মুসলিম উম্মাহর সংশোধনের গুরুত্ব ও পদ্ধতি
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
মুসলিম উম্মাহর সংশোধনের গুরুত্ব ও পদ্ধতি
[বাংলা - bengali - البنغالية]
জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
2011 - 1432
﴿ إصلاح الأمة الإسلامية: أهميته وطريقته ﴾
« باللغة البنغالية »
ذاكر الله أبو الخير
مراجعة: الدكتور أبو بكر محمد زكريا
2011 - 1432
মুসলিম উম্মাহর সংশোধনের গুরুত্ব ও পদ্ধতি
সংকলনে: জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
ইসলামী শরীয়তের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, ভালো কাজের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং খারাপ ও মন্দ কাজের পরিণতি হতে তাদের হেফাজত করা। মানুষ যাতে কোন খারাপ কাজে লিপ্ত না হয় তার জন্য তাদের সতর্ক ও সংশোধন করা। এ কারণেই মানুষের কাজের হিসাব নেয়া ও তা পর্যালোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ করতে নিষেধ করার মর্যাদা ও গুরুত্ব আল্লাহ তা‘আলার নিকট অধিক।
ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করা সমাজ সংশোধনের চাবিকাঠি ও সামাজিক নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সফলতার অন্যতম উপকরণ। একটি মুসলিম সমাজে এর প্রয়োজন এত তীব্র যে, বলতে গেলে এরই মাধ্যমে মুসলিমের ঈমান-আক্বীদার সংরক্ষণ হয়। ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজকে সমাজ থেকে প্রতিহত করা না হলে, ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কঠিন।
একজন মুসলিম তার স্বীয় মর্যাদা রক্ষা ও বাতিলকে প্রতিহত করতে হলে এর কোন ব্যতিক্রম কখনোই খুঁজে পাবে না। শুধু চুপ করে বসে থাকার মাধ্যমে সে তার ঈমান ও ইসলামের হেফাযত করতে পারবে না। তাকে অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করার মাধ্যমেই এ উম্মতকে ভোগবাদের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করা ও শুধু প্রবৃত্তির গোলামী ও দাসত্ব করা হতে হেফাযত করা যেতে পারে। উম্মতের অসংখ্য লোক যারা তাদের প্রবৃত্তি ও ভোগের তাড়নায় বিভিন্ন প্রকার অন্যায়, অশ্লীল ও খারাপ কাজে জড়িত হয় এবং খারাপ পরিবেশে যাতায়াত করে, এর মাধ্যমেই তাদেরকে প্রবৃত্তির অন্ধানুকরণ ও ভোগবাদিতা হতে সুরক্ষা করা সম্ভব হয়।
ইমাম গাযালী রহ. বলেন- দ্বীনের মধ্যে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণ করা হল দ্বীনের মহান এক নক্ষত্র। এর গুরুত্ব এত বেশি যে, এ কাজটির মিশন নিয়েই আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত নবী-রাসূল দুনিয়াতে প্রেরণ করেছিলেন। নবী ও রাসূলদের অবর্তমানে যদি আল্লাহর এ মিশনটিকে ঘুটিয়ে রাখা হয়, তার প্রতি ইলম ও আমল বন্ধ করা হয় তখন নবুওয়তের প্রয়োজনীয়তাই গুরুত্ব হয়ে পড়বে এবং দ্বীনদারী সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাবে। মানুষের মধ্যে গোমরাহি বিস্তার করবে, অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়বে, ফিতনা- ফাসাদ বৃদ্ধি পাবে, দেশ ও জাতি ধ্বংস হবে এবং বান্দাগণ আল্লাহর আযাবে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংসে নিপতিত হবে। আর তারা এ সব খারাপ পরিণতি সম্পর্কে সেদিন জানতে পারবে যেদিন আল্লাহ তা‘আলা মানুষদের ডেকে বলবেন- আজকের দিন রাজত্ব কার?[1]
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা এ উম্মতের সফলতার চাবিকাঠি:-
সৎ-কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার গুরুত্ব এত বেশি কেন হবে না? অথচ আল্লাহ তা‘আলা কাজটিকে এ উম্মতের নিদর্শন বানিয়েছেন এবং কল্যাণ ও সফলতার কেন্দ্র বিন্দু নির্ধারণ করেছেন। কাজটি করার মাধ্যমেই উম্মতের কামিয়াবি ও কল্যাণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْراً لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ﴾
‘‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত। তাদের কতক ঈমানদার। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক’’। [সূরা আলে ইমরান: ১১০]
আর আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট বর্ণনা দেন এ দায়িত্ব পালন করা সৌভাগ্যের প্রতীক ও সফলতার চাবিকাঠি। আর তা ছেড়ে দেয়া হল আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হওয়া ও তার আযাবের উপযুক্ত হওয়ার কারণ। এ কারণে আল্লাহ এ কাজের জন্য একটি জামাত থাকার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। একটি বিশেষ জামাত যাতে এ দায়িত্ব পালন করে সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের দায়িত্ব পালনের প্রতি তাগিদ দিয়ে বলেন-
﴿وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ﴾
‘‘আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম’’। [সূরা আলে-ইমরান: ১০৪]
আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরই সফল বলে আখ্যায়িত করেছেন যারা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে মানুষদের সতর্ক করে।
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন-
﴿لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرائيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ﴾
‘‘বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখে লা‘নত করা হয়েছে। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্য ছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ থেকে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত, তা কতই না মন্দ’’! [সূরা আল-মায়েদাহ:৭৮-৭৯]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও স্পষ্ট করে বলেন যে, এ কাজের দায়িত্ব পালন করা হলো মুক্তির পূর্বশর্ত আর তা হতে বিরত থাকা ধ্বংসের কারণ। যে ব্যক্তি এ কাজের দায়িত্ব পালন করা ছেড়ে দেবে, তাকে অবশ্যই আল্লাহর পাকড়াও- আযাবের মুখোমুখি হতে হবে এবং সে যখন আল্লাহর দরবারে দু‘আ করবে তার দু‘আ আল্লাহ্ তা‘আলা কবুল করবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দৃষ্টান্ত পেশ করে বলেন-
«مثل القائم على حدود الله والواقع فيها، كمثل قوم استهموا على سفينة، فأصاب بعضهم أعلاها وبعضهم أسفلها، فكان الذين في أسفلها إذا استقوا من الماء مروا على من فوقهم، فقالوا: لو أنَّا خرقنا في نصيبنا خرقاً ولم نؤذِ من فوقنا، فإن يتركوهم وما أرادوا هلكوا جميعاً، وإن أخذوا على أيديهم نجوا ونجوا جميعاً»
‘‘আল্লাহর আদেশ নিষেধ যারা বাস্তবায়ন করে এবং যারা বাস্তবায়ন করে না তাদের দৃষ্টান্ত সে সম্প্রদায়ের লোকদের মত, যারা একটি জাহাজে আরোহণ করল, তাদের কতক নীচ তলায় আবার কতক উপরের তলায় অবস্থান নিলো। নীচ তলার লোকেরা তৃষ্ণার্ত হলে পানির জন্য তাদের উপরের তলার লোকদের উপর দিয়ে চলাচল করতে হত। এতে উপর ওয়ালাদের কিছুটা কষ্টও হত, তাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে তারা পরস্পর বলল, আমরা যদি আমাদের নীচ তলায় জাহাজের নীচ দিয়ে ছিদ্র করে দিই, তাহলে পানির জন্য আমাদের আর উপরে যেতে হয় না এবং উপর ওয়ালাদের কষ্ট দেয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। (এ চিন্তা করে তারা যখন জাহাজের নিচ দিয়ে ছিদ্র করা আরম্ভ করল) তখন যদি তাদেরকে তাদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে জাহাজের সব লোক ধ্বংস হবে। আর যদি তাদের বাধা দেয়া হয়, তবে তারা নিজেরাও (ধ্বংস হতে) নাজাত পাবে এবং উপরের লোকেরাও নাজাত পাবে। [বুখারী: ২৪৯৩]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وقال -صلى الله عليه وسلم-: «والذي نفسي بيده! لتأمرن بالمعروف ولتنهوُنَّ عن المنكر أو ليوشكن الله أن يبعث عليكم عقاباً منه، ثم تدعونه فلا يستجاب لكم».
‘‘যার হাতে আমার জীবন আমি তার শপথ করে বলছি, তোমরা হয় ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে নিষেধ করবে অন্যথায় আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের পক্ষ হতে তোমাদের উপর আযাব পাঠাবে। আর তখন তোমরা আল্লাহর নিকট আযাব থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতে থাকবে তখন তোমাদের প্রার্থনার কোন উত্তর দেয়া হবে না’’।
[তিরমিযি (২১৬৯) এবং আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।]
আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে বিশেষ উৎসাহ ও নির্দেশ দেয়া এবং কাজটি ছেড়ে দেয়ার উপর শাস্তির ঘোষণা দেয়ার ফলে, ইতিহাস জুড়ে দেখা যায় মুসলিম মনীষী ও সংস্কারকগণ বিভিন্ন স্থানে হওয়া সত্বেও তারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। তারা তাদের জীবনের মিশন বানিয়ে নিয়েছিলেন। তাদের এ সব কর্ম ও মিশন থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ গুলো সুবিশাল ও সুবিস্তৃত হওয়াতে এ নিবন্ধে তা তুলে ধরা সম্ভব নয়। যার কারণে এখানে শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাত ও তার পবিত্র জীবনী হতে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা করা হচ্ছে। তিনি বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের কীভাবে সংশোধন করতেন এবং তাদের কীভাবে খারাপ ও মন্দ কাজ হতে বিরত রাখতেন তার কিছুটা এখানে আলোচনা করা হচ্ছে, যাতে আমরা এ সব ঘটনা থেকে শিখতে পারি এবং আমরাও আমাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকদের সংশোধন ও তাদের আল্লাহর রাহে পরিচালনা করতে পারি।
পরিবারের লোকদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সতর্ক ও সংশোধন করতেন:-
উম্মতের তালীম-তরবিয়ত চালিয়ে যাওয়া, কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেয়া, গুরুত্বপূর্ণ কাজের আঞ্জাম দেয়া, কাফের মুশরিকদের পক্ষ হতে নানাবিধ যুলুম নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া, রাত জেগে সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য বিনয়ী হয়ে কান্নাকাটি করা ইত্যাদি কোন ব্যস্ততাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার উপর ন্যস্ত বিশাল গুরু দায়িত্ব পালন করা হতে বিরত রাখতে পারেনি। হাজারো ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি পরিবারের সংশোধন, যে কাজ করলে আল্লাহর আযাব ও ক্রোধের কারণ হয় এবং তার রহমত ও কামিয়াবি লাভ হতে বঞ্চিত হয়, সে সব কাজ হতে দূরে থাকার জন্য অবিরাম উপদেশ, ওয়ায-নসিহত ও আদেশ-নিষেধ চালিয়ে যেতেন। তাদের থেকে কোন প্রকার অন্যায় ও ভুল-ত্রুটি সংঘটিত হতে দেখলে, তিনি সাথে সাথে তাদের সতর্ক করতেন এবং তার উপর ন্যস্ত গুরু দায়িত্ব যথাযথ পালন করতেন। যেমন-আয়েশা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-
«دخل عليَّ النبي -صلى الله عليه وسلم- وفي البيت قِرَام فيه صور، فتلوَّن وجهه، ثم تناول الستر فهتكه، وقال -صلى الله عليه وسلم-: إن من أشد النـاس عذاباً يـوم القـيامة الذين يصوِّرون هذه الصور»
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং দেখতে পেলেন, আমার ঘরের মধ্যে চিত্রবিশিষ্ট একটি পর্দা ঝুলানো ছিল। এ দেখে রাগে ও ক্ষোভে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারার রং লাল হয়ে গেল। তারপর তিনি পর্দাটি হাতে নিয়ে সাথে সাথে ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামতের দিন সর্বাধিক কঠিন আযাব তাদের দেয়া হবে, যারা এ ধরনের চিত্র তৈরী করে। (বুখারী: ৬১০৯)
وما روته ـ رضي الله عنها ـ قالت: قلت للنبي -صلى الله عليه وسلم-: حسبك من صفـية كـذا وكذا ـ تعـني قصيـرة ـ فقـال: «لـقد قلـتِ كلــمة لو مزجت بماء البحر لمزجته»
আয়েশা রা. হতে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন আমি একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম, সুফিয়া খাটো হওয়াটাই আপনার নিকট সে অপছন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এমন একটি বাক্য বলেছ, যদি তা সমুদ্রের পানির সাথে মিলানো হত, তাহলে সমুদ্রের পানিও দুর্গন্ধময় হয়ে যেত।
قالت: وحكيتُ له إنساناً، فقال: «ما أحب أني حكيت إنساناً وأن لي كذا وكذا»
আয়েশা রা. আরও বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একটি লোক সম্পর্কে আলোচনা করি। তখন তিনি বলেন- কোন লোক সম্পর্কে আমার নিকট আলোচনা করাকে আমি পছন্দ করি না। যদিও আমার জন্য অনুরূপ...অনুরূপ হোক। [সুনানে আবুদাউদ ৪৮৭৫] আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
وما رواه خادمه أنس ـ رضي الله عنه ـ قال: «بلغ صفية أن حفصة قالت: بنت يهودي، فبكت، فدخل عليها النبي -صلى الله عليه وسلم- وهي تبكي، فقال: ما يبكيك؟ فقالت: قالت لي حفصة: إني بنت يهودي، فقال النبي -صلى الله عليه وسلم-: إنك لابنة نبي، وإن عمك لنبي، وإنك لتحت نبي؛ ففيمَ تفخر عليك؟! ثم قال: اتقي الله يا حفصة!».
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাদেম আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- সুফিয়া রা. এর নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, হাফসা রা. তাকে একজন ইয়াহুদীর কন্যা বলে সম্বোধন করেছে, এ কথা শোনে তিনি কান্না করতে আরম্ভ করল। তার নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করে দেখতে পেল, সে কাঁদছে। তখন রাসূল তাকে বললেন- তুমি কাঁদছ কেন? তখন উত্তরে তিনি বললেন, হাফসা আমাকে বলেছে আমি একজন ইয়াহুদীর মেয়ে! তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলল, না, তুমি একজন নবীর মেয়ে আর তোমার চাচা একজন নবী আর তুমি একজন নবীর স্ত্রী। তাহলে সে তোমার উপর কি নিয়ে অহংকার করবে?! তারপর তিনি হাফসা রা. কে ডেকে বললেন, হে হাফসা! তুমি আল্লাহকে ভয় কর। [তিরমিযি: ৩৮৯৪ এবং তিনি বলেন- হাসান সহীহ এবং আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিবেষ্টিত সাহাবীদের সংশোধন কীভাবে করতেন:-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রত্যেক সাহাবীর সংশোধন ও তাদের অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। বিশেষ করে যারা তার খুব কাছাকাছি থাকত ও নিকটাত্মীয় ছিল। এছাড়াও যারা তার কাছে বেশি আসা যাওয়া করত এবং সফর সঙ্গী হত, তাদের প্রতি তিনি ছিলেন অধিক যত্নবান। তাদের তিনি গুনাহের কাজসমূহ হতে বিরত রাখতে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। মানুষের দেহ বা আত্মা দ্বারা যে সব ভালো কাজ সংঘটিত হয়, সে সব কাজগুলো করার প্রতি তিনি তাদের উপদেশ দিতেন। এ ছাড়া তিনি যখন তাদের মধ্যে ভুলত্রুটি, মন্দ ও অশোভনীয় কোন কাজ সংঘটিত হতে দেখতেন অথবা শয়তান তাদের কোন ভুলের দিকে নিয়ে যেতে দেখতেন, তখন তিনি সাথে সাথে তাদের অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, নমনীয়তা, সুন্দর ব্যবহার ও ভালোবাসা দিয়ে সতর্ক করতেন। তাদের সাথে তিনি কখনোই কোন প্রকার দুর্ব্যবহার ও কঠোরতা করতেন না।
যেমন- আবুযর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
«إني ساببت رجلاً فعيَّرته بأمه، فقال لي النبي -صلى الله عليه وسلم-: يا أبا ذر! أعيرته بأمه؟! إنك امرؤ فيك جاهلية، إخوانكم خَوَلُكم، جعلهم الله تحت أيديكم؛ فمن كان أخـوه تحـت يـده فليـطعمه مما يـأكـل، وليلبـسه ممـا يلبس، ولا تكلفوهم ما يغلبهم، فإن كلفتموهم فأعينوهم»،
‘‘আমি এক লোককে গালি গালাজ করি এবং তাকে তার মায়ের সাথে তুলনা করে কিছু খারাব কথা বলি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন- হে আবু জর! তুমি তাকে তার মায়ের সাথে মিলিয়ে দোষারোপ করলে! মনে রাখবে তুমি এমন এক লোক তোমার মধ্যে অবশ্যই জাহিলিয়্যাত বিদ্যমান! আর মনে রাখবে তোমাদের দাস-দাসীরা তোমাদের ভাইদেরই সমতুল্য। আল্লাহ তা‘আলা তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। যদি তোমাদের কোন ভাই তোমাদের অধীনে থাকে, তোমরা তাকে তাই খাওয়াও যা তোমরা খাও এবং তাকে তাই পরাও যা তোমরা পরিধান কর। তোমরা তাদের উপর এমন কোন বোঝা চাপিয়ে দেবে না, যা তাদের কষ্টের কারণ হয়। আর যদি তোমরা তাকে কোন ভারি কাজের দায়িত্ব দিয়ে থাক, তবে তোমরাও তাদের সহযোগিতা কর’’। [বুখারী: ৩০]
وحديث عائشة ـ رضي الله تعالى عنها ـ حين أَهَمَّ قريشاً شأنُ المرأة المخزومية التي سرقت، فقالوا: ومن يكلم فيها رسول الله -صلى الله عليه وسلم-؟! فقالوا: ومن يجترئ عليه إلا أسامة بن زيد، حِبُّ رسول الله -صلى الله عليه وسلم-؟ فكلمه أسامة، فقال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «أتشفع في حدٍ من حدود الله؟! ثم قام فاختطب، ثم قال: إنما أهلك الذين قبلكم أنهم كانوا إذا سرق فيهم الشريف تركوه، وإذا سرق فيهم الضعيف أقاموا عليه الحد، وأَيْم الله! لو أن فاطمة بنت محـمد سـرقت لقـطـعت يدها»
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, মাখযুমী গোত্রের একজন মহিলা চুরিতে ধরা পড়লে কুরাইশরা তার শাস্তি হাত কাটা হতে বাঁচানোর চেষ্টা করল এবং তারা বলাবলি করল যে মহিলাটির বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে কে সুপারিশ করবে? তখন তাদের মধ্যে কতক বলল, এ বিষয়ে একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাতি ও তার প্রিয় আস্থাভাজন উসামা ইবন যায়েদ ছাড়া আর কেউ সাহস করবে না। তাদের সিদ্ধান্তানুযায়ী উসামা ইবন যায়েদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে গিয়ে মহিলাটির জন্য সুপারিশ করলে, রাসূল ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- তুমি আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের বিষয়ে সুপারিশ করছ! এত বড় সাহস তোমার! এ বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দেয়ার জন্য দাড়িয়ে গেলেন। তারপর তিনি বললেন- তোমাদের পূর্বে যারা ধ্বংস হয়েছে, তাদের ধ্বংসের কারণ হল, তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করলে তার উপর তারা কোন শাস্তি প্রয়োগ করত না। পক্ষান্তরে যখন তাদের মধ্যে কোন দুর্বল-অসহায় লোক চুরি করত, তখন তার উপর তারা শাস্তি প্রয়োগ করত। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করে তবে আমি তারও হাত কেটে দেব। [বুখারী: ৩৪৭৫]
وحديث أبي مسعود البدري ـ رضي الله عنه ـ قـال: «كنـت أضرب غلاماً لي بالسوط، فسمعت صوتاً من خلفي: اعلمْ أبا مسعود! فلم أفهم الصوت من الغضب، قال: فلما دنا مني إذا هو رسول الله -صلى الله عليه وسلم-، فإذا هو يقول: اعلم أبا مسعود! اعلم أبا مسعود! قال: فألقيت السوط من يدي، فقال: اعلم أبا مسعود أن الله أقدر عليك منك على هذا الغلام! قال: فقلت: لا أضرب مملوكاً بعده أبداً».
আবু মাসউদ আল বাদরী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি আমার একজন গোলামকে লাঠি দ্বারা প্রহার করতাম। তখন আমি পেছন থেকে একটি আওয়ায শুনতে পেলাম: হে আবু মাসউদ! সতর্ক হও! আমি রাগের কারণে আওয়াযটি ভালোভাবে বুঝতে পারিনি তিনি বলেন, তারপর যখন আওয়াযকারী আমার নিকটে আসল, আমি দেখতে পেলাম তিনি হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন তিনি আমাকে বললেন- হে আবু মাসউদ জেনে রাখ! এ কথা শোনে আমি লাঠিটি হাত থেকে ফেলে দিলাম। তখন তিনি বললেন- হে আবু মাসউদ! তুমি গোলামের উপর যতটুকু ক্ষমতা রাখ আল্লাহ তা‘আলা তোমার উপর তার চেয়ে আরও অধিক ক্ষমতা রাখেন। তারপর সে বলল, আমি বললাম, আজকের পর থেকে আর কোন দিন কোন গোলামকে প্রহার করবো না। মুসলিম: ১৬৫৯
আলেম-ওলামা, ইবাদত-গুজার ও বিশিষ্ট-জনদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সতর্ক করতেন:-
আলেমগণ ও যারা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত বন্দেগীতে সময় কাটাতেন এবং যারা বেশি বেশি করে আল্লাহর আনুগত্য করত, এ উম্মতের মধ্যে ধরনের লোকদের একটি বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে। যার কারণে তাদের সাথে কথা বলতে হলে এবং তাদের কোন কিছুর দাওয়াত দিতে হলে অবশ্যই তাদের ইজ্জত সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের থেকে কোন ভুলভ্রান্তি, দোষত্রুটি ও অন্যায় প্রকাশ পেলে তাদের মর্যাদা ও সম্মান তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য তাদের সতর্ক করা বিষয়ে কোন প্রতিবন্ধক হয়নি। কারণ, রাসূল তো উম্মতের শিক্ষক ও অভিভাবক। তার মান-সম্মান ও ইজ্জতের সামনে সবই তুচ্ছ। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সতর্ক করার কারণে তাদের মান-ইজ্জত ও সম্মানের কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। বরং তার শিক্ষা পেয়ে তারা ধন্য ও সফল হয়েছে।
এর প্রমাণস্বরূপ জাবের রা. এর হাদীস:- তিনি বলেন,
«أن معاذ بن جبل ـ رضي الله عنه ـ كان يصلي مع النبي -صلى الله عليه وسلم-، ثم يأتي قومه فيصلي بهم الصلاة، فقرأ بهم البقرة، قال: فَتَجَوَّز رجـل فصلى صـلاة خفيـفة، فـبلغ ذلك معاذاً، فقال: إنه منافق، فبلغ ذلك الرجلَ، فأتى النبيَّ -صلى الله عليه وسلم-، فقال: يا رسول الله! إنَّا قوم نعمل بأيدينا، ونسقي بنواضحنا، وإن معاذاً صلى بنا الـبارحة، فـقرأ البـقرة فتجـوَّزت، فزعـم أني منافق، فقال النبي -صلى الله عليه وسلم-: يا معاذ! أفتَّان أنت؟ (ثلاثاً)، اقرأ: ﴿وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا﴾ [الشمس: 1]، و﴿سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى﴾ [الأعلى: 1]، ونحوها»
‘‘মুয়ায ইবন জাবাল রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে জামাতের সালাত আদায় করতেন। তারপর সে তার সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট আসতো এবং তাদের সালাতের জামাতের ইমামতি করত। আর তাদের সাথে যে জামাত পড়াতেন সে সালাতের জামাতে তিনি সূরা বাকারা তিলাওয়াত করত। এ দেখে এক লোক অসহ্য হয়ে জামাতে সালাত ছেড়ে দিয়ে, সংক্ষিপ্তাকারে একা একা সালাত আদায় করে বাড়িতে চলে যান। এ সংবাদ মুয়ায রা. এর নিকট পৌছলে, তিনি তার সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, নিশ্চয় সে মুনাফেক। তার এ মন্তব্য সম্পর্কে লোকটি জানতে পেরে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা এমন এক সম্প্রদায়ের লোক, আমরা হাতে কামাই করে আহার যোগাড় করি এবং নিজেরা কষ্ট করে পানি পান করি। আর মুয়ায রা. গত রাতে আমাদের সালাতের জামাতের ইমামতি করেন, তাতে তিনি সূরা বাকারা তিলাওয়াত করতে আরম্ভ করলে আমি অধৈর্য হয়ে একা একা সংক্ষিপ্ত সালাত আদায় করে চলে যাই। তারপর সে ধারণা করে বলে যে, আমি একজন মুনাফিক। তার কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলল, হে মুয়ায! তুমি কি ফিতনা সৃষ্টি কারী? এ কথাটি তিনি তাকে তিন বার বললেন। তুমি সালাতে ﴿وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا﴾ ও ﴿سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى﴾ এ ধরনের সূরা পড়’’। [বুখারী: ৬১০৬]
وحديث عبد الله بن عمرو ـ رضي الله عنهما ـ قال: «زوَّجني أبي امرأة، فجاء يزورها، فقال: كيف ترين بعلك؟ فقالت: نِعْم الرجل من رجل! لا ينام الليل ولا يفطر النهار. فوقع بي، وقال: زوَّجْتك امرأةً من المسلمين فعضلْتَها، قال: فجعلت لا ألتفت إلى قوله؛ مما أرى عندي من القوة والاجتهاد، فبلغ ذلك النبي -صلى الله عليه وسلم-، فقال: لكني أنا أقوم وأنام، وأصوم وأفطر، فقم ونم، وصم وأفطر! قال: صم من كل شهر ثلاثـة أيـام، فقلت: أنا أقـوى من ذلك، قـال: صـم صـوم داود ـ عليه السلام ـ صـم يومـاً وأفـطر يوماً، قلت: أنا أقوى من ذلك. قـال: اقـرأ القرآن في كل شهر، ثم انتهى إلى خمس عشرة وأنا أقول: أنا أقوى من ذلك».
আব্দুল্লাহ ইবন আমর রা. এর হাদিস তিনি বলেন, ‘‘আমার পিতা আমাকে একটি মহিলার সাথে বিবাহ দেন। তারপর তিনি যখন তাকে দেখতে গেলেন তখন জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তোমার স্বামীকে কেমন পেলে। সে উত্তরে বলল, মানুষের মধ্য হতে সে একজন ভালো মানুষ। রাতে ঘুমায় না সারা রাত এবাদত করে এবং দিনে সে খায় না রোজা রাখে। তারপর তিনি আমার নিকট এসে আমাকে বললেন, আমি তোমাকে একজন মুসলিমের মেয়ের সাথে বিবাহ দিলাম অথচ তুমি তাকে দুরে সরিয়ে রাখলে। আমি তার কথার দিকে কোন প্রকার গুরুত্ব দিলাম না। কারণ, আমি ভাবলাম আমার মধ্যে শক্তি-সামর্থ্যে কোন কমতি ছিল না। তাই তার কথায় কোন প্রকার কর্ণপাত করিনি। বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পৌছলে- তিনি বললেন, কিন্তু আমি রাত জেগে ইবাদত করি আবার ঘুমাই, আর রোজা রাখি এবং ইফতার করি। সুতরাং, তুমিও ঘুমাও এবং রাত জেগে ইবাদত কর আবার রোজা রাখ ও ইফতার কর। তারপর রাসূল সা. বললেন, তুমি প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখ, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এর চেয়েও আরও অধিক রোযা রাখার সামর্থ্য রাখি। তখন তিনি বললেন, তাহলে তুমি দাউদ আ. এর রোজা রাখার অনুকরণ কর। ( তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন ইফতার করতেন) একদিন রোজা রাখবে আর একদিন ইফতার করবে। তারপর আমি বললাম, আমিতো এর চেয়েও আরো অধিক ইবাদত বন্দেগীর সামর্থ্য রাখি। তারপর তিনি বললেন তাহলে তুমি প্রতি মাসে একবার কুরআন খতম কর। তারপর বললেন, তুমি পনের দিনে একবার কুরআন খতম কর। এভাবে রাসূলের কথার উত্তরে আমি বলতে ছিলাম, আমিতো এর চেয়েও আরও অধিক সামর্থ্য রাখি। বুখারী: ৫০৫২
আমীর, ওমারাহ, অভিভাবক ও দায়িত্বশীলদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সতর্ক করতেন:-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সঙ্গী-সাথীদের মধ্য হতে যাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্যতা দেখতেন, অন্যান্য লোকদের পরিচালনা করার মত দূরদর্শিতা লক্ষ করতেন এবং বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো খুব সতর্কতা ও আমানতদারীর সাথে আঞ্জাম দেয়ার মত সাহস অনুভব করতেন, তাদের তিনি বিভিন্ন কাজের দায়িত্বশীল, আমীর ও নেতা বানাতে কোন প্রকার কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু এ ধরনের যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের কাজের দায়-দায়িত্ব প্রদানের পরও যখন তাদের মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি, দোষ বা অন্যায় দেখতেন, তাদের সতর্ক করতে এবং আদেশ বা নিষেধ করতে তিনি বিন্দু পরিমাণও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। হিকমত, বুদ্ধি-মত্তা ও প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি তাদের সতর্ক ও সংশোধন করতেন।
যেমন:-আলী রা. এর হাদীস তিনি বলেন,
«أن النبي -صلى الله عليه وسلم- بعث جيشاً وأَمَّر عليهم رجلاً، فأوقد ناراً، وقال: ادخلوها! فأرادوا أن يدخلوها، وقال آخرون: إنما فررنا منها، فذكروا للنبي -صلى الله عليه وسلم-، فقال للذين أرادوا أن يدخلوها: لو دخلوها لم يزالوا فيها إلى يوم القيامة، وقال للآخرين: لا طاعة في معصيةٍ، إنما الطاعة في المعروف».
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা একটি সৈন্যদল পাঠান এবং একজনকে তাদের আমীর নিযুক্ত করেন। লোকটি তার সৈন্যদের পরীক্ষা করার জন্য আগুন জালিয়ে তাদের বললেন, তোমরা আমার আদেশানুযায়ী আগুনে প্রবেশ কর। তার নির্দেশ মানার উদ্দেশ্যে একদল আগুনে প্রবেশ করতে উদ্যত হল এবং অপর দল বলল, আমরাতো আগুন হতে পলায়ন করেই ইসলামে প্রবেশ করেছি। সুতরাং আমরা পুনরায় আগুনে প্রবেশ করবো না। এ ঘটনা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললে, তিনি যারা আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে বললেন, যদি তারা তাতে প্রবেশ করত, কিয়ামত পর্যন্ত তাতেই অবস্থান করত। আর অপর দল সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- অন্যায় কাজে কোন আনুগত্যতা নাই, আনুগত্যতা হল ভালো কাজে। [বুখারী: ৭৬৫৭]
وحديث أبي حميد الساعدي ـ رضي الله عنه ـ قال: «استعمل رسول الله -صلى الله عليه وسلم- رجلاً على صدقات بني سليمٍ يُدعَى ابن الْلَّتْبِيَّة؛ فلما جاء حاسبه، قال: هذا مالُكم، وهذا هدية، فقال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: فهلاَّ جلست في بيت أبيك وأمك حتى تأتيك هديتك إن كنت صادقاً! ثم خطبنا، فحمد الله وأثنى عليه، ثم قال: أما بعد: فإني أستعمل الرجل منكم على العمل مما ولاَّني الله، فيأتي فيقول: هذا مالكم وهذا هدية أُهديت لي! أفلا جلس في بيت أبيه وأمه حتى تأتيه هديته؟! واللهِ لا يأخذ أحد منكم شيئاً بغير حقه إلا لقي الله يحمله يوم القيامة، فلأعرفن أحداً منكم لقي الله يحمل بعيراً له رُغَاء، أو بقرة لها خُوَار، أو شاة تَيْعَر، ثم رفع يده حتى رُئي بياض إبطه يقول: اللهم هل بلَّغت، بَصَر عيني وسَمْعَ أذني».
আবু হুমাইদ আস্সায়েদী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোক যাকে ইবনে লাতবীয়া বলে ডাকা হত, তাকে বনী সুলাইমের সদকা আদায়ের জন্য কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন। সদকা উসুল করে আসার পর যখন তার নিকট হিসাব রক্ষক আসল, সে বলল, এ হল তোমাদের সম্পদ আর এ হল আমার জন্য হাদীয়া। এ কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কেন তোমার মাতা পিতার ঘরে বসে থাকলে না, যাতে তোমার নিকট লোকেরা হাদীয়া নিয়ে আসতো! যদি তুমি তোমার কথায় সত্যবাদী হয়ে থাক! ।
তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্য ভাষণ দিলেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন ও তার শুকরিয়া আদায় করেন। তারপর তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যে সব কাজ আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, তা হতে কতক কাজের বাস্তবায়নের জন্য আমি তোমাদের থেকে কাউকে কাউকে নিয়োগ দিয়ে থাকি। কিন্তু তারা আমার নিকট এসে বলে- এ হলো তোমাদের সম্পদ আর এ হল আমার জন্য হাদীয়া। সে যখন তার মাতা -পিতার ঘরে বসে থাকে, তখন কেন তার নিকট কেউ হাদীয়া নিয়ে আসে না। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তোমাদের যে কেউ অন্যায়ভাবে কোন কিছু আত্মসাৎ করবে, ক্বিয়ামতের দিন সে তা বহন করেই আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে। সেদিন আমি তোমাদের কাউকে দেখতে পাব, সে আল্লাহর সাথে একটি উট বহন করে সাক্ষাত করছে, যে অবস্থায় উটটি চিৎকার করছে। অথবা একটি গরু বহন করছে আর গরুটি বাঁ বাঁ করছে অথবা একটি ছাগল বহন করছে, আর ছাগলটি চিৎকার করছে। তারপর তিনি তার দুহাত আল্লাহর দরবারে এমন উঁচা করেন যে, তার বগলে নীচের সাদা রং দেখা যাচ্ছিল। এবং তিনি আল্লাহকে ডেকে বলেন- হে আল্লাহ আমি কি তোমার দ্বীনের দাওয়াত মানুষের নিকট পৌছাইনি? যা আমার চোখ প্রত্যক্ষ করেছে এবং আমার কর্ণদ্বয় শুনেছে? [বুখারী: ৬৯৭৯]
সমাজের সাধারণ মানুষদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সতর্ক করতেন:-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনেক ব্যস্ততা ও নানান কাজ-কর্ম থাকা সত্ত্বেও সমাজের যে সব লোকদের সাথে তুলনা মূলক কম উঠা-বসা করতেন তাদেরও তিনি সতর্কতা করতে কোন প্রকার র্কাপণ্য করেননি। যখন তাদের কোন বিষয়ে সতর্ক করার প্রয়োজন পড়ত এবং তাদের কোন কাজ করতে নিষেধ করা আবশ্যক হত, তিনি সাথে সাথে তাদের সংশোধন ও সতর্ক করতেন।
এর দৃষ্টান্ত আবু হুরাইরা রা. এর হাদীস:-
حديث أبي هريرة ـ رضي الله عنه ـ «أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- مرَّ على صُبْرَةِ طعامٍ، فأدخل يده فيها، فنالت أصابعُه بللاً، فقال: ما هذا يا صاحب الطعام؟! قال: أصابته السماء يا رسول الله! قال: أفلا جعلته فوق الطــعام؛ كـي يـراه الـناس؟! مـن غـشَّ فليس مني»
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দোকানের খাদ্যের স্তুপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তিনি স্তুপের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে হাত বের করে দেখলেন তার হাতের আঙ্গুল গুলো ভেজা। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- এ অবস্থা কেন ? উত্তরে সে বলল, এ গুলো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তখন তিনি তাকে বললেন- তাহলে তুমি এগুলোকে উপরে রাখলে না কেন? যাতে লোকেরা দেখতে পেত। মনে রাখবে- যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। [মুসলিম: ১০৬]
وحديث سلـمة بن الأكوع ـ رضي الله عنه ـ «أن رجلاً أكل عند رسول الله -صلى الله عليه وسلم- بشـماله، فقال: كُلْ بيمـينك! قال: لا أستـطيع، قـال: لا اسـتــطـعتَ. ما منـعه إلا الكِـبْر، قال: فما رفـعـها إلى فيـه»
সালমা ইবনুল আকওয়া রা. হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, একলোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে বাম হাত দিয়ে খেতে ছিল। তা দেখে রাসূল লোকটিকে বলল, তুমি ডাব হাত দিয়ে খাও। তখন লোকটি বলল, আমি তা করতে পারবো না। রাসূল বললেন, তুমি পারবে না? লোকটি একমাত্র অহংকার বশতই রাসূলের নির্দেশ মানা হতে বিরত রইল। তিনি বলেন, তারপর হতে লোকটি আর কোন দিন তার হাত স্বীয় মুখ পর্যন্ত নিতে পারেনি। [মুসলিম: ২০২১]
وحــديث ابـن عباس ـ رضي الله عنـهما ـ «أن رسـول الله -صلى الله عليه وسلم- رأى خاتماً من ذهب في يد رجل فنزعه فطرحه، وقال: يعمد أحدكم إلى جمرة من نار فيجعلها في يده؟ فقيل للرجل بعدما ذهـب رســول الله -صلى الله عليه وسلم-: خــذ خاتمـك انتـفع بـه، قال: لا واللهِ! لا آخذه أبداً وقد طرحه رسول الله -صلى الله عليه وسلم-»
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোকের হাতে স্বর্ণের একটি আংটি দেখেন এবং আংটিটি তিনি তার হাত থেকে চিনিয়ে নিয়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন, তোমাদের কেউ কেউ এমন আছে, সে আগুনের টুকরা গ্রহণ করে এবং তা তার হাতে পরিধান করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে যাওয়ার পর লোকটিকে বলা হল, তুমি তোমার আংটিটি কুড়িয়ে নাও এবং আবার ব্যবহার কর। লোকটি বলল, না! আল্লাহর কসম করে বলছি, যে জিনিষটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত থেকে নিয়ে ফেলে দিয়েছেন, তা আমি আর কখনোই তুলে নেবো না। [মুসলিম: ২০২১]
وحديث عبد الله بن جعفر ـ رضي الله عنهما ـ أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- «دخل حائطاً لرجل من الأنصار، فإذا جملٌ، فلما رأى النبيَّ -صلى الله عليه وسلم- حنَّ، وذرفت عيناه، فأتاه النبي -صلى الله عليه وسلم- فمسح ذِفْرَاه فسكت، فقال: مَنْ ربُّ هذا الجـمل؟ لمن هـذا الجـمل؟ فجاء فتى من الأنصار فقال: لي يا رسول الله! فقال: أفلا تتقي الله فـي هـذه البـهيمة التـي ملَّكك الله إيـاهـا؟ فـإنـه شـكا إلـيَّ أنــك تجيعه وتُدْئِبُه».
আব্দুল্লাহ ইবন জাফর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন একজন আনসারী লোকের বাগানে প্রবেশ করলে সেখানে তিনি দেখতে পেলেন, একটি উট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখে চটপট করছে এবং তার দু চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। তারপর উটটি রাসূলের কাছে আসলে তিনি তার গাড়ে হাত বুলিয়ে দেন। তারপর উটটি চুপ হয়ে গেল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ উটের মালিক কে? এ উট কার? এ কথা শোনে একজন আনসারী যুবক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! উটটি আমার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে চতুষ্পদ জন্তুর মালিক বানিয়েছে, তাদের ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় করো না। কারণ, এ উটটি আমার নিকট অভিযোগ করছে যে, তুমি তাকে ঠিকমত খাওয়ার দাও না এবং তাকে অধিক কষ্ট দাও। [মুসলিম: ২০৯০]
মোট কথা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণ করা এবং উম্মতের সংশোধন ও তাদের সতর্ক করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়তী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও সত্তাগত গুণ। তার জীবনের কোন একটি অধ্যায় ও কোন প্রেক্ষাপটেই তা তার থেকে পৃথক হয়নি। যারা তার নিকটাত্মীয় ছিল, তার সাথে যাদের সম্পর্ক ছিল তাদের সকলকেই তিনি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণ করতেন। আর তিনি যখন যেখানে যে অবস্থাতে থাকতেন উম্মতদের সতর্ক করতেন এবং তাদের খারাব কাজ হতে বাঁচাতেন। কথাও কোন অন্যায় অনাচার সংঘটিত হতে দেখলে তা থেকে তাদের বিরত রাখার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের অনুকরণ ও তার আনুগত্যতা প্রমাণ রাখতে হলে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণ করার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাহাবীরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতেন এবং তারা তাদের কর্মক্ষেত্রে ও জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ অনুপম আদর্শের যথার্থ অনুকরণ করতেন। যেমন, তুফায়েল ইবন আমর আদদাউস ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি তার স্বজাতির নিকট দৌড়ে গেলেন এবং সাথে সাথে তাদের ঈমানের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করলেন। তাদের তিনি অন্যায় ও মন্দ কাজ হতে সতর্ক করতে লাগলেন। এমনকি তার সম্প্রদায়ের অনেক লোককেই সে শিরক ও অন্যায় হতে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। যার ফলে তার গোত্র দাউস সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। [আবু দাউদ: ২৫৪৯, আলবানী সহীহ বলেছেন।]
সাহাবীরা একেবারে কঠিন রোগাক্রান্ত ও মুমূর্ষু অবস্থায়ও লোকদের সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে সতর্ক করতেন। কোন অবস্থাতেই তারা এ দায়িত্ব পালন হতে বিরত থাকতেন না। ওমর রা. এর ঘটনা তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত ছিলেন তখন একজন যুবক তাকে দেখতে গেল। আর তার পরিধেয় কাপড় তার পায়ের টাখনুর নিচে ঝুলতে ছিল। ওমর রা. যখন এ দৃশ্য দেখলেন তখন তিনি সাথে সাথে যুবকটিকে সতর্ক করলেন। তার মৃত্যু শয্যা ও দেশের অবস্থার চিন্তা বালকটিকে সতর্ক করা হতে তাকে বিন্দু পরিমাণও বিরত রাখতে পারেনি। তিনি বালকটিকে কাপড় উঁচা করে পরিধান করতে নির্দেশ দিলেন এবং ঝুলিয়ে কাপড় পরিধান করতে না করেন। [বুখারী: ৩৭০০]
বর্তমান সময়ের বাস্তবতার দিক লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই, উম্মতের অধিকাংশ বড় বড় নামী-দামী লোক ও অধিক মর্যাদাশীল নারী-পুরুষরা ইসলামের এ মহান ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন হতে পিছিয়ে আছে। যার কারণে সমাজে অন্যায়-অনাচার, আল্লাহর নাফরমানি, শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ, বিশৃঙ্খলা, অন্ধানুকরণ, কু-প্রবৃত্তির পূজারীদের দাপট, যুলুম নির্যাতন ও প্রকাশ্যে- দিবালোকে অপরাধের ঘটনা অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে বর্তমানে আমরা দেখতে পাই সামাজিক অবক্ষয়, মুসলিম উম্মাহর পতন ও তাদের করুণ পরিণতি। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে, ভেঙ্গে গেছে তাদের সামাজিক অবকাঠামো এবং দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের মনোবল। আজ তাদের শৌর্যবীর্য, গৌরব ও ঐতিহ্য বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নাই।
মুসলিমদের এ ধরনের দুর্বলতা ও পিছিয়ে থাকার অন্তর্নিহিত অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে এর উল্লেখযোগ্য কতক কারণ হল, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণ করা যে কত গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের পরিধির সীমাবদ্ধতা এবং কাজটির প্রতি অমনোযোগী হওয়া। এ মহান দায়িত্বটির প্রয়োজনীয়তা, যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারাও পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া এর আরও কারণ হল, নিজেকে এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত বলে বিশ্বাস না করা। যার ফলে সে মনে করে এ কাজটি করার দায়িত্ব তো আমার নয়, এটা-তো তারাই করবে যারা আমার চেয়ে বড়। অন্যদের দায়িত্ব বলে বিশ্বাস করে দায়িত্বটিকে অন্যদের গাড়ে চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা তার মধ্যে কাজ করে। এ ছাড়াও গুনাহ, অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে দায়িত্বটির গুরুত্ব তার নিকট গৌণ হওয়ায় এ দায়িত্ব পালনের প্রতি তার অনীহা জাগ্রত হয়। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে সব কষ্ট, যুলুম, নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়, তার উপর ধৈর্য ধারণের মানসিকতা না থাকাও দায়িত্ব পালনে অবহেলা করার অন্যতম কারণ। আর মানুষের পক্ষ হতে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সমালোচনার মুখোমুখি হওয়াকে ভয় করাও এ দায়িত্ব পালন হতে মানুষকে দূরে রাখে।
এ ছাড়াও বর্তমানে আমাদের মধ্যে যে সব দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ হল, ঈমানী দুর্বলতা, দ্বীন সম্পর্কে সঠিক বুঝ না থাকা এবং দ্বীনের মূল চেতনা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকা। যার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্বীয় বাণীতে ইশারাও করে গিয়েছেন। বর্তমানে ঘর থেকে নিয়ে মাদ্রাসা, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি সেক্টরে দ্বীনের চর্চা ও অনুশীলনের ঘাটতিও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আমাদের এ দুর্বলতা ও অলসতার ফলে অচিরেই সমাজে বাতিল মাথা ছাড়া দিয়ে উঠবে এবং দ্বীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংকোচিত হয়ে পড়বে। আর তখন এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হবে, তা আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষ তো দুরের কথা অনেক বড় বড় জ্ঞানী-গুণীরাও উপলব্ধি করতে পারছে না। ধীরে ধীরে সমাজ থেকে ভালো কাজ গুলো দূর হয়ে যাবে, ভালো লোকের সংখ্যা কমে যাবে এবং অন্যায় অনাচার বৃদ্ধি পাবে। মানুষের অন্তুরে আল্লাহর ভয় বলতে আর কোন কিছুই তখন অবশিষ্ট থাকবে না। পাগলা হাতীর মত মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে থাকবে। তাদের মধ্যে ভালো ও মন্দের কোন পার্থক্য থাকবে না।
হে মুসলিম জাতি! তোমরা হিসাব নিকাশের জন্য প্রস্তুত হও এবং হক্বের দাওয়াত ও খারাব কাজকে প্রতিহত করার যে দায়িত্ব তোমাদের দেয়া হয়েছে তা পালনে সচেষ্ট হও। এ বিষয়ে কথা ও কাজের মাধ্যমে যত প্রকার ভালো কাজ আছে তা পালনে তোমরা একত্র হও এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ কর। আল্লাহর বড়ত্বের প্রতি সম্মান, তার নির্দেশের আনুগত্যতা, আমাদের নবীর আদর্শের অনুকরণ, আল্লাহর নিকট ছাওয়াব ও বিনিময়ের আশা এসব কোন কিছুই যেন তোমাদের থেকে বিচ্যুত না হয়। আল্লাহর আযাব হতে মুক্তি পেতে হলে, তোমরা কোন ক্রমেই তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন হতে পিছ পা হবে না। মনে রাখতে হবে তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বকে খাট করে দেখার কোনই অবকাশ নাই। বরং তোমাদের দেয়া দায়িত্বের গুরুত্ব অধিক। দায়িত্বের তুলনায় তোমরা যে চেষ্টা ব্যয় করে থাক তা খুবই নগণ্য। এ চেষ্টা দিয়ে তোমরা তোমাদের লক্ষ্যে পৌছতে পারবে না।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য আমাদের উপর অর্পিত যাবতীয় দায় দায়িত্বকে সহজ করে দিও। আমি আমার এ নিবন্ধের দ্বারা একমাত্র তোমাদের সংশোধন করতে এবং তোমাদের মধ্যে অনুভূতিকে জাগ্রত করতে চেষ্টা করছি। তাওফীক দাতাতো একমাত্র আল্লাহ। আমরা তার উপরই একমাত্র তাওয়াক্কুল করি এবং তার দিকেই আমাদের ফিরে যাওয়া।
[1] ইহইয়ায়ু উলূমিদ্দিন: ২/২০৬।