×
এটি আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীরের প্রথম অংশ। সরল ও সাবলীল বাংলায় অনুবাদসহ বিভিন্ন আয়াতের মৌলিক শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সংক্ষিপ্ত এ তাফসীরে। অনুবাদের ক্ষেত্রে আল-বায়ান ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত আল-কুরআনের সরল অর্থানুবাদ-এর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে সূরা আল-বাকারা-এর ২১নং আয়াত থেকে ৮২নং আয়াত পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

    আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীর: ২য় পর্ব

    [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১-৮২]

    التفسير الموجز للقرآن الكريم: الجزء الثاني

    سورة البقرة: الآيات (21-82)

    < بنغالي- Bengal - বাঙালি>

    কতিপয় উলামা

    مجموعة من العلماء

    —™

    সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    مراجعة: د/ محمَّد منظور إلهي

    আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসির: ২য় পর্ব

    সূরা আল-বাকারা

    ২১ আয়াত থেকে ৮২ আয়াত পর্যন্ত অর্থসহ সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা

    بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

    পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে

    ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [البقرة: ٢١]

    ২১. হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।১৭

    ১৭. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত চর্চা ও দাসত্ব মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে পৃথিবীতে অসত্য-চিন্তা, ভুল-দৃষ্টিভঙ্গি ও অসার-অশ্লীল কাজ থেকে মুক্তি, আর পরকালে ব্যর্থ পরিণতি ও আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়।

    ﴿ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢]

    ২২. যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিযিকস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।১৮

    ১৮. অর্থাৎ জগতসমূহ ও এতে বিরাজিত সকল উপায়-উপাদানের সৃষ্টি যখন একমাত্র দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা-অনুগ্রহ ও কর্তৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে, তখন সৃষ্টির সেরা মানুষের সব বন্দেগী, দাসত্ব ও মুখাপেক্ষিতা নির্দিষ্ট হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহরই জন্য। মানুষ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে মানবে না। অন্য কারও আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান মানবে না; বরং জীবনে সকল ক্ষেত্রে অন্বেষণ করে যাবে একমাত্র আল্লাহর রেজামন্দি, ইবাদত-আরাধনা নিষ্ঠার সাথে নির্দিষ্ট করবে একমাত্র আল্লাহই জন্য। জীবনের সকল স্তর ও ক্ষেত্র সঁপে দিবে আল্লাহর নাযিলকৃত পবিত্র বিধানের হাতে।

    ﴿ وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ وَٱدۡعُواْ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٢٣ ﴾ [البقرة: ٢٣]

    ২৩. আর আমি আমার বান্দার ওপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস।১৯ এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

    ১৯. ইতিপূর্বে মক্কায় এ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছিল, যদি তোমরা এ কুরআনকে মানুষের রচনা মনে করে থাকো তাহলে এর সমমানের কোনো একটি বাণী রচনা করে আনো। এবার মদীনায় সে একই চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। আরো জানার জন্য দেখুন: সূরা ইউনুস: ৩৮, সূরা হূদ: ১৩, সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮ এবং সূরা তূর: ৩৩-৩৪ আয়াত।

    ﴿ فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ وَلَن تَفۡعَلُواْ فَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِي وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُۖ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ٢٤ ﴾ [البقرة: ٢٤]

    ২৪. অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর,২০ - যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য।

    ২০. অর্থাৎ সেখানে শুধুমাত্র সত্যদ্রোহী মানুষই জাহান্নামের জ্বালানী (নরকের ইন্ধন) হবে না বরং তাদের সাথে নিগৃহীত হবে তাদের সে সব উপাস্য নিথর প্রস্তর মূর্তিগুলোও।

    ﴿ وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنۡهَا مِن ثَمَرَةٖ رِّزۡقٗا قَالُواْ هَٰذَا ٱلَّذِي رُزِقۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَأُتُواْ بِهِۦ مُتَشَٰبِهٗاۖ وَلَهُمۡ فِيهَآ أَزۡوَٰجٞ مُّطَهَّرَةٞۖ وَهُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٥ ﴾ [البقرة: ٢٥]

    ২৫. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোনো ফল খেতে দেওয়া হবে, তারা বলবে, ‘এটা তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেওয়া হয়েছিল’। আর তাদেরকে তা দেওয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে২১ এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পূতঃপবিত্র সঙ্গী-সঙ্গিনী এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী।

    ২১. জান্নাতবাসীদেরকে যে সব ফল-ফলাদি পরিবেশন করা হবে তা তাদের পরিচিত আকার-আকৃতিরই হবে, তবে নিশ্চিতভাবেই তা হবে স্বাদে-গন্ধে অকল্পনীয়-অতুলনীয়, কারণ সেগুলো তো দুনিয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ আপ্যায়ন।

    ﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَسۡتَحۡيِۦٓ أَن يَضۡرِبَ مَثَلٗا مَّا بَعُوضَةٗ فَمَا فَوۡقَهَاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَيَعۡلَمُونَ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّهِمۡۖ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلٗاۘ يُضِلُّ بِهِۦ كَثِيرٗا وَيَهۡدِي بِهِۦ كَثِيرٗاۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِۦٓ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٦ ﴾ [البقرة: ٢٦]

    ২৬. নিশ্চয় আল্লাহ মাছি কিংবা তার চেয়েও ছোট কিছুর উপমা দিতে লজ্জা করেন না। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা জানে, নিশ্চয় তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আর যারা কুফরি করেছে তারা বলে, আল্লাহ এর মাধ্যমে উপমা দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছেন? তিনি এ দিয়ে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন এবং এ দিয়ে অনেককে হিদায়াত দেন।২৪ আর এর মাধ্যমে কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।

    ২৩. এখানে একটি আপত্তি ও প্রশ্নের উল্লেখ না করেই তার জবাব দেওয়া হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য মশা-মাছি ও মাকড়শা ইত্যাদির দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। এতে বিরোধীদের আপত্তি উঠেছিল: 'এটা কোন ধরনের আল্লাহর কালাম, যেখানে এসব তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের উপমা দেওয়া হয়েছে?'

    ২৪. যারা প্রকৃত অর্থে সত্যের প্রতি সমর্পিত হতে প্রস্তুত নয়, আন্তরিকভাবে কথা বুঝতে চায় না, সত্যের মর্ম অনুসন্ধান ও তা মেনে নেওয়া যাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, সমালোচনা করা আর খুঁত বের করাই যাদের কাছে মুখ্য, তাদের দৃষ্টি থাকে কেবল শব্দের বাইরের কাঠামোর ওপর নিবদ্ধ, ফলে তা থেকে এ হতভাগ্যরা অস্পষ্টতা ও বক্রতা উদ্ধার করে সত্য থেকে আরো দূরে সরে যায়।

    অপরদিকে যারা সত্য-সন্ধানী, আগ্রহী, যারা মনন ও সঠিক দৃষ্টিশক্তির অধিকারী, তারা আল-কুরআনের ঐ সব বক্তব্যের পরতে পরতে শুভ্র-সুস্পষ্ট জ্ঞানের আলোকচ্ছটা খুঁজে পায়। এ ধরনের দৃষ্টি-উন্মোচনকারী (eye-opener) ও জ্ঞানগর্ভ কথামালার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহই হতে পারেন বলে তাদের সমগ্র হৃদয়-মন সাক্ষ্য দিয়ে উঠে।

    ﴿ ٱلَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهۡدَ ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مِيثَٰقِهِۦ وَيَقۡطَعُونَ مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ أَن يُوصَلَ وَيُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٢٧ ﴾ [البقرة: ٢٧]

    ২৭. যারা আল্লাহর সুদৃঢ় অঙ্গীকার ভঙ্গ করে,২৫ এবং আল্লাহ যা জোড়া লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে২৬ এবং যমীনে ফাসাদ করে;২৭ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

    ২৫. এখানে সৃষ্টির সূচনাতেই সমগ্র মানবাত্মার কাছ থেকে গৃহীত একমাত্র মহান আল্লাহর আনুগত্য করার অঙ্গীকার পূরণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার উল্লেখ রয়েছে এখানে:

    "আর (স্মরণ করো), যখন তোমাদের প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্পর্কে স্বীকৃতি আদায় করলেন (বললেন): 'আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই'? তারা বললো: 'হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম'। (এটি এ জন্য) যেনো তোমরা পুণরুত্থানের (কিয়ামতের) দিন একথা বলতে না পার যে, 'আমরা তো এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলাম'!" (সূরা আল আ’রাফ: ১৭২)

    ২৬. এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে রয়েছে অর্থের অশেষ ব্যাপকতা। যেসব সম্পর্ককে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত রাখার ওপর নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণ, আল্লাহ তা‘আলা সেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

    যুবাইর ইবন মুতইম (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী (সা:)-কে বলতে শুনেছেন: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। -- সহীহ আল বুখারী, ৫ম খন্ড, হাদীস নং- ৫৫৪৯।

    এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: অপরিহার্য সম্পর্কগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও যত্ন না নিয়ে অহেতুক সম্পর্ক গড়ে তোলা মু’মিনের জন্য কখনো উচিত নয়। বিশেষ করে যাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ইসলামে নিষিদ্ধ; যেমন ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু, তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক-চর্চা অবশ্যাই বর্জনীয়।

    সম্পর্ক-চর্চার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরি। তা হলো, বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্ককে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে, আত্মীয়-স্বজনদেরকে ভুলে যাওয়া, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্ককে যথার্থরূপে পরিচর্যা না করা মারাত্মক অপরাধ। যারা এরূপ করে, তারা, উক্ত আয়াতের ভাষ্যানুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল।

    ২৭. এ তিনটি বাক্যের মাধ্যমেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যকার অঙ্গীকার কর্তন করা এবং মানুষে-মানুষে যে সম্পর্ক পরিচর্যার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করা এবং জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার অনিবার্য পরিণতি হলো বিপর্যয়।

    ﴿ كَيۡفَ تَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَكُنتُمۡ أَمۡوَٰتٗا فَأَحۡيَٰكُمۡۖ ثُمَّ يُمِيتُكُمۡ ثُمَّ يُحۡيِيكُمۡ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٨ ﴾ [البقرة: ٢٨]

    ২৮. কীভাবে তোমরা আল্লাহর সাথে কুফরী করছো অথচ তোমরা ছিলে মৃত? অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। এরপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন অতঃপর জীবিত করবেন। এরপর তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।২৮

    ২৮. এ আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে নিচের আয়াত দু'টির বক্তব্য লক্ষণীয়:

    যারা কাফির (আল্লাহকে অস্বীকারকারী), তাদেরকে (শেষ বিচারের দিন) বলা হবে: 'আজ তোমাদের (পরিণতি দেখে) নিজেদের প্রতি তোমাদের যে কঠিন ক্রোধ অনুভূত হচ্ছে, তার চেয়ে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরো অধিক ক্রুদ্ধ হতেন, যখন তোমাদেরকে (দুনিয়ায়) ঈমান আনতে বলা হতো, আর তা তোমরা অস্বীকার করতে'! তারা বলবে: 'হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের দু'বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু'বার জীবন দিয়েছেন। এখন আমাদের অপরাধগুলো স্বীকার করে নিচ্ছি। এখনও নিষ্কৃতির কোনো উপায় আছে কি'? [দেখুন: সূরা আল-মু'মিন, আয়াত: ১০-১১]

    ﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰٓ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَسَوَّىٰهُنَّ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ٢٩ ﴾ [البقرة: ٢٩]

    ২৯. তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আসমানের প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সাত আসমানে২৯ সুবিন্যস্ত করলেন। আর সব কিছু সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত।৩০

    ২৯. সাত আকাশের তাৎপর্য কি? সাত আকাশ বলতে কি বুঝায়? এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন। মানুষ প্রতি যুগে যুগে আকাশ বা অন্য কথায় পৃথিবীর বাইরের জগত সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ ও ধারণা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিভিন্ন চিন্তা ও মতবাদের অনুসারী হয়েছে। এ চিন্তা ও মতবাদগুলো বিভিন্ন সময় বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই এর মধ্য থেকে কোনো একটি মতবাদ নির্দিষ্ট করে তার ভিত্তিতে কুরআনের এ শব্দগুলোর অর্থ নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। তবে সংক্ষেপে এটুকু বুঝে নেওয়া দরকার যে, সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে যতগুলো জগত আছে সবগুলোকেই আল্লাহ তা‘আলা সাতটি সুদৃঢ় স্তরে বিন্যস্ত করে রেখেছেন অথবা এ বিশ্ব-জগতসমূহের যে স্তরে পৃথিবীর অবস্থিতি সেটি সাতটি স্তর সমন্বিত।

    ৩০. এখানে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে:

    ক. যে আল্লাহ আমাদের সব ধরনের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের খবর রাখেন এবং যাঁর দৃষ্টি থেকে আমাদের কোনো কার্যক্রমই গোপন থাকতে পারে না, তাঁর মোকাবিলায় মানুষ অস্বীকৃতি ও বিদ্রোহের পথ বেছে নেওয়ার সাহস কী করে করতে পারে?

    খ. যে আল্লাহ যাবতীয় সত্য জ্ঞানের অধিকারী ও প্রকৃত উৎস, তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অগ্রসর হলে অজ্ঞতার অন্ধকারে পথভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে?

    ﴿ وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَجۡعَلُ فِيهَا مَن يُفۡسِدُ فِيهَا وَيَسۡفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَۖ قَالَ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٠ ﴾ [البقرة: ٣٠]

    ৩০. আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করব,৩১ তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে?৩২ আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি? ৩৩ তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না।৩৪

    ৩১. খলীফা বলতে এখানে পৃথিবীকে কর্ষণ-চাষাবাদ ও পৃথিবীতে থাকাবস্থায় স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদত চর্চার ক্ষেত্রে প্রজন্মান্তরে একে অন্যের প্রতিনিধি হওয়া। কারও কারও মতে জিন্ন জাতি আল্লাহর ইবাদত চর্চায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ার পর আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর কর্ষণ-চাষাবাদ ও স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে ইবাদত চর্চার জন্য জিন্নদের স্থলাভিষিক্তরূপে মানবপ্রজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।

    মানুষ আল্লাহর খলীফা ঠিক এমনভাবে বলা উচিত নয়। কেউ মারা গেলে অথবা পদত্যাগ করলে তার জায়গায় যে আসে তাকেই মূলতঃ খলীফা বলা হয়। আর আল্লাহ যেহেতু চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর এবং তিনি কখনো তার চেয়ার অন্যের জন্য ছেড়ে দেবেন না তাই মানুষ আল্লাহর খলীফা অভিধানের এ ব্যবহার সালাফদের অধিকাংশ আলেমের নিকট অনুচিত।

    ৩২. এটি ফিরিশতাদের ভিন্নমত পোষণের বহিঃপ্রকাশ নয় - এর শক্তিই তাদের নেই, বরং তা ছিল মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জিজ্ঞাসা। মূল কথা হলো, 'খলীফা' হিসেবে যার সৃষ্টি, তাকে কিছু স্বাধীন কর্তৃত্বও দেওয়া হবে, তার থাকবে কিছু ইচ্ছার স্বাধীনতা - যা হতে পারে গোলযোগ ও বিশৃংখলার কারণ - এ ধারণাটির স্পষ্টকরণের জন্যই ছিল তাদের আবেদন।

    ৩৩. ফিরিশতাদের এ কথার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা এবং তাঁর সব নির্দেশ যথাযথভাবে পালনে তাদের কোনো অসম্পূর্ণতা রয়েছে কিনা, যার ফলে খলীফা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, বিনীতভাবে বিষয়টি আল্লাহর দরবারে পেশ করা।

    ৩৪. এটি ফিরিশতাদের দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব। খলীফা প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন, তারা জানে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পৃথিবীতে এমন এক প্রজাতি সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়েছে যাদেরকে দেওয়া হবে সীমিত ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা, যার ফলে তারা হবে ফিরিশতাদের চেয়েও অনেক সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ ও প্রতিদানপ্রাপ্য।

    ﴿ وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبِ‍ُٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ ﴾ [البقرة: ٣١]

    ৩১. আর তিনি আদমকে নামসমূহ৩৫ সব শিক্ষা দিলেন, তারপর তা ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।

    ৩৫. কোনো বস্তুর নামের মাধ্যমে মানুষ সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে থাকে। তাই সর্বপ্রথম সৃষ্ট মানুষ আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দেয়ার মানেই হলো তাঁকে সব ধরনের বস্তুর জ্ঞান দান করা হয়েছিল।

    ﴿ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢ ﴾ [البقرة: ٣٢]

    ৩২. তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ৩৬ নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’।

    ৩৬. এখানে ধারণা হয় যে, প্রত্যেক ফিরিশতার এবং তাদের প্রত্যেকটি শ্রেণীর জ্ঞান তাদের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেমন বায়ু-প্রবাহের ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের উদ্ভিদজগত সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অন্যান্য বিভাগে নিয়োজিতদের অবস্থাও তাই। তবে অবশ্যই মহান আল্লাহ সঠিক জানেন। অথচ মানুষকে দেওয়া হয়েছে ব্যাপকতর জ্ঞান, তাদের রয়েছে উদ্ভাবনী (innovative), প্রাসঙ্গিক (correlative), প্রায়োগিক (implementing) ও সমন্বয় (coordination) জ্ঞানসহ অমিত সৃজনশীল প্রতিভা। তাই তো তারা বিবেকসম্পন্ন, সীমিত-স্বাধীন, অথচ দায়বদ্ধ ও সৃষ্টির সেরা। ফলে তাদের রয়েছে একদিকে সম্মান ও পুরস্কার অথবা অন্যদিকে শাস্তি ও চরম অপমান; আর ফিরিশতাদের তা নেই, কারণ তাদের আছে নিয়ন্ত্রিত, সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান এবং দায়িত্ব; পাশাপাশি নেই অস্বীকার ও সীমালংঘনের কোনো ক্ষমতা।

    ﴿ قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئۡهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣ ﴾ [البقرة: ٣٣]

    ৩৩. তিনি বললেন, ‘হে আদম, এগুলোর নাম তাদেরকে জানাও’। সুতরাং যখন সে এগুলোর নাম তাদেরকে জানাল, তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েব জানি এবং জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা তোমরা গোপন করতে’?৩৭

    ৩৭. আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক সবকিছুর নাম বলে দেয়ার এ মহড়াটি ছিলো ফিরিশতাদের প্রথম সন্দেহের জবাব। তাদের উপস্থাপনাটি ছিলো: 'আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, যে সেখানে অশান্তি ও রক্তপাত ঘটাবে'? [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩০]

    এখানে ব্যাপারটি এরূপ যে, আল্লাহ তা'আলা ফিরিশতাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি আদমকে শুধুমাত্র ইচ্ছার স্বাধীনতাই দেননি, তাকে দিয়েছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আর খলীফা সৃষ্টির সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ। বিপর্য‌য়ের দিকটির তুলনায় এ কল্যাণের গুরুত্ব ও মূল্যমান অনেক বেশি।

    ﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٤ ﴾ [البقرة: ٣٤]

    ৩৪. আর যখন আমি ফিরিশতাদেরকে বললাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা৩৮ কর’। তখন তারা সিজদা করল, ইবলীস ছাড়া।৩৯ সে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার করল। আর সে হল কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।

    ৩৮. ফিরিশতাদেরকে মানুষের সামনে নত হবার নির্দেশটির মর্মার্থ হলো: পৃথিবীর সকল কিছু মানুষের অধীনস্থ করে দেয়া। কেননা ফিরিশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় পরিচর্যা ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আর এ ফিরিশতাগণকেই যখন আল্লাহ তা‘আলা আদমের সামনে নত হতে বললেন তার অর্থ এ মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই মানুষের অধীনতা স্বীকার করিয়ে নেওয়া হলো।

    ৩৯. এখানে একটি প্রশ্ন: ইবলীস একজন জিন্ন আগুনের তৈরী; [সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১৫; সূরা আল-হিজর, আয়াত: ২৭] হয়ে ফিরিশতাদের (আলোর তৈরী) প্রতি আল্লাহর নির্দেশের আওতায় এল কী করে?

    এর ব্যাখ্যা হলো: সে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে ফিরিশতার মর্যাদা লাভ করে। তাই সেও ছিলো ঐ নির্দেশের আওতাধীন। তাছাড়া সে নিজেই ঐ আদেশ অমান্যের কারণে একথা বলেনি যে, সে তো একজন জিন্ন, ফিরিশতা না; বরং সে সুস্পষ্টভাবে করেছে অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। [সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১২]

    তাছাড়া আরেকটি ব্যাপার হলো: আসলে ফিরিশতাদের আল্লাহর নির্দেশ না মানার কোনো শক্তি নেই। [দেখুন, সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬ ও সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫০], আর জিন্নদের সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলেই ইবলীস তা অমান্য করার দুঃসাহস করেছে।

    ﴿ وَقُلۡنَا يَٰٓـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَيۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٣٥ ﴾ [البقرة: ٣٥]

    ৩৫. আর আমি বললাম, ‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং তা থেকে আহার কর স্বাচ্ছন্দ্যে, তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী এবং এ গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না,৪০ তাহলে তোমরা যালিমদের৪১ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’।

    ৪০. পৃথিবীতে পাঠানোর আগে প্রথম মানব-মানবীকে জান্নাতে রেখে তাদের মানসিক প্রবণতা উন্মোচিত করার উদ্দেশ্যে এ পরীক্ষা। এতে একটি গাছ নির্দিষ্ট করে তার কাছে যেতে নিষেধ করা হয়। আর তা অমান্যের পরিণামও জানিয়ে দেওয়া হয়। সে গাছটি কি, তার ফলের নাম কি, তাতে কি প্রাকৃতিক দোষ ছিল ইত্যাদি এখানে গৌণ। মূলতঃ এটি ছিল একটি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে পরীক্ষা।

    আর এখানে জান্নাতকে পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে একথা বুঝিয়ে দেওয়া যে, মানবিক মর্যাদার প্রেক্ষিতে জান্নাতই তাদের উপযোগী স্থায়ী বাসস্থান; কিন্তু অভিশপ্ত শয়তান নিরবচ্ছিন্ন প্ররোচনার মাধ্যমে মানুষকে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ও বিমুখ করে জান্নাত থেকে বের করে জাহান্নামে তার সঙ্গী করার চেষ্টায় রত। তাই পরম করুণাময়ের ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্য মানুষকে সজাগ থেকে সে কুমন্ত্রণাদানকারী শয়তানের সফল মোকাবিলা করতে হবে।

    ৪১. 'যালিম' শব্দটি গভীর অর্থবোধক। 'যুলুম' বলা হয়, কোনো জিনিসকে তার নির্ধারিত জায়গায় না রেখে ভিন্ন জায়গায় রাখা। সে হিসেবে সকল অন্যায়-অনাচার-অধিকার হরণকে যুলুম বলা হয়। অতঃপর যে ব্যক্তি কারো অধিকার হরণ করে সে যালিম। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশনাবলী অমান্য করে এবং সীমালংঘনে সক্রিয় হয়, সে আসলে ৩টি বড় বড় মৌলিক অধিকার হরণ করে:

    ক. প্রথমত সে আল্লাহর অধিকার হরণ করে। কারণ আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালনকারী আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করতে হবে, এটা আল্লাহর অধিকার।

    খ. দ্বিতীয়ত আল্লাহর নির্দেশনাবলী অমান্য করতে গিয়ে সে যেসব উপকরণ ব্যবহার করে তাদের সবার অধিকার ক্ষুন্ন করে। কারণ তার বিবেক-বুদ্ধি, যোগ্যতা, ক্ষমতা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার সাথে বসবাসকারী সমাজের অন্যান্য লোক, তার ইচ্ছা ও সংকল্প পূর্ণ করার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ফিরিশতাগণ এবং যে সব বস্তু-সামগ্রী সে তার কাজে ব্যবহার করে – এদের সবার ওপর তার অধিকার ছিল যে, এদেরকে কেবলমাত্র এদের মালিক তথা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করবে; কিন্তু তাঁর নির্দেশনার বিরুদ্ধে এসব ব্যবহার করায় তাদের ওপর যুলুম করা হয়।

    গ. তৃতীয়ত সে তার নিজের অধিকার হরণ করে। কারণ তার নিজের সত্ত্বাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করা তার দায়িত্ব; কিন্তু অমান্যকারী ও বিদ্রোহী হয়ে যখন সে নিজেকে আল্লাহর শাস্তিলাভের যোগ্য করে তোলে, তখন সে আসলে তার আপন ব্যক্তিসত্ত্বার ওপরই যুলুম করে।

    এসব কারণে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে 'গুনাহ' শব্দটির জন্য 'যুলুম' আর 'গুনাহগার' শব্দটির জন্য 'যালিম' পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

    ﴿ فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيۡطَٰنُ عَنۡهَا فَأَخۡرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِۖ وَقُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوّٞۖ وَلَكُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُسۡتَقَرّٞ وَمَتَٰعٌ إِلَىٰ حِينٖ ٣٦ ﴾ [البقرة: ٣٦]

    ৩৬. অতঃপর শয়তান তাদেরকে জান্নাত থেকে স্খলিত করল। অতঃপর তারা যাতে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল, আর আমি বললাম, ‘তোমরা নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু৪২। আর তোমাদের জন্য যমীনে রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবাস ও ভোগ-উপকরণ’।

    ৪২. অর্থাৎ মানুষের শত্রু শয়তান এবং শয়তানের শত্রু মানুষ। শয়তান মানুষের শত্রু, একথা সুস্পষ্ট। কারণ সে মানুষকে আল্লাহর নির্দেশনার পথ থেকে সরিয়ে অজ্ঞতা ও ধ্বংসের পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করে; কিন্তু শয়তানের শত্রু মানুষ – একথার অর্থ কি? বস্তুতঃ মানুষের সঠিক পথে অবিচল থাকার স্বার্থে তাকে শয়তানের প্রতি শত্রুতার মনোভাব পোষণ করা অপরিহার্য। কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার সামনে শয়তান যে সব আকর্ষণীয় প্রলোভন অথবা ভয়-ভীতি বা ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে, মানুষ তাতে প্রতারিত হয়ে তাকে নিজের বন্ধু ভেবে বসে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে আপাতঃ দৃষ্টিতে যৌক্তিক কিন্তু প্রকৃত বিবেচনায় সত্য ও সুন্দর থেকে বিচ্যুত বা আরেকটু অগ্রসর হয়ে সে সত্য-বিমুখ হয়ে পড়ে। যা তাকে ঈমান, জ্ঞান ও সততার আলোকিত রাজপথ থেকে সরিয়ে অন্ধকার অলি-গলিতে চলতে তৃপ্তি দেয় তথা ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। তাই সত্যপন্থীদেরকে তাদের আত্মরক্ষার লক্ষ্যেই শয়তান, তার কুমন্ত্রণা, তার উৎস এবং সহযোগীদের থেকে সচেতনভাবে দূরে থেকে তার বিরোধিতা করে যেতে হবে আর সব সময় চাইতে হবে আল্লাহর সাহায্য। (দেখুন: সূরা আন-নাস)

    ﴿ فَتَلَقَّىٰٓ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَٰتٖ فَتَابَ عَلَيۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٣٧ ﴾ [البقرة: ٣٧]

    ৩৭. অতঃপর আদম তার রবের পক্ষ থেকে কিছু বাণী পেলো৪৩ ফলে আল্লাহ তার তাওবা৪৪ কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী, অতি দয়ালু।৪৫

    ৪৩. দয়াময় আল্লাহ আদম ‘আলাইহিস সালামকে তাওবার বা অনুশোচনার যে বাক্যগুলো শিখিয়ে দেন তা রয়েছে সূরা আল-আ'রাফের ২৩ নং আয়াতে –

    ﴿ رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٢٣ ﴾ [الاعراف: ٢٣]

    হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের ওপর যুলুম করেছি। এখন যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।

    ৪৪. 'তাওবা' অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং প্রকৃত আত্মোপলব্ধি ও বাস্তব কর্ম-সংশোধন, ভবিষ্যতে পাপ না করার সংকল্পের সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা।

    ৪৫. 'পাপের পরিণামে শাস্তি অবশ্যম্ভাবী এবং মানুষকে তা যে কোনো অবস্থাতেই ভোগ করতে হবে, ক্ষমার কোন সুযোগ তার নেই' – এটি মানুষের স্বকল্পিত ভ্রষ্টকারী মতবাদের একটি। কেননা যে ব্যক্তি একবার পাপ-পঙ্কিল জীবনে প্রবেশ করে, এ মতবাদ তাকে চিরদিনের জন্য নিরাশ করে দেয়।

    এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এখানে যে কোনো মুহূর্তে ভুল বুঝতে পারলে তার স্বীকৃতি দিয়ে, লজ্জিত হয়ে, তাৎক্ষণিকভাবে তা পরিত্যাগ করে, অনুশোচনা করে এবং অমান্য, অবহেলা আর বিদ্রোহের পথ ত্যাগ করে করুণাময় আল্লাহর আনুগত্য, নৈকট্য ও ক্ষমার দিকে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে উন্মুক্ত ও অবারিত। তবে অবশ্যই তা হতে হবে আন্তরিকতাপূর্ণ ও কার্যকরী।

    আরেকটি বিষয় হলো, কোনো ভুল উপলব্ধির পরও নিস্ক্রিয় থেকে – সময় ক্ষেপণ করে – তা থেকে ফিরে আসার শুধু পরিকল্পনা করতে থাকা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা ও ক্ষতিকারক প্রবৃত্তি। কারণ 'ভবিষ্যতে' তাওবা করার উপযুক্ত 'সময় ও সুযোগ' পাওয়া সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তাই যখনই বিচ্যুতি বা ভুল করে ফেলা বা বুঝতে পারা – অনুতাপের সময় তখনই, সংশোধিত হতে হবে অনতিবিলম্বে, দয়াময় আল্লাহর করুণা, ক্ষমা ও রহমত লাভের মাধ্যমে ফিরে আসতে হবে সত্য, সুন্দর আর সাফল্যের পথে।

    ﴿ قُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ مِنۡهَا جَمِيعٗاۖ فَإِمَّا يَأۡتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدٗى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٣٨ ﴾ [البقرة: ٣٨]

    ৩৮. আমি বললাম, ‘তোমরা সবাই তা থেকে নেমে যাও।৪৮ অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোনো হিদায়াত৪৯ আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।৫০

    ৪৮. এ বাক্যটির পুনরাবৃত্তি তাৎপর্যপূর্ণ। ৩৬নং আয়াতেও ছিল একই বাণী। সেখানে 'জান্নাত থেকে নেমে যাও' অর্থ মানুষকে তার কর্মস্থল তথা পৃথিবীতে চাষাবাদ ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইবাদত-দাসত্বের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হলো। আর সে মিশনে সার্বক্ষণিক প্ররোচক ও শত্রু হিসেবে ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী শয়তানকে পরিচিত করে দেওয়া হলো। এরপর (৩৭নং আয়াত) আদম ‘আলাইহিস সালাম তাওবা করলেন এবং মহান আল্লাহ তা কবুল করে নিলেন। এখন আর কোনো তিরস্কার না, বরং তাঁকে মহান নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হলো। কাজেই একটি ভুলের কারণে পৃথিবীতে মানুষকে আসতে হলো– এটি নিরেট ভ্রান্ত ধারণা।

    ৪৯. যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠতম মানুষদের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কাছে পৌঁছে গেছে সে সব পথ-নির্দেশ। সে ধারাবাহিকতার সর্বশেষ নির্দেশনা হলো আল-কুরআন।

    ৫০. দুনিয়া ও আখিরাতে সুখ, শান্তি, স্বস্তি, প্রকৃত সাফল্য ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

    ﴿ وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَكَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَآ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٣٩ ﴾ [البقرة: ٣٩]

    ৩৯. আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।

    ﴿ يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَوۡفُواْ بِعَهۡدِيٓ أُوفِ بِعَهۡدِكُمۡ وَإِيَّٰيَ فَٱرۡهَبُونِ ٤٠ ﴾ [البقرة: ٤٠]

    ৪০. হে বনী ইসরাঈল৫১! তোমরা আমার নিয়ামতকে স্মরণ কর, যে নিয়ামত আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পূর্ণ কর, তাহলে আমি তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর কেবল আমাকেই ভয় কর।

    ৫১. 'ইসরাঈল' শব্দের অর্থ আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দাহ। এটি ইয়াকুব ‘আলাইহিস সালামের আল্লাহ-প্রদত্ত উপাধি। তিনি ইসহাক ‘আলাইহিস সালামের পুত্র ও ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের প্রপুত্র। তাঁরই বংশধরকে বলা হয় বনী ইসরাঈল। এ জাতিধারায় মনোনীত হয়ে এসেছেন অগণিত নবী ও রাসূলগণ। ইউসুফ, ইউনুস, আইউব, দাউদ, সোলাইমান, যাকারিয়া, ইয়াহহিয়া, মূসা, হারূন আ'লাইহিমুস সালামসহ আমাদের অজানা আরো অনেক নবী-রাসূলগণের ধারাবাহিকতায় ঐ বংশ-ধারার শেষে আগমন করেছেন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম। আর ইসমাঈল ‘আলাইহিস সালামের বংশ-ধারায় আগমন করেন বিশ্ব-জাহানের সর্বশেষ নবী রাহমাতুল্লিল আ'লামীন মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম।

    ﴿ وَءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلۡتُ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَكُمۡ وَلَا تَكُونُوٓاْ أَوَّلَ كَافِرِۢ بِهِۦۖ وَلَا تَشۡتَرُواْ بِ‍َٔايَٰتِي ثَمَنٗا قَلِيلٗا وَإِيَّٰيَ فَٱتَّقُونِ ٤١ ﴾ [البقرة: ٤١]

    ৪১. আর তোমাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারীস্বরূপ আমি যা নাযিল করেছি তার প্রতি তোমরা ঈমান আন।৫২ এবং তোমরা তা প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না৫৩ এবং কেবল আমাকেই ভয় কর।

    ৫২. বনী ইসরাঈলের সাথে মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে অঙ্গীকারগুলো ছিলো, আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় তার বর্ণনা চলছে।

    ৫৩. 'সামান্য দাম' বলে দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের কথা বুঝানো হয়েছে। এ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক অর্জনের ধোঁকায় পড়ে মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও উপদেশকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে বা আরেকটু অগ্রসর হয়ে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে দূরে চলে যায়।

    এক্ষেত্রে সাধারণের চেয়ে সমাজে যারা বিভিন্নভাবে দিক-নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দানের সাথে জড়িত, তাদের যথেষ্ট উপলব্ধির ও সতর্ক হবার অবকাশ রয়েছে। কোনো কিছুর স্পষ্টকরণ বা ব্যাখ্যা প্রদানে অযাচিত ও অন্যায়ভাবে কারো পক্ষ নেওয়া, কারো মনোতুষ্টি বা বিরাগভাজন হওয়া, জনপ্রিয়তা ও পদ-পদবীলাভ বা তা সংরক্ষণ অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো বৈষয়িক অর্জনকে সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। শুধুমাত্র মহান অন্তর্যামী আল্লাহ ও তাঁর ক্রোধকে ভয় করে, তাঁর নিষ্ঠাবান প্রতিনিধির উপযুক্ত মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের কথা বিবেচনা করে আল্লাহ-প্রদত্ত নির্দেশনাবলীর অনুসরণ করে যেতে হবে।

    ﴿ وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢ ﴾ [البقرة: ٤٢]

    ৪২. আর৫৪ তোমরা হককে বাতিলের সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে হককে গোপন করো না।৫৫

    ৫৪. বনী ইসরাঈলের সাথে মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে অঙ্গীকারগুলো ছিলো, আগের আয়াতসমূহের ধারাবাহিকতায় তার বর্ণনা চলছে।

    ৫৫. তৎকালীন আরববাসীদের মধ্যে খ্রিস্টান বিশেষতঃ ইয়াহূদীরা যথেষ্ট শিক্ষিত ছিল। ফলে সাধারণ আরবরা মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়ত প্রসঙ্গে শিক্ষিত ইয়াহূদী পুরোহিতদের কাছে জানতে চাইত; কিন্তু তাদের আসমানী কিতাবের ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী সুস্পষ্ট ও নির্ভুল বৈশিষ্ট্য ও প্রমাণাদি লক্ষ্য করেও তারা সত্য-মিথ্যাকে মিশ্রিত করে বা গোপন করে প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ও সন্দেহ সঞ্চার করতে থাকে।

    আরো জানতে দেখুন:

    সূরা নং- ২ আল-বাকারা: ১১১, ১১৩, ১৩৫, ১৪০

    সূরা নং- ৩ আলে-ইমরান: ৬৭

    সূরা নং- ৪ আন-নিসা: ৪৬

    সূরা নং- ৫ আল-মায়িদা: ১৮, ৪১, ৪৪, ৬৪, ৮২

    সূরা নং- ৭ আল-আ’রাফ: ১৬৭

    সূরা নং- ৬১ আস-সাফ্‌: ৫-৬

    এছাড়া মহান আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন এ বাণী থেকে আমরা সত্য ও মিথ্যার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ কি হওয়া উচিত সে নির্দেশনাও পাই।

    ﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣ ﴾ [البقرة: ٤٣]

    ৪৩. আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর৫৭ এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর।৫৮

    ৫৬. বনী ইসরাঈলের প্রতি মহান রাব্বুল আ'লামীনের যে নির্দেশনাগুলো ছিলো, সে আলোচনাই এখানে চলমান।

    ৫৭. সালাত ও যাকাত প্রতি যুগে যুগে দ্বীন ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে; কিন্তু ইয়াহূদীরা এ ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শন করে জামা‘আতে সালাত পড়ার ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত প্রায় বিলুপ্ত করে বেশির ভাগ লোক ব্যক্তিগত পর্যায়ে সালাত ছেড়ে দেয়। আর যাকাত দেয়ার পরিবর্তে তারা অভ্যস্ত ছিলো সুদের ব্যবসায়।

    এখানে আমাদেরও ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সালাত ও যাকাত অনুশীলনে উপলব্ধির অবকাশ রয়েছে।

    ৫৮. পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতগুলো জামা‘আতে আদায় করার তাকিদ।

    ﴿ ۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٤٤ ﴾ [البقرة: ٤٤]

    ৪৪. তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দিচ্ছ আর নিজেদেরকে ভুলে যাচ্ছ? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত কর।৫৯ তোমরা কি বুঝো না?

    ৫৯. হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা কার্যতঃ করো না? আল্লাহর কাছে এটি অত্যন্ত ক্রোধ উদ্রেককারী ব্যাপার যে, তোমরা বলবে এমন কথা, যা করো না। [সূরা আস-সাফ, আয়াত: ২-৩]

    ﴿ وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى ٱلۡخَٰشِعِينَ ٤٥ ﴾ [البقرة: ٤٥]

    ৪৫. আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় তা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের ওপর কঠিন।

    ﴿ ٱلَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَٰقُواْ رَبِّهِمۡ وَأَنَّهُمۡ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ٤٦ ﴾ [البقرة: ٤٦]

    ৪৬. যারা বিশ্বাস করে যে, তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং তারা তাঁর দিকে ফিরে যাবে।

    ﴿ يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ٤٧ ﴾ [البقرة: ٤٧]

    ৪৭. হে বনী ইসরাঈল, তোমরা আমার নি‘আমতকে স্মরণ কর, যে নি‘আমত আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।৬০

    ৬০. এখানে সে যুগের কথা বলা হয়েছে, যখন দুনিয়ার সব জাতির মধ্যে একমাত্র বনী ইসরাঈল বা ইয়াহূদীদের কাছে আল্লাহ-প্রদত্ত সত্যজ্ঞান ছিল এবং তাদেরকেই বিশ্বের জাতিসমূহের নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। অন্যান্য জাতিদেরকে আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বের পথে আহবান করা ছিল তাদের দায়িত্ব।

    ﴿ وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا يُؤۡخَذُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٤٨ ﴾ [البقرة: ٤٨]

    ৪৮. আর তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যেদিন কেউ কারো কোনো কাজে আসবে না। আর কারো পক্ষ থেকে কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারো কাছ থেকে কোনো বিনিময় নেওয়া হবে না। আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। ৬১

    ৬১. 'জবাবদিহির দিনের' কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই বনী ইসরাঈলের মাঝে চরম পদস্খলন ঘটেছিল। বস্তুতঃ আখিরাত তথা মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা, কিয়ামত, পুনরুত্থান, হাশর, জবাবদিহি ও অনন্তকালের জীবন সম্পর্কিত সুস্পষ্ট ধারণা, বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি বা দুর্বলতাই মানুষের চরিত্র ও জীবনধারায় বিকৃতির অন্যতম প্রধান কারণ। তাই তো মানুষের প্রকৃত কল্যাণকামী প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন পবিত্র কুরআনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বর্ণনা করেছেন আখিরাতের কথা।

    ﴿ وَإِذۡ نَجَّيۡنَٰكُم مِّنۡ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ يَسُومُونَكُمۡ سُوٓءَ ٱلۡعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبۡنَآءَكُمۡ وَيَسۡتَحۡيُونَ نِسَآءَكُمۡۚ وَفِي ذَٰلِكُم بَلَآءٞ مِّن رَّبِّكُمۡ عَظِيمٞ ٤٩ ﴾ [البقرة: ٤٩]

    ৪৯. আর স্মরণ কর,৬২ যখন আমি তোমাদেরকে ফিরআউনের দল থেকে রক্ষা করেছিলাম। তারা তোমাদেরকে কঠিন আযাব দিত। তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে যবেহ করত এবং তোমাদের নারীদেরকে বাঁচিয়ে রাখত। আর এতে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ছিল মহা পরীক্ষা।

    ৬২. এখান থেকে পরবর্তী কয়েক রুকূ ক্রমাগতভাবে বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ অংশ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে একদিকে তাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত দয়া-অনুগ্রহ, অপরদিকে তার বিপরীতে তাদের সীমাহীন অকৃতজ্ঞতা ও দুষ্কর্মের সারাংশ বর্ণনা করা হয়েছে।

    ﴿ وَإِذۡ فَرَقۡنَا بِكُمُ ٱلۡبَحۡرَ فَأَنجَيۡنَٰكُمۡ وَأَغۡرَقۡنَآ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٠ ﴾ [البقرة: ٥٠]

    ৫০. আর যখন তোমাদের জন্য আমি সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে নাজাত দিয়েছিলাম এবং ফির‘আউন দলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তোমরা দেখছিলে।

    ﴿ وَإِذۡ وَٰعَدۡنَا مُوسَىٰٓ أَرۡبَعِينَ لَيۡلَةٗ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٥١ ﴾ [البقرة: ٥١]

    ৫১. আর যখন আমি মূসাকে চল্লিশ রাতের ওয়াদা দিয়েছিলাম,৬৪ অতঃপর তোমরা তার যাওয়ার পর বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছিলে,৬৫ আর তোমরা ছিলে যালিম।

    ৬৪. মিশর থেকে মূসা ‘আলাইহিস সালামের নেতৃত্বে মুক্তি লাভের পর বনী ইসরাঈল বা ইয়াহূদীরা যখন সাইনা (সিনাই) উপত্যকায় পৌঁছে, তখন মহান আল্লাহ তাঁকে ৪০ দিন-রাতের জন্য তূর পাহাড়ে ডেকে নেন। ফিরাউনের দাসত্ব থেকে এখন মুক্ত জাতিটির জন্য জীবন-যাপনের বিধান দান করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।

    ৬৫. সিনাই উপত্যকায় বনী ইসরাঈলের বসবাসের স্থানে প্রতিবেশি গোত্রদের মধ্যে গাভী ও ষাঁড় পূজার প্রথা বিদ্যমান ছিল। তা থেকে প্রভাবিত হয়ে এবং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর অনুপস্থিতিতে এবং হারুন ‘আলাইহিস সালামকে অগ্রাহ্য করে বাছুর আকৃতির মূর্তি নির্মাণ করে তার পূজা করতে শুরু করে।

    ﴿ ثُمَّ عَفَوۡنَا عَنكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٢ ﴾ [البقرة: ٥٢]

    ৫২. অতঃপর আমি তোমাদেরকে এ সবের পর ক্ষমা করেছি, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।

    ﴿ وَإِذۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡفُرۡقَانَ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ٥٣ ﴾ [البقرة: ٥٣]

    ৫৩. আর যখন আমি মূসাকে দিয়েছিলাম কিতাব ও ফুরকান৬৭ যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।

    ৬৭. ফুরকান হচ্ছে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্টকারী 'মানদণ্ড'। এর মর্মার্থ হলো দ্বীনের এমন জ্ঞান, বোধ (perception) ও উপলব্ধি যার মাধ্যমে মানুষ সঠিক ও সত্য এবং মিথ্যা ও বিকৃতিকে পৃথক করে চিনে নিতে পারে।

    ﴿ وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ يَٰقَوۡمِ إِنَّكُمۡ ظَلَمۡتُمۡ أَنفُسَكُم بِٱتِّخَاذِكُمُ ٱلۡعِجۡلَ فَتُوبُوٓاْ إِلَىٰ بَارِئِكُمۡ فَٱقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ عِندَ بَارِئِكُمۡ فَتَابَ عَلَيۡكُمۡۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٥٤ ﴾ [البقرة: ٥٤]

    ৫৪. আর যখন মূসা তার কওমকে বলেছিল, ‘হে আমার কওম, নিশ্চয় তোমরা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করে নিজদেরকে যুলুম করেছ। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তাওবা কর। অতঃপর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর।৬৮ এটি তোমাদের জন্য তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট উত্তম। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের তাওবা কবুল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।

    ৬৮. অর্থাৎ তাদের মধ্যে যেসব লোক গো-শাবককে উপাস্য বানিয়ে তার পূজা করেছে তাদেরকে হত্যা করো।

    ﴿ وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نُّؤۡمِنَ لَكَ حَتَّىٰ نَرَى ٱللَّهَ جَهۡرَةٗ فَأَخَذَتۡكُمُ ٱلصَّٰعِقَةُ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٥ ﴾ [البقرة: ٥٥]

    ৫৫. আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব না, যতক্ষণ না আমরা প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখি’। ফলে বজ্র তোমাদেরকে পাকড়াও করল আর তোমরা তা দেখছিলে।

    ﴿ ثُمَّ بَعَثۡنَٰكُم مِّنۢ بَعۡدِ مَوۡتِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٦ ﴾ [البقرة: ٥٦]

    ৫৬. অতঃপর আমি তোমাদের মৃত্যুর পর তোমাদেরকে পুনর্জীবন দান করলাম, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।৬৯

    ৬৯. এখানে ইঙ্গিতকৃত ঘটনাটি হলো, মূসা ‘আলাইহিস সালাম ৪০ দিনের জন্য তূর পাহাড়ে গমনের সময় মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী বনী ইসরাঈল থেকে ৭০জন বাছাইকৃত ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে যান। অতঃপর তাঁকে সেখানে 'কিতাব ও ফুরকান' দেওয়া হলে (দেখুন: আল-বাকারা, আয়াত: ৫৩) তিনি সেগুলো উক্ত ব্যক্তিদেরকে প্রদর্শন করেন। তখন এসবের মধ্য থেকে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক ধৃষ্টতার সাথে একথা বলতে থাকে যে, আল্লাহকে দৃশ্যমান আকারে আমাদেরকে দেখাও। তাদের ঐ আচরণের প্রেক্ষিতে তাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়।

    আরো জানতে দেখুন: সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৫৫।

    ﴿ وَظَلَّلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡغَمَامَ وَأَنزَلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡمَنَّ وَٱلسَّلۡوَىٰۖ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡۚ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَٰكِن كَانُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ يَظۡلِمُونَ ٥٧ ﴾ [البقرة: ٥٧]

    ৫৭. আর আমি তোমাদের ওপর মেঘের ছায়া দিলাম৭০ এবং তোমাদের প্রতি নাযিল করলাম ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’।৭১ তোমরা সে পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। আর তারা আমার প্রতি যুলুম করেনি, বরং তারা নিজেদেরকেই যুলুম করত।

    ৭০. মিশর থেকে প্রস্থানকালে বনী ইসরাঈলের সংখ্যা ছিল এক লাখের মত। আর সিনাই উপদ্বীপে ঘর-বাড়ী তো দূরের কথা, মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই পর্যন্ত ছিল না। তখন মহান আল্লাহ যদি দীর্ঘকাল পর্যন্ত আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন না রাখতেন, তাহলে এ জাতি প্রখর রোদে ধ্বংস হয়ে যেতো।

    ৭১. 'মান্না' এক প্রকার আঠা জাতীয় মিষ্টি খাদ্য (sweet gum), কুয়াশার মত এগুলো বর্ষিত হতো। আর 'সালওয়া' ছিল কোয়েলের মত এক প্রকার ছোট পাখী (quails)। সিনাই উপদ্বীপের প্রতিকূল পরিবেশে (severely adverse topography & terrain) এক লাখ লোকের ৪০ বছরের উদ্বাস্তু জীবনে এভাবেই দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন বিনা শ্রমে রিযিকের সংস্থান করেছিলেন (আরো জানতে দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং-৪১২০)

    ﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا ٱدۡخُلُواْ هَٰذِهِ ٱلۡقَرۡيَةَ فَكُلُواْ مِنۡهَا حَيۡثُ شِئۡتُمۡ رَغَدٗا وَٱدۡخُلُواْ ٱلۡبَابَ سُجَّدٗا وَقُولُواْ حِطَّةٞ نَّغۡفِرۡ لَكُمۡ خَطَٰيَٰكُمۡۚ وَسَنَزِيدُ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٥٨ ﴾ [البقرة: ٥٨]

    ৫৮. আর স্মরণ কর, যখন আমি বললাম, ‘তোমরা প্রবেশ কর এ জনপদে। আর তা থেকে আহার কর তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী, স্বাচ্ছন্দ্যে এবং দরজায় প্রবেশ কর মাথা নীচু করে। আর বল ‘ক্ষমা’। তাহলে আমি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং নিশ্চয় আমি সৎকর্মশীলদেরকে বাড়িয়ে দেব’।

    ﴿ فَبَدَّلَ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ قَوۡلًا غَيۡرَ ٱلَّذِي قِيلَ لَهُمۡ فَأَنزَلۡنَا عَلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ رِجۡزٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ بِمَا كَانُواْ يَفۡسُقُونَ ٥٩ ﴾ [البقرة: ٥٩]

    ৫৯. কিন্তু যালিমরা পরিবর্তন করে ফেলল সে কথা তাদেরকে যা বলা হয়েছিল, তা ভিন্ন অন্য কথা দিয়ে। ফলে আমি তাদের ওপর আসমান থেকে আযাব নাযিল করলাম, কারণ তারা পাপাচার করত।

    ﴿ ۞وَإِذِ ٱسۡتَسۡقَىٰ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ فَقُلۡنَا ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡحَجَرَۖ فَٱنفَجَرَتۡ مِنۡهُ ٱثۡنَتَا عَشۡرَةَ عَيۡنٗاۖ قَدۡ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٖ مَّشۡرَبَهُمۡۖ كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ مِن رِّزۡقِ ٱللَّهِ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ ٦٠ ﴾ [البقرة: ٦٠]

    ৬০. আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমের জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, ‘তুমি তোমার লাঠি দ্বারা পাথরকে আঘাত কর’। ফলে তা থেকে উৎসারিত হল বারটি ঝরনা;৭৬ প্রতিটি দল তাদের পানি পানের স্থান জেনে নিল।৭৭ তোমরা আল্লাহর রিযিক থেকে আহার কর ও পান কর এবং ফাসাদকারী হয়ে যমীনে ঘুরে বেড়িয়ো না।

    ৭৬. ঐ পাথর গুলোর অস্তিত্ব এখনো মিসরের সিনাই উপদ্বীপ এলাকায় বিদ্যমান।

    ৭৭. বারোটি ঝরনার উদ্ভবের কারণ, বনী ইসরাঈলে ছিল ১২টি গোত্র, যাতে পানি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিবাদ না হয়।

    দেখুন: সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ১৬০

    ﴿ وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نَّصۡبِرَ عَلَىٰ طَعَامٖ وَٰحِدٖ فَٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُخۡرِجۡ لَنَا مِمَّا تُنۢبِتُ ٱلۡأَرۡضُ مِنۢ بَقۡلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَاۖ قَالَ أَتَسۡتَبۡدِلُونَ ٱلَّذِي هُوَ أَدۡنَىٰ بِٱلَّذِي هُوَ خَيۡرٌۚ ٱهۡبِطُواْ مِصۡرٗا فَإِنَّ لَكُم مَّا سَأَلۡتُمۡۗ وَضُرِبَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلذِّلَّةُ وَٱلۡمَسۡكَنَةُ وَبَآءُو بِغَضَبٖ مِّنَ ٱللَّهِۗ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ يَكۡفُرُونَ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ وَيَقۡتُلُونَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۗ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٦١ ﴾ [البقرة: ٦١]

    ৬১. আর যখন তোমরা বললে, ‘হে মূসা, আমরা এক খাবারের ওপর কখনো ধৈর্য ধরবো না। সুতরাং তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দো’আ কর, যেনো তিনি আমাদের জন্য বের করেন, ভূমি যে সব্জি, কাঁকড়, রসুন, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করে, তা’। সে বলল, ‘তোমরা কি যা উত্তম তার পরিবর্তে এমন জিনিস গ্রহণ করছো যা নিম্নমানের? তোমরা কোনো এক নগরীতে অবতরণ কর। তবে নিশ্চয় তোমাদের জন্য (সেখানে) থাকবে, যা তোমরা চেয়েছ’। আর তাদের ওপর আরোপ করা হয়েছে লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য এবং তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হল। তা এ কারণে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করত৭৮ এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করত। ৭৯ তা এ কারণে যে, তারা নাফরমানী করেছিল এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত।৮০

    ৭৮. মহান আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করার কয়েকটি অবস্থা রয়েছে:

    ক. আল্লাহ-প্রদত্ত বিধি-বিধানের মধ্যে যেসব বিধান নিজের খেয়াল-খুশীর বিপরীত সেগুলো মানতে সরাসরি অস্বীকার করা।

    খ. কোনো বিধানকে আল্লাহ-প্রদত্ত জেনেও গর্ব-অহংকারের সাথে তার বিপরীত কাজ করা এবং আল্লাহর নির্দেশের কোনো পরওয়া না করা।

    গ. মহান রাব্বুল আ’লামীনের বাণীর মর্মার্থ ভালোভাবে জানা ও বুঝার পরও প্রবৃত্তির চাহিদা অনুসারে তার পরিবর্তন করা।

    ৭৯. বনী ইসরাঈল-কর্তৃক নবী-হত্যাসহ গুরুতর অপরাধসমূহের বিবরণ তাদের নিজেদের ইতিহাসেই লিপিবদ্ধ রয়েছে, তার দু-তিনটি উদাহরণ নীচে দেওয়া হলো। আপনি আগ্রহী হলে লিঙ্কগুলো দেখতে পারেন:

    ক. ইয়াহ্‌ইয়া আ: (যোহন)-কে হত্যা: মার্ক, অধ্যায় - ৬, শ্লোক ১৭-২৯. http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Mark.pdf

    খ. নবী ইয়ারমিয়ার (যেরেমিয়া) ওপর নির্যাতন: যেরেমিয়া, অধ্যায় - ১৮, শ্লোক ১৩-২৩

    http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Jeremiah.pdf

    গ. যাকারিয়া আ:-কে প্রস্তরাঘাত করা:

    http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Zechariah.pdf

    ঘ. ঈসা আ: এর বিরূদ্ধে মামলা, বিচার ও ফাঁসির রায়: মথি, অধ্যায় - ২৭, শ্লোক ২০-২৬

    http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbnew/Matthew.pdf

    ৮০. যুগে যুগে যে সব জাতি মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম নিয়ামত ও নিদর্শন লাভের পরও সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মানব তথা নবী-রাসূলদেরসহ সৎ, সত্য-পন্থী ও আল্লাহর পথে আহবানকারীদের নির্যাতন করেছে, বয়কট করেছে, হত্যা করেছে; অবাধ্যতা, সীমালংঘন আর মানুষের ন্যায্য অধিকার হরণের প্রতিযোগিতা করেছে, আর ফাসিক ও দুশ্চরিত্র লোকদের নেতৃত্বে নিজদেরকে চালিত করেছে - তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত অনিবার্য।

    ﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱلَّذِينَ هَادُواْ وَٱلنَّصَٰرَىٰ وَٱلصَّٰبِ‍ِٔينَ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَلَهُمۡ أَجۡرُهُمۡ عِندَ رَبِّهِمۡ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ﴾ [البقرة: ٦٢]

    ৬২. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং খ্রিস্টান ও সাবিঈনরা-৮১ (তাদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও আখিরাতের দিনের প্রতি এবং নেক কাজ করেছে - তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।৮২

    ৮১. সাবেয়ীদের ধর্মীয় বিশ্বাস কি ছিল তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহি. বলেছেন, সাবেয়ীদের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহমতুল্লাহি ‘আলাইহির মতে সাবেয়ীরা বৃহৎ একটি দল যাদের কেউ ছিল মু’মিন আবার কেউ কাফির। সাবেয়ীরা নবী-রাসূলদের অস্বীকার করত না, তবে তাদের আনুগত্যকেও বাধ্যতামূলক মনে করত না। তারা সর্বজ্ঞাত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত তবে তাদের অধিকাংশের বক্তব্য ছিল, মাধ্যম গ্রহণ ব্যতীত আল্লাহর কাছে পৌঁছা কখনো সম্ভব নয়। তাই তারা ঐসব মাধ্যমকে উপাসনার পাত্ররূপে গ্রহণ করে নিয়েছিল। সাবেয়ীরা যে ধর্মে যে বিষয়টাকে ভালো মনে করত তারা সেটাকেই আপন করে নিত। তারা সুনির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষপাতিত্ব করত না; বরং সাবেয়ীদের কাছে সকল ধর্মের বিধানগুলো পৃথিবীর কল্যাণার্থেই প্রবর্তিত হয়েছে।

    তবে সাবেয়ীরা দুটি মৌল ধারায় বিভক্ত ছিল বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। একটি ধারায় ছিল হুনাফা, অর্থাৎ একত্ববাদী সাবেয়ীরা, আরেকটি ছিল মুশরিক সাবেয়ীরা। (দ্র: আররাদ্দু আলাল মান্তেকিয়ীন: ১৮৭-৪৫৪, ২৯০-৪৫৮ )

    ৮২. মহান আল্লাহর কাছে মূল্য ও মর্যাদা একমাত্র যথাযথ ঈমান ও সৎ কাজের। যে ব্যক্তি এ সম্পদ নিয়ে তাঁর সামনে হাযির হতে পারবে, সে লাভ করবে পূর্ণ পুরস্কার।

    ﴿ وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱذۡكُرُواْ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٦٣ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَۖ فَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ لَكُنتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٤ ﴾ [البقرة: ٦٣، ٦٤]

    ৬৩-৬৪. আর স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের ওপর উঠালাম।৮৪ আমি (বললাম) ‘তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা শক্তভাবে ধর এবং তাতে যা রয়েছে তা স্মরণ কর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার’।৮৫

    অতঃপর তোমরা এ সবের পর বিমুখ হয়ে ফিরে গেলে। আর যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না হত, তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হতে।৮৬

    ৮৫. মুত্তাকী তারা যারা সবসময় দয়াময় আল্লাহর ক্ষমা ও পুরস্কার লাভের আশায় সতর্কাবস্থায় চলে এবং সৎকাজে সদা তৎপর থাকে; আর মহাবিচার দিনের মালিক আল্লাহর শাস্তিকে সব সময় ভয় পায়, তাই সদা সর্বদা অন্যায়-অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকে।

    ৮৬. এ হলো করুণাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর পরম প্রিয়সৃষ্টি মানুষকে - জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নয়- বরং নিজ আগ্রহে সংশোধিত হয়ে তাঁর ক্ষমা লাভে ধন্য হবার সুযোগ যা বার বার মানুষের দরজায় কড়া নাড়ে। তারপরেও কি আমাদের তাঁর সন্তষ্টির পথে পুরোপুরি ফিরে এসে আলোকিত জীবন গড়ার সময় হবে না?

    ﴿ وَلَقَدۡ عَلِمۡتُمُ ٱلَّذِينَ ٱعۡتَدَوۡاْ مِنكُمۡ فِي ٱلسَّبۡتِ فَقُلۡنَا لَهُمۡ كُونُواْ قِرَدَةً خَٰسِ‍ِٔينَ ٦٥ فَجَعَلۡنَٰهَا نَكَٰلٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهَا وَمَا خَلۡفَهَا وَمَوۡعِظَةٗ لِّلۡمُتَّقِينَ ٦٦ ﴾ [البقرة: ٦٥، ٦٦]

    ৬৫. আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের৮৭ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল, তাদেরকে অবশ্যই তোমরা জান। অতঃপর আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’।৮৮

    ৬৬. আর আমি একে বানিয়েছি দৃষ্টান্ত, সে সময়ের এবং তৎপরবর্তী জনপদসমূহের জন্য এবং মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।

    ৮৭. ‘সাব্‌ত’ অর্থ কালের একটি ক্ষণ যা আরাম-বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বনী ইসরাঈলের প্রতি এ বিধান ছিল যে, শনিবার দিনকে তারা বিশ্রাম ও ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট রাখবে। এদিনে তারা পার্থিব কোনো কাজ-কর্ম নিজেরা বা পরিচারকদের দিয়েও করাতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে এমন কড়া আইন ছিল যে, এ পবিত্র দিনের নির্দেশ অমান্যকারীর শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। বর্তমান বিকৃত বাইবেলেও (যাত্রা পুস্তক: অধ্যায় ৩১, শ্লোক ১২-১৭) এ নির্দেশনাটি দেখতে পাবেন এ লিঙ্কে-

    http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Exodus.pdfhttp://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Exodus.pdf

    কিন্তু তারা নৈতিক ও ধর্মীয় পতনের শিকার হবার পর এ বিধানের সুস্পষ্ট অবমাননা করতে থাকে। এমনকি তাদের শহরগুলোতে শনিবারে প্রকাশ্যে চলতে থাকে সব ধরনের কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য।

    ৮৮. তাদেরকে বানরে পরিণত করার অর্থ তাদের মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তিকে পূর্ববৎ রেখে শারীরিক বিকৃতি ঘটিয়ে বানরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।

    # আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন: সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৬৩-১৭১।

    ﴿ وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تَذۡبَحُواْ بَقَرَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَتَّخِذُنَا هُزُوٗاۖ قَالَ أَعُوذُ بِٱللَّهِ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ ٦٧ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ ﴾ [البقرة: ٦٧، ٦٨]

    ৬৭. আর স্মরণ কর, যখন মূসা তার কওমকে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা একটি গাভী যবেহ করবে’।৮৯ তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ?’ সে বলল, ‘আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি।’৯০

    ৬৮. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন গাভীটি কেমন হবে।’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে গরু, বুড়ো নয় এবং বাচ্চাও নয়। এর মাঝামাঝি ধরনের। সুতরাং তোমরা কর যা তোমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’৯১

    ৮৯. এ আয়াতের ‘বাকারাহ’ (গাভী) শব্দ থেকেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

    ৯০. এখানে উল্লেখিত ঘটনাটি সংক্ষেপে এ যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে একটি হত্যাকান্ড ঘটেছিল; কিন্তু হত্যাকারীকে সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তাই তারা মূসা ‘আলাইহিস সালামের স্মরণাপন্ন হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দিয়ে একটি গাভী যবেহ-এর মাধ্যমে নিহত লোকটিকে জীবিত করে তার হত্যাকারীর পরিচয় উদঘাটন করান। এটি ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা।

    ৯১. আসলে মহান আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে যে কোনো একটি গাভী কুরবানী করাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু দ্বীনের যে কোনো বিধান পালনে অযথা সন্দেহ-সংশয়, অন্বেষণ ও প্রশ্ন করা ছিল তাদের চিরাচরিত স্বভাব।

    ﴿ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا لَوۡنُهَاۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ صَفۡرَآءُ فَاقِعٞ لَّوۡنُهَا تَسُرُّ ٱلنَّٰظِرِينَ ٦٩ قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَ إِنَّ ٱلۡبَقَرَ تَشَٰبَهَ عَلَيۡنَا وَإِنَّآ إِن شَآءَ ٱللَّهُ لَمُهۡتَدُونَ ٧٠ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا ذَلُولٞ تُثِيرُ ٱلۡأَرۡضَ وَلَا تَسۡقِي ٱلۡحَرۡثَ مُسَلَّمَةٞ لَّا شِيَةَ فِيهَاۚ قَالُواْ ٱلۡـَٰٔنَ جِئۡتَ بِٱلۡحَقِّۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُواْ يَفۡعَلُونَ ٧١ ﴾ [البقرة: ٦٨، ٧١]

    ৬৯. তারা বলল,৯২ ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, কেমন তার রঙ?’ সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, নিশ্চয় তা হবে হলুদ রঙের গাভী, তার রঙ উজ্জ্বল, দর্শকদেরকে যা আনন্দ দেবে।’

    ৭০. তারা বলল, ‘তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট দোআ কর, তিনি যেনো আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দেন, তা কেমন? নিশ্চয় গরুটি আমাদের জন্য সন্দেহপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আর নিশ্চয় আমরা আল্লাহ চাহে তো পথপ্রাপ্ত হব।’

    ৭১. সে বলল, ‘নিশ্চয় তিনি বলছেন, ‘নিশ্চয় তা এমন গাভী, যা ব্যবহৃত হয়নি জমি চাষ করায় আর না ক্ষেতে পানি দেয়ায়। সুস্থ, যাতে কোনো খুঁত নেই।’ তারা বলল, ‘এখন তুমি সত্য নিয়ে এসেছ।’ অতঃপর তারা তা যবেহ করল অথচ তারা যবেহ করার ছিল না।৯৩

    ৯২. পূর্বের দুটি আয়াতের সাথে মিলিয়ে অধ্যয়ন করলে মর্মার্থ বুঝা সহজ হবে। গাভী সম্পর্কে বনী ইসরাঈলের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সন্দেহ নিরসন চলছে।

    ৯৩. বনী ইসরাঈলের লোকেরা তৎকালীন মিশরের ফিরাউনের যুলুম ও অত্যাচার থেকে মহান আল্লাহর অসীম-অলৌকিক সাহায্যে মুক্তিলাভের পর সিনাই উপদ্বীপে অবস্থান নেয়। এসময় আশপাশের গো-পূজারী জাতিসমূহ থেকে তাদের মাঝে ‘গাভীর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার’ ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ে; আর তারা শুরু করে দেয় গো-বৎস পূজা। ঐ গর্হিত কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে গাভী কুরবানীর নির্দেশ দিলেন। এটি তাদের জন্যে ছিল ঈমানের এক কঠিন পরীক্ষা। তাই তারা এ আদেশ এড়িয়ে যেতে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে; কিন্তু তার জবাবে সে ‘সোনালী বর্ণের বিশেষ ধরনের গাভী’ই তাদের সামনে এসে পড়ে, যাকে সে সময় তারা পূজা করতো!

    বর্তমান বিকৃত বাইবেলের গণনা পুস্তকের ১৯ অধ্যায়ের ১-১০ শ্লোকগুলোতে এ ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে ।

    http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Numbers.pdf

    ﴿ وَإِذۡ قَتَلۡتُمۡ نَفۡسٗا فَٱدَّٰرَٰٔتُمۡ فِيهَاۖ وَٱللَّهُ مُخۡرِجٞ مَّا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٧٢ ﴾ [البقرة: ٧٢]

    ৭২. আর স্মরণ কর, যখন তোমরা একজনকে হত্যা করলে অতঃপর সে ব্যাপারে একে অপরকে দোষারোপ করলে। আর আল্লাহ বের করে দিলেন তোমরা যা গোপন করছিলে।

    ﴿ فَقُلۡنَا ٱضۡرِبُوهُ بِبَعۡضِهَاۚ كَذَٰلِكَ يُحۡيِ ٱللَّهُ ٱلۡمَوۡتَىٰ وَيُرِيكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٧٣ ﴾ [البقرة: ٧٣]

    ৭৩. অতঃপর আমি বললাম, ‘তোমরা তাকে আঘাত কর গাভীটির (গোস্তের) কিছু অংশ দিয়ে। এভাবে আল্লাহ জীবিত করেন মৃতদেরকে। আর তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখান, যাতে তোমরা বুঝ।৯৪

    ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    ৯৪. এটি ছিল বনী ইসরাঈলের সময়ের অসংখ্য মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনার একটি। এখানে নিহত ব্যক্তি শুধুমাত্র তার হন্তার পরিচয় বলতে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশে জীবন ফিরে পেয়েছিল।

    ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    ﴿ ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَٱلۡحِجَارَةِ أَوۡ أَشَدُّ قَسۡوَةٗۚ وَإِنَّ مِنَ ٱلۡحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنۡهُ ٱلۡأَنۡهَٰرُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخۡرُجُ مِنۡهُ ٱلۡمَآءُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَهۡبِطُ مِنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٧٤ ﴾ [البقرة: ٧٤]

    ৭৪. অতঃপর তোমাদের অন্তরসমূহ এর পরে কঠিন হয়ে গেল যেনো তা পাথরের মত কিংবা তার চেয়েও শক্ত। আর নিশ্চয় পাথরের মধ্যে কিছু আছে, যা থেকে নহর উৎসারিত হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা চূর্ণ হয়। ফলে তা থেকে পানি বের হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।৯৫ আর আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে গাফেল নন।

    ৯৫. উপমাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। পাথর আপাতঃ দৃষ্টিতে এক নির্জীব প্রাকৃতিক কঠিন বস্তু; কিন্তু তার মাঝেও রয়েছে কোমলতা, যার অনুপম বর্ণনা করেছেন স্বয়ং তার সৃষ্টিকর্তা। এ বস্তুটির সাথে মানুষের হৃদয়ের তুলনা করেছেন রাব্বুল আলামীন। এখানে ৩ ধরনের পাথরের উল্লেখ করা হয়েছে:

    ক. যা থেকে প্রবাহিত হয় ঝরনাধারা তথা নদী-নালা, যা সৃষ্ট জীবের উপকারে আসে।

    খ. যা ফেটে গলে বের হয়ে আসে পানি, অর্থাৎ বাইরে কঠিন হলেও অন্তঃস্থল সুকোমল;

    গ. কিছু পাথর, আরো সংবেদনশীল, যা যমীনে ধ্বসে পড়ে মহান আল্লাহর ভয়ে।

    কিন্তু মানুষের মাঝে এমনও কিছু হৃদয় আছে, বিশেষতঃ এ আয়াতের প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখিত ইয়াহূদীদের অন্তর এতোই কঠিন যে, সৃষ্ট-জীবের দুঃখ-দুর্দশায়ও ঐ পাষাণদের চোখ অশ্রুসজল হয় না, আল্লাহর আক্রোশের ভয়ে হৃদয়গুলো এতটুকু প্রকম্পিত হয় না, অন্তরগুলো বিগলিত হয় না আল্লাহর কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন দেখেও।

    ﴿ ۞أَفَتَطۡمَعُونَ أَن يُؤۡمِنُواْ لَكُمۡ وَقَدۡ كَانَ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۡ يَسۡمَعُونَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُۥ مِنۢ بَعۡدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٧٥ ﴾ [البقرة: ٧٥]

    ৭৫. তোমরা কি এ আশা করছো যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল৯৬ যারা আল্লাহর বাণী শুনত,৯৭ অতঃপর তা বুঝে নেওয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে।৯৮

    ৯৬. বনী ইসরাঈলের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের বুঝানো হয়েছে।

    ৯৭. তাওরাত, যাবূর ও অন্যান্য কিতাবকে বুঝানো হয়েছে, যা নবীদের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছেছে।

    ৯৮. ‘তাহরীফ’ অর্থ বিকৃতি বা পরিবর্তন; যা দু’ভাবে হতে পারে:

    ক. কথার মূল অর্থ গোপন রেখে নিজ ইচ্ছা, প্রবৃত্তি ও সুবিধার অনুকূলে তার ব্যাখ্যা করা, যা মূল বক্তার লক্ষ্য ও ইচ্ছার খেলাফ।

    খ. উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাক্যের শব্দ পরিবর্তন।

    বনী ইসরাঈলের আলেমগণ আল্লাহর কিতাবে এ উভয় ধরনের বিকৃতিই করেছে।

    ﴿ وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ قَالُوٓاْ أَتُحَدِّثُونَهُم بِمَا فَتَحَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمۡ لِيُحَآجُّوكُم بِهِۦ عِندَ رَبِّكُمۡۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٧٦ ﴾ [البقرة: ٧٦]

    ৭৬. আর যখন তারা মু’মিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি।’ আর যখন একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, ‘তোমরা কি তাদের সাথে সে কথা আলোচনা কর, যা আল্লাহ তোমাদের ওপর উম্মুক্ত করেছেন, যাতে তারা এর মাধ্যমে তোমাদের রবের নিকট তোমাদের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করবে?৯৯ তবে কি তোমরা বুঝো না’?১০০

    ৯৯. আতা ইবন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে বললাম, তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় (বর্ণিত) আছে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। তিনি বলেন, হ্যাঁ, ঠিক কথা। কুরআনে বর্ণিত তাঁর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের কিছুটা তাওরাতে উল্লেখিত হয়েছে: ‘হে নবী! আমি আপনাকে (সত্য-দ্বীনের) সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি এবং উম্মিদের রক্ষাকারী হিসেবে পাঠিয়েছি। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনার নাম দিয়েছি মুতাওয়াক্কিল বা ভরসাকারী। আপনি দুশ্চরিত্র বা রূঢ় ও কঠোর হৃদয় নন এবং বাজারে ঝগড়া ও হৈ-হুল্লোড়কারী নন’। (আপনি এমন ব্যক্তি) যে কোনো মন্দ দিয়ে মন্দকে প্রতিহতকারী নয়, বরং মাফ করে দেয়। আল্লাহ তাঁকে (মৃত্যু দিয়ে) ততদিন পর্যন্ত দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন না যতদিন না সবাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই) একথা স্বীকার করার মাধ্যমে সৎপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তা দিয়ে অন্ধের চোখ, বধিরের কান এবং (অসত্যের অন্ধকারে) আচ্ছাদিত হৃদয় ও মন-মানসিকতা উন্মুক্ত না হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৭৭)

    ১০০. ইয়াহূদীদের নিজেদের মধ্যে আলোচিত ছিল যে, তাওরাত ও অন্যান্য আসমানী কিতাবে মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং যে সব আয়াত ও শিক্ষাবলী তাদের পবিত্র কিতাবসমূহে রয়েছে যা দিয়ে তাদের মানসিকতা ও কর্মনীতিকে দোষারোপ করা যায় সেগুলো যেনো মুসলিমদের কাছে প্রকাশ না পায়; কিন্তু তা ছিল এক ব্যর্থ চেষ্টা-দেখুন পরবর্তী আয়াত।

    ﴿ أَوَ لَا يَعۡلَمُونَ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعۡلِنُونَ ٧٧ ﴾ [البقرة: ٧٧]

    ৭৭. তারা কি জানে না যে, তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে, তা আল্লাহ জানেন?

    ﴿ وَمِنۡهُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّآ أَمَانِيَّ وَإِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ ٧٨ ﴾ [البقرة: ٧٨]

    ৭৮. আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর,১০১ তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে।১০২

    ১০১. এখানে ইয়াহূদীদের দ্বিতীয় ধরনের লোকদের তথা জনসাধারণের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আর প্রথম ধরনের দলটি ছিল তাদের আলেম-ওলামা ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতাদের, যার উল্লেখ ছিল ৭৫নং আয়াতে।

    ১০২. আল্লাহর কিতাবের কোনো জ্ঞানই তাদের ছিল না, তাতে দ্বীনের কি বিধি-বিধান রয়েছে, চারিত্রিক সংশোধন ও শরীয়তের নিয়ম-নীতি তথা মানবজীবনের প্রকৃত সাফল্য ও ব্যর্থতা কিসের ওপর নির্ভরশীল, তার প্রতি তাদের মোটেও মনোযোগ ছিল না। ওহীর জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী না হয়ে তারা নিজেদের ইচ্ছা-আকাঙ্খা অনুসারে নিজেদের মনগড়া কথাগুলোকে দ্বীন মনে করতো, আর মিথ্যামিথ্যি রচিত কিস্‌সা-কাহিনী আর ধারণা-অনুমানের ওপর ভর করে কালাতিপাত করতো।

    এখানে গভীর আশংকার সাথে উল্লেখ্য যে, বর্তমান বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠির অবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে অনুরূপ, যা আমাদের চলমান সামগ্রিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে অনতিবিলম্বে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং প্রকৃত কল্যাণের স্বার্থেই।

    ﴿ فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩ ﴾ [البقرة: ٧٩]

    ৭৯. সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তা তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতে পারে।১০৩ সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার পরিণামে তাদের জন্য ধ্বংস, আর তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস।

    ১০৩. যুগে যুগে আসমানী কিতাবকে বিকৃত করে বিভিন্ন ভাষ্যকারের মনগড়া বিশ্লেষণ, মুখরোচক কল্প-কাহিনী জুড়ে দেওয়া এবং উদ্ভাবিত সুবিধাজনক ও জনপ্রিয় আইন-কানুনের সংযোজনের মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে দুনিয়ার সাময়িক স্বার্থ, অর্থ বা অবস্থান লাভ করা। যার অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান রয়েছে অতীতের সব আসমানী কিতাব, ধর্মগ্রন্থ ও তাদের রক্ষকদের(!) মধ্যে।

    এ থেকে আমাদের দীন-শরিয়া ও জীবন-ব্যবস্থার বিধি-বিধানের ব্যাখ্যাতাদের শিক্ষা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে।

    তবে একমাত্র এবং শুধুমাত্র আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে প্রায় দেড় হাজার বছরেও কেউ, কোনো শক্তি আজ পর্যন্ত তার কোনো শব্দ এমনকি একটি অক্ষরও স্পর্শ করতে পারেনি, আর পারবেও না; যা সমগ্র মানবজাতির সামনে অনন্তকালের জন্য এক জাজ্জ্বল্যমান মু‘জিযা। কারণ, এর সুসংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তিনি বলেছেন,

    ﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]

    আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক। [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]

    ﴿ وَقَالُواْ لَن تَمَسَّنَا ٱلنَّارُ إِلَّآ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَةٗۚ قُلۡ أَتَّخَذۡتُمۡ عِندَ ٱللَّهِ عَهۡدٗا فَلَن يُخۡلِفَ ٱللَّهُ عَهۡدَهُۥٓۖ أَمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٨٠ ﴾ [البقرة: ٨٠]

    ৮০. আর তারা বলে, ‘গোনা-কয়েকদিন ছাড়া আগুন আমাদেরকে কখনো স্পর্শ করবে না’।১০৪ বল, ‘তোমরা কি আল্লাহর নিকট ওয়াদা নিয়েছ, ফলে আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না?১০৫ নাকি আল্লাহর ওপর এমন কিছু বলছ, যা তোমরা জান না’?

    ১০৪. এটি ছিল ইয়াহূদী সমাজের একটি সাধারণ ভুল ধারণা। তারা ভাবতো, যেহেতু তারা ইয়াহূদী, তাই জাহান্নামের আগুন তাদের জন্য নিষিদ্ধ। আর যদি তাদেরকে শাস্তি দেয়াও হয়, তাহলে তা হাতে-গোনা কয়েকদিনের জন্য মাত্র, তারপর তাদেরকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে!

    ১০৫. মুফাস্‌সিরগণের মতে, যদি আল্লাহ ক্ষমা না করেন তবে ঈমানদার ব্যক্তি গুনাহগার হলে জাহান্নামের শাস্তি পাবে, তবে চিরকালের জন্য নয়, শাস্তি ভোগের পর মুক্তি পাবে।

    ইয়াহূদীদের বিশ্বাস, মূসা আ:-এর ধর্ম রহিত হয়নি, তাই তারা ঈমানদার এবং তাঁর পরবর্তী নবী ঈসা আ: ও শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত অস্বীকার করলেও তারা কাফির নয়, যা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কারণ কোনো আসমানী কিতাবেই এটি লেখা নেই যে, মূসা এবং ঈসা ‘আলাইহিমুস সালামের আনীত দীন হলো চিরকালের জন্যে; বরং পরবর্তী এবং শেষ নবীর পূর্বাভাষ রয়েছে তাদের কিতাবে। অনেকগুলো প্রমাণের একটি এখানে দেখুন: দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮, শ্লোক ১৫-১৯ এ লিঙ্কে http://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Deuteronomy.pdfhttp://www.asram.org/downloads/scriptorium/jbold/Deuteronomy.pdf।

    শেষনবীর উম্মত হিসেবে তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান পোষণ করা সন্দেহাতীতভাবে অপরিহার্য। কাজেই নবুওয়াত অস্বীকারকারী কাফির; আর কাফিররা কিছুদিন শাস্তি ভোগ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে - একথাও কোনো আসমানী কিতাবে উল্লেখ নেই।

    ﴿ بَلَىٰۚ مَن كَسَبَ سَيِّئَةٗ وَأَحَٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيٓ‍َٔتُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨١ ﴾ [البقرة: ٨١]

    ৮১. হাঁ, যে মন্দ উপার্জন করবে এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে নেবে,১০৬ তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।

    ১০৬. ‘গুনাহ দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়া’ শুধুমাত্র (মহাসত্যগুলোকে অস্বীকারকারী) কাফিরদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, কুফরের ফলে তাদের কোনো সৎকর্মই গ্রহণযোগ্য হয় না। এমনকি কুফরের পূর্বে কিছু ভালো কাজ করে থাকলেও তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এজন্যে একথার মর্মার্থ এ যে, কাফিরদের গোটা সত্ত্বা ও কৃতকর্মগুলো যেনো নিরেট অপরাধ ও অবাধ্যতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে; সত্যের আলো যেনো গাঢ় অন্ধকারের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা তাদের অস্তিত্বে প্রবেশের কোনো পথ আর খুঁজে পায় না। তাই তাদের পরিণতি এতো ভয়াবহ।

    ﴿ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨٢ ﴾ [البقرة: ٨٢]

    ৮২. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে,১০৭ তারা জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে থাকবে স্থায়ীভাবে।

    ১০৭. ঈমানদারদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

    প্রথমতঃ ঈমানের জন্যে নির্দেশিত ও প্রয়োজনীয়, আপাতঃদৃষ্টিতে ‘অদৃশ্য ও দৃশ্যমান’ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভেজাল বিশ্বাস ও প্রত্যয় ধারণ করাটাই এক বিরাট সৎকর্ম।

    দ্বিতীয়তঃ দুনিয়ার জীবনে পরিলক্ষিত তথাকথিত অফুরন্ত চাকচিক্য, আরাম-আয়েশ, অবৈধ উপার্জন আর ভোগের হাতছানিগুলোকে ধোঁকা হিসেবে বিবেচনা করে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে, শয়তানের সার্বক্ষণিক প্ররোচনাগুলোকে পরিহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভয়-ভীতি, ক্ষয়-ক্ষতি, হুমকি, যুলুম-নির্যাতন ইত্যাদিকে মাথা পেতে নিয়ে মু’মিন ব্যক্তিরা যে সৎকাজগুলো করেন, মহান রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে তার প্রতিদান কতই না মূল্যবান হতে পারে!