আক্বীদা ও আমলের সংস্কার
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
- আক্বীদা ও আমলের সংস্কার
আক্বীদা ও আমলের সংস্কার
تجديد العقيدة والعمل
নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ ত'আলার জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করছি, তার নিকট সাহায্য চাচ্ছি, ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাঁরই ওপর ঈমান এনেছি। আর আমাদের নফসের কুমন্ত্রণা এবং খারাপ আমল করা হতেও সাহায্য চাচ্ছি। আল্লাহ তা'আলা যাকে হিদায়েত করেন কেউ তাকে গোমরাহ করতে পারে না আর যে গোমরাহ হয় কেউ তাকে হিদায়াত করতে পারে না। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক এবং তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও প্রেরিত রাসূল।
বড়দের মর্যাদার মাপকাঠি:
সবকিছু আমার জানা আছে অথবা আমার জানা বস্তুটিই সঠিক এমন দাবী স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও করেন নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আল্লাহর আদেশে বললেন: এটা আল্লাহর একটি আদেশ মাত্র। আর আমাকে জ্ঞানের সামান্য দেওয়া হয়েছে। এ হলো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানবের নিজের বিষয়ে মন্তব্য। তা ছাড়া কোনো কোনো সিদ্ধান্তে তাঁর চেয়ে অন্য সাহাবী -উমর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু-এর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলেও মহান গ্রন্থ কুরআনে এসেছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ভুল আমাদের পিছু ধাওয়া করে। আমাদের দ্বারা দীর্ঘ সময় যাবৎ পালন করে আসা আমাদের কোনো কাজ, মত, আদর্শ পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হলে তা ত্যাগ করা দোষণীয় নয়। এটা আমাদের পূর্ববর্তীদের আমলও ছিল। এমনিভাবে বিশ্বাস করতে হবে আমাদের অনুকরণীয় ব্যক্তিবর্গও ইমাম, পীর, দরবেশ, শিক্ষক অথবা পার্থিব কোনো নেতা ভুলের উর্ধ্বে নয়। সর্বক্ষেত্রে তাদের কথাই আমল করতে হবে এবং তাদের সব কথা ও কাজ নির্ভুল তাও অবাস্তব। কারণ, এমন অন্ধ বিশ্বাসের ফলে বহু ক্ষেত্রে কুরআন ও সহীহ হাদীস মোতাবেক আমল করা সম্ভব হয় না, যা বড় ধরণের অপরাধ।
মুসলিমদের জন্য এটাই কর্তব্য হওয়া উচিত যে, সে আল্লাহর ইবাদত ঐভাবে করবে, যেভাবে তিনি তার কিতাবে নির্দেশ দিয়েছেন আর যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহীহ সুন্নাতের মধ্যে নির্দেশিত হয়েছে। তারপর এ দুই মূল ভিত্তি থেকে যে সমস্ত হুকুম-আহকাম বের হয়েছে, সে অনুযায়ী সে চলবে। আর এ জাতীয় হুকুম আহকামের মূলসূত্রগুলো বের করা সকলের জন্য সহজ নয়। সে কারণেই আল্লাহ তা'আলা এ উম্মতের কল্যাণার্থে বহু সম্মানী আলেমদের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। সাহাবা, তাবেয়ীন এবং তাদের পরবর্তীগণের মধ্য থেকেও। তারা আল্লাহ তা'আলার দীনকে উত্তমভাবে অনুধাবন করেছেন। আর সাথে সাথে আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাহকে খুবই সুক্ষ্ণভাবে বুঝতে সচেষ্ট হয়েছেন। তারপর সেখান থেকে হুকুম-আহকাম বের করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে তারা সাধারণ লোকদের সম্মূখে ঐ সব আহকামকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যাতে তারা সঠিক দিক নির্দেশনা পেয়ে হিদায়াত ও সঠিক বুঝের উপর চলতে সক্ষম হন। তারা তাদের সাধ্যমত যে কষ্ট মেহনত করেছেন, তাতে আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি রাজী ও খুশী হয়ে গেছেন।
সুক্ষ্ম এ কাজ করতে গিয়ে গবেষণা কর্মে তাদের কোনো কোনো কথা ও কাজ অপরের সাথে বিরোধপূর্ণ হয়েছে। আর কখনও কোনা মাসআলায় তারা একাধিক ফতোয়া দিয়েছেন, এরও অনেক কারণ রয়েছে যা আলোচনায় আসছে এবং মতবিরোধ এমন পর্যায় যায় নি যে, তাদেরকে দোষ দেওয়া ওয়াজিব বা মুবাহ হয়ে দাড়ায়; বরং প্রতিটি মুসলিম ঐ কথাকে গ্রহণ করেছেন, যা তিনি দলীলসহ সহীহ মনে করেছেন এবং তার উপরই তিনি আমল করেছেন। আর যে ব্যক্তি দলীল খুঁজতে অপারগ, তিনি কোনো আমলওয়ালা বিশ্বাসী মুত্তাকী মুফতিকে প্রশ্ন করে তা গ্রহণ করে তার ওপর আমল করেছেন।
অনর্থক বিতর্কে লাভ হয় শত্রুপক্ষের:
যখন লোকেরা তাদের পছন্দনীয় কোনো কোনো ব্যক্তি ও তাদের বক্তব্যসমূহকে অন্ধভাবে দৃঢ়তার সাথে আকড়ে ধরতে থাকে। সাথে সাথে তাদের নানা ধরণের কামালিয়াত ও প্রশংসা করতে থাকে। তাদের ফজল, তাকওয়া ও ইলমের প্রশংসা করতে থাকে। আর অন্যদের যে দোষত্রুটি আছে তা প্রচার করতে থাকে এবং তাদের যে ভালো গুণাবলী আল্লাহ তা'আলা দান করেছেন তা উপেক্ষা করতে থাকে, তখন ইসলামের শত্রুরা এ সুযোগ কাজে লাগায়। তারা এ সমস্ত মতবিরোধের সুযোগ নিয়ে নিজেদের নিকৃষ্ট উদ্দেশ্য সাধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তাদের ভিতরের ঘৃণ্য উদ্দেশ্যসমূহকে হাসিল করার জন্য মুসলিমদের মধ্যে আরও বিরোধ সৃষ্টি করতে তৎপর হয়। এর ফলশ্রুতিতে উম্মত নানা মত ও দলে বিভক্ত হতে থাকে। তাদের মধ্যে নানা ফিরকাহ ও মাযহাবেরর সৃষ্টি হয়। ফলে প্রচণ্ডভাবে তর্কযুদ্ধ চলতে থাকে। নানা ধরনের কথাবার্তা চলতে থাকে আর আমলে ঘাটতি হতে থাকে। আর তখন থেকেই যারা আমাদের ভয় পেত, তারা আমাদের ক্ষতি করতে তৎপর হয়ে উঠে। ফলে বহু মুসলিম তথা দেশ দীর্ঘ সময় খ্রিষ্টানদের করতলগত হয়। তাতারদের দ্বারা পদানত হয়। তারপর আসে নাস্তিকদের নাস্তিকতা, খ্রিষ্টান ও ইয়াহূদীদের চক্রান্ত, যা আজকের মুসলিমদের দিকে তাকালে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়।
মতবিরোধ দূরীভূত করে কল্যাণ ফিরিয়ে আনার উপায়:
এ ধরণের ভুল ভ্রান্তির ব্যাপারে বড় বড় ইসলামী চিন্তাবিদগণ সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। ফলে প্রতিটি দেশ ও যমানায় বহু আলেম সচেষ্ট হয়েছেন নিজেদের পারস্পরিক মতবিরোধ দূরীভূত করতে এবং তাদের ঐ মূলের দিকে ফিরিয়ে আনতে, যার সাথে সম্পর্ক থাকা সকলের জন্যই অত্যন্ত গর্বের বিষয়। তার ওপর প্রতিটি মুসলিমই ভরসা করে আর তা হলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ। এর মাধ্যমেই মুসলিমদের একতাবদ্ধ করা সম্ভব, সম্ভব পারস্পরিক মতবিরোধ দূরীভূত করা এবং এবং নিজেদের মধ্যে বিরাজমান হিংসা বিদ্বেষ দূর করা।
প্রতিটি মুসলিমের ওপর করণীয় ওয়াজিবগুলোর মধ্য একটি হলো -মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করা, বিশেষ করে ওলামাদের সাথে। কারণ, তারাই হচ্ছেন সালাফে সালেহীনদের আদর্শস্বরূপ এবং রাসূলদের খলীফাস্বরূপ। উম্মতের মশহুর ইমামগণের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যে বা যারা ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলের কোনো সুন্নাহর বিরোধিতা করেছেন। এমনকি কোনো সাধারণ মুসলিমের জন্যও প্রকাশ্যভাবে তাঁর বিরোধিতা করা অথবা তার সম্মান হানিকর কাজ করা সম্ভব নয়। তারা সমষ্টিগতভাবে ইয়াকীন-ঈমানের সাথে একমত যে, যে সমস্ত সহীহ হাদীসের বিপরীতে কোনো সহীহ হাদীস নেই তার উপর আমল করা ওয়াজিব। আর রাসূলের কথার উপর অন্য কারো কোনো কথাকে প্রাধান্য দেওয়া কোনোভাবেই জায়েয নয়।
আলেমগণের সাথে সাধারণ মুসলিমের সম্পর্ক:
কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে গভীর সম্পর্কের পর মুমিনদের বিশেষত: আলেমগণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মুসলিমদের অবশ্য করণীয়। কেননা আলেম সমাজ নবীকূলের উত্তরাধিকারী। আল্লাহ যাদেরকে নক্ষত্রের ন্যায় উজ্জ্বলতা ও নির্দিষ্ট অবস্থান দান করেছেন। তাদের দ্বারা জল-স্থলের সমস্যার মধ্যে হিদায়াতের আলো প্রাপ্ত হওয়া যায়। ঐ সকল আলেমের হিদায়াতের ওপর পরিচালিত হওয়া এবং ধর্মীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। বস্তুতঃ আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে প্রত্যেক জাতির আলেমগণই তাদের কাওমের মধ্যে নিকৃষ্ট ছিল; কিন্তু মুসলিম জাতির আলেম সম্প্রদায় এ জাতির সর্বোৎকৃষ্ট অংশ। উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে তারাই রাসূলের প্রতিনিধি এবং তার সুন্নাতের পুণর্জীবনদানকারী। তাদের প্রচেষ্টায়ই কুরআন মাজীদ সুপ্রতিষ্ঠিত অবস্থায় আছে এবং কুরআনের কারণেই তারাও দীনের ওপর কায়েম আছেন।
কোনো ইমাম ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলের সুন্নাতের খেলাফ করেন নি:
স্মরণযোগ্য যে, সর্বজনস্বীকৃত কোনো ইমাম রাসূলের সুন্নতের -তা ছোট হোক বা বড় হোক- বিপরীত আমল করেন নি। কারণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ছাড়া অন্য যে কোনো লোকের বাণী গ্রহণও করা যেতে পারে আবার প্রত্যাখ্যানও করা যেতে পারে। অর্থাৎ যদি তাদের কথা শুদ্ধ হয়, তবে তা গৃহীত হবে আর যদি ভুল হয় তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। কখনও উম্মতের আলেমগণের কোনো মত হাদীসের বিপরীত দেখা গেলে সেখানে তাঁর দ্বারা সে হাদীসের ওপর আমল না করার কোনো না কোনো কারণ থাকতে হবে। এ ধরণের কারণ তিন প্রকার:
প্রথমত: এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বলে বিশ্বাস না করা।
দ্বিতীয়ত: এ হাদীস দ্বারা উক্ত মাস'আলা প্রতিষ্ঠা উদ্দেশ্য বলে মনে না করা।
তৃতীয়ত: এ হাদীস মনসুখ বা রহিত হয়ে গেছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস করা।
প্রথম কারণ: হয়ত হাদীসটি তার নিকট পৌঁছেনি। আর যার নিকট হাদীস পৌছেনি, উক্ত হাদীসের বিষয়বস্তু সম্পর্কেও জ্ঞাত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। তার নিকট ঐ হাদীস না পৌঁছার কারণে কোনো বিষয়ে স্পষ্ট আয়াত কিংবা অন্য হাদীস অথবা কিয়াসের নিয়ম বা ইসতেসহাবের দ্বারা তিনি রায় প্রদান করলে, তা কখনও ঐ হাদীসের অনুকূলে হয় আবার কখনও তার প্রতিকূলে হয়। সালাফে সালেহীনের কোনো কোনো মত হাদীসের বিপরীত হওয়ার জন্য উপরোক্ত কারণটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য।
উম্মতের কোনো এক ব্যক্তির পক্ষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত হাদীস পূর্ণরূপে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো হাদীস বর্ণনা করতেন, বিচার করতেন, কোনো বিষয়ে ফতোয়া দিতেন অথবা কোনো কাজ করতেন, তখন উপস্থিত লোকগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী শ্রবণ করতেন কিংবা অবলোকন করতেন। অতঃপর উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকেই কিংবা কেউ কেউ শ্রুত বা পরিদৃষ্ট হাদীসটি অপরের নিকট পৌঁছাতেন। তারপর উক্ত হাদীসটি বিজ্ঞ সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাদের পরবর্তীগণের মধ্যে যাদের কাছে আল্লাহ তা'আলা ইচ্ছা করতেন তাদের কাছে পৌঁছাতেন।
এরপর অন্য একটি মজলিসে হাদীস বর্ণিত হতো, সিদ্ধান্ত হতো, বিচার করা হতো অথবা কোনো কাজ করা হতো। যারা পূর্বের মজলিসে অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের কেউ কেউ পরবর্তী মজলিসে উপস্থিত থাকতেন। যাদের পক্ষে সম্ভব হতো তারা শ্রুত হাদীসটি প্রচার করতেন। অতএব, পূর্বের মজলিসে উপস্থিত লোকদের যে জ্ঞান লাভ হয়েছে, তা পরবর্তী মজলিসে উপস্থিত লোকদের হয় নি। আবার পরবর্তী মজলিসের লোকদের যে জ্ঞান লাভ হয়েছে তা পূর্ববর্তী লোকদের হয় নি। বিজ্ঞ সাহাবাগণের মর্যাদার তারতম্য তাদের পরবর্তীগণের পরস্পরের প্রাধান্য নির্ভর করে তাদের জ্ঞানের গভীরতা, ব্যাপকতা ও উৎকর্ষের উপর। একজনের পক্ষে রাসূলের সকল হাদীস আয়ত্ব করা সম্ভব -এরূপ দাবী করা বাতুলতা মাত্র। এ ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদীন আদর্শের প্রতীক। কেননা তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা-বার্তা, নিয়ম-পদ্ধতি, চলা-ফেরা ইত্যাদি অবস্থা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত। বিশেষত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু 'আনহু দেশে বিদেশে কখনও রাসূলের সঙ্গ ত্যাগ করেন নি; বরং সব সময় রাসূলের সঙ্গে থাকতেন। এমনকি মুসলিম জাতির প্রয়োজনে রাসূলের নিকট তিনি বিনিদ্র রাত্রি যাপন করতেন। উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহুও ছিলেন অনুরূপ। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় বলতেন:
«دَخَلْتُ أنَا وَأبُوْبَكْرٍ وَعُمَرُ وَخَرَجْتُ أنَا وَأبُوْبَكْرٍ وَعُمَرُ». رواه البخاري
“আমি এবং আবু বকর ও উমার প্রবেশ করেছি এবং আমি এবং আবু বকর ও উমার বের হয়েছি। (সহীহ বুখারী)
(কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি, যারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হওয়ার পরও সব জানতেন না, সব জানার দাবী করতেন না এবং সহীহ হাদীস জানার পর তাদের নিজস্ব মত ত্যাগ করে হাদীসের অনুসরণ করেছেন।)
স্বঅভিমত ত্যাগ করে হাদীসের অনুসরণের উজ্জল দৃষ্টান্ত যুগে যুগে:
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু:
এতদসত্ত্বেও যখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু 'আনহুকে দাদীর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি বললেন:
«مالكَِ في كتاب الله من شيء وما علمت لكِ في سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم من شيء، ولكن... حتى أسأل الناس».
“তোমার জন্য আল্লাহর কুরআনে অংশ নির্ধারিত নেই এবং হাদীসেও তদ্রূপ কোনো নির্দেশ আমার জানা নেই। তবে আমি লোকদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব।" লোকদিগকে জিজ্ঞেস করা হলে মুগীরা ইবন শো'বা রাদিয়াল্লাহু 'আনহু এবং মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা রাদিয়াল্লাহু 'আনহু দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাদীকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক ষষ্ঠাংশ দিয়েছেন। ইমরান ইবন হোসাইন এ হাদীসটি পৌছিয়েছেন।" (আবু দাউদ, তিরমিযী)
উক্ত তিনজন সাহাবী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু কিংবা খলীফা চতুষ্টয়ের অন্যান্যদের সমকক্ষ নন। তথাপি এ হাদীসটি সম্পর্কীয় জ্ঞানের ব্যাপারে তাদেরকে বিশেষত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এ রায় গ্রহণের ব্যাপারে সমস্ত উম্মত একমত।
উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু:
অনুমতি প্রার্থনার হাদীস তার জানা ছিল না। এ সম্পর্কে তাকে আবু মুসা আল আশ'আরী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু জানানোর পর অবগত হন এবং সত্যায়নের জন্য সাক্ষীও তিনি তলব করেছেন। (সহীহ বুখারী)
স্ত্রী স্বামীর দিয়তে (রক্তপণ বা জরিমানাস্বরূপ প্রাপ্ত সম্পদ) অংশীদারী হবে কিনা -এ বিষয়ে উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু জ্ঞাত ছিলেন না; বরং তার ধারণা ছিল দিয়ত অভিভাবকের প্রাপ্য। দাহহাক ইবন সুফইয়ান আল-কালবী -যিনি রাসূলের সময় কোনো গ্রাম্য এলাকায় আমীর ছিলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহুকে এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশইয়াম আদ-দিবাবী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর স্ত্রীকে স্বামীর দিয়তের অংশীদার করেছেন। অতঃপর উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু তাঁর মত পরিবর্তন করলেন এবং বললেন, যদি আমরা এ হাদীস না শুনতাম তবে -এর খিলাফ করতাম। (মসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী)
উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু অগ্নি পূজকদের নিকট থেকে জিযিয়া কর আদায় করা হবে কিনা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। অতঃপর আব্দুর রহমান ইবন 'আওফ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু তাকে রাসূলের হাদীস শোনালেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«سَنُّوْابِهِمْ سُنَّةَ أهْلِ الْكِتَابِ». رواه البخاري
“তোমরা তাদের সাথে জিযিয়ার ব্যাপারে আহলে কিতাবের ন্যায় আচরণ কর।" (সহীহ বুখারী)
উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু সারগা 'তাবুক উপত্যকার একটি গ্রামের নাম' স্থানে পৌঁছলেন, তখন খবর পেলেন যে, শাম দেশে (সিরিয়া ও তৎসংলগ্ন এলাকা) প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, তিনি তার সাথে থাকা মুহাজিরীনে আউয়ালিনের নিকট পরামর্শ চাইলেন। তৎপর আনসারদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তৎপর মক্কাবিজয়ের সময়ের মুসলিমদের মতামত চাইলেন। তারা সকলেই নিজ নিজ অভিমত পেশ করলেন। কেউই এ সম্পর্কে হাদীস বলতে পারলেন না। এ সময় আব্দুর রহমান ইবন 'আওফ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু আগমন করলেন এবং মহামারী সংক্রান্ত হাদিসটি বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إذَا وَقَعَ بِاَرْضٍ وَأنْتُمْ بِهَا فَلَا تَخْرُجُوْا فِرَاراً مِنْهُ وَاِذَا سَمِعْتُمْ بِهِ بِاَرْضٍ فَلَاتُقَدِّمُوْا عَلَيْهِ». متفق عليه
“তোমরা অবস্থানকালীন কোনো স্থানে মহামারী দেখা দিলে তোমরা ঐ জায়গা থেকে পালিয়ে যেও না এবং কোনো স্থানে মহামারী প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে সেখানে তোমরা প্রবেশ করবে না।" (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
উমার ও আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমা সালাতে সন্দেহ পোষণকারী ব্যক্তির বিধান সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ সম্পর্কে উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর নিকট পূর্বে কোনো সহীহ হাদীস পৌঁছে নি। তখন আব্দুর রহমান ইবন 'আওফ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসটি শোনালেন:
«اِنَّهُ يَطْرَحُ الشَّكَّ وَيُبْنِيْ عَلَى مَا اسْتَيْقَنَ». أحمد ومسلم وابوداود والترمذي
“সে সন্দেহ ছেড়ে ইয়াকীনের আমল করবে।" (মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযী)
একদা সফরকালে উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু ভীষণ ঝড়ের সম্মুখীন হলেন এবং বলতে লাগলেন, কে আমাদেরকে ঝড় সম্পর্কীয় হাদীস শুনাবে? তখন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু 'আনহু বললেন, যখন আমার নিকট উমরের কথাটি পৌঁছল তখন আমি দলের পশ্চাতে ছিলাম। অতঃপর আমি আমার বাহনকে তাড়াতাড়ি চালালাম এবং উমারের নিকট পৌঁছলাম এবং ঝড় প্রবাহের সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত হাদীস তার নিকট বর্ণনা করলাম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«اَلرِّيْحُ مِنْ رُوحِ اللهِ تَأتِيْ بِالرَّحْمَةِ وَتَأتِيْ بِالْعَذَابِ فَاِذَارَأيْتُمُوْهَا فَلَا تَسُبُّوْهَا وَاسْئلُوْاللهَ خَيْرَهَا وَاسْتَعِيْذُوْابِاللهِ مِنْ شَرِّهَا». رواه مسلم
“ঝড় আল্লাহার পক্ষ থেকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। তা কখনও রহমত বহন করে আবার কখনও 'আযাব বহন করে। অতএব, যখন তোমরা ঝড় প্রবাহিত হতে দেখ তখন তাকে গালি দিও না; বরং আল্লাহর নিকট তার মধ্যে নিহীত মঙ্গল কামনা কর এবং তার মধ্যে নিহীত অমঙ্গল হতে আশ্রয় প্রার্থনা কর।" (সহীহ মুসলিম)
এ মাস'আলাগুলো সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না; তা তার নিকট এমন লোকেরা পৌঁছালেন যারা তার সমকক্ষ নয়। এর পরও তিনি তা গ্রহণ করেছেন।
আরও কতগুলো এমন মাস'আলা আছে যেগুলো সম্পর্কে তার নিকট হাদীস এবং সে বিষয়ে হাদীস ব্যতিরেকেই বিচার করেছেন অথবা ফতোয়া দিয়েছেন। তার উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
তিনি হাতের অঙ্গুলির দিয়ত (জরিমানা) সম্পর্কে ফতোয়া দিয়েছেন যে, সকল অঙ্গুলির দিয়ত সমান নয়; বরং অঙ্গুলির উপকারিতার তারতম্য অনুসারে তার দিয়তও কম বেশী হয়ে থাকে। কিন্তু আবু মুসা ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমা তার তুলনায় জ্ঞানের দিক দিয়ে কম হওয়া সত্ত্বেও এ হাদীস সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন, তাদের জানা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«هَذِهِ وَهَذِهِ سَوَاءُ». رواه البخاري
“বৃদ্ধাঙ্গুলী ও অনামিকার দিয়ত সমান সমান।" (সহীহ বুখারী)
মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর শাসনামলে এ হাদীসটি তাঁর নিকট পৌঁছলে তিনি সে অনুসারে রায় প্রদান করেন। মুসলিমদের এর অনুসরণ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। উমারের নিকট উক্ত হাদীস না পৌঁছা তার জন্য ঐ ফতোয়া দোষণীয় ছিল না।
এমনিভাবে উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু মুহরিম ব্যক্তিকে হজ ও উমরার এহরামের পূর্বে এবং জামরাতুল 'আকাবায়ে শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করার পর মক্কায় তাওয়াফে ইফাদার (হজের ফরজ তাওয়াফ) পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। তিনি এবং তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ এবং অন্যান্য মর্যাদাবান সাহাবাগণ এ আদেশ করতেন। তাদের নিকট আয়েশা রাদিয়াল্লাহু 'আনহার হাদীসটি পৌঁছে নি।
«طيبت رسولَ الله صلى الله عليه وسلم لاِحرامه قبل أن يحرم ولحله قبل أن يطوف». متفق عليه
“আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধার পূর্বে এবং হালালের জন্য (ইহরাম খোলা) তাওয়াফের পূর্বে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম।" (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহু চামড়ার মোজা না খোলা পর্যন্ত অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোজা পরিধানকারীকে মোজার উপর মাসেহ করার হুকুম দিতেন। সালাফে সালেহীনের একদল এ মত অনুসরণ করেন। তাদের নিকট মোজার উপরে মাসেহর সময় নির্ধারণ সংক্রান্ত হাদীস পৌঁছেনি। পক্ষান্তরে, এমন কতিপয় লোকের নিকট সহীহ হাদীস পৌছেছিল, যারা জ্ঞানের দিক দিয়ে তাদের সমকক্ষ ছিলেন না। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সঠিকভাবে বিভিন্ন পন্থায় হাদীস বর্ণিত হয়েছে। (সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযী)
উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু:
উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু বিধবার নিজ ঘরে ইদ্দত পালন করা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না। আবু সাইদ খুদরীর বোন ফুরাইয়া বিনতে মালেক রাদিয়াল্লাহু 'আনহা -যার স্বামী মারা গেছেন- এ সম্পর্কীয় হাদীস শোনালেন যে, যখন ফুরাইয়ার স্বামী মারা গেলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন:
«اُمكثيْ في بيتكَ حتى يبلغ الكتابُ أجَلَهُ». رواه ابوداود والترمذي
“ইদ্দত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তুমি নিজ ঘরেই অবস্থান কর।" (আবু দাউদ ও তিরমিযী)
অতঃপর উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু এ হাদীস গ্রহণ করলেন।
একদা মুহরিম অবস্থায় শিকারকৃত পশু উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহুকে হাদিয়া দেওয়া হলো এবং জন্তুটি তার জন্যই শিকার করা হয়েছিল, তিনি ওটা খাবার ইচ্ছা করেছিলেন। এমন সময় আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু হাদীস শোনালেন যে, ইহরাম আবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিকারকৃত গোশত হাদিয়া দেওয়া হলে তিনি তা ফেরৎ দিয়েছিলেন। (মুসনাদে আহমাদ)
আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু:
আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যখন কোনো হাদীস শোনতাম, তা দ্বারা আল্লাহ তার ইচ্ছামত আমাকে উপকৃত করতেন। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কেউ আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করলে আমি তার নিকট হতে শপথ নিতাম। শপথ করার পর আমি তার বণির্ত হাদীস বিশ্বাস করতাম। আর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু আমার নিকট তওবার সালাতের হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তিনি সঠিক বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَامِنْ رَجُلٍ يَذْنِبُ ذَنْبَاً فَيَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ الْوَضُوْءَ ثُمَّ يُصَلِّي ركَعتينِ .......».
“যে ব্যক্তি কোনো গুনাহ করে, তারপর ভালোভাবে অযু করে দু রাকা'আত সালাত আদায় করে এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লিখিত আয়াতটি পাঠ করেন, যাতে আল্লাহ বলেন: যারা কোনো অশ্লীল অথবা অন্যায় কাজ করে অথবা নফসের উপর অত্যাচার করে, তৎপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৫] আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ প্রভৃতি।
আলী ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমা গর্ভবতী বিধবা স্ত্রীলোকের দুই নির্ধারিত ইদ্দতের সময়ের (সন্তান প্রসবের ইদ্দত এবং স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিয়ের জন্য যে ইদ্দত) দীর্ঘতম ইদ্দত পালন করার ফতোয়া প্রদান করতেন। সুবাই'আহ আল আসলামি সম্পর্কে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসটি তাঁর নিকট পৌঁছে নি। সুবাই'আহ আল-আসলামীর গর্ভাবস্থায় তার স্বামী সা'দ ইবন খাওলা -এর মৃত্যু হলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য সন্তান প্রসব পর্যন্ত ইদ্দতের সময় নির্ধারণ করেছিলেন। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ)
আলী, যায়েদ ইবন ছাবেত, ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমসহ আরো অনেকেই মাহর নির্ধারণ ব্যতিরেকেই বিয়ে হওয়া স্ত্রীলোকের স্বামী মারা গেলে -এ ফতোয়া দিতেন যে, তার মাহর দিতে হবে না। কেননা তাদের নিকট বারওয়া' বিনতে ওয়াশেক সম্পর্কের হাদিসটি পৌঁছে নি। (আহমদ, তিরমিযী)
এ এক অধ্যায়। সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত এরূপ ঘটনার সংখ্যা অগণিত; কিন্তু সাহাবীগণ ব্যতীত অন্যান্যদের হতে বর্ণিত সংখ্যাও হাজার হাজার, যা সংখ্যায়িত করা সম্ভব নয়।
উল্লিখিত সাহাবীগণ উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী, উত্তম ও আল্লাহভীরু। তাদের পরবর্তীগণ এ সকল গুণাবলী হতে আনুপাতিক হারে অপূর্ণ। সুতরাং তাদের নিকট রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কোনো হাদীস অজানা বা অস্পষ্ট থাকা কিছুমাত্র বিচিত্র নয় এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনার প্রয়োজন নেই।
সব হাদীস না জানা এবং হাদীসের বিপরীত আমলের কারণ:
যারা ধারণা করে যে, প্রত্যেক ইমাম অথবা কোনো নির্দিষ্ট ইমামের নিকট রাসূলের প্রত্যেকটি সহীহ হাদীস পৌঁছেছে, তারা অজ্ঞ বৈ কিছু নয়।
কেউ যেন কখনও এ কথা না বলেন যে, হাদীসসমূহের একত্রিকরণ ও সংকলনের পর সেগুলোর অস্পষ্টতা বা অজানা জ্ঞানবর্হিভূত। কেননা, সুনানগুলি হাদীস একত্রিত হওয়ার প্রসিদ্ধ সংকলন। এগুলি স্বীকৃত ইমামদের তিরোধানের পরই সংকলিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও রাসূলের হাদীসকে নির্দিষ্ট সংকলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ দাবী করা বৈধ নয়। যদিও ধরে নেওয়া যায় যে, হাদীস সংকলিত কিতাবের মধ্যে সীমিত, তবুও ঐ কথা বলা যায় না যে, একজন আলেম কিতাবের সমুদয় ইলম সম্পর্কে জ্ঞাত। আর করো পক্ষে এরূপ বিদ্যার্জন সম্পূর্ণ অসম্ভব; বরং কখনও এরূপ হয়ে থাকে যে, একজন লোকের নিকট অনেক অনেক সংকলন আছে অথচ সংকলিত বস্তু তার পূর্ণ আয়ত্বে নেই; বরং হাদীস শাস্ত্রের এরূপ সংকলনের সময়কালের পূর্বের লোকেরা পরবর্তী লোকদের থেকে হাদীস শাস্ত্র বেশী জ্ঞাত ছিলেন। কেননা, তাদের নিকট যেগুলো সহীহ ও সঠিকভাবে পৌঁছেছে, এমন অনকেগুলো আমাদের নিকট অজানার দরুণ কিংবা সনদের বিচ্ছিন্নতার কারণে পৌঁছে নি কিংবা হাদীসটি অদৌ পৌঁছে নি।
তাদের বক্ষ ছিল সংকলিত গ্রন্থ স্বরূপ। কেননা, তাদের বক্ষ ঐ সকল গ্রন্থরাজি হতেও অধিক ধারণ করত। এ বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তিরা সন্দেহ করেন না এবং এ কথা বলা উচিৎ নয় যে, যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ হাদীস সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, সে মুজতাহিদ হতে পারবে না। কেননা, মুজতাহিদ হওয়ার জন্য যদি এ শর্ত করা হয় যে, তাকে আহকাম সম্পর্কিত রাসূলের সমুদয় হাদীস জানতে হবে, তাহলে উম্মতের মাঝে কোনো মুজতাহিদ পাওয়া যাবে না। তবে একজন আলেমের জন্য এটা যথেষ্ট যে, সে এর অধিকাংশ বিষয়বস্তু ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। বিস্তারিত বিষয়ের অংশ বিশেষ ছাড়া সবই তার কাছে স্পষ্ট। অধিকন্তু অল্প কিছু যা তার অজানা। কখনও তার নিকট বিস্তারিত হাদীস পৌঁছানো হলে তার অল্পটি হাদীসের বিপরীত হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় কারণ:
হাদীসটি তার নিকট পৌঁছেছে; কিন্তু হাদীসটি কোনো কারণে তার নিকট নির্ভরযোগ্য নয়।
এর কারণ হলো:
হাদীস তার কাছে বর্ণনাকারী, বর্ণনাকারীর কাছে বর্ণনাকারী, সনদের অন্য কোনো ব্যক্তি তার কাছে অজ্ঞাত, কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত, স্মৃতি শক্তিতে দুর্বল, হাদীসটি তার নিকট মারফু অবস্থায় পৌঁছেনি; বরং মুনকাতি' অবস্থায় পৌঁছেছে কিংবা হাদীসের শব্দগুলি দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত হয় নি।
পক্ষান্তরে ঐ হাদীসটি অপর একজনের নিকট নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী দ্বারা মুত্তাসিল সনদে পৌছেছে এবং অজ্ঞাত বর্ণনাকারী তার নিকট নির্ভরযোগ্য অথবা এরূপও হয়ে থাকে যে, ঐ হাদীসটি অন্য সনদে বর্ণিত, যার বর্ণনাকারী কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত নয় এবং সনদটি ও মুনকাতি' বা বিচ্ছিন্ন নয়; বরং মুত্তাসিল। এতদসত্ত্বেও হাদীস শাস্ত্রের কতিপয় হাফেয, হাদীসের শব্দগুলি দৃঢ়তার সাথে বর্ণনা করেছেন অথবা ঐ হাদীসটির জন্য এমন কতকগুলো মুতাবা'আত ও শাওয়াহিদ রয়েছে, যার দ্বারা উক্ত হাদীসটি বিশুদ্ধ প্রমাণিত হয়।
এ জাতীয় হাদীস তাবেয়ীন ও তাবে তাবেঈন থেকে আরম্ভ করে প্রসিদ্ধ ইমামগণের মধ্যে বহুল প্রকারে পাওয়া যায় এবং এ সকল হাদীসের সংখ্যা প্রথম যুগের চেয়ে বেশি অথবা প্রথম প্রকার হতে অধিকতর বেশি। কেননা, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হাদীস প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল, তাতে এমনও বহু হাদীস ছিল যা বহু আলেমের নিকট দুর্বল পন্থায় পৌছে। সুতরাং এ পর্যায়ে অত্র হাদীসগুলো দলীল হতে পারে, যদিও বিপক্ষীয়দের নিকট এ পন্থায় না পৌঁছে থাকে।
এ জন্য বহু ইমাম তাদের রায় প্রদানের সময় বিশুদ্ধ হাদীসের ওপর নির্ভর করে কথা বলেন। তারা বলে থাকেন অমুক মাস'আলায় আমার রায় হচ্ছে, কেননা এ সম্পর্কে অমুক হাদীস বর্ণিত আছে। যদি হাদীসটি সহীহ হয়, তবে তাই আমার রায়।
তৃতীয় কারণ:
ইজতেহাদ মোতাবেক কোনো হাদীসকে দুর্বল মনে করা, যদিও অন্যান্য আলেমগণ সেটাকে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেন না। হতে পারে তিনি সঠিক অথবা তারা উভয়ে সঠিক।
সমাপ্ত