বিজ্ঞান ও কুরআনে মানুষের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
বিজ্ঞান ও কুরআনে মানুষের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর
الجنين ونشأة الإنسان بين العلم والقرآن
< بنغالي >
ড. শরীফ কাফফুল গাযাল
অনুবাদক: মুহাম্মদ ইসমাইল জাবীহুল্লাহ
সম্পাদক:
মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
د. شريف كف الغزال
ترجمة: محمد إسماعيل ذبيح الله
مراجعة:
محمد شمس الحق صديق
د/ أبو بكر محمد زكريا
বিজ্ঞান ও কুরআনে মানুষের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর
কুরআন মাজীদ মানুষের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর নিয়ে আলোচনা করেছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:
﴿وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ مِن سُلَٰلَةٖ مِّن طِينٖ ١٢ ثُمَّ جَعَلۡنَٰهُ نُطۡفَةٗ فِي قَرَارٖ مَّكِينٖ ١٣ ثُمَّ خَلَقۡنَا ٱلنُّطۡفَةَ عَلَقَةٗ فَخَلَقۡنَا ٱلۡعَلَقَةَ مُضۡغَةٗ فَخَلَقۡنَا ٱلۡمُضۡغَةَ عِظَٰمٗا فَكَسَوۡنَا ٱلۡعِظَٰمَ لَحۡمٗا ثُمَّ أَنشَأۡنَٰهُ خَلۡقًا ءَاخَرَۚ فَتَبَارَكَ ٱللَّهُ أَحۡسَنُ ٱلۡخَٰلِقِينَ ١٤﴾ [المؤمنون: ١٢، ١٤]
“আর আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির সারাংশ থেকে। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে একটি নতুনরুপে দাড় করিয়েছি। সুতরাং নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা কতই না কল্যাণময়।" [সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ১২-১৪]
আরবি الْعَلَقَةَ (আলাকা) শব্দের তিনটি অর্থ রয়েছে। যথা:
১. জোক
২. সংযুক্ত জিনিস
৩. রক্তপিণ্ড
আমরা যদি জোককে গর্ভস্থ সন্তানের সাথে মেলাতে যাই তাহলে, আমরা দু'টির মধ্যে সামঞ্জস্য দেখতে পাই। নিচের ১নং ছবিতে সেটা স্পষ্ট।[1]
এ অবস্থায় জোক যেমন অন্যের রক্ত খায় তেমনি উক্ত ভ্রুন তার মায়ের রক্ত খেয়ে বেচে থাকে।[2]
দ্বিতীয় অর্থের আলোকে আমরা যদি তাকে 'সংযুক্ত জিনিস' অর্থে নিই তাহলে দেখতে পাই যে, গর্ভস্থ ভ্রুন মায়ের গর্ভের সাথে লেপ্টে আছে। (২নং ও ৩ নং চিত্র দ্রষ্টব্য)
তৃতীয় অর্থের আলোকে আমরা উক্ত শব্দের 'রক্তপিণ্ড' অর্থ গ্রহণ করলে দেখতে পাব যে, তার বাহ্যিক অবস্থা ও তার সংরক্ষিত খাচা (আবরণ) রক্তপিণ্ডের মতোই দেখায়। উক্ত অবস্থায় এখানে প্রচুর পরিমাণ রক্ত বর্তমান থাকে।[3] (৪র্থ চিত্র দ্রষ্টব্য)
এতদসত্বেও তিন সপ্তাহ পর্যন্ত এ রক্ত সঞ্চালিত হয় না।[4] সুতরাং বলা যায় যে, এ অবস্থা রক্তপিণ্ডের মতোই।
চিত্র-১
চিত্রে জোক ও মানব ভ্রুনকে একই রকম দেখা যাচ্ছে।
(জোকের ছবিটি কুরআন-হাদীসের আলোকে মানব দেহের প্রবৃদ্ধি –মুর ও অন্যান্য, গ্রন্থের ৩৭ নং পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে যা হিলমান ও অন্যান্যদের প্রণিত “পুর্ণাংগ মৌলিক জীব" গ্রন্থ থেকে সংশোধিত হয়েছে এবং মানব দেহের চিত্রটি মানবদেহের প্রবৃদ্ধি, ৫ম সংস্করণ, ৭৩ পৃষ্ঠা হতে নেওয়া হয়েছে)
চিত্র-২
এ চিত্রে দেখা যাচ্ছে উক্ত ভ্রুনটি মায়ের গর্ভের সাথে লেপ্টে রয়েছে। (চিত্রটি মানবদেহের প্রবৃদ্ধি, ৫ম সংস্করণ, ৬৬ পৃষ্ঠা হতে নেওয়া হয়েছে)
চিত্র-৩
এ চিত্রে দেখা যাচ্ছে B চিহ্নিত ভ্রুনটি মাতৃগর্ভে লেপ্টে আছে। এর বয়স মাত্র ১৫ দিন। আয়তন ০.৬ মি.মি. (চিত্রটি মানবদেহের প্রবৃদ্ধি, ৩য় সংস্করণ, ৬৬ পৃষ্ঠা হতে নেওয়া হয়েছে, যা সংকলিত হয়েছে লেসন এন্ড লেসনের হিস্টোলজী গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে)
চিত্র-৪
এ চিত্রে দেখা যাচ্ছে ভ্রুন ও তার আবরণকে প্রচুর রক্ত থাকার কারণে রক্ত পিণ্ডের মতোই দেখাচ্ছে। (চিত্রটি মানবদেহের প্রবৃদ্ধি, ৫ম সংস্করণ, ৬৫ পৃষ্ঠা হতে নেওয়া হয়েছে)
উক্ত 'আলাকা' শব্দের তিনটি অর্থের সাথেই ভ্রুনের বিভিন্ন স্তরের গুণাবলী হুবহু মিলে যাচ্ছে।
কুরআন মাজীদের আয়াতে উল্লিখিত ভ্রুনের ২য় স্তর হলো مُضْغَةً (মুদগাহ)। مُضْغَةً হলো চর্বিত দ্রব্য। যদি কেউ ১ টুকরা চুইংগাম নিয়ে দাঁতে চর্বন করার পর তাকে ভ্রুনের সাথে তুলনা করতে যায় তাহলে দেখতে পাবে যে, দাঁতে চর্বন করার পর উক্ত দ্রব্য যেমন দেখায় সেটার সাথে ভ্রুনের হুবহু মিল রয়েছে।[5] (৫ ও ৬ নং চিত্র দ্রষ্টব্য)
আজ বিজ্ঞানীরা মাইক্রোস্কোপসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে এগুলো আবিস্কার করেছে কুরআন নাযিল হওয়ার দেড় হাজার বছর পর। তাহলে এত কিছু জানা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য কেমন করে সম্ভব ঐ সময়ে যখন এ সবের কিছুই আবিস্কৃত হয় নি?
চিত্র-৫
এ চিত্রটি ২৮ দিন বয়সের (মুদগাহ স্তরের) ভ্রুনের চিত্র। উক্ত চিত্রটি দাত দ্বারা চর্বিত চুইংগামের মতোই দেখাচ্ছে। (চিত্রটি মানবদেহের প্রবৃদ্ধি, ৫ম সংস্করণ, ৭২ পৃষ্ঠা থেকে নেওয়া হয়েছে)
চিত্র-৬
চিত্রে চুইংগাম ও ভ্রুনের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। আমরা উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য দেখতে পাই। উপরের চিত্র A তে আমরা ভ্রুনের গায়ে দাঁতের মত চিহ্ন এবং চিত্র B তে চর্বিত চুইংগাম দেখতে পাচ্ছি।
১৬৭৭ খৃষ্টাব্দে হাম ও লিউয়েনহোক নামক দুই বিজ্ঞানী মাইক্রোস্কোপ দিয়ে মানুষের বীর্যের মধ্যে জীবনের অস্তিত্ব (Spermatozoma) খুজে পান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগের এক সহস্রাধিক বছর পর। এ দুইজন বিজ্ঞানীই আগে ভুলক্রমে বিশ্বাস করেছিলেন যে, মানুষের বীর্যের মধ্যে উক্ত কোষের রয়েছে অতি সামান্য প্রক্রিয়া। নারীর ডিম্বানুতে আসার পর তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।[6]
আর প্রফেসর কেইথ এল. মুর বিশ্বের একজন প্রসিদ্ধ ভ্রুন বিজ্ঞানী এবং “মানবদেহের প্রবৃদ্ধি" গ্রন্থের লেখক; যা বিশ্বের আটটি ভাষায় ছাপা হয়েছে। এটি বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স বই। এ বইটি আমেরিকার বিশিষ্ট একটি গবেষণা বোর্ড কর্তৃক কোনো একক লেখকের শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
কেইথ এল. মুর হচ্ছেন কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীর বিদ্যা ও কোষ বিভাগের প্রফেসর। তিনি ওখানে মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অধীনে মৌলিক বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী ডীন হিসেবে এবং আট বছর শরীর বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি কানাডায় শরীর বিদ্যা বিভাগের ওপর কৃতিত্বপূর্ণ স্বাক্ষর রাখার জন্য কানাডার শরীর বিদ্যা বোর্ডের পক্ষ থেকে J.C.B পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি “কানাডিয়ান এন্ড এমেরিকান এসোসিয়শন এবং দি কাউন্সিল অফ দি ইউনিয়ন অফ বাইয়োলজিকাল সাইন্স" সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৮১ সালে সউদীর দাম্মামে অনুষ্ঠিত এক মেডিক্যাল সেমিনারে তিনি বলেন: আমার জন্য এটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল যে, আমি মানব শরীরের প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে ভালোভাবে জানতে কুরআন মাজীদের সহায়তা নিতাম। আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, এ বিষয়গুলো আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। কেননা, এ সকল বিষয়ের প্রায় সব কিছুই তার মৃত্যুর কয়েকশত বছর পর আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ব্যাপারটি প্রমাণ করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার সত্য নবী।[7]
এ সময় তাকে প্রশ্ন করা হল, তাহলে কি এর অর্থ দাঁড়ায় -কুরআন আল্লাহ তা'আলার বাণী? তিনি জবাব দিলেন: “আমি এ কথা মেনে নিতে কুন্ঠাবোধ করি না।"
প্রফেসর মুর একটি কনফারেন্সে বলেছিলেন: “কুরআন ও হাদীসে মানবভ্রুনের বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার সময়কার বিভিন্ন স্তরকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিভিন্ন নামে ভাগ করেছে।" এর পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত চমৎকার ও বিস্তৃত অর্থ নির্দেশ করে থাকে। যা আধুনিক শরীর বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারের সাথে সংগতিপূর্ণ। বিগত চার বছরে সপ্তম শতাব্দীতে নাযিলকৃত কুরআন ও হাদীসের আলোকে মানবভ্রুন নিয়ে গবেষণা করে বিস্ময়কর ফলাফল পাওয়া গেছে।
এরিস্টটল ভ্রুন বিদ্যার জনক হওয়া সত্বেও খ্রিস্টপুর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মুরগীর ডিমের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন যে, মুরগীর বাচ্চার সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় কয়েকটি স্তরে। তবে তিনি স্তরগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছুই জানাতে পারেন নি। ধরে নেওয়া যায় যে, কুরআন নাযিলের সময় খুব কমই জানা ছিল ভ্রুনের স্তরগুলো সম্বন্ধে যা সপ্তম শতাব্দীতে বিজ্ঞানের কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করে তা জানার সুযোগ ছিল না।
এখানে এসে শুধু একটি মাত্র নির্ভরযোগ্য ফলাফলে আসা যায় যে, এ সমস্ত জ্ঞান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসেছে একমাত্র আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে। কারণ, তিনি ছিলেন নিরক্ষর তার এগুলো জানার কথা ছিল না। এছাড়া অন্য কোথাও থেকে তার মতো নিরক্ষর লোককে যে ট্রেনিং দেওয়া হবে তাও ছিল অসম্ভব।[8]
সমাপ্ত
[1] মানবদেহের প্রবৃদ্ধি-মুর ও পারসাউড, ৫ম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৮
[2] কুরআন-হাদীসের আলোকে মানব দেহের প্রবৃদ্ধি–মুর ও অন্যান্য পৃষ্ঠা-৩৬
[3] কুরআন-হাদীসের আলোকে মানব দেহের প্রবৃদ্ধি –মুর ও অন্যান্য পৃষ্ঠা-৩৭ ও ৩৮
[4] মানবদেহের প্রবৃদ্ধি-মুর ও পারসাউড, ৫ম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৬৫
[5] মানবদেহের প্রবৃদ্ধি, ৫ম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৮
[6] মানবদেহের প্রবৃদ্ধি-মুর ও পারসাউড, ৫ম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৯
[7] 'হাজিহী হিয়াল হাকিকাহ' তথা এটাই সত্য নামক ভিডিও ডকুমেন্টারী থেকে সংগৃহীত।
[8] ভিডিও ডকুমেন্টারী 'হাজিহী হিয়াল হাকীকাত'।