রিযকের হ্রাস-বৃদ্ধি আল্লাহর ইচ্ছাধীন
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿قُلۡ إِنَّ رَبِّي يَبۡسُطُ ٱلرِّزۡقَ لِمَن يَشَآءُ وَيَقۡدِرُ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٣٦﴾ [سبا: ٣٦]
“বল, আমার রব যার জন্য ইচ্ছা রিযিক প্রশস্ত করেন অথবা সঙ্কুচিত করেন। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।” [সূরা সাবা, আয়াত: ৩৬]
আল্লাহ তা‘আলা নিজ বান্দাদের পরীক্ষা ও পরখ করার জন্য রিযিক বৃদ্ধি বা হ্রাস করেন। রিযিক বৃদ্ধি যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রমাণ নয়, অনুরূপ রিযকের সংকীর্ণতা তার অসন্তুষ্টির কারণ নয়। অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়টি জানে না। দুনিয়ার সচ্ছলতা কারো শুভ লক্ষণের দলীল নয়; কারণ আখেরাতের সাফল্য নির্ভর করে নেক আমলের ওপর, যা চিরস্থায়ী ও চিরকাল। দুনিয়াতে কখনো আল্লাহ অবাধ্যকে দেন সচ্ছলতা, অনুগতকে দেন সংকীর্ণতা। আবার কখনো এর বিপরীত করেন। কখনো উভয়কে সচ্ছলতা দেন, কখনো দেন সংকীর্ণতা। কখনো অবাধ্য বা আনুগত্য একই ব্যক্তিকে এক সময় দেন সচ্ছলতা, অপর সময় দেন অস্বচ্ছলতা। এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন আল্লাহ তা‘আলা নিজ প্রজ্ঞা ও হিকমতের ভিত্তিতে। যদি সচ্ছলতা সম্মান ও আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রমাণ হতো, তাহলে এর অধিকারী একমাত্র অনুগতরাই হতো, অবাধ্যরা কখনো এর স্বাদ পেত না। আর যদি সংকীর্ণতা অপমান ও আল্লাহর গোস্বার কারণ হতো, তাহলে অবাধ্যরা সদা সংকীর্ণতা ভোগ করত; অথচ বাস্তব এমন নয়। সারকথা, সচ্ছলতা বা সংকীর্ণতা অবাধ্য বা অনুগত উভয়ের জন্যই সমান।
কতক কাফির সচ্ছলতাকে সামনে রেখে তাদের পক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রমাণ পেশ করেছে, তারা বলতো, ‘যদি আমাদের ওপর আল্লাহর অনুকম্পা না হতো, তাহলে তিনি আমাদেরকে সচ্ছলতা দিয়ে সম্মানিত করতেন না। হে রাসূলের অনুসারীগণ, আল্লাহর নিকট তোমরা তুচ্ছ বলেই বঞ্চিত।’ বস্তুত সচ্ছলতা বা অস্বচ্ছলতা শুভ লক্ষণ বা অশুভ কোনো লক্ষণ নয়, হতভাগা বা সৌভাগ্যবান হওয়ারও কোনো আলামত নয়। এ পার্থিব জগতে অনেক সচ্ছল ব্যক্তি বিদ্যমান যারা হতভাগা, আবার অনেক অসচ্ছল ব্যক্তি রয়েছে যারা সৌভাগ্যবান। অধিকাংশ লোকই তা জানে না। অভাব, অস্বচ্ছলতা, প্রবৃদ্ধি, সচ্ছলতা ইত্যাদি আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। নেককার বা বদকার বলে কোনো বিষয় নেই। সম্মান ও মর্যাদার কারণে যেমন কাউকে সচ্ছলতা প্রদান করা হয় না, আবার হীন ও তুচ্ছতার কারণে কাউকে অভাব দেওয়া হয় না। সচ্ছলতা কখনো অবকাশ ও সুযোগ হিসেবে প্রদান করা হয়, অস্বচ্ছলতা কখনো মর্যাদা বৃদ্ধি ও পরীক্ষামূলক দেওয়া হয়।
ইমাম তাবারি বলেছেন: দাম্ভিক কাফিররা আল্লাহর নবী ও রাসূলদের বলেছে: ‘তোমাদের তুলনায় আমাদের সম্পদ ও সন্তান অধিক, আমাদেরকে আখেরাতে আযাব দেয়া হবে না; কারণ আল্লাহ যদি আমাদের বর্তমান ধর্ম ও আমলের উপর সন্তুষ্ট না হতেন, তাহলে আমাদেরকে তিনি অধিক সম্পদ ও সন্তান দান করতেন না, রিযিকের ব্যাপারে স্বচ্ছলতা দিতেন না। তাই আল্লাহ আমাদেরকে যা দিয়েছেন তা এ জন্যই যে, তিনি আমাদের আমলের উপর সন্তুষ্ট, আমরা তার প্রিয় পাত্র।’ আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেন: হে মুহাম্মদ তাদেরকে বলুন: নিশ্চয় আমার রব তার বান্দাদের থেকে যার জন্য ইচ্ছা রিযিক বৃদ্ধি করেন, আর যার ওপর ইচ্ছা তিনি সংকীর্ণ করেন। মহব্বত, কল্যাণ কিংবা নৈকট্যের কারণে কাউকে তিনি ধন দৌলত প্রদান করেন না, আবার অসন্তুষ্টি ও গোস্বার কারণে তিনি কারো ওপর রিযিকের সংকীর্ণতা করেন না। শুধু পরীক্ষার জন্য কাউকে প্রদান করেন, করো থেকে ছিনিয়ে নেন। অধিকাংশ লোক তা জানে না। এটা আল্লাহর একটা পরীক্ষা। তাদের ধারণা, প্রিয়পাত্র হলে তিনি সচ্ছলতা দেন, আবার গোস্বার পাত্র হলে তিনি অভাবে পতিত করেন।
আল্লামা শাওকানী বলেছেন: আল্লাহ যাকে অভাব দিতে চান, তার ওপর তিনি অভাব সৃষ্টি করেন। কখনো আল্লাহ কাফের ও অবাধ্যকে রিযিক প্রদান করে অবকাশ দেন, আবার কখনো তিনি মুমিন ও আনুগত্যকারীকে অভাবের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন, যেন তার সাওয়াব বৃদ্ধি পায়। কাউকে স্বচ্ছলতা দেওয়ার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তার ওপর ও তার আমলের প্রতি সন্তুষ্ট। আবার কাউকে অভাবে রাখার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট কিংবা তার আমল পরিত্যাজ্য। পার্থিব এসব বিষয় দ্বারা আখেরাতকে বুঝা ভুল ও স্পষ্ট বিভ্রান্ত।
সহীহ মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إنَّ اللّهَ لاَ يَنْظُرُ إلى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ ، ولكن يَنْظُرُ إلى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ».
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না। কিন্তু তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান।”
অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত যে, প্রয়োজনের চেয়ে অধিক সম্পদ দ্বারা খুব কম লোকই সুখী হয়েছে, তবে আল্লাহ যাকে হিফাযত ও সুরক্ষা দিয়েছেন তার কথা ভিন্ন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَوۡ بَسَطَ ٱللَّهُ ٱلرِّزۡقَ لِعِبَادِهِۦ لَبَغَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ﴾ [الشورا: ٢٧]
“আর আল্লাহ যদি তার বান্দাদের জন্য রিযিক প্রশস্ত করে দিতেন, তাহলে তারা জমিনে অবশ্যই বিদ্রোহ করত।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২৭]
সহীহ বুখারী ও অন্যান্য কিতাবে আবু যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: অধিক সম্পদের মালিকরা কিয়ামতের দিন অল্প সম্বলের মালিক হবে, তবে যে তার সম্পদ দ্বারা...এটা বা ওটা.. করে। হাদীস বর্ণনাকারী ইবন শিহাব সামনে, বামে ও ডানে হাত নেড়ে এর অর্থ বর্ণনা করেন। অর্থাৎ অধিক সদকাকারী। কিন্তু এদের সংখ্যা খুব কম।
ইবন মুবারক তার “রাকায়েক” কিতাবে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: শয়তান বলেছে: ধনীরা আমার তিনটি প্রতারণার একটিতে অবশ্যই পড়বে। আমি তার সামনে সম্পদ সুসজ্জিত করে রাখব, ফলে সে তার হক আদায় করবে না। অথবা আমি তার জন্য অপচয় ও অযথা খরচ করার রাস্তা উন্মুক্ত করে দেব। অথবা আমি তার কাছে সম্পদ প্রিয় করে দেব, ফলে সে তা অবৈধ পথেও উপার্জন করবে।