×
গান-বাদ্য ও এর কুপ্রভাব : এ নিবন্ধে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে গান-বাদ্যের অপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে।

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

    গান-বাদ্য ও এর কুপ্রভাব

    [বাংলা - bengali - البنغالية]

    লেখক: আলী হাসান তৈয়ব

    সম্পাদনা : ড. মোঃ আবদুল কাদের

    2011- 1432

    ﴿ الأغاني والموسيقى وآثارها السيئة ﴾

    « باللغة البنغالية »

    علي حسن طيب

    مراجعة: د. محمد عبد القادر

    2011- 1432

    গান-বাদ্য ও এর সামাজিক কুপ্রভাব

    আলী হাসান তৈয়ব

    গত কয়েক বছরে নাচ-গানের চর্চা অকল্পনীয় মাত্রায় বেড়েছে। দেশে যেখানে শিক্ষা-গবেষণা ও সুনাগরিক তৈরিতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই, সেখানে চরিত্রবিধ্বংসী নাচ-গানের পেছনে অনুদান বা বিনিয়োগ তথা আগ্রহের অন্ত নেই। যেখানে রোজই চিকিৎসার অর্থ না পেয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহরগোনা অসহায় মানুষের করুণ মুখ পত্রিকায় ছাপা হয় সেখানেই বহুজাতিক কোম্পানি ও বড় বড় ব্যবসায়িক ইন্ডাস্ট্রিগুলো তাদের উপার্জিত অর্থের অনেকটাই ঢালে নৃত্য ও সঙ্গীতের পেছনে! এখনো যেখানে বিরাটসংখ্যক মানুষের বাস দারিদ্রসীমার নিচে, আজো যারা পেটের আগুন নেভাতে গিয়ে নিজের ঈমান পর্যন্ত বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয়, সেখানকারই একশ্রেণীর নাগরিক নির্দ্বিধায় পঞ্চাশ হাজার টাকায় কেনে এক সন্ধ্যার কনসার্টের টিকেট! যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়, সেখানে আবার অনেক কিন্ডারগার্টেনে নিষ্পাপ শিশুদের নৃত্য ও সঙ্গীত শেখা বাধ্যতামূলক! আমরা যে আজ নাচ-গানে কতটা মেতেছে তা প্রমাণে বোধ হয় আর কিছু বলার দরকার নাই। তারপরও খানেকটা ইঙ্গিত দেয়া যাক।

    আসলে বাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা টিভি চ্যালেনগুলোই নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নেমেছে মুসলিম সমাজকে গানে মাতাল বানাতে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নীতি ও আদর্শ বিবর্জিত মুনাফাগৃধ্নু ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো। ‘ক্লোজ আপ নাম্বার ওয়ান’, ‘গাও বাংলাদেশ গাও’, ‘ক্ষুদে গানরাজ’, ‘নির্মাণশিল্পীদের গান’, গার্মেন্ট শ্রমিকদের গান’, ‘শাহরুখ খান লাইভ ইন কনসার্ট’, ‘ডেসটিনি ট্রাইনেশন বিগ শো’ ইত্যাদি চটকদার সব শিরোনামের আড়ালেই রয়েছে এ দুই শ্রেণীর বস্তুগত উদ্দেশ্য।

    মিডিয়ার অকল্পনীয় উন্নতির সুবাদে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীই মাতাল আজ এসব আয়োজনকে ঘিরে। দুঃখজনক সত্য হলো এসবে শুধু তরুণ প্রজন্মই মেতে নেই, মেতে আছেন একশ্রেণীর অপরিণামদর্শী অভিভাবক মহলও। নাচ-গান শেখানোর পেছনে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ যদি তারা না ঢালেন, তবে তো নৃত্য-সঙ্গীতের স্কুলগুলো এত রমরমা ব্যবসা করতে পারে না। ইদানীং বিশ্বে অনেক কিছু নিয়েই জরিপ চালানো হয়। নাচ-গানে বিনিয়োগ-আত্মনিয়োগ নিয়ে যদি কোনো জরিপ পরিচালিত হয় তবে বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশের নাম যে ওই তালিকার অন্যতম শীর্ষস্থানে থাকবে তাতে সন্দেহের কিছু নেই।

    এতসব আয়োজন ও আয়োজকদের বদান্যতায় এ জাতি এতটাই মেতেছে, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জর এ জাতি এতটা মাতাল হয়েছে যে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষ কোনো শ্রেণীর মানুষই গানের জোয়ারে গা না ভাসিয়ে বসে থাকছে না। আর সে জোয়ারেই ভেসে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের নীতি-আদর্শ ও কাম্য সচ্চরিত্র। যে ইভটিজিং ও যৌন অপরাধের ব্যাপক বৃদ্ধিতে এ দেশের চিরসবুজ শান্তির নিবাসগুলোতে জ্বলছে অশান্তির কালো আগুন তার অনেকখানি দায় এসব নাচ-গানকেন্দ্রিক আয়োজনের। অবৈধ ভালোবাসা আর ভোগ জীবনের আহ্বানে সদা সরব এসব গান কাউকে স্বস্তি দিচ্ছে না। বরং তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে পাপের আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে।

    এমন কোনো স্থান নেই যেখানে গেলে গানের আযাব থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ মেলে। ঘরে বলেন বা বাইরে, পথে বলেন কিংবা যানবাহনে— সর্বত্র ওই কানে অগ্নিবর্ষণকারী গানের আওয়াজ। বাসায় ঘুমিয়ে, পড়াশোনা করে এমনকি পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়েও নিস্তার নেই এই গানের অশ্রাব্য আওয়াজ থেকে। ঘর থেকে বের হলেন তো সেরেছে। কোথায় যাবেন দোকানে? সেখানেও কিন্তু গানের উপকরণের অভাব নেই। হেঁটে পথ পাড়ি দেবেন? সেখানেও দেখবেন মোবাইলে সজোরে গান শুনতে শুনতে কেউ না কেউ পথ চলছে। আর বাস বা যানবাহনের কথা তো বলাইবাহুল্য। বড় পরিতাপের বিষয় হলো একমাত্র নিরাপদ স্থান আল্লাহর ঘর মসজিদেও এই অভিশপ্ত গানের আওয়াজ ইদানীং কানে আসছে। অসচেতন কিছু মুসল্লী তাদের মোবাইলের রিংটোন হিসেবে গান ব্যবহার করায় এমনটি হচ্ছে। একজন মুসল্লী কিভাবে নিজের ছায়াসঙ্গী এই মোবাইল রিংটোন বানান গানকে তা কিছুতেই বোধগম্য নয়!

    কেবল সংবাদ শোনা কিংবা নিছক ক্রিকেট খেলা দেখার অজুহাতে যারা অপছন্দকে সঙ্গী করেই কদাচিৎ টিভি দেখেন, তারাও আজ বিপদে। এসবের ফাঁকে বিজ্ঞাপনগুলোতে নাচ-গানের এমন দৃষ্টিকটু অনুপ্রবেশ থাকে যা তাদের মতো ‘স্বল্পপুঁজির’ ঈমানদারদেরও টিভির সামনে ঘেঁষতে দ্বিধান্বিত করে।

    আসলে নাচ-গানের ক্ষতিকারিতা এত বেশি যে তা নাজায়েয হওয়ার জন্য আলাদা কোনো প্রমাণের দরকার পড়ে না। তদুপরি মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু ভাষ্য থেকে তা হারাম হওয়া প্রমাণিত। যেমন : আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

    وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ (6)

    ‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।’[1]

    গান-গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চাকে হারাম আখ্যায়িত করে তিনি বলেন,

    لاَ تَبِيعُوا الْقَيْنَاتِ وَلاَ تَشْتَرُوهُنَّ وَلاَ تُعَلِّمُوهُنَّ وَلاَ خَيْرَ فِى تِجَارَةٍ فِيهِنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ

    ‘তোমরা গায়িকা (দাসী) কেনাবেচা করো না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিও না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণও নেই। জেনে রেখ, এ থেকে প্রাপ্ত মূল্য হারাম।’[2]

    অন্যত্র তিনি বলেন,

    لَيَشْرَبَنَّ أُنَاسٌ مِنْ أُمَّتِى الْخَمْرَ يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا وَتُضْرَبُ عَلَى رُءُوسِهِمُ الْمَعَازِفُ يَخْسِفُ اللَّهُ بِهِمُ الأَرْضَ وَيَجْعَلُ مِنْهُمْ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ ».

    ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মাটিতে ধ্বসিয়ে দেবেন। এবং তাদের মধ্যে অনেককে শূকর ও বাঁদর বানিয়ে দেবেন।’[3]

    তিনি আরও বলেন,

    لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ

    ‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল সাব্যস্ত করবে।’[4]

    আরেক জায়গায় তিনি বলেন,

    بَعَثَنِي اللهُ رَحْمَةً وَهَدًى لِلْعَالَمِينَ وَبَعَثَنِي لِمَحْقِ الْمَعَازِفِ وَالْمَزَامِيرِ، وَأَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ

    ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন এবং বাদ্যযন্ত্র, ক্রুশ ও জাহেলি প্রথা অবলুপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’[5]

    আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

    الْغِنَاءُ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِى الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ

    ‘পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।’[6]

    অথচ সবাই জানেন বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে মাদক ও পাপাসক্তির ক্রমবিস্তার প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। হাজার প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনেও নেশার ছোবল থেকে এদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। এদের হাতেই রোজ খুন-ধর্ষণসহ ইত্যাকার নানা অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এসব নাচ-গানে ডুবে তারা মানবজীবনের মূল লক্ষ্য হারিয়ে হতাশার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই দেখা যায় সুখী ও উন্নত দেশগুলোতেই আত্মহত্যার হার সবচে বেশি। আসলে পরকাল ভাবনাই মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের ভেতরে সুপ্রবৃত্তি ও সদগুণাবলি জাগিয়ে তোলে। আর নাচ-গানের মূল সাফল্যই এখানে যে তা আখিরাত ভাবনাকে একেবারে ভুলিয়ে দেয়। মানুষের সুকুমার বৃত্তির ওপর পর্দা ফেলে ক্ষণিকের বস্তুতে মজে রাখে।

    সাহাবী ও তাবেয়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী গান ও বাদ্যযন্ত্র বহু গুনাহর সমষ্টি। যেমন : ক. নিফাক বা মুনাফেরির উৎস খ. ব্যভিচারে অনুপ্রাণিতকারী গ. মস্তিষ্কের ওপর আবরণ ঘ. কুরআনের প্রতি অনীহা সৃষ্টিকারী ঙ. আখিরাতের চিন্তা নির্মূলকারী চ. গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ও ছ. জিহাদি চেতনা বিনষ্টকারী।[7]

    আজ বড্ড প্রয়োজন তাই এ নাচ-গানের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা। মসজিদ, মাহফিলে, আলোচনার টেবিলে এবং সব ধরনের মিডিয়াতে এ ব্যাপারে সর্বশ্রেণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এ জাতির অস্তিত্ব, সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের স্বার্থেই তা জরুরী। হ্যা, নাচ-গান তথা অসুস্থ বিনোদনের প্রতি মানুষকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি সুস্থ বিনোদনের দিকেও পথনির্দেশ করতে হবে। বিনোদন মাধ্যমের উন্নতির যুগে মানুষের জন্য কুরআন-হাদীসের আলোচনা, হামদ-নাত, ইসলামী সঙ্গীতও সহজলভ্য করতে হবে। এ জন্য দরকার এসব কাজে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। এসবের সঙ্গে জড়িতদের বুদ্ধি-পরামর্শ ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা। কারণ, মানুষকে উত্তম বিকল্প না দেয়া পর্যন্ত মানুষ কোনোদিন মন্দ থেকে বিরত থাকবে না। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে গান-বাদ্যের ফিতনা থেকে দূরে থাকবার এবং এসব বন্ধে কাজ করার তাওফীক দিন। আমীন।

    [1]. সূরা লুকমান, আয়াত : ০৬।

    [2]. তিরমিযী : ১৩২৯; ইবন মাজা : ২১৬৮।

    [3]. বাইহাকী, সুনান : ১৭৮৪৫; ইবন মাজা : ৪০২০; ইবন হিব্বান : ৬৭৫৮।

    [4]. বুখারী : ৫৫৯০।

    [5]. মুসনাদ আহমদ : ২২৩৬১ ; বাইহাকী : ৬১০৪।

    [6]. বাইহাকী : ২১৫৩৬; ইগাছাতুল লাহফান ১/১৯৩; তাফসীরে কুরতুবী ১৪/৫২।

    [7]. ইগাছাতুল লাহফান ১/১৮৭।