকল ভালো কাজ সম্পাদন করা।
৮. সবর বা ধৈর্য-সহিষ্ণুতা :
আমি সবরের দ্বারা বুঝাতে চাচ্ছি ইলম হাসিলের পথে যে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয় তাকে। যেমন শিক্ষক যখন অপ্রত্যাশিত আচরণ করেন। তেমনি মুখস্থ করতে গিয়ে সবর করা, যখন তা মুখস্থ হতে না চায় এবং রিযিক স্বল্পতায় সবর করা, কারণ ইলম অর্জনে ব্যস্ততা সাময়িকভাবে আর্থিক সম্পদের স্বল্পতার কারণ হতে পারে।
৯. বিবাদ এড়িয়ে যাও, যদিও তুমি হও সত্যবাদী :
নিজের অবস্থান সঠিক হলেও অনেক সময় ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে যেতে হয়। কারণ, ঝগড়া-বিবাদ ইলমের প্রসার ঘটায় না, বরং হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ায়। দম্ভ ও অহংবোধের জন্ম দেয়। তবে সত্যের ব্যাপারে বিতর্ক ও গঠনমূলক সমালোচনার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, আমরা সবাই যেমন জানি, বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে সত্য প্রকাশিত হয় এবং মিথ্যা অন্তর্হিত হয়। ইলমের গভীরতা পরিমাপ করা যায়। তবে বিতর্কের সময় নিয়ত দুর্বল হয়ে যায়। অতএব এ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।
১০. ইলম হাসিল করতে গিয়ে শুধু এক ইলমে সীমাবদ্ধ না থাকা :
কারণ, ইলম হাসিল করাটা এক ধরনের সংখ্যার মতো যার সূচনা আছে কিন্তু তার সমাপ্তি নেই। সূচনাকালে তোমার অনেক ইলমের চাবির প্রয়োজন হবে। যাতে করে তুমি ইলমের পথে সহজে নিজে চলতে পার এবং অন্যকেও পরিচালিত করতে পার।
১১. গোঁড়ামি পরিহার করা :
সত্যে উপনীত হবার পথে গোঁড়ামির মত কোনো অন্তরায় হয় না। কেউ যদি কোনো ব্যক্তি, দল, মত, ধারা, শিক্ষক, শাসক বা লেখকের পক্ষে গোঁড়ামি দেখায়, তবে তার পাত থেকে তোমার হাত ধুয়ে নাও। চার চারবার তাকবীর দিয়ে তার কাছ থেকে পালিয়ে যাও। আল্লাহর কাছে তার জন্য করুণা প্রার্থনা করো। কারণ, সে মৃতদের দলে চলে গেছে। সে আর জীবিত হবে না যাবৎ হকের ব্যাপারে গোঁড়ামি ত্যাগ করে। আর এ ধরনের লোকদের সঙ্গে বিতর্ক বা আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়ে তুমি নিজেকে ক্লান্ত বানিয়ো না। আল্লাহর দোহাই দিয়ে জানতে চাই, মৃতের সঙ্গে কি আলোচনা করা যায়? তেমনি তার সঙ্গেও আলোচনা প্রয়াসও একেবারে নিষ্ফল ব্যাপার যাবৎ সে তার গোঁড়ামি পরিহার করে।
১২. চিত্ত বিনোদনে ভারসাম্য রক্ষা করো :
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মানবমনকে বিনোদন বা ক্রিড়া-কৌতুকে আসক্ত বানিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে কোনো সমস্যাও নাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কৌতুক করেছেন বলে হাদীসে প্রসিদ্ধ অনেক ঘটনা রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো মৌলিকভাবে কাজটি শরীয়তসম্মত হতে হবে। এ ব্যাপারে তেমনি ভারসাম্যও রক্ষা করতে হবে, যাতে অন্তর মরে না যায়।
১৩. নিজের জিহ্বাকে সংযত করো :
জ্ঞান অন্বেষণকারীকে অনেক সময় তার সম্মান হারানোর মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, মূর্খ ও নির্বোধদের সঙ্গে কখনো আলোচনা করতে হয়, পরশ্রীকাতর ও সমবয়সীদের গোলযোগের মুখোমুখী হতে হয়। সুতরাং সে যদি আত্মার শক্তি ও বিবেকের প্রহরায় সুসজ্জিত না হয় তবে একের পর এক সে ডানে-বাঁয়ে ঝুঁকতে থাকে। এক পর্যায়ে সে ধ্বংসই হয়ে যায়। পতিত হয় সে কর্দমাক্ত জলাশয়ে। যেমনটি অনেক সময়ই পরিলক্ষিত হয়।
পঞ্চমত : অন্তরে এসব রোগের অনুপ্রবেশ ঘটে কিভাবে ?
পূর্বোল্লিখিত রোগগুলো অন্তরে প্রবেশের প্রকৃত কারণ হলো অজ্ঞতা, যা জটিল রোগ ও ভয়ঙ্কর ব্যধির মতো। হ্যা, কেউ কেউ তার মূর্খতায় আনন্দও বোধ করে! আল্লাহর কাছে মূর্খতা ও মূর্খদের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। পূর্ববর্তী আলেমদের প্রতি আল্লাহ রহম করুন তাঁরা পরিত্রাণের পথগুলো ভালো চিনতেন :
আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. বলেন,
وقلما تجد بالعلم معجبًا، وبما أدرك مفتخرًا، إلا من كان فيه مُقلًّا مقصرًا؛ لأنه قد يجهل قدره، ويحسب أنه نال بالدخول فيه أكثره، فأما من كان فيه متوجهًا، ومنه مُستكثِرًا، فهو يعلم من بعد غايته والعجز عن إدراك نهايته ما يصده عن العجب به.
‘তুমি অল্প লোককেই তার ইলমে পরিতৃপ্ত এবং নিজের ইলমে অহংকারী দেখতে পাবে, তবে শুধু তাকেই পাবে এসব করতে যার ইলম সামান্য ও ত্রুটিপূর্ণ। কারণ সে কখনো নিজের অবস্থান ভুলে যায়। ধারণা করে সে বুঝি ইলম দরিয়ায় একটু বেশিই ঢুকে পড়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলমের ক্ষেত্রে অতৃপ্ত থাকে, আরও বেশি অর্জনে আগ্রহী হয়, সে তার লক্ষ্যের দূরত্বে এবং প্রান্ত স্পর্শে অক্ষমতা সম্পর্কে সজাগ থাকে। আর এটি তাকে আত্মতৃপ্ত ও অহংকারী হতে বাধা দেয়।’[9]
ইমাম শা‘বী রহ. বলেন,
العلم ثلاثة أشبار: فمن نال شبرًا منه شمخ بأنفه، وظن أنَّه ناله، ومن نال منه الشبر الثاني صغرت إليه نفسه، وعلم أن لم ينَلْه، وأما الشبر الثالث فهيهات لا يناله أحدًا أبدًا.
‘ইলম হলো তিন বিঘত পরিমাণ : যে তা এক বিঘত পরিমাণ লাভ করে সে নাক উঁচু করে এবং ভাবে সে বুঝি পেয়েই গেছে। আর যে দ্বিতীয় বিঘত পায় সে নিজেকে ছোট ভাবে এবং ভাবে সে কিছুই পায় নি। আর তৃতীয় বিঘত, হায় হায় তা কেউ কখনো পায় নি।’
ষষ্ঠত : কিভাবে আমার নিয়ত খাঁটি বানাবো ?
সাহাল তাসতারী রহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন জিনিস অন্তরের জন্য কঠিন ?!!
নফস পছন্দ করে নেতৃত্ব, প্রশংসা ও প্রদর্শনী। ধাবিত হয় কর্মহীনতা ও অলস্যের প্রতি। আর তার জন্য সুসজ্জিত করা হয়েছে যাবতীয় লালসা ও বাসনাকে। এ জন্যই বলা হয়েছে, নিয়তকে খাঁটি বানানো কর্ম সম্পাদনকারীর জন্য কর্ম সম্পাদনের চেয়েও কঠিনতর।
কেউ কেউ বলেন,
إخلاص ساعة نجاة الأبد، ولكن الإخلاص عزيز.
‘এক মুহূর্তের ইখলাস চিরকালের মুক্তি। কিন্তু ইখলাস বড় কঠিন’।
কেউ কেউ নিজের আত্মাকে সম্বোধন করে বলতেন,
اخلصي تتخلصي.
‘তুমি ইখলাস অর্জন করো তবে খালাস (মুক্তি) পেয়ে যাবে’।
আরো বলা হয়েছে,
طوبى لمن صحت له خطوة لم يرد بها إلا وجه الله.
‘ওই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যার একটি পদক্ষেপ সঠিক হয়েছে যেখানে সে একমাত্র আল্লাহকে খুশি করতে চেয়েছে’।
সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন,
قالت لي والدتي: يا بُني لا تتعلم العلم إلا إذا نويت العمل به، وإلا فهو وبال عليك يوم القيامة.
‘আমার মা আমাকে বলতেন, হে আমার প্রাণপ্রিয় পুত্র, একমাত্র আমলের নিয়ত ছাড়া তুমি ইলম শিখ না, অন্যথায় তা কিয়ামতের দিন তোমার জন্য বিপদের কারণ হবে’।
যুন্নূন মিসরী রহ. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বান্দা সম্পর্কে কখন জানা যাবে সে মুখলিসদের অন্তর্ভুক্ত ? তিনি উত্তর দেন,
إذا بذل المجهود في الطاعة ، وأحب سقوط المنزلة عند الناس.
‘যখন আল্লাহর আনুগত্যে সব চেষ্টা নিয়োগ করে এবং মানুষের কাছে মর্যাদা পড়ে যাওয়া পছন্দ করে।
ইয়াহয়া ইবন মু‘আয রহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো বান্দা কখন মুখলিস হয় ? তিনি উত্তর দেন,
إذا صار خلقه كخلق الرضيع ، لا يبالي من مدحه أو ذمه.
‘যখন তার স্বভাব হয় দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো; কে প্রশংসা করল আর কে ভর্ৎসনা দিল তার পরোয়া করে না’।
প্রশংসা ও সুনামের ক্ষেত্রে নির্লোভ হওয়ার সহজ কৌশল হলো এ কথা হৃদয়ে বদ্ধমূল করা যে, কারো সুনাম বা বিশেষণই উপকার দেয় না এবং কারো ভর্ৎসনা বা নিন্দাই ক্ষতি করে না একমাত্র আল্লাহরটা ছাড়া। অতএব তার প্রশংসার ব্যাপারে নির্লোভ হও যার প্রশংসা তোমাকে সৌন্দর্য দান করে না। তেমনি তার নিন্দারও পরোয়া কর না যার নিন্দা বা সমালোচনা তোমার মানহানী ঘটায় না। তুমি আগ্রহী হও তাঁর প্রশংসায়, সকল সৌন্দর্য যার প্রশংসায় এবং সকল মানহানী যার নিন্দায়। আর এটা পারবে না তুমি যাবৎ না সবর ও ইয়াকীন তথা আল্লাহর প্রতি ধৈর্য ও বিশ্বাস অর্জন কর। সম্বল হিসেবে তোমার কাছে সবর ও ইয়াকীন না থাকলে তোমার অবস্থা হবে ওই ব্যক্তির মতো যে সমতলে সফরের ইচ্ছা করে কোনো বাহন বা যান ছাড়া। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿فَٱصۡبِرۡ إِنَّ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقّٞۖ وَلَا يَسۡتَخِفَّنَّكَ ٱلَّذِينَ لَا يُوقِنُونَ٦٠﴾ [الروم: ٦٠]
‘অতএব, তুমি সবর কর। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা হক। আর যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে না তারা যেন তোমাকে অস্থির করতে না পারে’। {সূরা আর-রূম, আয়াত : ৬০}
আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَجَعَلۡنَا مِنۡهُمۡ أَئِمَّةٗ يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُواْۖ وَكَانُواْ بَِٔايَٰتِنَا يُوقِنُونَ ٢٤﴾ [السجدة: ٢٤]
‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিল, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত’। {সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত : ২৪}
সপ্তমত. ইখলাসের অন্তরায়সমূহ এবং সেসবের প্রতিকার :
১. লোভ-লালসা :
এর প্রতিকার হলো মানুষের কাছে যা আছে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা না করা। আল্লাহর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাঁর কাছে যা আছে তার প্রতি আগ্রহ রাখা।
২. প্রশংসাপ্রিয়তা :
এর প্রতিকার হলো, এ কথা জানা যে সে-ই প্রকৃতপক্ষে প্রশংসা পাবার যোগ্য যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন। যদিও লোকে তার নিন্দা করে। জনৈক বুযুর্গ বলেন, সে পর্যন্ত কেউ মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত হবে না যাবৎ তার কাছে প্রশংসা ও নিন্দাকারী সমান মনে হয়।
৩. রিয়া বা লোক দেখানো মানসিকতা :
ইখলাসপ্রত্যাশী সবার জানা উচিত যে, বস্তুত মাখলূক বা সৃষ্টি তার কোনো উপকার বা অপকার করতে পারে না। অতএব বৃথাই নিজেকে ক্লান্ত বানিয়ে, নিজের দীনের ক্ষতি করে, নিজের সব আমল বরবাদ করে, আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টি কুড়িয়ে এবং তাঁর সন্তুষ্টি হারিয়ে মানুষের মন যোগাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে না। মনে রাখবে, তুমি যাকে দেখিয়ে কাজ করছ তার অন্তর কিন্তু তাঁর হাতে যাকে তুমি রুষ্ট করছো।
৪. আত্মতুষ্টি :
আত্মতুষ্টি থেকে বাঁচার উপায় হলো এ কথা জানা যে, আমল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তার জন্য এক ধরনের নিয়ামত। আর এটি তার কাছে অস্থায়ী আমানতস্বরূপ। কারণ, আল্লাহ যা নিয়ে নেন তা তাঁরই, যা দান করেন তাও তাঁর। আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসই সুনির্দিষ্ট মেয়াদধারী। অতএব তার জন্য এমন কিছু নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা সমীচীন নয়, যা সে আবিষ্কার করে নি কিংবা যা তার মালিকানাধীন নয় তদুপরি সে তার স্থায়িত্বের ব্যাপারেও তো নিশ্চিত নয়।
৫. অন্যকে হেয় বা অবজ্ঞা করা কিংবা ছোট ভাবা :
অন্যকে ছোট ভাবা কিংবা হেয়, অবজ্ঞা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা থেকে বাঁচার উপায় হলো, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন সঠিকভাবে তা ভেতরে লালন করা। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সম্মানের মাপকাঠি নির্ধারণ করে ইরশাদ করেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣﴾ [الحجرات: ١٣]
‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত’। {সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত : ১৩}
নিজেকে বড় ভেবে নিজেই নিজের সার্টিফেকেট দেয়া থেকে সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَجۡتَنِبُونَ كَبَٰٓئِرَ ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡفَوَٰحِشَ إِلَّا ٱللَّمَمَۚ إِنَّ رَبَّكَ وَٰسِعُ ٱلۡمَغۡفِرَةِۚ هُوَ أَعۡلَمُ بِكُمۡ إِذۡ أَنشَأَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ وَإِذۡ أَنتُمۡ أَجِنَّةٞ فِي بُطُونِ أُمَّهَٰتِكُمۡۖ فَلَا تُزَكُّوٓاْ أَنفُسَكُمۡۖ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَنِ ٱتَّقَىٰٓ ٣٢﴾ [النجم: ٣٢]
‘যারা ছোট খাট দোষ-ত্রুটি ছাড়া বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে, নিশ্চয় তোমার রব ক্ষমার ব্যাপারে উদার, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত। যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রুণরূপে ছিলে। কাজেই তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। কে তাকওয়া অবলম্বন করেছে, সে সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত’। {সূরা আন-নাজম, আয়াত : ৩২}
সুতরাং অনেক সময় সে যাকে নিজের চেয়ে নিম্ন মর্যাদার ভাবছে হতে পারে সে তার চেয়ে আল্লাহর ভীতিতে, অন্তরের পবিত্রতায়, নিয়তের শুদ্ধতায় এবং আমলের শুভ্রতায় এগিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া সে তো জানে না নিজের শেষ অবস্থা কী হবে।
শেষ কথা :
পরিশষে আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার যে, নিয়ত খাঁটি নয় মনে করে কোনো দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা থেকে বিরত হওয়া উচিত নয়। কারণ, ইলমের বরকতে নিয়তের পরিশুদ্ধি অর্জন খুবই প্রত্যাশিত ও সম্ভাব্য বিষয়। যেমন জনৈক বুযুর্গ বলেছেন,
طلبنا هذا العلم لغير الله فأبى أن يكون إلا لله.
‘আমরা এ ইলম শিখেছি গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়াও অন্য কারও উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ ইলমই কেবল আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোও জন্যে হাসিল হতে অস্বীকার করেছে।’[10]
তেমনি ইমাম মুজাহিদ ও অন্য অনেকে বলেছেন,
طلبنا هذا العلم، وما لنا فيه كبير نية، ثم رزق الله النية بعدُ.
‘আমরা এ ইলম শিখেছি, অথচ এতে আমার নিয়ত বড় কিছু ছিল না। অতপর আল্লাহ পরবর্তীতে আমাদেরকে ‘সহীহ নিয়তে’র তাওফীক দান করেছেন।’[11]
একবার ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহিমাহুল্লাহকে বলা হলো,
إن قومًا يكتبون الحديث، ولا يُرى أثره عليهم، وليس لهم وقار. فقال: يؤولون في الحديث إلى خير.
‘এক দল লোক আছে যারা হাদীস সংকলন করে অথচ তাদের ওপর এর কোনো সুপ্রভাব দৃষ্টিগোচর হয় না। তাদের কোনো গাম্ভীর্য প্রকাশ পায় না। তিনি বললেন, হাদীস তাদেরকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাবে।’
হাবীব ইবন আবী ছাবেত রহ. বলেন,
طلبنا هذا العلم، وما لنا فيه نية، ثم جاءت النيةُ والعملُ بعد.
‘আমরা এ ইলম শিখেছি তখন আমাদের বড় কিছু নিয়ত ছিল না। অতপর পরবর্তীতে সহীহ নিয়ত এবং আমল যোগ হয়েছে।’
অতএব বান্দার হার মানা উচিত নয়। বরং নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যদিও প্রথম দিকে এই শুদ্ধ করার কাজটিকে কঠিন মনে হবে। কারণ, শায়খ সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
ما عالجت شيئًا أشدَّ عليَّ من نيتي.
‘আমি নিয়তে চেয়ে অন্য কিছু দেখি নি যা শুদ্ধ করা এত কঠিন।’
অতএব জ্ঞান অন্বেষণকারীর কর্তব্য হলো, ইলম তলবে নিজের নিয়তকে সুন্দর বানাবে, ইখলাস রচনা করবে এবং তাওহীদকে খাঁটি বানাবে। সুতরাং যে ইলম অন্বেষণে নিজের নিয়তকে খাঁটি করবে এবং এ পথে কষ্ট-সহিষ্ণুতার মাধ্যমে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, তাকে অবশ্যই দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। তাহলে সে এর মাধ্যমে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার যোগ্য হয়ে উঠবে।
এই হলো কিছু উপদেশ যা আমি তোমাদের সামনে উপস্থাপন করলাম। প্রতিটি আগ্রহী শ্রোতা যা গ্রহণ করবে। আর আমিই এসবের বেশি মুখাপেক্ষী। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের এই খাঁটি নিয়ত অর্জনে সাহায্য করেন, আমরা যা শিখি তা থেকে আমাদের উপকৃত করেন এবং একে আমাদের বিপক্ষে নয়; পক্ষে দলীল বানান। এ হলো অল্প পূঁজির চেষ্টা। আমার ধারণা আমি আমার সব সামর্থ্য ব্যয় করেছি, আমি নিজেকে নির্দোষ দাবি করছি না। আমি এসব মূলত নসীহত হিসেবে লিখেছি। অতএব কেউ যদি এতে ভালো কিছু পান তাহলে আমার জন্য হিদায়াতের দু‘আ করবেন। আর যদি কেউ অন্য কিছু পান তবে বলব, আমি কোনো পদ বা অর্থ চাই নি; চেয়েছি কেবল অপরের কল্যাণ। আল্লাহ আমাদের সকল মহৎ বাসনা পূরণ করুন। আমীন। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম।
[1]. আল- আরবাঈন আন- নাববিয়্যাহ : ১/৩।
[2]. আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া : ২/২০৭।
[3]. বুখারী : ৫৪।
[4]. তিরমিযী : ২৬৫৪।
[5]. ইবন মাজাহ্ : ২৫৩; সহীহ জামে‘তে শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সহীহ জামে‘ : ৬১৫৮।
[6] মুসলিম, ১/১৪। ভূমিকা। মুয়াত্তা মালিক, ১/২৫। [সম্পাদক]
[7]. বুখারী : ৫৪।
[8]. জামেউস সগীর : ৩৮৪৮; আবূ নাঈম, হুলইয়াতুল আওলিয়া : ৪১১২। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন, সহীহুল জামে : ২০৮৫।
[9]. আদাবুদ্দুনইয়া ওয়াদ্দীন, পৃ. ৮১।
[10]. প্রাগুক্ত।
[11].প্রাগুক্ত।