সাদাসিধে জীবনের প্রতি ইসলামের প্রেরণা
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
সাদাসিধে জীবনের প্রতি ইসলামের প্রেরণা
الإسلام يحث على معيشة بسيطة
<بنغالي>
জহির উদ্দিন বাবর
ظهير الدين بابر
সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
مراجعة: د/ محمد منظور إلهي
সাদাসিধে জীবনের প্রতি ইসলামের প্রেরণা
সাদাসিধে জীবনের প্রতি ইসলামের প্রেরণা
ইসলাম মানুষের সহজাত প্রকৃতির পরিচায়ক একটি জীবনবোধের নাম। সাদাসিধে, অনাড়ম্বর ও সাবলীল জীবনই ইসলামের অন্বেষা। সহজ-সরলভাবে জীবনাতিপাত করাই ইসলামের নির্দেশনা। মানুষের লৌকিকতা উপসর্গ হিসেবে যুক্ত না হয় সে তাগিদ ইসলামে করা হয়েছে বারবার। জাঁকজমক, লৌকিকতার ঝলক কিংবা বাড়তি সৌখিনতাকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। ইসলামি জীবনবোধ হচ্ছে, পার্থিব এই জীবন ক্ষণস্থায়ী- পরকালের শষ্যক্ষেত্র স্বরূপ। এখানকার কর্মফলই সে ভোগ করবে আখেরাতে। এজন্য এখানে তার অবস্থাটা সীমিত সময়ের জন্য স্বল্প পরিসরে। এখানকার পার্থিব হিসাবটা মূখ্য নয়। পরজগতের ভাবনায় ইহজাগতিক যাবতীয় কর্মকাণ্ড সূচীবদ্ধ একটি নিয়মের অধীনে পরিচালিত হবে। জাগতিক প্রতিষ্ঠা ও বৈষয়িক চিন্তা থাকবে গৌণ হিসেবে। একজন পথিক যেমন তার আরামস্থলকে স্থায়ী কোনো ঠিকানা মনে করে না, এখানে তার ভোগ প্রাচুর্যের তেমন কোনো অন্বেষা থাকে না, তেমনি দুনিয়ার জীবনটাও মানুষের জন্য মুহূর্তের অবস্থানস্থল, পথিকের বিশ্রামস্থলের মতো। ক্ষণিকের আবাসে আড়ম্বর ও লৌকিকতা প্রদর্শন কোনো যুক্তিবানের কাজ নয়।
নীতিগতভাবে যেমন ইসলাম অতিরিক্ত জাঁকজমক ও আড়ম্বরতাকে সমর্থন করে না, তেমনি প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও ইসলামে এর বাস্তব উদাহরণ ভুরি ভুরি বিদ্যমান। ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনধারায় নজর বুলালে এটা ধ্রুব সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠে। আল্লাহর প্রিয় হাবীব ও উভয় জগতে বনী আদমের সরদার হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জীবনাচরণ ও জীবনধারা ছিল অতি সাধারণ। প্রাচুর্যের খনিতে ঐশ্বর্যমণ্ডিত হওয়ার সমূহ ব্যবস্থা থাকার পরও সাদাসিধে ও আড়ম্বরহীন জীবনকে নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তিনি। জাগতিক উচ্চবিলাস ও প্রতিষ্ঠার ভাবনা তার মধ্যে ছিলই না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের অর্ধাহার, অনাহার ও অভাবের চিত্রগুলো সাদাসিধে জীবনের প্রতি ইসলামের জোরালো প্রেরণার কথা প্রমাণ করে। নবীর শিক্ষায় শিক্ষিত আদর্শের মূর্ত প্রতীক সাহাবায়ে কেরামও ছিলেন ইসলামের এ প্রেরণা বাস্তবায়নের উত্তম নমুনা। তাঁদের জীবনধারাও ছিল নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদলে সাবলীল ও অনাড়ম্বর। ইসলামের ইতিহাস তালাশ করলে এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ আমাদেরকে সে পথেই তাড়িত করে।
ইসলামের প্রথম খলীফা সাহাবী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর পত্নীর একবার ইচ্ছে হলো কিছু মিষ্টি জাতীয় খাবার রান্না করে পরিবারের সবাইকে খাওয়াবেন। স্বীয় স্বামী খলীফাতুল মুসলিমীনের নিকট এ ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করলেন। খলীফা সাফ জবাব দিলেন, মিষ্টির জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা আমার কাছে নেই। তিনি খলীফার সাথে কথা আর না বাড়িয়ে সংসারের দৈনন্দিন খরচ থেকে অল্প অল্প করে রেখে মিষ্টি কেনার মতো পয়সা জমালেন। একদিন খলীফাকে তিনি আনন্দের সাথে সংবাদটি দিলেন। কিন্তু এবার খলীফা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাইতুল মালে খবর পাঠালেন। বাইতুল মালের লোক খলীফার বাড়িতে এসে হাজির হল। খলীফা পত্নী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, খলীফা তার সঞ্চিত অর্থ বায়তুল মালের লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। স্ত্রীর সঞ্চিত অর্থ বাইতুল মালে জমা দিয়ে খলীফা আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, এই সঞ্চয়ের ঘটনায় প্রমাণ হলো যে, এ পরিমাণ অর্থ বায়তুল মাল থেকে না তুললেও আমার সংসারের খরচ চলে যাবে। অতিরিক্ত সম্পদ আমি কিছুতেই বাইতুল মাল থেকে গ্রহণ করতে পারি না।
কৃচ্ছ্রতা সাধন ও সাদাসিধে জীবনের এর চেয়ে বড় নজির আর কি হতে পারে? আমরা জানি রাজা-বাদশাদের কোনো অভাব থাকে না। অভাব অনটন তো তাদের ছুঁতেই পারে না। সিন্দুকে থাকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। দামি আলমিরায় থরে থরে সাজানো থাকে হাজার রকম পোশাক। আর সুস্বাদু খাবার-দাবারে তো ঘর বোঝাই থাকে। দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের ধারাই এমন। এর উল্টো হতে কখনো দেখি নি। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের সাহাবিগণ সবকিছুই উল্টে-পাল্টে দিয়েছেন। তাদের দু’চোখের সামনে ছিল আখেরাত। তারা সংযম আর দারিদ্র্যের মধ্যেই নিজেদেরকে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পর খলীফা নির্বাচিত হলেন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। অর্ধ জাহানের বাদশা তিনি। বায়তুল মাল থেকে তিনি যে ভাতা নিতেন তাতে সংসার চলতো না। তার এ সমস্যার সমাধানকল্পে শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম পরামর্শ করে ভাতা বাড়ানোর চিন্তা করলেন। কিন্তু এ প্রস্তাব তারা সরাসরি খলীফার কাছে উপস্থাপন করার সাহস পেলেন না। শরণাপন্ন হলেন খলীফার মেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এর কাছে। সুযোগ বুঝে হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এ প্রস্তাব ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দরবারে পেশ করলেন। প্রস্তাব শুনে খলীফা ক্রুদ্ধ হলেন। কিছুটা রাগত আর কিছুটা বিষণ্ণ স্বরে প্রশ্ন করলেন, বলো তো হাফসা তোমার ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে ভালো পোশাক কেমন ছিল? উত্তরে হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহারের জন্য আমার ঘরে মাত্র দুটি হলুদ রঙের কাপড় ছিল। জুমার দিনে আর বিদেশি কোনো মেহমান সাক্ষাত করতে এলে তিনি কাপড়গুলো পরিধান করে বের হতেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জিজ্ঞেস করলেন, বলতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে ভালো খাবার কি খেতেন? হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, আমরা যবের রুটি খেতাম। একদিন ঘির পাত্রে যে তলানিটুকু ছিল তা গরম রুটিতে লাগিয়ে লাগিয়ে আমরা খেয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তা খেয়েছিলেন। উপস্থিত অন্যদেরকেও তা খেতে দিয়েছিলেন। এবার ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু প্রশ্ন করলেন, বল তো তোমার ঘরে রাসূলের সবচেয়ে ভালো বিছানাটা কেমন ছিল? হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা উত্তরে বললেন, বিছানার জন্য একটি মোটা কাপড় ছিল। গরমের সময় কাপড়টি চার ভাঁজ করে বিছিয়ে দিতাম। শীতকালে অর্ধেকটুকু বিছিয়ে নিতাম আর বাকি অর্ধেক দিয়ে আমরা শরীর ঢাকতাম।
এসব প্রশ্নোত্তরের পর খলীফা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তার চেহারায় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল। আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন, আমাকে আমার ভাতা বাড়ানোর সুপারিশ করে কোনো লাভ নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যেভাবে সাদাসিধে জীবনাতিপাত করে গেছেন আমিও সেই আদর্শে অবিচল থাকব।
এটাই ছিল সাহাবায়ে কেরামের সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনের বাস্তব চিত্র।
খেলাফতে রাশেদার পরবর্তী যুগের কথা। মুসলিম জাহানে খলীফা নির্বাচিত হলেন ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ.। ঘোড়াপাল থেকে শ্রেষ্ঠ ঘোড়াটি এনে সামনে দাঁড়ালো প্রধান সহিস। নবনির্বাচিত খলীফা সহজ হাসি হেসে বললেন, আমার এমন সুসজ্জিত ঘোড়ার প্রয়োজন নেই, পুরোনো খচ্চরটিতেই আমি চড়ে বেড়াবো। ওটি ফেরত নিয়ে যাও তোমরা। রাজকীয় ঘোড়াদের খাবার-দাবার, পরিচর্যা ও সহিসদের বেতন-ভাতা ইত্যাদির বিরাট খরচ দেখে খলীফা ঘোষণা করে দিলেন, এসব অপচয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। সব ঘোড়া বাজারে বিক্রি করে সে টাকা জনগণের কল্যাণে ব্যয় করো। মুসলিম রাজা-বাদশাদের প্রবাদ পুরুষ ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের চাকচিক্যহীন সাদাসিধে জীবনের অসংখ্য কাহিনী ইতিহাসের পাতায় পাতায় ভরপুর। সে সব কাহিনী দ্বারা ইসলামের আবিলতামুক্ত নিষ্কন্টক বহমান জীবনধারার একটা সুস্থ ধারণা লাভ করা যায়। ইসলামের অমলিন আদর্শের আলোকোজ্জ্বল একটা আভা ভেসে উঠে।
সময়ের স্রোতধারায় আবিলতাযুক্ত জীবনবোধে বর্তমানে ইসলামের সেই আদর্শিক শিক্ষাটা আর অবশিষ্ট নেই। মুসলমানরা আজ ভোগ-বিলাসের সম্ভারে ডুবে আছে। সাদাসিধে অনাড়ম্বর জীবনের কাহিনী আজ অলীক ও অকল্পনীয় মনে হবে। বৈষয়িকতার প্রাবল্যের কারণে জীবনের সুখ-শান্তি আজ অনুপস্থিত। শান্তির স্থানে মানুষ আজ ব্যাকুল হয়ে ফিরছে। সবকিছুতেই একটা অপূর্ণতা ও খাই খাই ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। চারিদিকে বিরাজ করছে হাহাকার। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ইসলামের প্রেরণায় উত্তীর্ণ হয়ে জীবনধারায় সাদাসিধে ও অনাড়ম্বরতা নিয়ে আসা। তবেই আসবে কাঙ্খিত মুক্তি ও সাফল্য।
সমাপ্ত