বিনয় ও সৌজন্যের সৌন্দর্য এগিয়ে দিতে পারে মুসলিম সমাজকে
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
বিনয়ের সৌন্দর্য সব পরিস্থিতিতেই উজ্জল ও প্রস্ফুটনমুখী। বিনয় যদি অন্তরে থাকে বাইরে তার সুন্দর প্রকাশ ঘটাই স্বাভাবিক। ইসলাম অহংকারকে দূর করে বিনয় অবলম্বন করার কথা নানাভাবে বলেছে। ইসলামের এ শিক্ষাটির চর্চা সমাজের আলেম ওলামার মাঝে ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। নিজেদের পরিধিতে এর অল্প কিছু দৃষ্টিকটু ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে আলেমদেরকে অন্তত সাধারণ মানুষের সংগে বিনয়াশ্রয়ী আচরণ করতেই দেখা যায় বেশি; কিন্তু বিনয়ের পাশাপাশি সমাজের আরো কিছু সৌজন্য ও সৌন্দর্যময় আচরণের প্রকাশে ব্যাপক ঘাটতি বা দুর্বলতার লক্ষণও তাদের মাঝে ধরা পড়ে। সমাজে প্রভাব সৃষ্টিকারী বা প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতাকামী আলেম সমাজের মাঝে সে ঘাটতিগুলো না থাকাই সব দিক থেকে প্রত্যাশিত।
আচরণের সৌন্দর্য কাদের সম্পদ?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস হলো :
«إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ»
“নিশ্চয় আমি মহৎ চারিত্রিক গুণাবলীর পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছি”।[1]
ইসলামের উৎস, সূত্র ও মনীষীদের চরিত্র থেকে এ হাদীসের উজ্জল সব দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মুআশারা বা পরস্পর সম্পর্কগত অঙ্গন বা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পছন্দনীয় স্বভাব, গুণাবলি, আদব ও নীতি আমাদের চেয়ে পশ্চিমা সমাজ আয়ত্ব করে নিয়েছে বেশি। এ দেশের আধুনিক শিক্ষিতদের অনেকে সে সমাজ থেকেই সেসব পছন্দনীয় স্বভাবগুলো গ্রহণ করেছেন এবং এসব ক্ষেত্রে আমাদের আলেম সমাজের একটি অংশের নির্বিকারত্ব বা অসতর্কতা দেখে তারা ধারণা করে বসেছেন, এটা পশ্চিমাদের দেওয়া সম্পদ, ইসলামী সংস্কৃতি কিংবা মুসলিম সমাজের এ ক্ষেত্রে প্রদত্ত বা প্রদানযোগ্য কিছু নেই।
বাস্তবে এ ধারণাটি সঠিক নয়। কিন্তু বাস্তব আচরণ ও উদাহরণ দিয়ে এ ধারণাটিকে ভুল প্রমাণ করার কাজটি এ সমাজের আলেম সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশই করছেন না। প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার শাইখ মুহাম্মদ তকী উসমানী তার বিশাল ভ্রমণকাহিনী এবং বক্তৃতাবলিতে এ কথা কয়েকবার বলেছেন যে, ইসলামের দেওয়া সামাজিক ও পার্থিব সৌন্দর্যময় আচরণগুলো ছেড়ে দিয়ে দুনিয়াতে মুসিলমরা কোণঠাসা ও অপমানজনক জীবনযাপন করছেন। আর পশ্চিমের ইসলাম-দুশমনরা মুসিলমদের সেই ছেড়ে দেওয়া মহৎ আচরণ-কালচারকে অবলম্বন করায় দুনিয়াতে তারা সফল জীবনযাপন করছেন। তার এ অভিমতের পক্ষে তিনি বেশ কিছু ঘটনাও তুলে ধরেছেন। কিংবা বলা যায় সেসব ঘটনা, অভিজ্ঞতা ও সার্বিক পৃথিবীচিত্র বিশ্লেষণ করে এ অভিমত তিনি দিয়েছেন।
যেই ইসলামী মু‘আশারা বা সামাজিক জীবনধারার মূল কথা হচ্ছে, আমার কোনো আচরণে যেন অন্য কেউ কষ্ট না পায়, আমার আচরণ দ্বারা যেন অন্যের আরাম ও সুবিধা হয়, সেটি এখন আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন অতি অল্প কিছু ইসলামী ব্যক্তিত্বের বাইরে বাস্তবে অন্যদের মাঝে প্রায় দেখাই যায় না।
আমাদের ছেড়ে দেওয়া, ফেলে আসা ও ভুলে যাওয়া সেই আচরণের সৌন্দর্যগুলোকে আবার আমাদের আপন করে নেওয়া উচিত। আমরা সেগুলো আমাদের কিতাবসমূহের “মুআশারা” সংশ্লিষ্ট অধ্যায়সমূহে পাবো, আর অতি অল্প কিছু আত্মশুদ্ধিসম্পন্ন সঠিক ইসলামী ব্যক্তিত্বের মাঝে পাবো, এবং আরো খুঁজলে বিস্ময়করভাবে পাবো পশ্চিমানুরক্ত বহু আধা দীনদার মানুষের জীবনে আচরণে।
আচরণের সৌন্দর্য: কিছু নমুনা
একজন অপরজনের সঙ্গে দেখা হলেই সালাম দেওয়া ও জবাব দেওয়ার রীতি ইসলামের। এর সৌন্দর্য, ফযীলত ও সুফল অনেক। এটি একটি ইবাদতও। পশ্চিমা সমাজের ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি ভিন্ন হওয়ায় এ জায়গাটিতেই তারা চালু করেছে শুভসকাল-শুভসন্ধ্যার কালচার। এবং সেটি তাদের অঙ্গনে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ও প্রভাব সৃষ্টি করেছে। কারো ঘরে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নেওয়া, সালাম জানানো কিংবা দরজায় টোকা দিয়ে আগমনবার্তা জানানো কালচারটিও ইসলামের। কিন্তু আধুনিক সমাজে এ চর্চাটি যত কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে করা হয়, আমাদের চেনা জগতে তার মাত্রাটা ততো তীব্র নয়। কাউকে স্বাগত জানানো, সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানানো, কেউ আমার কাছে এসে চলে যাওয়ার সময় কিছুদূর তাকে এগিয়ে দিয়ে আসা, আমার জন্য শুভ ও কল্যাণকর ছোট বড় কোনো কাজ কেউ করলে কিংবা তেমন কোনো সংবাদ কেউ দিলে তাকে “জাযাকাল্লাহু খাইরান” বা “থ্যাংক ইউ” অথবা ধন্যবাদ বলা, কারো জন্য আমার আচরণ বা ভূমিকা বিড়ম্বনারকর সাব্যস্ত হলে সঙ্গে সঙ্গেই সরি (দুঃখিত) বা ক্ষমাপ্রার্থী বলার চর্চাগুলো আমাদের পরিচিত মুসলিম সমাজে যতটুকু পরিমাণ ও যত দ্রুত লক্ষ্য করাটা প্রত্যাশিত, বাস্তবে ততটুকু পরিমাণ ও তত দ্রুত দেখা যায় না। পক্ষান্তরে পশ্চিমা কালচারে অনুরক্তদের মাঝে সেটা দেখা যায় অনেক বেশি পরিমাণে।
এ পর্যায়ে এ বিষয়টির উল্লেখ প্রাসঙ্গিক যে, এসব পর্যায়ে ইসলামী শব্দাবলির ব্যবহার অন্তর্গতভাবে যে পরিমাণ কল্যাণকর, তাৎপর্যপূর্ণ ও সওয়াব লাভের মাধ্যম, পশ্চিমা সমাজের চালু করা শব্দগুলো সে রকম নয়। সেসবের মাঝে সেক্যুলার কিছু নগদ ভাব-উচ্ছাসের তরঙ্গ বিদ্যমান। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা আমাদেরটা না করার কারণে এবং সেগুলো বিকল্প হিসেবে চালু হওয়ার কারণে এখন সেগুলোরও একটা সামাজিক আবেদন ও প্রভাব দাঁড়িয়ে গেছে। সংস্কৃতির নীতি এমনই হয়ে থাকে। বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজে সেই নগদ ভাব-উচ্ছাসের সৌজন্যমূলক শব্দাবলীর ব্যবহার ও প্রয়োগ তাই ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।
এ পরিস্থিতিতে আমরা কি করব বা করতে পারি? আমাদের আচরণের সৌন্দর্য ও সৌজন্য নীতিকে সামনে নিয়ে আসতে চাইলে শুরুতেই চলমান ধারাটির সমালোচনার পরিবর্তে আমাদের সংস্কৃতি বিকাশক শব্দ ও আচরণগুলোর ব্যাপক চর্চা ও প্রয়োগ শুরু করতে পারি। কখনো কখনো দুটো এক সঙ্গেও চালাতে হতে পারে। যেমন; থ্যাংক ইউ জাযাকাল্লাহু খাইরান। মোটকথা সৌজন্যময় সামাজিকতায় আমাদের প্রবেশটা ঘটাতে হবে আরো বেশী। আর সেই সৌজন্য ও সৌন্দর্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে, রেওয়াজে পরিণত করতে হবে। এরপর তার স্টাইল ও ধরনে পরিবর্তন প্রয়াসী হলে আশা করা যায় ক্ষতি হবে না। তারা যেটিকে “এটিকেট” বলে ও মানে, আমরা সেটিকে আদব ও মুআশারার নীতি বলে চর্চা করতে পারি। যেখানে যেখানে তাদেরটাকে সঙ্গতভাবেই সংশোধনযোগ্য বলে মনে হয়, আমরা সেখানে শুদ্ধতাও নিয়ে আসতে পারি, কোনো সমস্যা নেই।
স্মার্টনেস ও জড়তাহীনতা:
আচরণের সৌন্দর্য বা সৌজন্যের একটি বড় বিষয় হচ্ছে- হাত কচলানো, অস্পষ্টতা ও জড়তা থেকে বের হয়ে এসে বিনয়ের সঙ্গে ঋজু ভঙ্গিতে স্পষ্ট কথাটি তুলে ধরা। ইসলামী মুআশারায় যেমন এটি সমর্থিত, তেমনি আধুনিক এটিকেটেও এই স্পষ্টতা ও স্মার্টনেসের গুরুত্ব অধিক। প্রকাশ্য আচার-আচরণে কোনো দৃষ্টিকটু মুদ্রাদোষ, চুলকানো, খোঁচানো, প্রকাশ্যে নাকঝাড়া, হেলেদুলে থুথু ছিটিয়ে কথা বলা, বিনয়ের ভারে বক্তব্য অস্পষ্ট করে তোলার মতো বিড়ম্বনাগুলো থেকে মুক্ত থাকার অভ্যাস রপ্ত করে নেয়ায় কল্যাণের পরিবর্তে কোথাও কোনো ক্ষতির কথা বলা নেই।
একটি দেশের অতি অল্প কিছু নিয়ম ভাঙ্গা মানুষ তাদের অতি প্রভাব ও ব্যক্তিত্বের কারণে এসব এটিকেট ও আদবনীতির বাইরে থেকেও বরেণ্য হয়ে যেতে পারেন, এটা সব দেশে এবং হয়তো সব যুগেই হয়ে এসেছে। কিন্তু সাধারণের জন্য এটা উদাহরণ হতে পারে না। সাধারণের জন্য ঋজুতা, স্পষ্টতা, বিড়ম্বনামুক্ততা অবলম্বনের কোনো বিশেষ বিকল্প নেই।
একজন তরুণ কিংবা মাঝারি বয়স ও পর্যায়ের মুসলিমের জন্য এ গুণটির অবলম্বন তার পক্ষে অপেক্ষাকৃত আনুকূল্যই উপহার দেবে।
সৌজন্য-অসৌজন্য: সুফল-কুফল
আচরণের ছোট ছোট সৌন্দর্য ও সৌজন্য ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন তুচ্ছ ভাবার নয়, তেমনি তার বাস্তব ও সামাজিক সুফলও অনুল্লেখ করার মত নয়। অভ্যাসগত বিনয়ের পাশাপাশি সৌজন্যবোধ ও আচরণের সৌন্দর্যের কারণে যে কোনো পর্যায়ের ব্যক্তিকে এ সমাজ তুলনামূলক অধিক গ্রহণযোগ্যতা দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার যোগ্যতা থাকলে এ ধরনের গুণাবলি তাকে আরো মর্যাদাবান করে তার পথ পরিক্রমা সহজ করে দেবে এবং তাকে অবশ্যই কিছুটা এগিয়ে দেবে। পক্ষান্তরে বাস্তব অর্থে একজন বড় ব্যক্তিত্বকে এসব গুণের শূন্যতার কারণে সমাজ কিছুটা অপাংক্তেয় ও অনুপোযোগী মনে করে বসতে পারে। কারণ, এ সমাজের যে বাহ্যদর্শী রাডার রয়েছে, ইলম ও ব্যক্তিত্বের গভীরতা মাপার তার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। প্রকাশিত গুণাবলি, উন্নত সৌজন্য ও মানবিকতার মতো পারিপার্শ্বিকতাগুলো তার কাছে ভালো কোনো ম্যাসেজ পৌঁছাতে পারে, অন্য কিছু নয়।
আজকের সমাজের সর্ব পর্যায়ের মুলিমদের উচিত দ্বীনী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বিনয়ের সঙ্গে সৌজন্যের এবং সদাচারের সঙ্গে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা। এতে আমাদের পরকালীন ফায়েদাটুকু তো অবশ্যই হবে ইনশাআল্লাহ।
[1] সুনান বায়হাকী, হাদীস নং ২০৫৭১