ইসলামের পর্দা বিধান নিয়ে একটি সংলাপ
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
মিডিয়াওয়াচ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় দৈনিক আমাদের সময়-এর সহযোগী পত্রিকা হিসেবে। মাসখানেক আগে এ ম্যাগাজিনে পর্দা বা নারীবাদী নিয়ে বিতর্ক শুরু হবার পর থেকে এর প্রতি কেউ কেউ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। তাদেরই অনুরোধে মিডিয়াওয়াচ পড়া শুরু। দারুণ উপভোগ করছিলাম জব্বার হোসেন ও মুহাম্মদ মাহবুব হাসানের বুদ্ধিদীপ্ত পাল্টাপাল্টি লেখাগুলো। এরা দু’জন পর্দার পক্ষে-বিপক্ষে লিখছিলেন। এ বিষয়ে কিছু লেখার জন্য প্রথম থেকেই আমারও আগ্রহ জেগেছিল। তবে তাদের যুক্তিগুলোর শেষ দেখার অপেক্ষায় সংযত ছিলাম। ভাবছিলাম একটি লেখা দিয়ে বুদ্ধি ও যুক্তির এই সুস্থ লড়াইয়ের ইতি টানবার চেষ্টা করবো। কিন্তু ১৭ জানুয়ারি (৪ নং) সংখ্যায় জনাব মাহবুব হাসানের লেখার পাশাপাশি ‘পর্দা বিতর্ক’ শিরোনামে প্রদীপপরি নামে একজনের লেখা প্রকাশ হতে দেখে মনে হলো পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আলোচনার একটি উপসংহারে আসতে চাইছেন। বলাবাহুল্য, পর্দার বিপক্ষেই তাদের অবস্থান প্রতিভাত হচ্ছিল। উপসংহারটির সঙ্গে একমত না হতে পারায় শেষাবধি আমি এই লেখাটি প্রস্তুত করি। লেখাটি প্রকাশের পর সারাদেশ থেকে ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানতে পারি। লেখাটির আবেদন ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী সত্য অনুসন্ধানীদের জন্য ইসলাম হাউজে তা প্রকাশ করা হল।
‘বৃটেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী এক মুসলিম ছাত্রকে তার এক খ্রিষ্টান সতীর্থ বললো, তুমি কি আমাকে তোমাদের ধর্মীয় গ্রন্থের কোনো ইংরেজি অনুবাদ সংগ্রহ করে দিতে পারো? মুসলিম ছাত্রটি বললো, অবশ্যই। পরদিনই সে ইংরেজি ভাষান্তরসহ একটি কুরআন তুলে দিলো খ্রিষ্টান সহপাঠীর হাতে। মাত্র দু’দিন পরই ছেলেটি বাঙালী ছাত্রের কাছে পবিত্র কুরআনের ওই কপি ফেরত দিয়ে বললো, এটা নয়; যে কুরআন তোমরা অনুসরণ করো তার একটি কপি চাই আমার। এ কুরআনের সঙ্গে তো তোমাদের কোনো মিলই নেই।’ এটি কোনো বানানো গল্প নয়। বাস্তব ঘটনা। বাঙালী ওই যুবকের আত্মীয়ের মুখেই শুনেছি গল্পটি। গল্পটির অবতারণা এখানে কেন তা একটু পরেই খোলাসা করি।
আসলে শুধু ইসলামের পর্দা বিধান নয়; আরও অনেক বিধান নিয়েই সমালোচনার একটা ধারা চলে আসছে অতীত থেকে। আগে করতেন অমুসলিমরা। এখন মুসলিম নামধারীরাই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে। আমার পর্যবেক্ষণ বলে, এ ধরনের সমালোচনার মূল কারণ ইসলাম সম্পর্কে অপূর্ণ ও অপর্যাপ্ত জ্ঞান এবং ইসলাম নিয়ে স্টাডি না করে মুসলিমদের নিয়ে স্টাডি করা। কেউ যদি খোলা মনে ইসলামের পূর্ণ অবয়বটাকে অধ্যয়ন-অবলোকন করেন, তবে তিনি এর অনুসারী না হোন; অন্তত সমালোচক হতে পারবেন না। এই শক্তি ও অসাধারণ ক্ষমতা আছে বলেই পৃথিবীর সবচে বেশি অপপ্রচারের শিকার ধর্ম হবার পরও ইসলামের আলো ক্রমশ বিকশিতই হচ্ছে। তবে অধিকাংশই ভুল করেন ইসলাম অধ্যায়ন না করে আমাদের মতো বক ধার্মিক মুসলিমদের দেখে। ওপরের গল্পটিই আমার পক্ষে সাক্ষী। তাই সমালোচকদের ভর্ৎসনা করার আগে নিজেদেরই একপ্রস্থ ভর্ৎসনা করে নিই।
হবার কথা ছিল এমন, মুসলিমকে দেখে অমুসলিমরা ইসলাম সম্পর্কে জানবে। আকৃষ্ট হবে ইসলামের অনির্বাণ আলোর প্রতি। অতীতে তাই হয়েছে। নয়তো শুধু আরবী ভাষা জানা মরুবাসীদের মাধ্যমে চীনে কিভাবে ইসলাম প্রচারিত ও সাদরে বরিত হলো? মাত্র অর্ধশতাব্দীকালের মধ্যে প্রায় অর্ধজাহান মুসলিমদের করায়ত্ব হলো? হয়েছে তরবারির জোরে নয়; অনুপম আদর্শ আর অকপট মানবিকতার গুণে।
দুঃখজনক হলেও সত্য ইসলাম আর মুসলিমের মধ্যে ফারাক এখন বিস্তর। তাই মুসলিমদের জন্য শিক্ষণীয় ওপরের গল্পের মতো ঘটনা ঘটে। তাইতো আজ জব্বার হোসেনের মতো মুসলিমরা ধর্ম তথা আত্মপরিচয় নিয়ে সংকটে ভোগেন। সাচ্চা মুসলিম নামধারীদের প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে প্রদীপপরিরা ইসলামকে খারাপ বলার সুযোগ পান। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, জব্বার হোসেনরা পৃথিবীর সব কিছুই পড়েন আদ্যোপান্ত। শুধু ইসলামটাই পড়েন খণ্ডিতরূপে। তাদের গবেষণার টেবিলে সবই স্থান পায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের হাত ধরে। ইসলামটাই শুধু তারা জানতে এবং বুঝতে চান নিজের ইচ্ছে মতো কিংবা গুটিকয় মেকি মুসলিমের আচরণ দেখে।
বন্ধু জব্বার লিখেছেন, ‘আমার শুধু একটি জায়গায় আপত্তি, তা হলো অপব্যাখ্যা। আমি ভয়ংকর ঘৃণা করি অপব্যাখ্যাকে। আমার মত নিয়ে, লেখা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করুক, বিতর্ক হোক, যুক্তি দিক লোকে, তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি আমার নেই। কিন্তু অপব্যাখ্যার মতো ক্ষতিকর আর কী আছে, বলুন। যা আমি বলিনি, লিখিনি, ব্যাখ্যা দিইনি, তা যদি নিজে থেকে অন্যেরা দিয়ে দেয়, তাহলে এর চেয়ে আর ভয়ংকর কী হতে পারে? কী আছে এর চেয়ে দুঃখজনক জগতে?’ আপনি যদি সত্যের পূজারী হয়ে থাকেন তবে বলুন আপনার এই অপ্রিয়, অনভিপ্রেত ও ভয়ংকর কাজটিই কি আপনি করছেন না? আমাদের কারো প্রতি তো আপনার কোনো ঋণ নেই; তাতেই আপনার কথার অপব্যাখ্যা যদি এত বড় অপরাধ ও এত নিন্দনীয় হয়ে থাকে, তবে যার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই সেই মহান স্রষ্টার বাণীর অপব্যাখ্যা কত অপরাধ?
ইসলাম সম্পর্কে আপনার জানাশোনার দৌড় কতদূর? সাধারণত আপনার মতো শেকড়ভোলা লোকদের ইসলাম জানার দৌড় একেবারে সীমিত। আপনারা কখনো সমাজের সেসব মানুষের কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছুক নন যারা সত্যিকার অর্থে ইসলাম লালন ও অনুশীলন করেন। যাদের কাছে গেলে আপনার মতো পাতি নাস্তিকরা কেন চরম ইসলামবিদ্বেষীরা পর্যন্ত সোনার মানুষে পরিণত হয়। এরা কখনো ইভটিজিং করেন না। এদের মেয়েরা কখনো ইভটিজিংয়ের শিকারও হয় না। আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন ইসলাম সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা নয়? জনাব মাহবুব হাসানকে আপনি যে অপরাধে অপব্যাখ্যাকারী, প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদী বলে গালমন্দ করেছেন আপনাকেও তো সে অপরাধেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়।
আপনিই লিখেছেন, ‘ধর্মেই তো বলা হয়েছে, পুরুষদের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে নারীদের ওপর, একজন পুরুষ সাক্ষী সমান দুজন নারী সাক্ষী। স্ত্রীকে শাসনের নামে মৃদু প্রহারের অনুমতি তো ধর্মই দিয়েছে। পুরুষের বহুবিবাহের কথা, সে তো ধর্মেরই গল্প। ধর্মের কথা বলেই তো বোরকা, জোব্বা, হিজাব-অস্বীকারের সুযোগ আছে কোনো? ধর্মই তো থাকে মৌলবাদের গোড়ায়।’ হ্যা, আপনার এসব অভিযোগই মূলত ইসলামের অপব্যাখ্যা। পরিসর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে ব্যাখ্যা দিতে পারছি না। সঠিক ব্যাখ্যা যদি আপনি, প্রদীপপরি বা অন্য কোনো ভাই সত্যিকার অর্থে জানতে চান তবে বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিন।
প্রমাণ দিয়ে দাবি করেছেন সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মানুষ আপনি। সত্যিই যদি তাই হয়ে থাকেন তবে আপনার কলম থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের ইতিবাচক দিক নিয়েও কিছু লেখা প্রসবিত হওয়ার কথা। তা কি হয়েছে? বিবেকের আদালতে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন তা করেছেন কি-না। আপনি নিজেকে ‘আক্রমণের শিকার’ বলেছেন। অথচ বাস্তবে আপনি আক্রান্ত নন; আক্রমণকারী। আপনি আক্রমণ করেছেন কোটি মানুষের বিশ্বাস ও চেতনার বাতিঘরে। আঘাত করেছেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসার শীর্ষবিন্দুতে। ইসলাম অনুসারীদের ভালো কী কী গুণ হতে পারে, তারা কতটা সুনাগরিক তা জানতে আপনি এই লিংকের সাহায্য নিতে পারেন :
(http://www.dailynayadiganta.com/2010/12/04/fullnews.asp?News_ID=248274&sec=6)
এবার আসি ভ্রাতৃপ্রতীম প্রদীপপরির কথায়। আপনি লিখেছেন, ‘জব্বার হোসেন সব ধর্মকেই দায়ী করেছেন নারীর স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে, অন্যদিকে মাহবুব হাসান যুক্তির আশ্রয় না নিয়েই সবার ওপরে তার ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং তিনি তার সর্বশেষ লেখার (সংখ্যা:৩) শেষদিকে বলেছেন, তিনি বুক উঁচিয়ে গর্ব করে বলতে পারেন, যারা পর্দা করে তারা এ পর্যন্ত ইভ টিজিংয়ের শিকার হননি। কথাটা মোটেও সত্য নয়।’
গল্পে বর্ণিত মুসলিম এবং তসলিমা-জব্বারদের মতো শেকড়, ঐতিহ্য ও আদর্শচ্যুত কিছু মুসলিমের অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে আপনার মতো অনেক অমুসলিম ভাই-বোনই মনে করেন, ইসলাম তার অনুসারীদের ভ্রাতৃপ্রতীম তো দূরের কথা অমুসলিমদের অমানুষ ভাবতে শিক্ষা দেয়। মুসলিম-মুসলিমে সম্পর্ক ধর্মের আর মুসলিম-অমুসলিমে সম্পর্ক রক্তের। ইসলাম মতে, পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানব ছিলেন বাবা আদম আলাইহিস সালাম। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পরবর্তী সবাই তার সন্তান। সে হিসেবে পৃথিবীর সব মানুষকেই রক্ত সম্পর্কের ভাই এবং একই স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে সম্মান দেবার শিক্ষা দেয় ইসলাম। সেই মানবতাবাদী ইসলামকে যখন অন্য ধর্মগুলোর সঙ্গে একই কাতারে এনে তসলিমা-জব্বাররা সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেন। শুধু তাই নয়, যে ইসলাম অধিকারহারা নারীর পেছনে প্রথম দাঁড়ালো, নারীকে যেখানে মানুষ হিসেবে স্বীকারই করা হতো না, সেখানে তাদের মা-মেয়ে-বোন ও স্ত্রী রূপে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করলো, জীবনের প্রতিটি স্তরে তাদের অধিকার নিশ্চিত করলো, দিবালোকের মতো পরিষ্কার সাম্য ও মানবতার ধর্ম সে ইসলামকে যখন কেউ খোঁড়া যুক্তিতে আঘাত করে, তখন ‘যুক্তির আশ্রয় না নিয়ে’ তা প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালানোই তো যুক্তিযুক্ত।
‘যারা পর্দা করে তারা এ পর্যন্ত ইভটিজিংয়ের শিকার হননি’- আপনার মতে ‘কথাটা মোটেও সত্য নয়’। আমার মতে এ কথা অবশ্যই সত্য। প্রমাণ হিসেবে আপনি যে গানের কলি তুলে ধরেছেন তা-ই আমার প্রমাণ। ‘আলতা রাঙা পায়ে আবার নূপুর পরেছে, বোরকা পরা মেয়ে পাগল করেছে।’ এ বাক্যে বোরকা পরা মেয়ের কথা আছে ঠিক। কিন্তু তাতে এ কথাও আছে যে, সে বোরকা দেখে পাগল হয়নি, পাগল হয়েছে তার রাঙা পায়ে ‘অসুস্থ হৃদয়ে’ ঝড়তোলা নূপুরের নিক্কন আওয়াজ শুনে। ইসলাম নারীকে ঘরের বাইরে আসার সময় নূপুর পায়ে দিতে নিষেধই করেছে। এ কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করার ফলে বোরকাও তাকে আল্লাহর নির্দেশভোলা পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পারেনি। আর টুনীরা যাতে কুরুচিপূর্ণ আবেদনের শিকার না হয় সেজন্যই নারী-পুরুষ সবার জন্য দরকার নৈতিক শিক্ষার। নৈতিক তথা ধর্মীয় শিক্ষাই পারে নারী-পুরুষকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে। ইভটিজিং নির্মূলে নারী-পুরুষের যে আদর্শিক শক্তি দরকার তার যোগান দিতে পারে কেবল ধর্ম। একমাত্র নারীদের শালীনতা আর পুরুষদের সংযমই পারে ইভটিজিংয়ের মতো সামাজিক ভাইরাস নির্মূল করতে। বলাবাহুল্য, এ এন্টিভাইরাসের সবচে বড় যোগানদাতা ইসলাম।
আপনি আরো বলেছেন, ‘নারী ও পুরুষ সমমর্যাদাসম্পন্ন এখানে কেউ কাউকে মুক্ত করার ভার অর্পণ করেনি।’ বলি, নারী-পুরুষ কেউ কাউকে মুক্ত করার ভার অর্পণ করবে কেন? এদুই সত্তার মহান স্রষ্টা আল্লাহই এ দায়িত্ব অর্পন করেছেন পরস্পরের প্রতি। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববান হবার মধ্য দিয়েই নারী-পুরুষ মুক্ত ও সুখী হতে পারে। নারী-পুরুষ তো সমমর্যাদাসম্পন্ন নয়। কিছু ক্ষেত্রে তারা সমান হলেও প্রায় ক্ষেত্রে কোথাও নারীরা আবার কোথাও পুরুষরা বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। আর ইসলাম নারীকে কিছুটা সুবিধা দিয়েছিল যখন মানছেন, তাহলে ইসলাম স্বাধীনতা ও মুক্তি দিয়েছে তা মানছেন না কেন? আচ্ছা, মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রয়োজন কেন? অবশ্যই মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। ইসলাম তো তা নিশ্চিত করেছেই; উপরন্তু চৌদ্দশ বছর আগে এমন কিছুও করেছে সভ্যতাগর্বী জাতিগুলো যা করেছে মাত্র গত শতাব্দীতে এসে।
‘ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতন্ত্রেরও জয় হয়, পর্দার আড়ালে ও ঘরে ঢুকতে হয় নারীকে’- এমন আষাঢ়ে গল্প আপনি পেলেন কোথায়? মুসলিমদের বাদই দিলাম আপনার কথাকে মিথ্যা প্রমাণে অমুসলিম মনীষীবৃন্দের পর্যাপ্ত বক্তব্যই যথেষ্ট। ইন্টারনেটে ঢুকে আপনি যেকোনো সময় তাদের বক্তব্য দেখে নিতে পারেন। ডা. জাকির নায়েক ও আহমদ দিদাতের বক্তব্যও চোখ এবং হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিতে পারে। তাও আপনি পড়ে দেখতে পারেন ইউটিউবে ঢুকে। পৃথিবীর তাবৎ ধর্মেবিশ্বাসীরাই জানেন, প্রাক ইসলামী যুগে নারীরা ছিল শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। ইসলামই প্রথম এ অবস্থায় পরিবর্তন এনেছে। একটু পরেই আপনার প্রিয় কবি সুরাইয়া কমলা দাসের মুখেও শুনবেন সে কথা।
প্রিয় প্রদীপ, আরব নারীদের অবস্থার কী জানেন আপনি? আরবদের সম্পর্কে আপনার জ্ঞান নিশ্চয় পক্ষপাতদুষ্ট একচোখা বিশ্বমিডিয়ার সরবরাহ করা তথ্য পর্যন্ত সীমিত। আমাদের দেশে যেখানে প্রতিনিয়তই যৌতুকের জন্য নারীকে প্রাণ দিতে হয়, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার হৃদয়বিদারী আহাজারী শুনতে হয়, সেখানে ইসলাম থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার পরও সৌদি আরবে আজ পর্যন্ত যৌতুকের বলি হতে হয় না কোনো নারীকে। কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ায় পরিতাপ করতে হয় না কোনো পিতাকে। ছেলের পিতাদের চেয়ে বরং মেয়ের বাবারাই বেশি সুবিধা ভোগ করে থাকেন। আমরা প্রায়ই দেখি বিদেশে গিয়ে অনেকেই সেদেশের মেয়েদের বিয়ে করে দেশে নিয়ে আসেন। অনেক উন্নত ও সভ্য দেশের মেয়েদেরও বিয়ে করে আনতে দেখেছি অবিরলভাবে। কিন্তু সৌদি মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে, এমন কাউকে দেখিনি এখনো। কারণ, সেখানে মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রায় লাখ খানেক রিয়াল জমা দিতে হয়। যার মালিক হন মেয়ে ও মেয়ের বাবা। আরবের সেসব নারীই নেশায় আসক্ত যারা ইসলাম ও দেশের আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। অতএব তাদের দায় তাদেরই নিতে হবে; ইসলাম বা রাষ্ট্র নেবে কেন?
ইশ্বর নারী না পুরুষ তা নিয়ে তো এ পর্যন্ত কোনো জেন্ডার সচেতনকেও প্রশ্ন তুলতে দেখিনি; আপনাকেই প্রথম দেখলাম। অন্য ধর্ম সরাসরি ইশ্বরকে নারী বা পুরুষ বলেছে তাতে কী হয়েছে? অন্য ধর্ম তো ইশ্বরকে কত কিছুই না ঠাওরিয়েছে। মুসলিমরাই নিজের থেকে তাঁকে কিছু বানায়নি। তিনি নিজে যা বলেছেন মুসলিমরা সে অনুযায়ীই তাঁকে লিঙ্গের উর্দ্ধে রাখে। আপনার আরেকটি অভিযোগ, মাহবুব হাসান পশ্চিমা নারীদের উদাহরণ টেনে বোরকাকে জায়েয করতে চেয়েছেন। একদম ডাহা ভুল তথ্য। কথায় কথায় যারা পশ্চিমাদের উদাহরণ দিয়ে আমাদের শিক্ষা দিতে চান, চোখ বুজে যারা পশ্চিমাদের অনুসরণ করেন, তাদের চোখ খুলে দিতেই পশ্চিমা নারীদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভারতের প্রখ্যাত কবি সুরাইয়া কমলা দাসের ইসলাম গ্রহণের দৃষ্টান্ত দেয়ায় আপনি যার পর নাই অবাক হয়েছেন। অবাক আরও হবেন যদি নিচের এই লিংকে গিয়ে ইসলামের প্রতি তাঁর আত্মনিবেদন ও শ্রদ্ধার অমূল্য বাক্যগুলো স্বচক্ষে পড়ে দেখেন। উইকিপিডিয়ার সেই বাসি ও সেকেলে কয়েকটি বাক্যই কেবল চোখে পড়লো আপনার? এতকিছু আপনার চোখ এড়ালো কী করে! তাছাড়া উইকিপিডিয়ার ওই লিংকেও তো আপনার বক্তব্যের সপক্ষে তেমন কিছু নেই। লিংকটি এই :
(http://www.shomoy24.com/index.php/2009-09-29-07-58-17/20-2009-09-29-07-56-50/16884-2010-11-09-05-32-57)
১৯৯৯ সালের ১২ ডিসেম্বর কেরালার কোচিন শহরে এক সাহিত্য সম্মেলনে ড. সুরাইয়া দাস ভাষণ দেন। ওই সম্মেলনে ভারতের বহুসংখ্যক রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, কবি, পণ্ডিত, গবেষক সাংবাদিকসহ বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেই ভাষণে বলেন, ‘দুনিয়ার মানুষদের আজ আমি একথা জানাতে চাই যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্ব এবং ভালোবাসার ধর্ম। ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আমার এই সিদ্ধান্ত কোনো আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত নয়। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমি গভীর নিষ্ঠা এবং ধৈর্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ পড়াশোনা করেছি। আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, অন্যান্য অনেক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইসলাম নারীকে আত্মরক্ষার অনুভূতি শিক্ষা দিয়েছে। এই আত্মরক্ষার অধিকার নারীর ভীষণ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমি ইসলাম গ্রহণ করার কারণে অসংখ্য খোদার পরিবর্তে আমাকে এক খোদার উপাসনা করতে হবে। এখন রমযান মাস চলছে। মুসলিমদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র এই মাস। এই মাসে আমি আমার চিত্তচেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছি। আমি জেনে বুঝে সজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে ঘোষণা করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। অতীতে আমার কোন ধর্মবিশ্বাস ছিল না। মূর্তিপূজার প্রতি বিরক্ত হয়ে আমি নাস্তিকতা গ্রহণ করেছিলাম। এখন আমি ঘোষণা করছি, আমি এক আল্লাহর এবাদত করবো। কোনো রকম পার্থক্য না করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আল্লাহর সকল বান্দাকে আমি ভালোবাসবো।’
পরবর্তীকালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘কারো চাপের মুখে আমি ইসলাম গ্রহণ করিনি। এটা আমার স্বাধীন সিদ্ধান্ত। আমি কোনো সমালোচকের সমালোচনার পরোয়া করি না। আমি আমার ঘর থেকে সকল মূর্তি অপসারণ করেছি। আজ আমার মনে হচ্ছে আমি নয়া জন্ম লাভ করেছি।’
টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ড. সুরাইয়া কমলা বলেন, ‘ইসলামী শিক্ষার মধ্যে নারীদের বোরকা আমাকে দারুণ প্রভাবিত করেছে। মুসলিম নারীগণ সাধারণত এই পোশাক পরিধান করেন। প্রকৃতপক্ষে নারীদের জন্য বোরকা এক ওয়ান্ডারফুল পোশাক। বোরকা নারীদেরকে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে হেফাযত করে। নারীকে বিশেষ রকমের নিরাপত্তার নিয়শ্চয়তা দেয়।’
তিনি তাদের বলেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত আপনাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হবে। কিন্তু কি করবো বলুন, তথাকথিত স্বাধীনতায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। নারীরা নগ্ন চেহারায় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে এসব আমার মোটেই পছন্দ নয়। আমি চাই না কোনো পুরুষ আমার প্রতি তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকাবে। আপনারা শুনে অবাক হবেন, বোরকা পরিধান করার কারণে আমি আত্মরক্ষায় এবং নিজেকে হেফাযত করার বিশেষ আনন্দ অনুভব করছি। আমি লক্ষ্য করছি যেসব নারী পর্দা করে অন্যরা তাদের সম্মান করে। কেউ তাদের অকারণে উত্যক্ত করে না।’
প্রদীপ আপনি লিখেছেন, ‘গত দশ বছরে মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গির্জা, প্যাগোডা অনেক বেড়েছে, বেড়েছে চোর, বাটপার, সন্ত্রাসীও এবং অনেক কমেছে ভালো মানুষের সংখ্যা। তাহলে ধর্মের জাদু দিয়ে যে নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এই মাহবুব হাসানেরা কীভাবে তা অস্বীকার করেন?’ একচোখ দিয়ে দেখে কথা বললে তা হয় সত্যের অপলাপ। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বেড়েছে বলে অপরাধী বাড়েনি। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিক হারেই বেড়েছে সবকিছু। আপনি ঠিকই বলেছেন নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে এসব সমস্যার সমাধান ধর্মের জাদু দিয়ে সম্ভব নয়। তবে সম্ভব কি দিয়ে তা বলেননি। হ্যা, সম্ভব একমাত্র ধর্মের পূর্ণ অনুগত্য ও অনুশীলন দিয়ে। প্রদীপের আলো দিয়েও কি জব্বার-পরিরা দেখতে পান শিক্ষিতের সংখ্যা যত বাড়ছে সুনাগরিকের সংখ্যাও কমছে তত? কিছুদিন আগে সংবাদ বেরিয়েছিল কীভাবে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত একদল মানুষ পরীক্ষায় প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নকলে সাহায্য করেন! প্রথম আলোতে ছবিসহ ছাপা হয়েছিল একজন কলেজ শিক্ষক কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আপন ছাত্রীদের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশা করে তার ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন! এভাবে অসংখ্য উদাহরণই এখানে হাজির করা যায়।
বন্ধুবর জব্বার ও প্রদীপ, আপনারা যত সামাজিক ও চারিত্রিক সমস্যা চিহ্নিত করেছেন এবং আরো যেসব চিহ্নিত করা হয়ে থাকে- সবগুলোর মূলে রয়েছে নৈতিক তথা ধর্মীয় শিক্ষা ও তার অনুশীলনের অভাব। আমরা মুসলিম, তবে ইসলামকে নিজেদের জীবনের প্রতিটি পর্বের দিকনির্দেশক না মেনে কেবল কতিপয় আচার নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এ অবস্থার পরিবর্তন যতদিন না হবে, যতদিন আমরা ইসলামের পূর্ণ অনুগত না হবো, যতদিন প্রতিটি নাগরিক নৈতিক বলে বলীয়ান হবে, এসব সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। মহিলা শিক্ষক সম্পর্কে আমাদের যুব সমাজের অনেকেরই যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ওই নৈতিক শিক্ষার দৈন্যতারই দলিল। তাই আসুন শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে, স্বর্গতুল্য দেশ গড়তে আমরা সবাই নৈতিক শিক্ষায় আলোকিত হই। পক্ষপাত ও দলাদলি বন্ধ করে প্রকৃত জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হই। আসুন আমরা বক্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্রষ্টা ও স্রষ্টার শিক্ষাকে না দেখে সফেদ অপঙ্কিল হৃদয় নিয়ে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করি। প্রভু আমাদের সহায় হোন।