×
ফতোয়া প্রদানকারী এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মীলাদুন্নবী অনুরূপ অন্যান্য বিদআতি অনুষ্ঠানসমূহকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করা, নতুন প্রজন্মের মাঝে পরস্পর সম্পর্ক সৃষ্টি করা, দ্বীনের প্রতি তাদের গর্ব ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি করা এবং সন্তানদের চরিত্র ও আচরণের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী বিধর্মীদের মনগড়া উৎসব যেমন ভালবাসা দিবস ইত্যাদি থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যে মীলাদুন্নবী উদ্যাপন করা বিদআত ও হারাম।

প্রশ্ন: আমরা স্পেনবাসী, আমরা সভা সমাবেশকে একতা, ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, নতুন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি, দ্বীনের প্রতি তাদের গর্ব ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি এবং আমাদের প্রজন্মের চরিত্র ও আচরণের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী বিধর্মীদের মনগড়া উৎসব যেমন ভালোবাসা দিবস ইত্যাদি থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যে আমরা ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করি, এ কাজ কি বৈধ?

উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ

প্রথমত: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতবিরোধ রয়েছে, তবে এ ব্যাপারে তারা একমত যে, হিজরী এগারতম বছর রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমান যুগে এ মৃত্যু দিবসেই কিছু লোক মাহফিলের আয়োজন করে 'ঈদে মীলাদুন্নবী' উদযাপন করছে।

দ্বিতীয়ত: ইসলামি শরী'আতে 'ঈদে মীলাদুন্নবী' নামে কোনো অনুষ্ঠান নেই। সাহাবায়ে কেরাম, তাবে'ঈ ও কোনো ইমাম এসব অনুষ্ঠান পালন করা তো দুরের কথা এ জাতীয় ঈদের সাথে পরিচিতও ছিলেন না। মূর্খ বাতেনী-শিয়া গ্রুপের কতক লোক এ ঈদের সূচনা করলে কতিপয় শহরের লোকেরা এ বিদ'আতের দিকে ধাবিত হয়।

তৃতীয়ত: সুন্নতের কতক সত্যিকার ভক্ত নিজ দেশের এসব অনুষ্ঠান দেখে প্রভাবিত হয়, তারা এসব বিদ'আত থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য পরিবার নিয়ে জমায়েত হয়, বিশেষ খাবারের আয়োজন করে এবং সবাই মিলে খায়। একই উদ্দেশ্যে কেউ বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের একত্র করে, কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত আলোচনা অথবা দীনি বক্তৃতা উপস্থাপনের জন্য লোকদের একত্র করে।

সন্দেহ নেই এর উদ্দেশ্য আপনাদের ভালো, যেমন পরস্পরের মাঝে ঐক্য তৈরি, অমুসলিমপ্রধান ও কুফুরী দেশে ইসলামি মূল্যবোধ সৃষ্টি করা ইত্যাদি।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে: আপনাদের এসব ভালো উদ্দেশ্য কোনো অনুষ্ঠানকে বৈধতার সনদ দেয় না; বরং এসব ঘৃণিত বিদ'আত। আপনাদের ঈদের প্রয়োজন হলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাই যথেষ্ট, আরও ঈদের প্রয়োজন হলে আমাদের সাপ্তাহিক ঈদ জুমু'আর দিন পালন করুন, এতে আপনারা জুমু'আর সালাত ও দীনের মূল্যবোধ তৈরির জন্য একত্র হোন। এটা সম্ভব না হলে এসব বিদ'আতী অনুষ্ঠান ব্যতীত বছরের আরও অনেক দিন রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন বৈধ উপলক্ষে একত্র হতে পারেন, যেমন বিয়ের অনুষ্ঠান অথবা ওলিমার দাওয়াত অথবা আকিকা অথবা বিশেষ উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এসব অনুষ্ঠানকে আপনারা পরস্পর সম্প্রীতি সৃষ্টি, একতার বন্ধন তৈরি ও দ্বীনের মূল্যবোধ জাগ্রত করার ন্যায় ইত্যাদি সৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারেন।

নিম্নে ভালো নিয়তে বিদ'আতি অনুষ্ঠানে যোগদান সম্পর্কে আলেমদের ফতোয়া উল্লেখ করছি:

এক. ইমাম আবু হাফস তাজুদ্দিন আল-ফাকেহানী রহ. মিলাদের বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কে বলেন: “কোনো ব্যক্তির নিজ অর্থায়নে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও সন্তানদের জন্য মাহফিলের আয়োজন করা, শুধু পানাহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা এবং পাপের কোনো সুযোগ না রাখা, এসব অনুষ্ঠানকেই আমরা বিদ'আত, ঘৃণিত ও মাকরূহ বলছি। কারণ, এ ধরণের অনুষ্ঠান আমাদের কোনো মনীষী করেন নি, যারা ছিল ইসলামের পণ্ডিত, যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম, যুগের আলোকবর্তিকা ও জগতবাসীর উজ্জ্বল নক্ষত্র।" (দেখুন: 'আল-মাওরেদ ফি আমালিল মাওলিদ' পৃষ্ঠা: ৫)

দুই. ইবনুল হাজ আল-মালেকী রহ. গান-বাজনা ও নারী-পুরুষের সহাবস্থান মুক্ত ঈদে মীলাদুন্নবী সম্পর্কে বলেন: “ঈদে মীলাদুন্নবী যদি এসব পাপাচার মুক্ত শুধু খানার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে উদযাপন করা হয় এবং তাতে বন্ধু-বান্ধবদের আহ্বান করা হয়, তাহলেও শুধু নিয়তের কারণে এ অনুষ্ঠান বিদ'আত হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, এটা দীনের মধ্যে সংযোজনের শামিল, পূর্বসূরিদের আমল বিরোধী এবং তাদের নিয়ত ও কর্মের বিপরীত। আমাদের তুলনায় তাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য, সম্মান ও মহব্বত বেশি ছিল। দীনি বিষয়ে তারা ছিলেন আমাদের চেয়ে অগ্রগামী। তাদের কেউ মীলাদের নিয়ত করেন নি। আমরা তাদের অনুসারী, অতএব তাদের জন্য যা যথেষ্ট, আমাদের জন্যও তাই যথেষ্ট। মৌলিক ও পূর্বাপর সকল বিষয়েই তারা আমাদের আদর্শ ও পথিকৃৎ। ইমাম আবু তালেব আল-মাক্কী রহ. তার কিতাবে অনুরূপই বলেছেন"(দেখুন: আল-মাদখাল ২/১০)

তিনি আরও বলেন: কেউ কেউ এসব হারাম গান-বাদ্যের পরিবর্তে 'বুখারী খতম' দ্বারা ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করে। সন্দেহ নেই হাদীসের দরস ইবাদাত ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম, এতে রয়েছে বরকত ও কল্যাণ; কিন্তু এসব হাসিল করার জন্য শরী'আত অনুমোদিত পন্থা অবলম্বন করা জরুরি, মিলাদের উদ্দেশ্যে তা পাঠ করা নয়, যেমন সালাত আল্লাহর বিশেষ ইবাদাত, তবুও অসময়ে এ সালাত পড়া নিন্দনীয়, সালাতের এ অবস্থা হলে অন্যান্য ইবাদাতের অবস্থা কি হবে?! (দেখুন: আল-মাদখাল ২/২৫)

মোদ্দাকথা: এসব মৌসুমে আপনাদের উল্লিখিত সৎ উদ্দেশ্যে, যেমন পরস্পর একতা তৈরি, উপদেশ ও নসিহত প্রদান ইত্যাদি নিয়তে, জমা হওয়া বৈধ নয়; বরং এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য অন্য কোনো উপলক্ষ বেছে নিন, পুরো বছরের যে কোনো একটি দিন নির্ধারণ করুন। দো'আ করছি আল্লাহ আপনাদের কল্যাণের চেষ্টা করার তাওফীক দান করুন এবং আপনাদের হিদায়াত ও তাওফীক বৃদ্ধি করুন। আল্লাহ ভালো জানেন।