×
সন্তান প্রতিপালনে ইসলামের প্রেরণা: প্রবন্ধটিতে প্রবন্ধকার ইসলামে সন্তান লালন-পালনের গুরুত্ব আলোচনা করেছেন। অনুরূপভাবে কন্যা-সন্তানের প্রতি ইসলামের বিশেষ দিঙ্‌নির্দেশনা ও মর্যাদা সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। অতঃপর নবজাতকের প্রতি পিতা-মাতার কিছু কর্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।

    সন্তান প্রতিপালনে ইসলামের প্রেরণা

    [ বাংলা – Bengali – بنغالي ]

    আলী হাসান তৈয়ব

    সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    2011-1432

    ﴿ حث الإسلام على تربية الأولاد ﴾

    « باللغة البنغالية »

    علي حسن طيب

    مراجعة: الدكتور محمد منظور إلهي

    2011 - 1432

    সন্তান প্রতিপালনে ইসলামের প্রেরণা

    ইসলাম যেসব দিক বিবেচনায় নিয়ে মানুষকে বিবাহে উদ্বুদ্ধ করে সন্তান জন্ম দেয়া তার অন্যতম প্রধান কারণ। সন্তানের মাধ্যমে বিবাহিত জীবনের স্বার্থকতা ফুটে ওঠে। বিবাহিত মানুষ মাত্রই সন্তান কামনা করেন। বিশেষত নারীদের দৃষ্টিতে। আপন জন্মের স্বার্থকতাই সন্তান জন্ম দেবার মধ্যে বলে মনে করেন নারীরা। নিঃসন্তান দম্পতিরাই জানেন সন্তান কতটা আরাধ্য। মানুষের স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা তার স্বভাব সম্পর্কে সবচে ভালো জানেন। তাই তিনি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

    ﴿ٱلۡـَٰٔنَ بَٰشِرُوهُنَّ وَٱبۡتَغُواْ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ ﴾ [البقرة:187]

    ‘অতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা অনুসন্ধান কর।’ {সূরা আল-বাকারা : ১৮৭}

    ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, ইকরামা, হাসান বসরী, সাদ্দী ও যাহহাক বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য সন্তান।

    আজ পশ্চিমা প্রচারণার যুগে অধিক সন্তান নেয়াকে শুধু নিরুৎসাহিতই করা হচ্ছে না। বেশি সন্তান জন্মদানকারী দম্পতিকে অপরাধীর দৃষ্টিতেও দেখা হচ্ছে কোথাও কোথাও। অথচ মানবতার কল্যাণের বার্তাবাহী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অধিক সন্তান নিতে সুস্পষ্টভাবে অনুপ্রাণিত করছেন।

    আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْمُرُ بِالْبَاءَةِ ، وَيَنْهَى عَنِ التَّبَتُّلِ نَهْيًا شَدِيدًا ، وَيَقُولُ : تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ ، إِنِّي مُكَاثِرٌ الأَنْبِيَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ».

    ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং বৈরাগ্য থেকে তীব্রভাবে বারণ করতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমরা অধিক সন্তানদানকারী স্বামীভক্ত নারীদের বিয়ে করো। কেননা কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের (সংখ্যা) নিয়ে নবীদের সামনে গর্ব করবো।’ [মুসনাদ আহমাদ : ১২৬৩৪।]

    মা‘কাল বিন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ إِنِّى أَصَبْتُ امْرَأَةً ذَاتَ حَسَبٍ وَجَمَالٍ وَإِنَّهَا لاَ تَلِدُ أَفَأَتَزَوَّجُهَا قَالَ : لاَ. ثُمَّ أَتَاهُ الثَّانِيَةَ فَنَهَاهُ ثُمَّ أَتَاهُ الثَّالِثَةَ فَقَالَ : «تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّى مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ».

    ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক ব্যক্তি এলো। সে বলল, একজন কুলীনা ও সুন্দরী মহিলা পেয়েছি, তবে সে সন্তান জন্ম দিতে পারে না। আমি কি তাকে বিয়ে করবো? তিনি বললেন, ‘না’। অতপর তাঁর কাছে দ্বিতীয়বার এসে পরামর্শ চাইলেন। আবার তিনি বারণ করলেন। সে তৃতীয়বার তাঁর কাছে এলে সেবারও তিনি তাকে নিষেধ করলেন। অতপর তিনি বললেন, ‘তোমরা অধিক সন্তানদানকারী স্বামীভক্ত নারীদের বিয়ে করো। কেননা কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের (সংখ্যা) নিয়ে গর্ব করবো।’ [আবূ দাউদ : ২০৫২; নাসায়ী : ৩২২৭]

    আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «النِّكَاحُ مِنْ سُنَّتِي ، فَمَنْ لَمْ يَعْمَلْ بِسُنَّتِي , فَلَيْسَ مِنِّي، وَتَزَوَّجُوا ، فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأُمَمَ ، وَمَنْ كَانَ ذَا طَوْلٍ فَلْيَنْكِحْ ، وَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَعَلَيْهِ بِالصِّيَامِ ، فَإِنَّ الصَّوْمَ لَهُ وِجَاءٌ».

    ‘বিবাহ আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নত মোতাবেক কাজ করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়। তোমরা বিবাহ করো। কেননা আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অন্যান্য উম্মতের সামনে গর্ব করব। অতএব যার যোগ্যতা আছে সে যেন বিয়ে করে। আর যার নাই সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা, সাওম একে প্রশমিত করে।’ [ইবন মাজা : ১৮৪৬]

    ইদানীং তথাকথিত অনেক আধুনিক ব্যক্তিকে দেখা যায় বিয়ের প্রতি তারা উন্নাসীক। এমনকি অনেক ধার্মিক ব্যক্তিকেও দেখা যায় বিবাহিত জীবনকে কেবল ‘ঝামেলা’ (?) হিসেবে দেখেন। তাদের বিয়েতে উদ্বুদ্ধ হবার জন্য সন্তান গ্রহণের ফযীলতসম্বলিত হাদীসগুলো হতে পারে দারুণ প্রেরণা। কেননা বিয়ে না করলে এসব ফযীলত তারা কখনো অর্জন করতে পারবেন না। যেমন :

    আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَرْفَعُ الدَّرَجَةَ لِلْعَبْدِ الصَّالِحِ فِي الْجَنَّةِ ، فَيَقُولُ : يَا رَبِّ ، أَنَّى لِي هَذِهِ ؟ فَيَقُولُ : بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ».

    ‘জান্নাতে নেক ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। সে বলবে, হে রব, কিসের সৌজন্যে আমার এ মর্যাদা? আল্লাহ বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তেগফারের বদৌলতে।’ [ইবন মাজা : ১০৬১৮]

    আবূ হাসসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    قُلْتُ لِأَبِي هُرَيْرَةَ إِنَّهُ قَدْ مَاتَ لِيَ ابْنَانِ فَمَا أَنْتَ مُحَدِّثِي عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِحَدِيثٍ تُطَيِّبُ بِهِ أَنْفُسَنَا عَنْ مَوْتَانَا قَالَ قَالَ نَعَمْ «صِغَارُهُمْ دَعَامِيصُ الْجَنَّةِ يَتَلَقَّى أَحَدُهُمْ أَبَاهُ أَوْ قَالَ أَبَوَيْهِ فَيَأْخُذُ بِثَوْبِهِ أَوْ قَالَ بِيَدِهِ كَمَا آخُذُ أَنَا بِصَنِفَةِ ثَوْبِكَ هَذَا فَلَا يَتَنَاهَى أَوْ قَالَ فَلَا يَنْتَهِي حَتَّى يُدْخِلَهُ اللَّهُ وَأَبَاهُ الْجَنَّةَ».

    ‘আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু -এর উদ্দেশে আমি বললাম আমার দু’টি সন্তান মারা গেছে। আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের কোনো হাদীস শোনাতে পারেন যা মৃতদের ব্যাপারে আমাদের মনটাকে খুশি করে দেবে? হাসসান বলেন, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হ্যা। ‘তাদের ছোটরা জান্নাতে মুক্তবিচরণশীল। এদের কেউ তার পিতা অথবা (তিনি বলেছেন) পিতামাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। অতপর তার কাপড় অথবা (বলেছেন) হাত ধরবে যেমন আমি তোমার এ কাপড়ের প্রান্ত ধরেছি। অতপর সে ছাড়বে না অথবা ক্ষান্ত হবে না যাবৎ না আল্লাহ তার বাবাকে জান্নাতে প্রবেশ করান।’ [মুসলিম : ৪৭৬৯; মুসনাদ আহমদ : ১০৩৩১]

    মুয়াবিয়া বিন কুররা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন,

    أَنَّ رَجُلاً كَانَ يَأْتِي النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَعَهُ ابْنٌ لَهُ ، فَقَالَ لَهُ النَّبِيّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : «أَتُحِبُّهُ ؟» فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ ، أَحَبَّكَ اللَّهُ كَمَا أُحِبُّهُ ، فَفَقَدَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَقَالَ «مَا فَعَلَ ابْنُ فُلاَنٍ ؟» قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ ، مَاتَ ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لأَبِيهِ : «أَمَا تُحِبُّ أَنْ لاَ تَأْتِيَ بَابًا مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ ، إِلاَّ وَجَدْتَهُ يَنْتَظِرُكَ ؟ فَقَالَ رَجُلٌ : يَا رَسُولَ اللهِ ، أَلَهُ خَاصَّةً أَمْ لِكُلِّنَا ؟ قَالَ : بَلْ لِكُلِّكُمْ».

    ‘এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসতো। তার সঙ্গে থাকতো তার একটি ছেলে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি কি তাকে ভালোবাসো?’ সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ আপনাকেও তেমন ভালোবাসুন যেমন আমি তাকে ভালোবাসি। পরবর্তীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে (কয়েকদিন) দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অমুকের সন্তানের খবর কী? সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সে মারা গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার পিতার উদ্দেশে বললেন, তুমি কি এমনটি পছন্দ করো না যে জান্নাতের যে দরজাতেই তুমি যাবে সেখানে তাকে তোমার জন্য অপেক্ষমান পাবে?’ এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, এটা কি শুধু ওই ব্যক্তির জন্য নাকি আমাদের সবার জন্য? তিনি বললেন, ‘বরং তোমাদের সবার জন্য’।’ [মুসনাদ আহমদ : ১৫৫৯৫]

    سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، يَقُولُ : «مَنْ كَانَ لَهُ فَرَطَانِ مِنْ أُمَّتِي ، دَخَلَ الْجَنَّةَ فَقَالَتْ عَائِشَةُ : بِأَبِي ، فَمَنْ كَانَ لَهُ فَرَطٌ ؟ فَقَالَ : وَمَنْ كَانَ لَهُ فَرَطٌ يَا مُوَفَّقَةُ قَالَتْ : فَمَنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ فَرَطٌ مِنْ أُمَّتِكَ ؟ قَالَ : فَأَنَا فَرَطُ أُمَّتِي ، لَمْ يُصَابُوا بِمِثْلِي».

    ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে যার দু’দুটি সন্তান বিয়োগ ঘটবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোন, যার একটি সন্তান বিয়োগ ঘটবে (সেও কি এমন বিনিময় পাবে)? তিনি বললেন, ‘হে সুন্দরপ্রশ্নের তাওফীক প্রাপ্তা, যার একটি সন্তান বিয়োগ ঘটবে তার জন্যও একই (বিনিময়) রয়েছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আপনার উম্মতের মধ্যে যার কোনো সন্তানই বিয়োগ ঘটবে না? তিনি বললেন, আমিই আমার উম্মতের মৃত সন্তান, তারা আমার মতো আর কাউকে পাবে না।’ [মুসনাদ আহমদ : ৩০৯৮; শুয়াবুল ঈমান : ৯২৯৫]

    আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    جَاءَتْ امْرَأَةٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ ذَهَبَ الرِّجَالُ بِحَدِيثِكَ فَاجْعَلْ لَنَا مِنْ نَفْسِكَ يَوْمًا نَأْتِيكَ فِيهِ تُعَلِّمُنَا مِمَّا عَلَّمَكَ اللَّهُ قَالَ «اجْتَمِعْنَ يَوْمَ كَذَا وَكَذَا» فَاجْتَمَعْنَ فَأَتَاهُنَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَّمَهُنَّ مِمَّا عَلَّمَهُ اللَّهُ ثُمَّ قَالَ «مَا مِنْكُنَّ مِنْ امْرَأَةٍ تُقَدِّمُ بَيْنَ يَدَيْهَا مِنْ وَلَدِهَا ثَلَاثَةً إِلَّا كَانُوا لَهَا حِجَابًا مِنْ النَّارِ فَقَالَتْ امْرَأَةٌ وَاثْنَيْنِ وَاثْنَيْنِ وَاثْنَيْنِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاثْنَيْنِ وَاثْنَيْنِ وَاثْنَيْنِ»

    ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের উদ্দেশে বলেন, একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, পুরুষরা তো আপনার হাদীস শুনে যায়। অতএব আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্যও একটি দিন নির্ধারণ করুন। আমরা সেদিন আপনার কাছে আসবো, যাতে আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন আমাদেরকেও তার কিছু শিখিয়ে দেন। তিনি বললেন, ‘তোমরা অমুক অমুক দিনে সমবেত হবে। অতপর তারা জমায়েত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাশরীফ রাখলেন। আল্লাহ তাঁকে যা শিখিয়েছেন তা থেকে তাদের শিক্ষা দিলেন। এক পর্যায়ে তিনি তাদের বললেন, ‘তোমাদের যে কারও তিনটি সন্তান মারা গিয়ে থাকে তার জীবদ্দশায়, তবে তারা তার জন্য (জান্নামের) আগুন আড়ালকারী হবে। এক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, যদি দু’টি দু’টি দু’টি করে সন্তান মরে গিয়ে থাকে তবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দু’টি সন্তানও (অগ্নি থেকে আড়ালকারী হবে।) [মুসলিম : ৪৭৬৮; বুখারী : ১১৯২]

    আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,

    «مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ لَهُ ثَلاَثَةٌ مِنَ الْوَلَدِ لَمْ يَبْلُغُوا الْحِنْثَ ، فَتَمَسُّهُ النَّارُ ، إِلاَّ تَحِلَّةَ الْقَسَمِ».

    ‘এমন কোনো মুসলিম নেই তিনটি সন্তান মারা যাবে অপ্রাপ্ত বয়সে আর তাকে আগুন স্পর্শ করবে। হ্যা, সামান্য পরিমাণ হতে পারে[1]।’ [মুসনাদ আহমদ : ১০১২০]

    আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «مَا مِنَ النَّاسِ مُسْلِمٌ يَمُوتُ لَهُ ثَلَاثَةٌ مِنَ الْوَلَدِ لَمْ يَبْلُغُوا الْحِنْثَ إِلَّا أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ بِفَضْلِ رَحْمَتِهِ إِيَّاهُمْ»

    ‘মুসলিমদের মধ্যে যে কোনো ব্যক্তির যদি তিনটি সন্তান মারা যায় নাবালক অবস্থায়, আল্লাহ অবশ্যই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এটি করবেন তিনি তাদের প্রতি ওই ব্যক্তির মমতার কারণে।’ [বুখারী : ১৩৮১]

    আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    أَتَتِ امْرَأَةٌ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- بِصَبِىٍّ لَهَا فَقَالَتْ يَا نَبِىَّ اللَّهِ ادْعُ اللَّهَ لَهُ فَلَقَدْ دَفَنْتُ ثَلاَثَةً قَالَ «دَفَنْتِ ثَلاَثَةً» قَالَتْ نَعَمْ. قَالَ « لَقَدِ احْتَظَرْتِ بِحِظَارٍ شَدِيدٍ مِنَ النَّارِ»

    নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একজন মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে এসে বলল, হে আল্লাহর নবী, আপনি এর জন্য দু‘আ করুন (যাতে এ জীবিত থাকে)। কেননা, আমি (এর আগে) তিনজনকে দাফন করেছি। তিনি বললেন, তুমি কি তিনজনকে দাফন করেছ? মহিলা বলল, জী। তিনি বললেন, তুমি তো কঠিন বন্ধনী দিয়ে নিজেকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছো।’ [মুসলিম : ৬৮৭১; নাসায়ী : ৮৮৭৭; মুসনাদ আহমদ : ৯৪২৭]

    আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثٍ : صَدَقَةٌ جَارِيَةٌ ، وَعِلْمٌ يُنْتَفَعُ بِهِ ، وَوَلَدٌ صَالِحٌ يَدْعُو لَهُ.»

    ‘মানুষ যখন মরে যায়, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায় তবে সে তিনটি (উৎস থেকে নেকী প্রাপ্তি বন্ধ হয় না) : সাদাকায়ে জারিয়া, এমন কোনো ইলম যা থেকে মানুষ উপকৃত হয় এবং সুসন্তান যে তার জন্য দু‘আ করে।’ [তিরমিযী : ১৩৭৬; মুসলিম : ১৬৩১; ইবন খুযাইমা : ২৪৯৪]

    কন্যা জন্মে নাখোশ হওয়ার নিন্দা

    অনেক ভাইকে দেখা যায়, কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তারা বেজায় নাখোশ হন। তারা কি ভেবে দেখেছেন তাদের এ মনোভাব কাদের সঙ্গে মিলে যায়? কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাতে রুষ্ট হওয়া মূলত জাহেলী চরিত্রের প্রকাশ, আল্লাহ তা‘আলা যার সমালোচনা করেছেন পবিত্র কুরআনে। ইরশাদ হয়েছে :

    ﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِٱلۡأُنثَىٰ ظَلَّ وَجۡهُهُۥ مُسۡوَدّٗا وَهُوَ كَظِيمٞ ٥٨ يَتَوَٰرَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ مِن سُوٓءِ مَا بُشِّرَ بِهِۦٓۚ أَيُمۡسِكُهُۥ عَلَىٰ هُونٍ أَمۡ يَدُسُّهُۥ فِي ٱلتُّرَابِۗ أَلَا سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ ٥٩﴾ [النحل:58-59]

    ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। আপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!’ {সূরা আন-নাহল : ৫৮-৫৯}

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কন্যাদের বড় ভালোবাসতেন। মেয়েরা ছিল তাঁর আদরের দুলালী। আজীবন তিনি কন্যাদের ভালো বেসেছেন এবং কন্যা সন্তান প্রতিপালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ . وَضَمَّ أَصَابِعَهُ».

    ‘যে ব্যক্তি সাবালক হওয়া পর্যন্ত দু’টি কন্যার ভার বহন করবে কিয়ামতের দিন আমি আর সে আবির্ভূত হব। একথা বলে তিনি তার হাতের দুই আঙ্গুল একসঙ্গে করে দেখান।’ [মুসলিম : ৬৪৬৮; তিরমিযী : ১৯১৪; ইবন আবী শাইবা : ২৫৯৪৮]

    আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    جَاءَتْنِى امْرَأَةٌ وَمَعَهَا ابْنَتَانِ لَهَا فَسَأَلَتْنِى فَلَمْ تَجِدْ عِنْدِى شَيْئًا غَيْرَ تَمْرَةٍ وَاحِدَةٍ فَأَعْطَيْتُهَا إِيَّاهَا فَأَخَذَتْهَا فَقَسَمَتْهَا بَيْنَ ابْنَتَيْهَا وَلَمْ تَأْكُلْ مِنْهَا شَيْئًا ثُمَّ قَامَتْ فَخَرَجَتْ وَابْنَتَاهَا فَدَخَلَ عَلَىَّ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- فَحَدَّثْتُهُ حَدِيثَهَا فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم: «مَنِ ابْتُلِىَ مِنَ الْبَنَاتِ بِشَىْءٍ فَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَّارِ»

    ‘আমার কাছে এক মহিলা এলো। তার সঙ্গে তার দুই মেয়ে। আমার কাছে সে কিছু প্রার্থনা করল। সে আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। আমি তাকে সেটি দিয়ে দিলাম। সে তা গ্রহণ করল এবং তা দুই টুকরো করে তার দুই মেয়ের মাঝে বণ্টন করে দিল। তা থেকে সে কিছুই খেল না। তারপর সে ও তার মেয়ে দু’টি উঠে পড়ল এবং চলে গেল। ইত্যবসরে আমার কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলেন। আমি তাঁর কাছে ওই মহিলার কথা বললাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যাকে কন্যা দিয়ে কোনো কিছুর মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয় আর সে তাদের প্রতি যথাযথ আচরণ করে, তবে তা তার জন্য আগুন থেকে রক্ষাকারী হবে।’ [মুসলিম : ৬৮৬২; মুসনাদ আহমদ : ২৪৬১৬]

    কন্যা সন্তান প্রতিপালনে শুধু পিতাকেই নয়; ভাইকেও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বোনের কথাও বলা হয়েছে হাদীসে। যেসব ভাই মনে করেন মেয়ে বা বোনের পেছনে টাকা খরচ করলে ভবিষ্যতের তার কোনো প্রাপ্তি নেই তারা আসলে ভুলের মধ্যে আছেন। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «لَا يَكُونُ لِأَحَدٍ ثَلَاثُ بَنَاتٍ، أَوْ ثَلَاثُ أَخَوَاتٍ، أَوْ ابْنَتَانِ، أَوْ أُخْتَانِ، فَيَتَّقِي اللهَ فِيهِنَّ وَيُحْسِنُ إِلَيْهِنَّ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ»

    ‘কারও যদি তিনটি মেয়ে কিংবা বোন থাকে অথবা দুটি মেয়ে বা বোন থাকে আর সে তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাদের সঙ্গে সদাচার করে, তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [মুসনাদ আহমদ : ১১৪০৪; বুখারী, আদাবুল মুফরাদ : ৭৯]

    আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ أَوِ ابْنَتَانِ أَوْ أُخْتَانِ فَأَحْسَنَ صُحْبَتَهُمْ ، وَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ وَاتَّقَى اللَّهَ فِيهِنَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ.»

    ‘যার তিন মেয়ে অথবা তিনটি বোন কিংবা দুটি মেয়ে বা দুটি বোন রয়েছে, সে তাদের সঙ্গে সদাচার করে এবং তাদের (বিবিধ সমস্যায়) ধৈর্য ধারণ করে আর তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে, সে জান্নাতে যাবে।’ [মুসনাদ হুমাইদী : ৭৭২]

    কন্যা সন্তান প্রতিপালনে যাতে বৈষম্য না করা হয়, বস্তুবাদী ব্যক্তিরা যাতে হীনমন্যতায় না ভোগেন, তাই তাদের কন্যা প্রতিপালনে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেয়া হয়েছে। শোনানো হয়েছে পরকালে বিশাল প্রাপ্তির সংবাদ। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَنْ كَانَتْ لَهُ ثَلاثُ بَنَاتٍ فَصَبَرَ عَلَى لأْوَائِهِنَّ، وَعَلَى ضَرَّائِهِنَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ، زَادَ فِي رِوَايَةِ مُحَمَّدِ بْنِ يُونُسَ: فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَاثْنَتَيْنِ ؟ قَالَ: وَاثْنَتَيْنِ، قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَوَاحِدَةً؟ قَالَ: وَوَاحِدَةً»

    ‘যার তিনটি কন্যাসন্তান থাকবে এবং সে তাদের কষ্ট-যাতনায় ধৈর্য ধরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুহাম্মদ ইবন ইউনূসের বর্ণনায় এ হাদীসে অতিরিক্ত অংশ হিসেবে এসেছে) একব্যক্তি প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসূল, যদি দু’জন হয়? উত্তরে তিনি বললেন, দু’জন হলেও। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, যদি একজন হয় হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, একজন হলেও।’ [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১১]

    আউফ বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَنْ كَانَ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ يُنْفِقُ عَلَيْهِنَّ حَتَّى يَبِنَّ أَوْ يَمُتْنَ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ»

    ‘যার তিনটি মেয়ে রয়েছে, যাদের ওপর সে অর্থ খরচ করে বিয়ে দেয়া বা মৃত্যু পর্যন্ত, তবে তারা তার জন্য আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে।’ [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১২]

    আউফ বিন মালেক আশজায়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «مَا مِنْ عَبْدٍ يَكُونُ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ فَيُنْفِقُ عَلَيْهِنَّ حَتَّى يَبِنَّ أَوْ يَمُتْنَ إِلَّا كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّارِ» فَقَالَتِ امْرَأَةٌ: يَا رَسُولَ اللهِ، وَاثْنَتَانِ ؟ قَالَ: «وَاثْنَتَانِ»

    ‘যে বান্দার তিনটি মেয়ে রয়েছে, যাদের ওপর সে অর্থ খরচ করে বিয়ে দেওয়া অথবা মৃত্যু পর্যন্ত, তবে তারা তার জন্য আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। তখন এক মহিলা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আর দুই মেয়ে? তিনি বললেন, ‘দুই মেয়েও’।’ [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১৩]

    আবূ আম্মার আউফ বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «أَنَا وَامْرَأَةٌ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ كَهَاتَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ " وَجَمَعَ بَيْنَ أُصْبُعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى " امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ آمَتْ مِنْ زَوْجِهَا، حَبَسَتْ نَفْسَهَا عَلَى أَيْتَامِهَا حَتَّى بَانُوا أَوْ مَاتُوا »

    ‘আমি এবং গাল মলিনকারী[2] মহিলা কিয়ামতের দিন এভাবে উঠব।’ এ কথা বলে তিনি তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল একত্রিত করে দেখান। (আর গাল মলিনকারী হলেন) ‘ওই মহিলা যিনি সুন্দরী ও সুবংশীয়া। তার স্বামী মারা গিয়েছেন। তথাপি তিনি তার এতিম সন্তানদের জন্য তাদের বিয়ে বা মরণ পর্যন্ত নিজেকে (কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে) বিরত রেখেছেন’। [মুসনাদ আহমদ : ২৪০৫২; আবূ দাউদ : ৫১৫১; বুখারী, আদাবুল মুফরাদ : ৫১৪৯]

    ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَكُونُ لَهُ ابْنَتَانِ فَيُحْسِنُ إِلَيْهِمَا مَا صَحِبَهُمَا وَصَحِبَتَاهُ إِلَّا أَدْخَلَتَاهُ الْجَنَّةَ»

    ‘যে কোনো মুসলিমের দুটি মেয়ে থাকবে আর সে তাদের সঙ্গে সদাচার করতে যতদিন সে তাদের সঙ্গে থাকবে এবং তারা যতদিন তার সঙ্গে থাকবে, তবে তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।’ [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১৪; আবী ইয়া‘লা, মুসনাদ : ২৫৭১]

    মুহাম্মদ ইবন মুনকাদির থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    "«مَنْ كَانَتْ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ أَوْ أَخَوَاتٍ فَكَفَّهُنَّ وَأَوَاهُنَّ وَرَحِمَهُنَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ "، قَالُوا: أَوِ اثْنَتَانِ ؟ قَالَ: " أَوِ اثْنَتَانِ "، قَالَ: حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُمْ لَوْ قَالُوا: أَوْ وَاحِدَةً قَالَ: أَوْ وَاحِدَةً »

    ‘যার তিন তিনটি কন্যা অথবা বোন আছে আর সে তাদের থেকে অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে, তাদের আশ্রয় দেয় এবং তাদের ওপর দয়া করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’। সাহাবীরা বললেন, আর দু’জন? তিনি বললেন, দু’জনও। বর্ণনাকারী বলেন, এমনকি আমরা মনে করলাম যদি তারা বলতেন, আর একজন? তবে তিনি বলতেন, আর একজনও। [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১৫]

    উকবা বিন আমর জুহানী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,

    "«مَنْ كَانَ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ، فَأَطْعَمَهُنَّ وَسَقَاهُنَّ وَكَسَاهُنَّ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النَّار»

    ‘যার তিনটি কন্যা সন্তান থাকে আর সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধরে, তাদেরকে খাওয়ায়, পান করায় এবং তাদের পোশাকের ব্যবস্থা করে, তবে সে কন্যারা তার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে।’ [বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১৭; মুসনাদ আহমদ : ১৭৪০৩; আবী ইয়া‘লা, মুসনাদ : ১৭৬৪]

    মনে রাখতে হবে, আজ যে অবিবেচক পিতা কন্যা সন্তান দেখে রাগান্বিত হচ্ছেন, কন্যার মাকে যাচ্ছে তাই গালমন্দ করছেন, কাল তিনি এর জন্য আফসোস করতে পারেন। ছেলেদের অবাধ্যতায় অতিষ্ঠ এ পিতাকে এ মেয়েই একদিন আমোদিত ও স্বার্থক পিতা বানাতে পারে। আমরা ভুলে যাই স্থুল দৃষ্টিতে অনেক কিছু মন্দ মনে হলেও অনেক সময় তা মঙ্গল বয়ে আনে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء:19]

    ‘আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোন কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রাখবেন।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১৯}

    উল্লেখিত হাদীসগুলোর আলোকে আমরা জানলাম যে, কন্যাসন্তানও অনেক সময় দুনিয়া ও আখিরাতে বরকতের বার্তাবাহী হয়। অতএব মেয়ে হলে তাকে অশুভ মনে করা, কন্যা সন্তান দেখে অসন্তুষ্ট হওয়া কেবল মূর্খতা ও মূঢ়তার পরিচায়ক। প্রসঙ্গত ইসলাম শুধু সন্তান জন্ম দেয়ার কথাই বলেনি, সাথে সাথে সন্তানের প্রতি কর্তব্যের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে দ্ব্যর্থহীনভাবে। একটি সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর পিতা ও তার পরিবার-প্রতিবেশেরও কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন :

    নব জাতকের পিতাকে সুসংবাদ দেয়া বা অভিবাদন জানানো

    মানুষকে সন্তান প্রতিপালনে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে ইসলাম নানাবিধ তাৎপর্যপূর্ণ বিধান প্রবর্তন করেছে। সন্তান জন্মকে ইসলাম আনন্দের উপলক্ষ্য আখ্যা দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَلَقَدۡ جَآءَتۡ رُسُلُنَآ إِبۡرَٰهِيمَ بِٱلۡبُشۡرَىٰ قَالُواْ سَلَٰمٗاۖ قَالَ سَلَٰمٞۖ فَمَا لَبِثَ أَن جَآءَ بِعِجۡلٍ حَنِيذٖ ٦٩ فَلَمَّا رَءَآ أَيۡدِيَهُمۡ لَا تَصِلُ إِلَيۡهِ نَكِرَهُمۡ وَأَوۡجَسَ مِنۡهُمۡ خِيفَةٗۚ قَالُواْ لَا تَخَفۡ إِنَّآ أُرۡسِلۡنَآ إِلَىٰ قَوۡمِ لُوطٖ ٧٠ وَٱمۡرَأَتُهُۥ قَآئِمَةٞ فَضَحِكَتۡ فَبَشَّرۡنَٰهَا بِإِسۡحَٰقَ وَمِن وَرَآءِ إِسۡحَٰقَ يَعۡقُوبَ ٧١ قَالَتۡ يَٰوَيۡلَتَىٰٓ ءَأَلِدُ وَأَنَا۠ عَجُوزٞ وَهَٰذَا بَعۡلِي شَيۡخًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عَجِيبٞ ٧٢ قَالُوٓاْ أَتَعۡجَبِينَ مِنۡ أَمۡرِ ٱللَّهِۖ رَحۡمَتُ ٱللَّهِ وَبَرَكَٰتُهُۥ عَلَيۡكُمۡ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِۚ إِنَّهُۥ حَمِيدٞ مَّجِيدٞ ٧٣ فَلَمَّا ذَهَبَ عَنۡ إِبۡرَٰهِيمَ ٱلرَّوۡعُ وَجَآءَتۡهُ ٱلۡبُشۡرَىٰ يُجَٰدِلُنَا فِي قَوۡمِ لُوطٍ ٧٤ ﴾ [هود: 69-74]

    ‘আর অবশ্যই আমার ফেরেশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইবরাহীমের কাছে আসল, তারা বলল, ‘সালাম’। সেও বলল, ‘সালাম’। বিলম্ব না করে সে একটি ভুনা গো বাছুর নিয়ে আসল। অতঃপর যখন সে দেখতে পেল, তাদের হাত এর প্রতি পৌঁছছে না, তখন তাদেরকে অস্বাভাবিক মনে করল এবং সে তাদের থেকে ভীতি অনুভব করল। তারা বলল, ‘ভয় করো না, নিশ্চয় আমরা লূতের কওমের কাছে প্রেরিত হয়েছি’। আর তার স্ত্রী দাঁড়ানো ছিল, সে হেসে উঠল। অতঃপর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম ইসহাকের ও ইসহাকের পরে ইয়া‘কূবের। সে বলল, ‘হায়, কী আশ্চর্য! আমি সন্তান প্রসব করব, অথচ আমি বৃদ্ধা, আর এ আমার স্বামী, বৃদ্ধ? এটা তো অবশ্যই এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার’! তারা বলল, ‘আল্লাহর সিদ্ধান্তে তুমি আশ্চর্য হচ্ছ? হে নবী পরিবার, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত। নিশ্চয় তিনি প্রশংসিত সম্মানিত’। অতঃপর যখন ইবরাহীম থেকে ভয় দূর হল এবং তার কাছে সুসংবাদ এল, তখন সে লূতের কওম সম্পর্কে আমার সাথে বাদানুবাদ করতে লাগল।’ {সূরা হুদ : ৬৯-৭৪}

    আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

    ﴿فَبَشَّرۡنَٰهُ بِغُلَٰمٍ حَلِيمٖ ١٠١﴾ [الصافات: 101]

    ‘অতঃপর তাকে আমি পরম ধৈর্যশীল একজন পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলাম।’ {সূরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১০১}

    মহান আল্লাহ আরও বলেন,

    ﴿وَبَشَّرُوهُ بِغُلَٰمٍ عَلِيمٖ ٢٨﴾ [الذاريات: 28]

    ‘তারা তাকে এক বিদ্বান পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল।’ {সূরা যারিয়াত, আয়াত : ২৮}

    ﴿وَنَبِّئۡهُمۡ عَن ضَيۡفِ إِبۡرَٰهِيمَ ٥١ إِذۡ دَخَلُواْ عَلَيۡهِ فَقَالُواْ سَلَٰمٗا قَالَ إِنَّا مِنكُمۡ وَجِلُونَ ٥٢ قَالُواْ لَا تَوۡجَلۡ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَٰمٍ عَلِيمٖ ٥٣ قَالَ أَبَشَّرۡتُمُونِي عَلَىٰٓ أَن مَّسَّنِيَ ٱلۡكِبَرُ فَبِمَ تُبَشِّرُونَ ٥٤ قَالُواْ بَشَّرۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ فَلَا تَكُن مِّنَ ٱلۡقَٰنِطِينَ ٥٥ قَالَ وَمَن يَقۡنَطُ مِن رَّحۡمَةِ رَبِّهِۦٓ إِلَّا ٱلضَّآلُّونَ ٥٦﴾ [الحجر: 51-56]

    ‘আর তুমি তাদেরকে ইবরাহীমের মেহমানদের সংবাদ দাও। যখন তারা তার নিকট প্রবেশ করল, অতঃপর বলল, ‘সালাম’। সে বলল, ‘আমরা নিশ্চয় তোমাদের ব্যাপারে শঙ্কিত’। তারা বলল, ‘তুমি ভীত হয়ো না, নিশ্চয় আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী শিশুর সুসংবাদ দিচ্ছি’। সে বলল, ‘তোমরা কি আমাকে সুসংবাদ দিচ্ছ, যখন বার্ধক্য আমাকে স্পর্শ করেছে ? সুতরাং তোমরা কিসের সুসংবাদ দিচ্ছ’ ? তারা বলল, ‘আমরা তোমাকে যথার্থ সুসংবাদ দিচ্ছি। সুতরাং তুমি নিরাশদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’। সে বলল, ‘পথভ্রষ্টরা ছাড়া, কে তার রবের রহমত থেকে নিরাশ হয়’ ? {সূরা আল-হিজর, আয়াত : ৫১-৫৬}

    ﴿يَٰزَكَرِيَّآ إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَٰمٍ ٱسۡمُهُۥ يَحۡيَىٰ لَمۡ نَجۡعَل لَّهُۥ مِن قَبۡلُ سَمِيّٗا ٧ ﴾ [مريم:7]

    (আল্লাহ বললেন) ‘হে যাকারিয়্যা, আমি তোমাকে একটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি, তার নাম ইয়াহইয়া। ইতিপূর্বে কাউকে আমি এ নাম দেইনি।’ {সূরা মারইয়াম, আয়াত : ০৭}

    ﴿فَنَادَتۡهُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَهُوَ قَآئِمٞ يُصَلِّي فِي ٱلۡمِحۡرَابِ أَنَّ ٱللَّهَ يُبَشِّرُكَ بِيَحۡيَىٰ مُصَدِّقَۢا بِكَلِمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَسَيِّدٗا وَحَصُورٗا وَنَبِيّٗا مِّنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ٣٩﴾ [آل عمران: 39]

    ‘অতঃপর ফেরেশতারা তাকে ডেকে বলল, সে যখন কক্ষে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে ইয়াহইয়া সম্পর্কে সুসংবাদ দিচ্ছেন, যে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণীর সত্যায়নকারী, নেতা ও নারী সম্ভোগমুক্ত এবং নেককারদের মধ্য থেকে একজন নবী।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩৯}

    আর সুসংবাদ যেহেতু মানুষকে আনন্দিত করে, তার ভেতরে পুলক সঞ্চার করে তাই মুসলিমের উচিত তার ভাইকে আনন্দে আহ্লাদিত হবার মতো সংবাদ আগেভাগে পৌঁছে দেয়া। যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেন, আবূ লাহাবকে তার দাসী সুয়াইবা এ খুশির সংবাদ দেন। আবূ লাহাবের কাছে গিয়ে সুয়াইবা বলেন, রাতে আব্দুল্লাহর একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে। এ সংবাদে খুশি সে সুয়াইবাকে আজাদ করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা তার এ ভালো কাজকে বৃথা বানাননি। মৃত্যুর সময় তার কণিষ্ঠা আঙ্গুলের গর্ত থেকে তাকে পানি পান করান। অতএব সন্তানের সুসংবাদ দেয়া মুস্তাহাব। যদি তা না পারা যায় তবে তাকে অন্তত শুভেচ্ছা জানানো মুস্তাহাব। সুসংবাদ ও শুভেচ্ছার মধ্যে পার্থক্য হলো, সুসংবাদ বলে এমন কিছু জানানো যা তাকে খুশি করবে আর খুশির খবর পাওয়ার পর তাতে বরকত বৃদ্ধির দু’‌আ করাকে বলা হয় শুভেচ্ছা জ্ঞাপন।

    নবজাতকের কানে আযান দেয়া

    সন্তান জন্ম নেয়ার খুশিকে সার্বজনীতা দিতে আরেকটি বিধান দেয়া হয়েছে। আর তা হলো, নবজাতকের কানে আযান দেয়া। এর মধ্যে যেমন পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত, তেমনি এতে আছে সামাজিক কিছু ইতিবাচক দিক। আবূ রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

    «أَذَّنَ فِى أُذُنِ الْحَسَنِ بْنِ عَلِىٍّ - حِينَ وَلَدَتْهُ فَاطِمَةُ – بِالصَّلاَةِ».

    ‘ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহু হাসান বিন আলীকে প্রসব করার পর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি দেখেছি তার কানে আযান দিলেন।’ [তিরমিযী : ১৫১৪; আবূ দাউদ : ৫১০৭। {ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ ও শায়খ আলবানী এটিকে হাসান বলেছেন}]

    আর সদ্যভূমিষ্ট শিশুর কানে আযান দিতে বলা হয়েছে যাতে পৃথিবীতে আগমনের পর মানুষের কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর বড়ত্ব-মাহাত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং যে শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশ করে সে বক্তব্য সম্বলিত বাক্যই প্রবেশ করে। এতে করে ধরাধামে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তার ইসলামের নিদর্শন শেখার সুযোগ তৈরি হয়, যেমন তাকে দুনিয়া ত্যাগের প্রাক্কালে তাওহীদের বাক্য শিখিয়ে দেয়া হয়। শিশুটি অস্বীকার করা যাবে না যে, এ বাক্য অনুধাবন করতে যদিও শিশু সক্ষম নয়, তথাপি তার অন্তরে এ আজানের কিছুটা প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। এ ছাড়া আরও উপকার রয়েছে। যেমন, আজানের বাক্যগুলো শুনে শয়তানের পলায়ন করে। একটি শিশু ভূমিষ্ট হবার পূর্ব মুহূর্তে শয়তান অপেক্ষায় থাকে, দুনিয়াতে আসামাত্রই সে চায় বাচ্চাটির ওপর তার অশুভ প্রভাব বিস্তার করতে। কিন্তু আযান দেয়া মাত্র সে সেখান থেকে পলায়ন করে।

    এ আজানের আরেকটি তাৎপর্য এই যে, এর মাধ্যমে শিশুটিকে শয়তানের মন্দ আহ্বানের আগেই আল্লাহ ও দীনে ইসলামের দিকে আহ্বান জানানো সম্পন্ন করা হয়। যেমন, মানব প্রকৃতি হলো, সে যাবতীয় শুভ ও শুভ্রতা নিয়ে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়েই পৃথিবীতে আসে। অতপর শয়তান তাকে এ সুপথ থেকে বিচ্যুত করে এবং দীনে ইসলাম থেকে দূরে নিয়ে যায়।

    সন্তানকে তাহনীক করানো

    নব জাতকের কানে আযান দেবার পর এবার দায়িত্ব তাকে তাহনীক করানো। অর্থাৎ সামান্য খেজুর চিবিয়ে নব জাতকের মুখে খানিকটা ঘষে দেয়া। আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

    «وُلِدَ لِي غُلاَمٌ فَأَتَيْتُ بِهِ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَسَمَّاهُ إِبْرَاهِيمَ فَحَنَّكَهُ بِتَمْرَةٍ وَدَعَا لَهُ بِالْبَرَكَةِ وَدَفَعَهُ إِلَيَّ ، وَكَانَ أَكْبَرَ وَلَدِ أَبِي مُوسَى».

    ‘আমার একটি সন্তান জন্ম নিল। তাকে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন মূসা। তারপর খেজুর দিয়ে তাকে তাহনীক করেন। তিনি তার জন্য বরকতের দু‘আ করেন এবং আমার কাছে তাকে ফিরিয়ে দেন। এটি ছিল আবূ মূসার বড় সন্তানের ঘটনা।’ [বুখারী : ৫৪৬৭; মুসলিম : ৫৭৩৯]

    আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «كَانَ ابْنٌ لأَبِى طَلْحَةَ يَشْتَكِى فَخَرَجَ أَبُو طَلْحَةَ فَقُبِضَ الصَّبِىُّ فَلَمَّا رَجَعَ أَبُو طَلْحَةَ قَالَ مَا فَعَلَ ابْنِى قَالَتْ أُمُّ سُلَيْمٍ هُوَ أَسْكَنُ مِمَّا كَانَ. فَقَرَّبَتْ إِلَيْهِ الْعَشَاءَ فَتَعَشَّى ثُمَّ أَصَابَ مِنْهَا فَلَمَّا فَرَغَ قَالَتْ وَارُوا الصَّبِىَّ. فَلَمَّا أَصْبَحَ أَبُو طَلْحَةَ أَتَى رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَأَخْبَرَهُ فَقَالَ : أَعْرَسْتُمُ اللَّيْلَةَ. قَالَ نَعَمْ قَالَ : اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمَا. فَوَلَدَتْ غُلاَمًا فَقَالَ لِى أَبُو طَلْحَةَ احْمِلْهُ حَتَّى تَأْتِىَ بِهِ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم-. فَأَتَى بِهِ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- وَبَعَثَتْ مَعَهُ بِتَمَرَاتٍ فَأَخَذَهُ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ : أَمَعَهُ شَىْءٌ. قَالُوا نَعَمْ تَمَرَاتٌ. فَأَخَذَهَا النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- فَمَضَغَهَا ثُمَّ أَخَذَهَا مِنْ فِيهِ فَجَعَلَهَا فِى فِى الصَّبِىِّ ثُمَّ حَنَّكَهُ وَسَمَّاهُ عَبْدَ اللَّهِ».

    ‘আবূ তালহার একটি ছেলে ছিল অসুস্থ। এমতাবস্থায় আবূ তালহা সফরে গেলেন। সফর থেকে যখন ফিরলেন, জিজ্ঞেস করলেন আমার ছেলের কী অবস্থা? উম্মু সুলাইম বললেন, সে আগের চেয়ে বেশি প্রশান্তিতে আছে। উম্মু সুলাইম তারপর তার সামনে রাতের খাবার পরিবেশন করলেন। আবূ তালহা রাতের খাবার গ্রহণ করলেন। অতপর তার সঙ্গে সহবাস করলেন। এ কাজ সমাপ্ত হলে উম্মে সুলাইম বললেন, (আমাদের সন্তান মৃত্যু বরণ করেছে তাই) লোকেরা তাকে দাফন করেছে। সকাল হলে আবূ তালহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন। তাঁকে এ ঘটনা জানালেন। অতপর (তার স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের পারাকাষ্ঠায় মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে) তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ কি তোমরা সহবাস করেছো?’ বললেন, জী। তিনি দু‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ, এদের মধ্যে বরকত দিন’। (রাসূলুল্লাহর দু‘আর বরকতে সে রাতের মিলনে গর্ভ ধারণ হয়।) অতপর উম্মে সুলাইম একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেন। তখন আবূ তালহা আমাকে বলেন, একে নিয়ে তুমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও। শিশুটিকে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এলেন। আর উম্মে সুলাইম তার সঙ্গে কিছু খেজুরও পাঠান। (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলে) তিনি তাকে গ্রহণ করেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তার সঙ্গে কি কিছু আছে?’ সাহাবীরা বললেন, হ্যা, তার সঙ্গে খেজুর আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর গ্রহণ করলেন এবং তা চিবুলেন। তারপর নিজের মুখ থেকে নিয়ে তা শিশুর মুখে দেন এবং তাহনীক করেন। আর তার নাম রাখেন আব্দুল্লাহ।’ [বুখারী : ৫০৪৮; মুসলিম : ৫৭৩৭]

    عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّهَا حَمَلَتْ بِعَبْدِ اللهِ بْنِ الزُّبَيْرِ بِمَكَّةَ قَالَتْ فَخَرَجْتُ وَأَنَا مُتِمٌّ فَأَتَيْتُ الْمَدِينَةَ فَنَزَلْتُ قُبَاءً فَوَلَدْتُ بِقُبَاءٍ ثُمَّ أَتَيْتُ بِهِ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَوَضَعْتُهُ فِي حَجْرِهِ ثُمَّ دَعَا بِتَمْرَةٍ فَمَضَغَهَا ثُمَّ تَفَلَ فِي فِيهِ فَكَانَ أَوَّلَ شَيْءٍ دَخَلَ جَوْفَهُ رِيقُ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ حَنَّكَهُ بِالتَّمْرَةِ ثُمَّ دَعَا لَهُ فَبَرَّكَ عَلَيْهِ ، وَكَانَ أَوَّلَ مَوْلُودٍ وُلِدَ فِي الإِسْلاَمِ فَفَرِحُوا بِهِ فَرَحًا شَدِيدًا لأَنَّهُمْ قِيلَ لَهُمْ إِنَّ الْيَهُودَ قَدْ سَحَرَتْكُمْ فَلاَ يُولَدُ لَكُمْ

    ‘আসমা বিনতে আবী বকর রাদিয়াআল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়েরকে গর্ভে ধারণ করেন। তিনি বলেন, আমি মক্কা থেকে বের হলাম আমি প্রায় বাচ্চা প্রসবের মেয়াদ পুরো করে ফেলেছি। তারপর আমি মদীনায় পৌঁছলাম। সেখানে কুবা পল্লীতে আমি সন্তান জন্ম দিলাম। অতপর বাচ্চাটিকে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলাম এবং তাকে তাঁর কোলে দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর চাইলেন। খেজুর চিবুলেন এবং বাচ্চাটির মুখে একটু থুথু দিয়ে দিলেন। ফলে তার পেটে প্রথম যা পড়ে তা হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থুথু। অতপর তিনি খেজুর দিয়ে তার তাহনীক করেন। অতপর তার জন্য দু‘আ করেন। বরকত কামনা করেন। আর এ-ই ছিল ইসলামে জন্মগ্রহণকারী প্রথম শিশু। এতে সবাই যার পর নাই খুশি হন। কারণ, তাদের বলা হয়েছিল ইহুদীরা তাদের যাদু করেছে। তাই তাদের কোনো সন্তান হবে না।’ [বুখারী : ৫৪৬৯; মুসলিম : ৫৭৪১]

    সন্তানের তাহনীক করানো পর আসে তার আকীকার কথা। ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধই লিখিত হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিগণ সেখান থেকে বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন।

    পরিশেষে বলতে চাই, আমরা যারা দীনের ওপর চলতে চাই, নিজের জীবনটাকে নববী আদর্শে সুসজ্জিত করতে চাই, তারাও কিন্তু সন্তান জন্ম ও তৎপরবর্তী করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে না জানার কারণে যা করার তা করতে পারি না। উল্টো যা না করা উচিত, যা পিতার ও সন্তানের জন্য কল্যাণকর নয়, তাই করা করে থাকি। আশা করি আমাদের কুরআন-হাদীস রোমন্থিত এ নিবন্ধ আমাদের চলার পথে অমূল্য পাথেয় যোগাবে। আল্লাহ তা‌’আলা আমাদের সবাইকে তাঁর নির্বাচিত এবং তাঁর রাসূলের প্রদর্শিত পথে চলবার তাওফীক দিন। আমীন।

    [1]. কেবল কসম পূরণের নিমিত্তে। আর তা হলো, আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, ‘আর তোমাদের প্রত্যেককেই তা (পুলসিরাত) অতিক্রম করতে হবে, এটি তোমার রবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ {সূরা মারইয়াম : ৭১}

    [2]. যেসব মহিলা স্বামী মারা যাবার পর এতিম সন্তানদের পেছনেই জীবন কাটিয়ে দেন, তারা স্বাধারণত নিজের সৌন্দর্য চর্চার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার অবকাশ পান না। তাদের ওপর দিয়ে বরং অনেক ঝক্কি-ঝামেলা যায় বলে চেহারার স্বাভাবিক লাবণ্য বজায় থাকে না। ‘গালমলিনকারী’ বলে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।