×
ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমরা মনে করি ইসলাম বুঝার জন্য অন্য কারো দরকার নাই, আমরা যা বুঝি তাই চূড়ান্ত। কিন্তু আসলে কি এভাবে ইসলাম চলে? না। চলে না। তবে জেনে নেই কিভাবে ইসলাম শিখা এবং মানা উচিত। প্রবন্ধে বিষয়টি সুন্দরভাবে উপমার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    আমরা যারা কোনো ফর্ম পূরণের সময় ধর্মের ঘরে 'ইসলাম' লিখি তারা স্কুলে পড়াশোনার সময় বিষয় হিসেবে ইসলামিয়াত নামে একটি নির্বিষ বিষয় পড়তাম। নির্বিষতার মাহাত্ম্য SSC তে এ বিষয়ের মাত্র ১০টি প্রশ্ন পড়েই A+ বা লেটার পাওয়া যায়, আগের ক্লাসগুলোর কথা আর নাই বা বললাম। আসলে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের অনেকেরই বাবা-মা ছোটবেলা থেকে বুঝিয়েছেন যা পড়লে রেজাল্ট ভালো হবে তাই হলো কাজের পড়াশোনা আর বাকিটা অকাজের। ১০ পৃষ্ঠা পড়লে যেখানে চলে, কোনো পাগল বাকি ৯০ পৃষ্ঠা পড়বে? আর জানার জন্য পড়ার তো প্রশ্নই উঠে না। ফলে ইসলামিয়াতের আবরণ ভেদ করে কখনো আমাদের মনের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রবেশ করতে পারে নি। তো এহেন গুণধরেরা যখন কোনো এক মানসিক দুর্বলতার মুহূর্তে বাপ-দাদার দীন ইসলাম মানার চেষ্টা করে তখন প্রথম বাঁধাটা আসে জানার ক্ষেত্রে। শূণ্য জ্ঞানের পাত্র নিয়ে তখন আমরা বই/ওয়েবসাইট হাতড়াই। এর ফলাফল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা হয় তা হলো, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। কিছু ভাসা ভাসা পড়াশোনা করে আমাদের এ ধারণা জন্মে যায় যে, আমরা ইসলাম সম্পর্কে অনেক জানি-বুঝি। আর আমাদের দেশের ফতোয়া দেওয়া কাঠমোল্লা, মিলাদজীবি হুজুর আর মুরিদচোষা পীরদের আধিক্যে আমাদের একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে গিয়েছে -তা হলো আমরা পুরো আলেমজাতির ওপর একটা বিরূপ ধারণা পোষণ করে চলি। এ জন্য ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমরা মনে করি ইসলাম বুঝার জন্য অন্য কারো দরকার নাই, আমরা যা বুঝি তাই চূড়ান্ত। কিন্তু আসলে কি এভাবে ইসলাম চলে? না। চলে না। তবে জেনে নিই কীভাবে ইসলাম শিখা এবং মানা উচিত।

    ইসলাম শিক্ষাটা একটা ধারাবাহিক শিক্ষার মত ব্যাপার, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বুঝেছেন, তাঁকে দেখে সাহাবীগণ যা বুঝেছেন, তাবেঈগণ যা বুঝেছেন সেটাই কিন্তু ইসলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ২৩ বছর ধরে কুরআন নাযিল করা হলো যাতে তিনি কুরআনের আদেশ নিষেধ নিজের জীবনে প্রতিফলন করে দেখান। আবার তিনি যা বুঝলেন এবং প্রচার করলেন তাই কিন্তু সাহাবীগণের জীবনে প্রতিফলিত হলো। তাই কুরআন তাফসীর-এর মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে ইবন কাসীর তার আত-তাফসীর আল-কুরআন আল-আযীম-এর ভূমিকায় লিখলেন, কুরআনের ব্যাখ্যা হবে নিম্নোক্ত ধারাবাহিকতায়। একটা না পেলে তবেই এর পরেরটায় যাওয়া যাবে:

    ১। কুরআনের ব্যাখ্যা কুরআন দ্বারা।
    ২। কুরআনের ব্যাখ্যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী/আদেশ/নিষেধ দ্বারা।
    ৩। কুরআনের ব্যাখ্যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের দ্বারা।
    ৪। কুরআনের ব্যাখ্যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের অনুসারী তাবে'ঈদের দ্বারা।
    ৫। কুরআনের ব্যাখ্যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের অনুসারী তাবে'ঈদের অনুসারী তাবে' তাবে'ঈনদের দ্বারা।
    ৬। কুরআনের ব্যাখ্যা কুরআনের সাতটি ক্বিরাতের দ্বারা।
    ৭। আরবি ভাষার জ্ঞান দ্বারা।

    যিনি শুধু কুরআন পড়লেন (তাও মূল আরবি না, শুধু অনুবাদ); কিন্তু বাকিগুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখলেন না, তিনি যখন কুরআন পড়তে গিয়ে কোনো কিছু না বুঝবেন তখন তার সেই “নলেজ গ্যাপ" এর জন্য নিজের মত করে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শয়তানের মতো করে) তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নিবেন। এর উদাহরণ আমাদেরই অনেক ভাই যাদের ধারণা শুধু কুরআন মানাটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাদের বক্তব্য, যেহেতু আল্লাহ কুরআন সংরক্ষণ করবেন বলেছেন সেহেতু কুরআন সংরক্ষিত আছে। যেহেতু হাদীস সরাসরি আল্লাহর বাণী নয় তাই তা বিকৃত হয়ে গেছে এবং এগুলো মানা যাবে না। যদিও বা মানতে হয় তবে চিন্তা ভাবনা করে বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে সেগুলো মানা যেতে পারে। এখানে মূল সমস্যা হলো খণ্ডিত জ্ঞান। কেউ যদি কোনো হাদিসের ভাষ্য বা Text জানেন; কিন্তু তার ব্যাখ্যা না জানেন তবে তিনি ব্যাখ্যা না করতে পেরে ধারণা করবেন যেহেতু এটা হাদীস তাই এতে ভুল আছে।

    আবার ব্যাপারটি এরকমও হতে পারে যে, কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে কেউ যদি একটি হাদীস জানেন এবং সেটা থেকে নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্তে আসেন তবে সেটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে।

    যেমন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক শিশুসন্তানেরা আখিরাতে কী পরিণতি লাভ করবে?

    প্রথম হাদীসঃ অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি'রাজের সময় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সাথে জান্নাতে একটি গাছের কাছে থাকতে দেখেছিলেন।

    দ্বিতীয় হাদীসঃ খাদিজা রাদিয়াল্লাহু 'আনহা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর জাহেলিয়াতের সময়কার মৃত সন্তানদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন যে, তাঁরা জাহান্নামী।

    যারা প্রথমটি জানেন তারা অপ্রাপ্তবয়ষ্করা কী পরিণতি লাভ করবে -এর উত্তর দিবেন জান্নাত আর যারা দ্বিতীয়টি জানেন, তাঁরা বলবেন জাহান্নাম। যিনি প্রথম হাদীসটি জানেন তিনি ইসলামের খণ্ডিত জ্ঞানের অধিকারী। যিনি শুধু দ্বিতীয় হাদীসটি পড়লেন তিনি বিবেক দিয়ে বিশ্লেষণ করে বলবেন এটা আবার কেমন বিচার? যে শিশু কোনো পাপ করে নি সে কেন আগুনে পুড়বে? যারা দু'টিই জানেন তাদের মনে শয়তান বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে বলবে, দেখেছ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা স্ববিরোধী। সুতরাং হাদীস মানার দরকার নাই।

    তৃতীয় হাদীসঃ আনাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামাতের দিন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক, পাগল এবং যারা দুই নবীর মাঝখানে এসেছে (আহলুল ফাতরাহ) তারা পরীক্ষিত হবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন দূত এসে তাদের আল্লাহর নির্দেশে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলবেন। যারা এ আদেশ মানবে তাঁরা জান্নাতে যাবে, যারা অগ্রাহ্য করবে তারা জাহান্নামী।

    যিনি তৃতীয় হাদীসটিও জানেন তিনি কিন্তু প্রশ্নটির একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। ইসলাম টোটালারিয়ান ভিউ সাপোর্ট করে, ফ্র্যাগমেন্টেড ভিউ না। যেমন একজন মানুষ একটি জানালা দিয়ে একটি রাস্তার কিছু অংশ দেখল যেখানে শুধু কাপড়ের দোকান আছে। এখন সে যদি দাবী করে যে, ঐ রাস্তায় শুধু কাপড়ের দোকান আছে তা ঠিক কিন্তু সম্পূর্ণ ঠিক না। সে যদি ছাদে দাঁড়িয়ে ঐ রাস্তাটি দেখে তবে সে দেখতে পেত কাপড়ের দোকান ছাড়াও আরো অনেক কিছুই ঐ রাস্তায় আছে। জানালার দৃশ্যটি ফ্র্যাগমেন্টেড ভিউ; কিন্তু ছাদের দৃশ্য টোটালারিয়ান ভিউ। এমনটি শুধু ইসলাম নয় অনেক অন্য ক্ষেত্রেও একই ভাবে কাজ করে। আমরা জিনোমিক্স নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি আগে যেখানে একটা জিন-এর কাজ নিয়ে গবেষণা হত; এখন হয় পুরো কোষের সব জিন নিয়ে। কারণ ঐ জিনের কাজ পুরো কোষের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়ই বদলে যায়। ঠিক তেমনি অনেক আয়াত বা হাদীস অন্যান্য সব আয়াত ও হাদীসের সাহায্যে পুরো অর্থ নেয়, একাকি ভিন্ন অর্থ নেয়। পুরো অর্থ মানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ যে অর্থে নিয়েছিলেন এবং জীবনে আমল করেছিলেন সেই অর্থ।

    বড় আলেমের সুবিধাটা হলো -এখানে যে তিনি একটি বিষয় সম্পর্কে সব আয়াত এবং তার সম্পর্কিত হাদীসগুলো জানেন তাই তিনি একটা আয়াত বা একটি বিষয় ব্যাখ্যার সময় আমাদের থেকে ভালো ব্যাখ্যা করতে পারেন। তিনি যদি না জেনেও থাকেন তবে জানার চেষ্টা করে তবেই ব্যাখ্যা করবেন, তার আগে করবেন না। আমি যদি সম্পূর্ণ জ্ঞান ছাড়াই আয়াতের অন্তর্নিহিত মানে বুঝতে যাই বা কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করতে যাই তাহলে সমস্যা হবে। আমার জ্ঞানের অভাবে আমি ভুল ব্যখ্যা করব; কিন্তু শয়তান আমাকে বুঝাবে যে ঐ অশিক্ষিত আলেমের থেকে আমিই ভালো জানি, বুঝি এবং আমার ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে আমি তর্ক করব এবং ভুল পথে চলে যাব। (নাউযুবিল্লাহ)

    কোনো বিষয়ের কোনো ব্যাখ্যা বড় কোন আলেম করেছেন, অন্য আলেমরা তাদের এ ব্যাখ্যাকে তাদের পরিপূর্ণ জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক বলেছেন, তারপরেই আমাদের উচিৎ সেটা মেনে নেওয়া ও প্রচার করা। যে কেউ ইসলাম নিয়ে সিস্টেমেটিকালি পড়াশোনা করুক, এরপর কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা করুক, সেই ব্যাখ্যা বড় 'আলেমরা মেনে নিক, আল্লাহর কসম ঐটা মেনে নিতে আমার কোনো আপত্তি নাই। কেউ একজন সারাজীবন ফ্লুইড মেকানিক্স পড়ল, পড়াল, রিটায়ার করে যখন দেখল আর কোনো কাজ নাই, তখন ইসলামি ফাউন্ডেশন বা আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলির অনুবাদ পড়ে আমাকে বুঝাবে যে, হাদীস দরকার নাই, কুরআনেই সব আছে তাহলে আমি এই লোকের ধারেকাছে নাই। ইসলাম পুরাটা না বুঝে খণ্ডিত বুঝ নিয়ে অনেক মানুষ নিজে বিভ্রান্ত হয়, অন্যদের বিভ্রান্ত করে ও সমস্ত মুসলিমদের বিপদে ফেলে। ইবন লাদেনের জিহাদের আয়াতের ব্যাখ্যার চোটে আফগানিস্তান আর ইরাক এক সাথে কাত হয়ে গেছে! হতে পারে উনার সন্ত্রাসকে বেছে নেওয়ার কারণ আল্লাহকে খুশি করা; কিন্তু ইবনে বাযের মত 'আলেমকে কাফির ঘোষণা দিয়ে তাদের পরামর্শ না শুনে নিজের ভার্সনের জিহাদ করে, তিনি মুসলিম উম্মাহর অপরিমাণ ক্ষতি করেছেন। আল্লাহর রাসুলের সুন্নাত উপেক্ষা করায় এ কাজের জন্য তিনি পাপ কামাই করেছেন, পূণ্য না।

    আমরা অন্তত ইসলামের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে অতি গুরুত্ব না দিয়ে বড়মাপের 'আলেমদের মতামতটা জেনে নিব, তারপরে সেটা নিয়ে কথা বলব। তাদের মধ্যে মতের ভেদাভেদ থাকলে আমরা উভয় মত সম্পর্কে পড়ব, চিন্তা করব তারপর যেটা পছন্দ হবে (জীবনযাত্রার সুবিধার্থে না, ইসলাম মানার ক্ষেত্রে যেটা বেশি তাকওয়াপূর্ণ, ও দলীল নির্ভর) সেটা মেনে নিব। যার মত মেনে নিলাম না তাকে হেয় করব না; বরং সম্মান করব। আমরা মনে রাখব 'আলেমরাই রাসূলদের উত্তরাধিকারী। সবচেয়ে ভালো হয় আমরা নিজেরা নিয়মানুযায়ী পড়াশোনা করে 'আলেম হয়ে যাই। ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটিতে অনলাইনে পড়াশোনা করা যায় এমনকি সার্টিফিকেট পর্যন্ত নেওয়া যায়। যারা জানার উদ্দেশ্যে জানতে চান তারা আরব বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত 'আলেম, যারা বর্তমানে আমাদের দেশে অবস্থান করছেন তাদের কাছে ফর্মাল ক্লাসের আয়োজন করতে পারেন, এতে নিজের শিক্ষা হলো, আরো মানুষ দীন শিখতে পারল।

    “ইসলাম একটা সিম্পল, সহজ ধর্ম" -এ কথা বলে যার যা করতে ভালো লাগে সব ইসলামের মধ্যে ঢুকাবে, এটা খুব বড় ধরণের অন্যায়। আমার নিজের কাছে যে ইসলাম মানতে ভালো লাগে তা মানলে আর আল্লাহর ইসলামের দরকার কী ছিল? আমরা ইসলাম মানি আল্লাহকে খুশি করে পুরষ্কার পেতে, তাঁর শাস্তি থেকে বাঁচতে। এই উদ্দেশ্য সফল করতে আল্লাহ আমাদের জন্য যেই ইসলাম পছন্দ করেছেন ঠিক সেটাই মেনে চলতে হবে।

    আল্লাহ আমাদের আপন আত্মার ঔদ্ধত্য থেকে রক্ষা করুন, তাঁর আদেশ ঠিক মত জেনে তা মেনে নেওয়ার তাওফীক দিন। আমিন।