×
সমাজ সংস্কারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ: সমাজ সংস্কারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যায়ক্রমিকতার নীতি অবলম্বন করে চলেছেন। কেননা তাৎক্ষণিক কোনো কার্যক্রম চালিয়ে সমাজ সংস্কার অসম্ভব ব্যাপার। এর জন্য বরং প্রয়োজন পরিকল্পিত সার্বক্ষণিক মেহনত, কর্মতৎপরতা। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে এবিষয়টিকেই শিল্পিত আকারে তুলে ধরা হয়েছে।

 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমাজ সংস্কার

إصلاح النبي صلى الله عليه وسلم للمجتمع

শান্তি-কল্যাণ ও সহযোগিতাপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষায় মানব চরিত্রকে সংশোধন ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আবির্ভূত হন। তিনি সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে সংস্কার বাস্তবায়ন করেন তা আজো সারা বিশ্বের শত কোটি মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আর্বিভাব পূর্বকালীন সময়ের মানুষের অপকর্মের বর্ণনায় ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “তাদের আচরণে শয়তানও লজ্জা পেত!” সে সময় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে ভয়াবহ ও বিশৃংখল অবস্থা বিরাজ করছিল। ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবনে ছিল চরম নৈরাজ্য, এজন্য ঐ সময়কে বলা হয় আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা মূর্খতার যুগ।

ধর্মীয় ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে হতাশা-অনিশ্চয়তার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ধূলির ধরায় আগমন মহান আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষ। আল-কুরআনের ভাষায়-

﴿ لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ ﴾ [ال عمران: ١٦٤] 

“মু’মিনদের প্রতি আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ, তিনি তাদের প্রতি তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল পাঠিয়েছেন যিনি তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন (শিরক কুফর থেকে) এবং তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ও সুন্নাহের প্রজ্ঞা শিক্ষা দান করেন।” [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৬৪]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্বনবী, তাই কল্যাণ ও মুক্তির নিশ্চিত পথ দেখানো ছিল তাঁর প্রতিটি কর্ম, বাণী ও অবস্থানগত তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য। সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাঁর তৎপরতা সামষ্টিকভাবেই নিয়ে আসে গুণগত পরিবর্তন ও চমৎকার স্বস্তির পরিবেশ। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার সম্পর্কে অবহিত হওয়া আমাদের ঈমানী কর্তব্য।

ইসলাম-পূর্ব যুগে সমাজে গোত্রে গোত্রে কলহ, নিন্দা, হানাহানি ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। কবির লড়াই, উটের দৌড়, পবিত্র মাসের অবমাননা ইত্যাদি বিচিত্র কারণেই সহসা শুরু হয়ে যেত রক্তারক্তি কান্ড। গৃহপালিত পশু, পানির ঝর্ণা, নারী লুণ্ঠন, এমনকি তুচ্ছ ঘটনায় বচসা থেকে বিদ্রোহ এবং বিরাট লড়াই একবার শুরু হলে তা চলত বছরের পর বছর আর যুগ যুগান্তরের পরিক্রমায়। যাকে ‘আইয়ামুল আরব’ বলা হত। একমাত্র বাসুসের যুদ্ধ চলে ৪০ বছর আর এতে মারা যায় ৭০০০০ লোক।

আউস, খাযরাজ, হাওয়ালিন ইত্যাদি গোত্রগুলো ছিল সার্বক্ষণিক যুদ্ধে লিপ্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ যুদ্ধবাজ জাতিকে শান্তির পতাকাতলে সমবেত করেন। আল্লাহ বলেন-

﴿ إِذۡ كُنتُمۡ أَعۡدَآءٗ فَأَلَّفَ بَيۡنَ قُلُوبِكُمۡ فَأَصۡبَحۡتُم بِنِعۡمَتِهِۦٓ إِخۡوَٰنٗا ﴾ [ال عمران: ١٠٣] 

“তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু; অতঃপর তিনি তোমাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করে দিলেন আর তোমরা হয়ে গেলে পরস্পর ভাই ভাই।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বকালে নৈতিক স্খলন, অনাচার, মদ, জুয়া, সুদ, ব্যভিচার, চুরি, হত্যাকান্ড, নারী হরণ, চরিত্রহনন ইত্যাদিতে সমাজ ছিল কলুষিত। বিধবা-বিমাতা বিয়ে, সুদ আদায়ে অপারগ গ্রহীতার স্ত্রী-সন্তানকে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি, বিজয়ী সেনাদেরকে বিজিত গোত্রের নারীদের অবাধে দেহদান ইত্যাদি ছিল এক পৈশাচিক নারকীয় আনন্দের ব্যাপার। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সকল অপরাধ দমনের জন্য আল-কুরআনের শিক্ষার বাস্তবায়ন করেন। ব্যভিচারের জন্য একশত বেত্রাঘাত, চুরির অপরাধে হাতকাটাসহ মদ, জুয়া, হত্যাকান্ড ইত্যাদির বিরুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর-কঠিন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ফলে অপরাধমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের ঘোষণা হলো-

﴿ وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلزِّنَىٰٓۖ ﴾ [الاسراء: ٣٢] 

‘তোমরা ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেও না।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩২]

 আল্লাহ আরো বলেন-

﴿ وَمَن يَقۡتُلۡ مُؤۡمِنٗا مُّتَعَمِّدٗا فَجَزَآؤُهُۥ جَهَنَّمُ خَٰلِدٗا فِيهَا وَغَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ وَلَعَنَهُۥ وَأَعَدَّ لَهُۥ عَذَابًا عَظِيمٗا ٩٣ ﴾ [النساء: ٩٣] 

“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো মু’মিনকে হত্যা করে তার শাস্তি হলো জাহান্নাম, যাতে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত করবেনএবং তার জন্য ভয়াবহ আযাবতৈরী করে রাখবেন।” [সূরা আল-নিসা, আয়াত: ৯৩]

 আল-কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা-

﴿ وَٱلسَّارِقُ وَٱلسَّارِقَةُ فَٱقۡطَعُوٓاْ أَيۡدِيَهُمَا ﴾ [المائ‍دة: ٣٨] 

“চোর-চোরনীর হাত কেটে দাও।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩৮]

 মহান আল্লাহ আরো বলেন-

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠ ﴾ [المائ‍دة: ٩٠] 

“হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ্যপান, জুয়া খেলা, মূর্তি, লটারী, নিশ্চয়ই এগুলো শয়তানের কাজ। এগুলো থেকে বিরত থাক; যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৯০]

প্রাচীন আরবে জীবিত শিশু কন্যাকে কবর দেয়া হত। কেননা তখন কন্যা সন্তান জন্মকে কলঙ্কজনক বিষয় মনে করা হত। কুরআনের ভাষায়-

﴿ وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِٱلۡأُنثَىٰ ظَلَّ وَجۡهُهُۥ مُسۡوَدّٗا وَهُوَ كَظِيمٞ ٥٨ ﴾ [النحل: ٥٨] 

“আর যখন তাদেরকে কন্যা সন্তানের সংবাদ দেওয়া হত; তখন ক্ষোভ-অপমানে তাদের মুখমণ্ডল অন্ধকার হয়ে যেত।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৮]

এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের আরো কঠোর উচ্চারণ রয়েছে-

﴿ بِأَيِّ ذَنۢبٖ قُتِلَتۡ ٩ ﴾ [التكوير: ٩] 

“কোন অপরাধে তাদের হত্যা করা হয়েছিল?” [সূরা আত-তাকবীর, আয়াত: ৯]

 তাই এ ধরনের মানবতাবিরোধী তৎপরতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন।

 মহান আল্লাহর নির্দেশ –

﴿ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَوۡلَٰدَكُمۡ خَشۡيَةَ إِمۡلَٰقٖۖ ﴾ [الاسراء: ٣١] 

“তোমরা তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩১]

অন্ধকার যুগে দাস-দাসীকে পশু, গৃহস্থালী সামগ্রীর ন্যায় বিক্রি করা হতো এবং তাদের প্রতি নিমর্ম ব্যবহার করা হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন এবং অপরাধের কাফ্‌ফারা হিসেবেও তিনি দাস মুক্তির ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। চির নিগৃহীত বিলাল, যায়েদ, সালমান ফারসি, সুহাইল রুমী রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

ইসলাম পূর্বকালে নারীকে নরের অধীন ও ভোগের সামগ্রী মনে করা হত। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে স্ত্রীর মর্যাদায় মোহরানা ও উত্তরাধিকারের দাবীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রাচীনপন্থীরা মনে করত ‘নারী’- ওরা যেন মানুষ নয় কেবলই মেয়ে মানুষ। উটের দৌড়ের সময় উটের লেজের সাথে মেয়েদেরকে বেঁধে দেয়া হত আর নগ্ন দেহবল্লবীর বিভৎসতা ও আর্ত-চিৎকারে ঐ পিশাচেরা আনন্দ পেত। এহেন অবস্থার পরিবর্তন সাধনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেন-

﴿ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧] 

“তারা তোমাদের ভূষণ তোমরা তাদের ভূষণ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭]

বিদায় হজ্জে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

«اتَّقُوا اللَّهَ فِي النِّسَاءِ، فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوهُنَّ بِأَمَانَةِ اللَّهِ»

“তোমরা নারী জাতির (অধিকারের) ব্যাপারে সতর্ক হও। কেননা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ”[1]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-

فَإِنَّ الْجَنَّةَ عِنْدَ رِجْلِهَا

“মায়ের পায়ের কাছে সন্তানের জান্নাত”[2]

তৎকালে এতিম, মিসকিনদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। এতিমের মাল লুটেপুটে খাওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের ভাষায় ঘোষণা করেন-

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ أَمۡوَٰلَ ٱلۡيَتَٰمَىٰ ظُلۡمًا إِنَّمَا يَأۡكُلُونَ فِي بُطُونِهِمۡ نَارٗاۖ وَسَيَصۡلَوۡنَ سَعِيرٗا ١٠ ﴾ [النساء: ١٠] 

“নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে অনাথদের সম্পদ ভোগ করে তারা নিজেদের পাকস্থলীকে অগ্নি দ্বারা পূর্ণ করে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০]

প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থায় আরবের মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন তথা মানুষের ন্যূনতম অধিকারকে স্বীকার করা হত না। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইসলামি জীবনবোধ প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও মানুষের সার্বিক অধিকার-কর্তব্যকে ঈমানের পূর্ণতার সাথে সংশ্লিষ্ট করে। সমাজে উঁচু-নিচু, শ্রেণীতে ভেদাভেদ, কৌলিন্যের অংহকার, হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা ইত্যাদি ছিল প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার উপাদান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাম্যের নীতির মাধ্যমে নিছক জন্মগত প্রাধান্য ও বৈষম্যের প্রাচীর অতিক্রম করেন।

অন্যদিকে ইসলাম কর্মবিমুখিতাকে সমর্থন করে না। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ছিল- ‘করো না ভিক্ষা’।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ سَأَلَ وَلَهُ مَا يُغْنِيهِ، جَاءَتْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ خُمُوشٌ، أَوْ خُدُوشٌ، أَوْ كُدُوحٌ فِي وَجْهِهِ»

“যে ব্যক্তি ধনী হওয়া সত্ত্বেও হাত পাতে সে কিয়ামতে উপস্থিত হবে এমন অবস্থায় যে, তার মুখমন্ডলে গোশত থাকবে না”[3]

অনুরূপভাবে দেহগত বৈশিষ্ট্য ও বর্ণগত কারণে মানুষে মানুষে কৃত্রিম বিভাজন ইসলাম সমর্থন করে না। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-‘সাদার উপর কালোর এবং কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন-

»وَأَطْعِمُوا الجَائِعَ، وَعُودُوا المَرِيضَ»

“ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও; রুগ্নের সেবা কর।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০৪৬)

মূলত: মুনাফিকী, মিথ্যাচার, পরচর্চা, পরনিন্দা, অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি নৈতিক ত্রুটিসমূহ ত্যাগ করে পরকালের ভয় অন্তরে লালন করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। বক্তব্য ও ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতাহীন সমাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গালাগালিকে গলাগলিতে, হাতাহতিকে করমর্দনে রূপান্তরিত করেন। সামাজিক জীবনে পূর্ণ শান্তির দিকনির্দেশনা দিয়ে বিদায় হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন-

« أَلَا وَإِنَّ أَمْوَالَكُمْ، وَدِمَاءَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ شَهْرِكُمْ هَذَا، فِي بَلَدِكُمْ هَذَا، فِي يَوْمِكُمْ هَذَا»

“জেনে রাখ, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের রক্ত তোমাদের জন্য পবিত্র, যেমন সম্মানিত তোমাদের এ মাস, তোমাদের এই নগরীতে ও তোমাদের এই দিনে”[4]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বনবী, সবার নবী, কেননা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামকে বিশ্ব ধর্ম তথা সবার ধর্ম হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। শিরক, কুফর, নিফাক ও বিদআতের স্বর্গরাজ্যে আরব ভূখন্ডে ইসলাম প্রচারের পূর্বে ধর্মীয় রীতিতে ছিল পৌত্তলিকতা, ইহুদি, নাসারা বা খ্রীষ্টান মতের প্রাধান্য। এছাড়া ছিল “সাবেইন” নামক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, যারা তারকা বা অগ্নি পূজক বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে অল্প সংখ্যক একেশ্বরবাদী-অদৃশ্যে বিশ্বাসী হানিফ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। এরা নিজেদেরকে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অনুসারী বলে মনে করত- যদিও তা স্পষ্ট নয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, তৎকালীন সকল মত পথ মানব মুক্তির সহায়ক ছিল না। তাই একজন ত্রাণকর্তার আগমন ছিল বিশ্ববাসীর অত্যন্ত প্রত্যাশিত বিষয়। ঐতিহাসিক আমির আলীর ভাষায়- “পৃথিবীর ইতিহাসে পরিত্রাণকারী আর্বিভাবের এত বেশি প্রয়োজন এবং উপযুক্ত সময় অন্যত্র কখনো অনুভূত হয়নি।”

সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে আর্বিভূত হন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিবিধ বিশ্বাস ও বিভক্ত মানবজাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দানের জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামকে আল্লাহ মনোনীত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। আল-কুরআনের ভাষায়-

﴿ إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ﴾ [ال عمران: ١٩] 

“নিশ্চয়ই আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম- ইসলাম।” [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৯]

 ইসলামের মর্মবাণী হলো, তাওহীদ ও রিসালতে বিশ্বাস। পৌত্তলিকতা বা বহুত্ববাদের স্থান ইসলামে নেই। আল-কুরআনের নির্দেশ হলো-

﴿ ۞وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ ﴾ [النساء: ٣٦] 

“আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করো না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬]

অন্যত্র আল্লাহ বলেন-

﴿ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣ ﴾ [لقمان: ١٣] 

“শিরক জঘন্যতম অন্যায়।” [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৩]

ইসলাম ধর্ম পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষায়-

«بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ»

“ইসলাম ধর্ম পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দান করা, হজ পালন করা, রমযান মাসে সাওম পালন করা”[5]

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একমাত্র ধর্মভীরুতা বা তাকওয়াকে মানব মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে স্থির করেছেন। পুরোহিত প্রথা, বৈরাগ্যবাদ ইত্যাদি ভ্রান্ত চেতনা খন্ডন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের কর্মময় জীবনকে পরকাল চিন্তা ও জবাবদিহিতার মানদণ্ডে নির্ধারণ করেছেন। পবিত্র কুরআনের বাণী দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন-

﴿ فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨ ﴾ [الزلزلة: ٧،  ٨] 

“যে সামান্য পূণ্য নিয়ে উপস্থিত হবে সে তার প্রতিদান পাবে আর যে বিন্দু মাত্র পাপ করবে সেও তার প্রতিফল ভোগ করবে।” [সূরা আয-যিলযাল, আয়াত: ৭-৮]

ধর্মীয় সুবিধাবাদের নামে ভন্ডামী, লেজুড়বৃত্তি, মিথ্যা, প্রতারণা, কুট-কৌশল, ছল-চাতুরি, বর্ণচোরা ভাব ইত্যাদি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধর্মীয় শিক্ষার পরিপন্থী। এ জন্যই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ فِي ٱلدَّرۡكِ ٱلۡأَسۡفَلِ مِنَ ٱلنَّارِ ﴾ [النساء: ١٤٥]

“মুনাফিকের আবাসস্থল জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪৫]

অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্ম দর্শনে আল্লাহর ইবাদত ও মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে অভিন্ন মাত্রায় বিবেচনা করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন-

﴿ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلۡمَوۡتَ وَٱلۡحَيَوٰةَ لِيَبۡلُوَكُمۡ أَيُّكُمۡ أَحۡسَنُ عَمَلٗاۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡغَفُورُ ٢ ﴾ [الملك: ٢] 

‘তিনিই মানুষের জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন কে সৎকর্ম করে তা পরীক্ষা করার জন্য।” (সূরা আল-মুলক, আয়াত: ২)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধর্মীয় শিক্ষার আরো একটি দিক হলো তিনিই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বিশ্বনবী। পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের অংশ। অন্যদিকে ধর্মীয় সাম্য ও সম্প্রীতি হলো ইসলামের অঙ্গীকার। বলপ্রয়োগে ইসলাম পালনে বাধ্য করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ নয়। বরং শান্তি ও সৎচরিত্রের মাধুর্যে অন্যকে কাছে টানা হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বৈশিষ্ট্য। কেননা পবিত্র কুরআনের নীতি হলো-

﴿ لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ ﴾ [البقرة: ٢٥٦] 

“ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৬]

মূলতঃ পবিত্র কুরআন ও হাদিসের কল্যাণকর শিক্ষা আর অনুপম আদর্শের আলোকে আলোকিত মানুষ গড়া হলো ইসলামের উদ্দেশ্য এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তৎপরতার লক্ষ্য। এ জন্যই বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেন-

«تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ»

“আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি যার অনুসরণ করলে তোমরা কখনো বিভ্রান্ত হবে না। (জিনিস দু’টি হচ্ছে-) আল্লাহর কিতাব এবং তাঁরই নবীর সুন্নাহ”[6]

বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ধর্মীয় আদর্শের অন্যতম দিক “খতমে নবুয়ওত”। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দীন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল- এ কথায় বিশ্বাস করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। কেননা পবিত্র কুরআনে তাকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বলা হয়েছে। আর সমগ্র কুরআন মজিদই হলো খতমে নবুওয়তের প্রমাণ।

পরিশেষে বলা যায় শান্তি ও কল্যাণের পথই হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও সংস্কারের মূল চেতনা। যুগ ও কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার বিশ্ব মানবতার একমাত্র পাথেয়। তাই জর্জ বার্নার্ড শ’ যথার্থই বলেছেন-

“অনাগত আগামীতে সকল ধর্ম ও বিশ্বাস তার কার্যকারিতা হারাবে কিন্তু মুহাম্মদ প্রচারিত বিশ্বাসের মধ্যে মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পাবে।”

মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ পরিপূর্ণ রূপে পালন করার শক্তি দান করুন। আমীন!

সমাপ্ত



[1] সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ১৯০৫

[2] হাসান সনদে মুসনাদ ইমাম আহমাদ, হাদীস নং ১৫৫৩৮

[3] সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ১৬১৯

[4] সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০৫৭

[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬

[6] মুআত্তা মালেক, হাদীস নং ৩৩৩৮