মসজিদকে কেন্দ্র করে আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
মসজিদকে কেন্দ্র করে আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে
دور المسجد في بناء المجتمع
< بنغالي >
চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ
أبو الكلام أزاد
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
মসজিদকে কেন্দ্র করে আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে
এদেশে সিংহভাগ লোক মুসলিম। মুসলিমগণ একতাবদ্ধ হয়ে কল্যাণকর কাজ করার জন্য এবং ইবাদত বন্দেগী করার লক্ষে মসজিদ তৈরি করে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন, কলেমা, সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত হচ্ছে দ্বীনের স্তম্ভ বা খুঁটি। খুঁটি ছাড়া যেমন ঘর তৈরি করা যায় না, তদ্ররুপ কলেমা, সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত আদায় না করলে মুসলিম হওয়া যায় না। আবার শুধু খুঁটি যেভাবে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় থেকে রেহাই দিতে পারে না তদ্রূপ শুধু সালাত, সাওম জাতীয় ইবাদত করলে মুসলিম হওয়া যায় না। ঘরের সুবিধা পেতে যে রকম খুঁটির সঙ্গে ছাউনি প্রয়োজন তদ্রূপ মুসলিম হতে গেলে সালাত সাওম পালনের সঙ্গে মানবিক ও নৈতিক গুণাবলী অর্জন করা দরকার। এসব হুকুমগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষার এক একটি বিষয় হিসাবে বিবেচনা করতে আবেদন জানাচ্ছি। কোনো বিষয়কে উপেক্ষা করে মুসলিম দাবি করা যাবে কি? যেমন, পরীক্ষার দশটি বিষয়ের ৯টিতেই লেটার নম্বর পেয়ে একটি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে কি?
বর্ণিত কল্যাণকর কাজসমূহের আলোচনা, আহ্বান, প্রেরণা ও তাগিদ দেওয়ার জন্যই মুসলিমদের মসজিদ। জামা'আতবদ্ধ হওয়ার কারণে অল্প সময়ে বেশি লোকের কাছে কল্যাণকর কাজের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ হয়। খেলাফতের শেষ সূর্য অস্তমিত হওযার পূর্ব পর্যন্ত মসজিদে কাতারবন্দী হয়ে সালাত পড়া ছাড়াও এটাই ছিল মুসলিমদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক-আধ্যাত্বিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল কাজের কেন্দ্রস্থল। কি দ্বীনি, কি বৈষয়িক মুসলিম মিল্লাতের স্বার্থে সকল প্রকার অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ের আলোচনা, পরামর্শ, সমাধান ও তাগিদ মসজিদেই সম্পন্ন হত। মসজিদ মুসলিম মিল্লাতের প্রাণকেন্দ্র। জুমু'আ তার স্পন্দন এবং খুৎবা তার জীবনীশক্তি। জীবনী শক্তির অভাব ঘটলে জুমু'আ হয় নিষ্কৃয়, মসজিদ হয় নিষ্প্রাণ। আর মুসলিম সমাজে সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে দাড়ায়। আজকে বাংলাদেশসহ সারা মুসলিম বিশ্বে মুসলিমদের দূরবস্থার কারণ হচ্ছে -মসজিদসমূহে জীবন যাপনের ইসলামি বিবিধ-বিধানের আলোচনার অনুপস্থিতি। সেসব বিষয়ে কোনো আলোচনা নাই, থাকলেও তা বত্রিশ দাঁতের এক দাঁত থাকার মত। তার দ্বারা না চিবিয়ে খাওয়া যায় না ছিড়ে খাওয়া যায়। যে আদর্শগুলো আজ আলোচনায় নেই তা ময়দান তথা জীবনাচারে আশা করতে পারি কীভাবে? জীবন যাপন পদ্ধতিতে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের আদর্শ সম্বন্ধে আলোচনা করতে আমাদের প্রতিবন্ধকতা কী? কে বাধা দিচ্ছে আমাদের? আমরা সালাত পড়ার আড়ালে কাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছি। মসজিদে প্রায় সকল মুসল্লিদের মনে এরকম ধারণা জন্মেছে যে, জীবনাচারের কোনো বিষয়ে আলোচনা করা যেন পাপের কাজ। মসজিদ হওয়া চাই চির জীবন্ত, মসজিদ হওয়া চাই প্রাণবন্ত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজ নিষেধ করেছেন, যে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন- সে কাজটিই বর্তমানে অনেক মসজিদে আমরা বাস্তবায়ন করে চলেছি। অনেক মসজিদের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ সালাতের আগে কোনো আলোচনা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সালাতের পরে কি আর মুসল্লি থাকে? এটা হচ্ছে আলোচনা এড়ানোর একটা কৌশলমাত্র। সপ্তাহের জুমু'আর দিনে কেবল এক ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে তথা জুমু'আর সালাতের পূর্বে শতকরা দু-একটি মসজিদে কিছু আলোচনা হয়ে থাকে, যা সমসাময়িক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তো নয়-ই, জীবন ও চরিত্র গঠনমূলকও নয়। কিচ্ছা, কাহিনী, দো'আ-মোনাজাত তথা ফযীলত সম্পর্কে কিছু আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকে। সপ্তাহে বাকি ৩৪ ওয়াক্ত সালাতের সময় মসজিদ থাকে নিরব, নিথর ও নিষ্প্রাণ। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে দিয়েছেন যা খানিক পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিমদেরকে মানব কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মসজিদের প্রতিষ্ঠা। মসজিদকে আমরা মানব কল্যাণে প্রেরণা যোগানোর কাজে ব্যবহার করছি না কেবল সালাত পড়ার কাজে ব্যবহার করছি- বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছি। আজ ৯৯% মসজিদ শুধু সালাত পড়ার কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। কল্যাণমূলক কাজ তাতে হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না, অথচ কল্যাণ ও সৎ কাজ সম্পাদনের জন্যই মুসলিমদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ﴾ [ال عمران: ١١٠]
“তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে।" [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০]
﴿فَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ لَهُم مَّغۡفِرَةٞ وَرِزۡقٞ كَرِيمٞ ٥٠ ﴾ [الحج: ٥٠]
“যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক জীবিকা ও ক্ষমা।" [সূরা আল-হজ, আয়াত: ৫০]
﴿ۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَٱلۡأَنۡعَٰمِ بَلۡ هُمۡ أَضَلُّۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡغَٰفِلُونَ ﴾ [الاعراف: ١٧٩]
“তারা চুতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট, তারাই অমনোযোগী। [সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৭৯]
যে সব মুসলিম কল্যাণকর কাজে গুরুত্ব দেয় না তারা হচ্ছে পশু বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট বলে বর্ণিত আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছে। আজ মসজিদসমূহে সেসব কল্যাণকর কাজের আলোচনাও নেই, তাগিদও নেই। যা আছে তা বত্রিশ দাঁতের এক দাঁত থাকার মত কার্যকরী। যে বিষয়টি যত গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে তত বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। লক্ষ্য করা গেছে, সাধারণ বিষয়ে বার বার আলোচনা ও তাগিদের ফলে তার গুরুত্ব বেড়ে যায় পক্ষান্তরে গুরুপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা ও তাগিদের অভাবে গুরুত্ব কমে যায়। এক সময় অপ্রয়োজনীয়ও মনে হতে পারে।
অধিকাংশ মসজিদে ইমাম সাহেব সালাতের পূর্বক্ষণে মসজিদে প্রবেশ করেন তা হুজরা থেকে হোক কিংবা বাহির থেকেই হোক। এসেই দাঁড়ানো অবস্থায়ই ইমাম সাহেবেরই নির্দেশে ইকামতের তাকবীর দেওয়া শুরু হয়ে যায়। সালাত পড়েই ৯০% মুসল্লি তাৎক্ষাণিক মসজিদ ত্যাগ করে চলে যান। ভাবখানা এরকম -যেন মসজিদ নামক খাঁচা থেকে বের হতে পারলেই বাঁচি। অথচ মসজিদে মুমিনের অবস্থান পানিতে মাছের অবস্থানের মতো আর মসজিদে মুনাফিকের অবস্থান খাঁচায় পাখির অবস্থান করার মতো। মসজিদকে আমরা ৯০% মুসল্লি খাঁচার মতো মনে করে এখানে যত কম সময় কাটানো যায় ভেবে নিয়েছি। ১০% মুসল্লি যারা মসজিদে থাকেন তারাও যিকির, মসলা-মাসায়েল, মাখরাজ, ব্যাকরণ শিখে মসজিদ থেকে বের হয়ে পড়ি। কোনো আলোচনা হতে থাকলে মসজিদে মন বসে না। অথচ মসজিদ থেকে বের হয়ে মসজিদের পাশের দোকানে চা পান করে, গল্প করে সময় অতিবাহিত করলেও মসজিদে বসে থাকতে ভালো লাগে না। জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে নবী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের বিষয়গুলো আজ মসজিদে আলোচনায় নেই। যা মুখের আলোচনায় নেই তা কি করে ময়দানে (জীবন-জীন্দেগীতে) আশা করা যায়? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শই হচ্ছে কল্যাণকর কাজ। ইসলামের চেতনাও হচ্ছে কল্যাণকর কাজ। দো'আ, যিকির মানব কল্যাণকর কাজ বটে; তবে কল্যাণ শুধু কথায় আসবে না, কল্যাণ আসবে কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে। যেই ধর্ম -কল্যাণকর কাজে উৎসাহ যোগায় না সেটা ধর্ম নয়, ওটাই হচ্ছে বড় অধর্ম। আজ ধর্মকে পুঁজি করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলছে বাণিজ্য। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আসলে এক শ্রেণির সত্যবিমুখ মানুষ সব কিছু জেনে-বুঝে সত্যকে এড়িয়ে চলে স্বার্থের টানে ও দলাদলি ও দলপ্রীতির জন্য।
আমরা যখন মসজিদে যাই তখন অন্তরটা একটু নরম থাকে। সালাতের আগে কিংবা পরে অব্যাহতভাবে কল্যাণকর কাজের তাগিদ দেওয়ার জন্যই তো মুসলিমদের মসজিদ। বর্তমান সময়ে আমরাতো মসজিদকে শুধু সালাত পড়ার কাজেই ব্যবহার করছি। অথচ সেই সালাতের আযান ইকামতেই আহ্বান জানানো হচ্ছে সালাতের জন্য আস, কল্যাণের জন্য আস। কল্যাণ রয়েছে উল্লিখিত মানবতা ও নৈতিকতায়, যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। তবে কেন সালাতের আগে বা পরে বর্ণিত বিষয়গুলোর ওপর আলোচনা ও তাগিদ দেওয়া হচ্ছে না?
যে মসজিদে একদা নখ কাটা থেকে শুরু করে যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করতে হবে ইত্যাদি জীবন জিন্দেগীর বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে আলোচনা ও পরামর্শ হত, তাগিদ দেওয়া হত। সেখানে আজ পরামর্শেরও তাগিদ নেই, মীমাংসার প্রতিও উৎসাহিত করা হয় না। আপোষ করে নেওয়ারও কোনো প্রেরণা যোগানো হয় না। এক এক মসজিদে এক এক বিষয়ের প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করায় মুসল্লিগণও ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। যে যখন মঞ্চে উঠেন এমনভাবে আলোচনা করতে থাকেন, যেন ওনার দলই সঠিক, বাকি সব দল বিভ্রান্ত। এমনভাব দেখান যেন ভিন্ন ভিন্ন কুরআন নাযিল হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)। কুরআন থেকে তাফসীর করার চেয়ে দলীয় কিতাবের আলোচনায় তৃপ্তি পান বেশি। প্রত্যেক দলে কিছু জানবাজ কর্মী আছেন যারা দলের জন্য জান দিতে সদা প্রস্তুত থাকলেও ভিন্ন দলের আয়োজিত কুরআন-হাদীসের কোনো আলোচনা শুনতেও রাজী নয়। যদি আবার দলে ভিড়ে যেতে হয়। মুখে স্বীকার করবে আল্লাহভীতি দরকার, আত্মশুদ্ধি দরকার; কিন্তু আল্লাহভীতি অর্জনে কোনো আগ্রহও নেই, প্রচেষ্টাও নেই, এমনকি মনে মনে ব্যাকুলতাও নেই। এরা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে গুরুত্ব না দিয়ে দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে পেরেশান। এদের দ্বারা দল কিছু উপকার পেলেও দীন হয় ক্ষতিগ্রস্ত। সাধারণ মানুষ হয় বিভ্রান্ত। তাই এদেরকে কোনো মনীষী ধর্ম সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। কুরআনের বড় অলৌকিকত্ব হচ্ছে মানবের জীবন জীন্দেগী নির্বাহে আদেশ নিষেধ সম্পর্কিত বিধি বিধানসমূহ।
সমাপ্ত