×
ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজের জন্য নিয়ে এসেছে সনুন্দরতম দিকনির্দেশনা, যা ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি অর্জনের একমাত্র পাথেয়। প্রবন্ধটি এবিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।

    ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনে ইসলামি দিক নির্দেশনা

    توجيه الإسلام للفرد والمجتمع

    < بنغالي- Bengal - বাঙালি>

    মুহাম্মাদ ইবন জামিল যাইনু

    محمد بن جميل زينو

    —™

    অনুবাদক: ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান

    সম্পাদনায়: ড. মোহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী

    ترجمة: محمد مجيب الرحمن

    مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

    ব্যক্তি ও সমাজ সংশোধনে ইসলামি দিক নির্দেশনা

    ইসলামের বৈশিষ্ট্য:

    ১। ইসলাম হচ্ছে তাওহীদ বা একত্ববাদের দীন। তা হল অন্তরে দৃঢ়ভাবে এ ঈমান পোষণ করা যে, এক স্রষ্টা সমস্ত জগতকে সৃষ্টি করেছেন, তা বাস্তব সত্য, যা প্রতিটি বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল লোকের বুদ্ধিবৃত্তিক কথা। আর এ স্রষ্টাই হচ্ছেন সত্যিকারের মাবুদ; তাই একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা কর্তব্য। এছাড়া একমাত্র তাঁর নামেই হতে হবে যবেহ করা, নজর-নেওয়াজ দেয়া। আর বিশেষ করে দো‘আর ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

    «الدُّعاَءُ هُوَ الْعٍبَادةً»

    “দো‘আই হচ্ছে ইবাদাত।”[1]

    এ কারণেই গায়রুল্লাহর নিকট দো‘আ করা জায়েয নেই।

    ২। ইসলাম সকল কিছুর সমন্বয় সাধন করে, কোনো বিভেদ সৃষ্টি করে না। এবং ঐ সমস্ত রাসূলগণের উপর ঈমান আনতে বলে যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা প্রেরণ করেছিলেন লোকদের হিদায়াতের জন্য, তাদের জীবনকে সুসংহত করার জন্য। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন তাদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। আর তার শরীয়ত আল্লাহর হুকুমে পূর্ববর্তী সমস্ত শরী‘আতসমূহকে বাতিল করে দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সমস্ত মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি তাদের অন্যান্য মিথ্যা ও বিকৃত ধর্মের হাত হতে রক্ষা করে ইসলামের অপরিবর্তিত দীনের মধ্যে শামিল করতে পারেন।

    ৩। ইসলামের শিক্ষাসমূহ সহজ ও সাধারণের বোধগম্য। ইসলাম কোনো রকম অবাস্তব চিন্তা কিংবা বিকৃত আকীদা অথবা দার্শনিকের কাল্পনিক কোনো চিন্তাকে স্বীকৃতি দেয় না। তা প্রত্যেক যুগে ও সমাজে সহজেই পালন করা চলে।

    ৪। ইসলাম জড় ও আত্মিক জগতকে সম্পূর্ণ আলাদা করে না। বরঞ্চ জীবনকে একক ও সর্বব্যাপী রূপ প্রদান করে এবং উভয় জগতকে একই স্রষ্টার পরিকল্পনার অংশ হিসাবে দেখে। তাই কোনো একটাকে গ্রহণ করা, আর অন্যটাকে ছেড়ে দেয়ার নীতি তার মধ্যে নেই।

    ৫। ইসলাম অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মুসলমানদের একে অন্যের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বকে বজায় রাখে এবং জাতি বা এলাকাগত দূরত্বকে অস্বীকার করে।

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ ١٣ ﴾ [الحجرات: ١٣]

    “নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]

    ৬। ইসলামে এমন কোনো পূজারীর দল নেই যারা দীন নিয়ে ব্যবসা করে। আর এমন কোনো অবাস্তব চিন্তা ভাবনা নেই যা বিশ্বাস করা কঠিন। প্রতিটি ব্যক্তিই আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস পড়তে পারে এবং সালফে সালেহীনগণ যেভাবে বুঝেছেন ঐভাবে বুঝে নিয়ে তার ভিত্তিতেই জীবনকে গড়তে পারবে।

    ইসলাম জীবনের পরিপূর্ণ বিধান

    ১। ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকেই সুন্দর ও সুসংহত করেছে। তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা সামাজিক যাই হোক না কেন। আর সাথে সাথে এই জাতীয় সমস্যাবলী সমাধানের জন্য উত্তম রাস্তাও প্রদর্শন করেছে।

    ২। ইসলাম মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ রাস্তা দেখানোর জন্য সচেষ্ট। এর মধ্যে মূল কথা হচ্ছে, সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহার। আর ইসলামের বিধানসমূহই হচ্ছে মুসলিমদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের কামিয়াবীর সঠিক দিক নির্দেশনা।

    ৩। ইসলামের মূল হচ্ছে আকীদাহ অত:পর শরীয়াহ। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মক্কার জীবনের সম্পূর্ণ প্রচেষ্টাই ছিল আকীদাহ প্রচার। তারপর যখন তিনি মদীনায় হিজরত করেন, তখন শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে তথায় ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করা যায়।

    ৪। ইসলাম মানুষকে জ্ঞানের দিকে আহবান করে। আর উৎসাহিত করে নবলব্ধ উপকারী ইলম অর্জনের জন্য। তাই দেখা যায়, মধ্য যুগে মুসলিমরা জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অতি উচ্চস্তরে পৌছে ছিলেন। যেমন, ইবন হাইছাম, বাইরূণী এবং আরও অনেকে।

    ৫। ইসলাম হালাল ধন দৌলত অর্জন করাকে স্বীকার করে। তবে শর্ত হল, তাতে কোনো ধোঁকা কিংবা জোর-জবরদস্তি থাকবে না। আর সাথে সাথে এটাও উৎসাহিত করে যে, নেককার ব্যক্তিগণ হালাল মাল উপার্জন করবে এবং ঐ উপার্জিত অর্থ দ্বারা ফকীরদের সাহায্য করবে ও আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে। আর এভাবেই ইসলামের সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রচারিত হয়, যারা তাদের শরীয়াহ তাদের রব হতে গ্রহণ করে।

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورا: ١١]

    “তার মত কেউ নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১১]

    ৬। ইসলাম হচ্ছে এমন দীন যাতে রয়েছে জিহাদ ও জীবন পরিচালনার বিধান। প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরয করা হয়েছে দীনের সাহায্যের জন্য সে তার জান ও মালকে ব্যয় করবে, আর এটাই জিহাদের মূলকথা। ইসলাম জীবন ধারণেরও দীন। অর্থাৎ তা মানুষকে এমন শিক্ষা দেয় যদ্বারা তারা সুন্দরভাবে জীবনকে গড়ে তুলবে ইসলামের ছায়াতলে। তবে শর্ত হলো, সে আখেরাতের জীবনকে দুনিয়ার জীবনের ওপর প্রাধান্য দিবে।

    ৭। ইসলাম তার গণ্ডীর মধ্যে স্বাধীন চিন্তাভাবনার পথকে প্রশস্ত করে দেয়। সাথে সাথে চিন্তাজগতের জড়তাকে দূর করে, আর ইসলামের মধ্যে যে সমস্ত খারাপ চিন্তাভাবনা প্রবেশ করে তাকে হটিয়ে দেয়। আর ঐ সমস্ত বিদআত, কুসংস্কার, মউদু‘ হাদীসসমূহকে দূরীভূত করে, যা মুসলিমদের অগ্রযাত্রাকে বাধা প্রদান করে।

    দো‘আ হচ্ছে ইবাদাত

    দো‘আ যে ইবাদাত তা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এটা হতে প্রমাণিত হয় যে, দো‘আ বিশেষ ধরনের ইবাদাত। কোনো রাসূল কিংবা অলীর জন্য যেমন সালাত আদায় করা চলেনা, তেমনিভাবে কোনো রাসূল অথবা অলীর নিকট (তাদের মৃত্যুর পর) আল্লাহকে ছেড়ে কোনো দো‘আ চাওয়া যাবে না।

    ১। যদি কোনো মুসলিম বলে: হে রাসূলুল্লাহ বা হে গায়েবের খবর জানা ব্যক্তি, আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর, সাহায্য কর; তখন ওটা হবে দো‘আ এবং ঐ ইবাদাত গায়রুল্লাহর জন্য করা হলো, যদিও তার অন্তরে এই নিয়ত থাকে যে, সত্যিকারভাবে আল্লাহই রক্ষাকর্তা। এর তুলনা হচ্ছে ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে আল্লাহর সাথে কোনো শিরক করে বলে: আমার অন্তরে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তথাপিও তার এ কথা অগ্রাহ্য হবে। কারণ, তার মুখের কথা তার আমলের বিপরীত। এজন্যই তার মুখের কথা তার অন্তরের নিয়্যাত ও আকিদার সাথে মিল থাকতে হবে। নতুবা তা শির্ক বা কুফুরীর পর্যায়ে যাবে, যা তাওবা ব্যতীত আল্লাহ ক্ষমা করেন না।

    ২। আবার যদি কোনো মুসলিম বলে, আমার অন্তরের নিয়ত হচ্ছে তাদেরকে (তথা রাসূলুল্লাহ ও অলীকে) আল্লাহর নিকট মধ্যস্থতাকারী বানানো। যেমন, কোনো আমিরের নিকট আমি যেতে পারি না কোনো মধ্যস্থতাকারী ব্যতীত। এমতাবস্থায় এটি সৃষ্টিকর্তার সাথে অত্যাচারী সৃষ্ট ব্যক্তির তুলনা করা হলো, যার নিকট মধ্যস্থতাকারী ব্যতীত পৌঁছা যায় না। আর এ ধরনের তুলনা কুফুরীর পর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলার জাত, সিফাত ও কার্যসমূহ যে কত পাক পবিত্র তা বর্ণনা করে বলেন,

    ﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورا: ١١]

    “তার মতো কেউ নেই, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১১]

    যদি আল্লাহর সাথে কোনো ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির তুলনা করা হয়, তবে তা কুফরি ও শিরকের পর্যায়ভুক্ত। আর সেখানে কোনো অত্যাচারীর সাথে তুলনা করা তো আরো ভয়ংকর। আল্লাহ তা‘আলা ঐ সমস্ত যালিম, যারা বড় বড় অহংকারের কথা বলে, তা হতে খুবই পবিত্র।

    ৩। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যমানায় মুশরিকরা পর্যন্ত এই ধারণা পোষণ করত যে, আল্লাহ তা‘আলাই স্রষ্টা, রিযিকদাতা। এতদসত্ত্বেও তারা তাদের আউলিয়াদের ডাকত (যারা মূর্তি আকারে ছিল) মধ্যস্থতাকারী হিসেবে, যাতে তারা তাদেরকে আল্লাহর নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এতটুকু মধ্যস্থতা পর্যন্ত পছন্দ করেন নি, বরঞ্চ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

    ﴿ وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ ٣ ﴾ [الزمر: ٣]

    “যারা তাঁকে (আল্লাহ) ছেড়ে অন্যদের আউলিয়া বলে আঁকড়ে ধরেছিল, তারা বলত: আমরা এদের উপাসনা এজন্য করি যাতে তারা আমাদের আল্লাহর নিকট পৌঁছায়। আল্লাহ অবশ্যই তাদের মধ্যে যে মতবিরোধ ছিল, তার বিচার করবেন। নিশ্চয়ই তিনি কাফের ও মিথ্যাবাদীকে হিদায়াত প্রদান করেন না।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]

    আল্লাহ তা‘আলা আমাদের অতি নিকটবর্তী ও শ্রবণকারী। তাঁর নিকট কোনো মধ্যস্তকারীর প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেন,

    ﴿ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ ﴾ [البقرة: ١٨٦]

    “আর যদি কোনো বান্দা তোমার নিকট আমার সম্বন্ধে প্রশ্ন করে তবে বলো: আমি খুবই নিকটে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৬]

    ৪। এমনকি ঐ সমস্ত মুশরিকরাও প্রচণ্ড বিপদে পড়ে একমাত্র আল্লাহকে ডাকত।

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَجَآءَهُمُ ٱلۡمَوۡجُ مِن كُلِّ مَكَانٖ وَظَنُّوٓاْ أَنَّهُمۡ أُحِيطَ بِهِمۡ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ لَئِنۡ أَنجَيۡتَنَا مِنۡ هَٰذِهِۦ لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلشَّٰكِرِينَ ٢٢ ﴾ [يونس: ٢٢]

    “আর যখন চর্তুদিক হতে প্রচণ্ড ঢেউ তাদের বেষ্টন করে ফেলত, তখন তারা ধারণা করত যে, তাদের দ্বারা তারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছে। তখন তারা কায়মনোবাক্যে এক আল্লাহকে ডেকে ডেকে বলত: যদি আপনি আমাদের এই বিপদ হতে উদ্ধার করেন তবে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হব।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ২২]

    তারা তাদের আউলিয়াদেরকে (যারা মূর্তির আকারে ছিল) ডাকত সুখের সময়। এতদসত্ত্বেও কুরআন তাদের কাফের আখ্যায়িত করেছে।

    তাহলে ঐ সমস্ত মুসলিম, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা নেককার (মৃত) ব্যক্তিদের ডেকে তাদের নিকট উদ্ধার কামনা করে, প্রচণ্ড বিপদে ও পরীক্ষার সময় এবং সুখের সময়েও তাদের ডাকে, তাদের সম্বন্ধে আপনাদের কি ধারণা? তারা কি আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী পড়েনি?

    ﴿ وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن يَدۡعُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسۡتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَآئِهِمۡ غَٰفِلُونَ ٥ وَإِذَا حُشِرَ ٱلنَّاسُ كَانُواْ لَهُمۡ أَعۡدَآءٗ وَكَانُواْ بِعِبَادَتِهِمۡ كَٰفِرِينَ ٦ ﴾ [الاحقاف: ٥، ٦]

    “আর তার থেকে অধিক গোমরাহ আর কে হতে পারে, যে আল্লাহ ছাড়া এমন কাউকে ডাকে যে কিয়ামত পর্যন্ত (ডাকলেও) তার ডাকে সাড়া দিবে না। আর তারাও (গাইরুল্লাহ) তাদের দো‘আ সম্বন্ধে অজ্ঞ। যখন লোকদের হাশর হবে, তখন তারা তাদের শত্রু বনে যাবে, আর তারা যে তাদের ইবাদাত (দো‘আ ) করত তাকে অস্বীকার করবে।” [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ৫, ৬]

    ৫। অনেকের ধারণা যে, মুশরিকরা (যাদের কথা কুরআনে আছে) পাথরের তৈরী মূর্তিদের নিকট দো‘আ করত। এটা ভুল ধারণা। কারণ, যে মূর্তিদের কথা কুরআনে বর্ণিত আছে তারা ছিলেন নেককার ব্যক্তি।

    সহীহ বুখারীতে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে সূরা নুহের ঐ কথার ব্যাখ্যায় বর্ণিত আছে:

    «وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آَلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا)قَالَ هَذِهِ اَسْمَاءُ رِجَالٍ صاَلِحِيْنَ مِنْ قَوْمِ نُوْحٍ فَلَمَّا هَلَكَ اُولَئِكَ أوْحيَ الشَّيْطَانُ إلَي قَوْمِهِمْ: أنِِ انْصِبُو إليَ مَجَالِسِهِمْ الَّتِي كَانُوا يَجْلِسُوْنَ فِيهَا أنْصَابًا وَ سَمُّوْهَا بِأسْمَائِهِمْ فَفَعَلُوْا وَلَمْ تُعْبَدْ حَتَّي إذَا هَلَكَ اُولَئِكَ وَنُسِيَ الْعِلْمُ عُبِدَتْ»

    “আর তারা বলল: তোমরা তোমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করোনা। আর পরিত্যাগ করোনা ওয়াদ্দা, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাছরাকে।” এর ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এরা ছিলেন নূহ আলাইহিস সালামের বংশের নেককার ব্যক্তিগণ। যখন তারা মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, শয়তান তখন তাদের কওমের লোকদের বলল: তারা যেখানে বসত সেখানে তাদের মূর্তি বানিয়ে স্থাপন কর, আর তাদের নামকরণও কর। তারা সেটা করল, যদিও তারা তখনও তাদের ইবাদত করত না। তারপর যখন এই লোকেরা মৃত্যুমুখে পতিত হল, তখন থেকেই এই মূর্তিদের ইবাদাত শুরু হয়ে গেল।”[2]

    ৬। যারা নবী ও আউলিয়াগণকে ডাকে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ধিক্কার দিয়ে বলেন,

    ﴿ قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا ٥٧ ﴾ [الاسراء: ٥٦، ٥٧]

    “বল: তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে মাবুদ মনে করে আহবান কর, দেখবে তোমাদের দু:খ দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই। তারা যাদেরকে আহবান করে তাদের মধ্যে যারা নিকটতর তারাইতো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে। তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে, তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬, ৫৭]

    ইবন কাসীর রহ. এ আয়াতের তাফসীরে যা বলেন, তার মূল কথা হলো, এ আয়াত ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের শানে নাযিল হয়েছে, যারা ঈসা আ. এবং মালাইকাদের ইবাদাত করত। এই আয়াত ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের কাজের প্রতিবাদ করে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের নিকট দো‘আ করত, হোকনা তারা নবী কিংবা অলী।

    ৭। কেউ কেউ ধারণা করে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট বিপদে মুক্তি চাওয়া জায়েয। তারা বলে: সত্যিকারের বিপদ উদ্ধারকারী হলেন আল্লাহ, আর রাসূলুল্লাহ বা আউলিয়াদের নিকট বিপদ থেকে উদ্ধার চাওয়া রূপক। যেমন, বলা হয়, আমাকে ঐ ঔষধ বা ডাক্তার রোগ মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু তাদের এ কথা সঠিক নয়। কারণ ইব্রাহিম আ. বলেন,

    ﴿ ٱلَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهۡدِينِ ٧٨ وَٱلَّذِي هُوَ يُطۡعِمُنِي وَيَسۡقِينِ ٧٩ وَإِذَا مَرِضۡتُ فَهُوَ يَشۡفِينِ ٨٠ ﴾ [الشعراء: ٧٨، ٨٠]

    “যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই হিদায়াত দান করেন। আর তিনিই আমার খাদ্য যোগান ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেন। আর যখন অসুস্থ হই তখন তিনিই আমাকে সুস্থ করেন।” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ৭৮-৮০ আয়াত]

    উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বার বার তিনিই করেন কথাটা উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, নিশ্চয়ই হিদায়াতদাতা রিযিকদাতা সুস্থতাদানকারী একমাত্র তিনিই, অন্য কেউ নয়। তাই ঔষধ হচ্ছে আল্লাহর রহমতের দ্বারা রোগমুক্তির কারণ, সে নিজে রোগমুক্তিদাতা নয়।

    ৮। এমন অনেকে আছে যারা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য, উদ্ধারকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে জীবিত কি মৃত তা প্রভেদ করে না। কিন্ত আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَمَا يَسۡتَوِي ٱلۡأَحۡيَآءُ وَلَا ٱلۡأَمۡوَٰتُۚ ﴾ [فاطر: ٢٢]

    “জীবিত ও মৃত ব্যক্তিরা কখনই সমতুল্য নয়।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ২২]

    অন্যত্র তিনি বলেন,

    ﴿ فَٱسۡتَغَٰثَهُ ٱلَّذِي مِن شِيعَتِهِۦ عَلَى ٱلَّذِي مِنۡ عَدُوِّهِۦ ﴾ [القصص: ١٥]

    “তখন সে তার বংশের লোকের নিকট সাহায্য চাইল, তার শত্রুর বিরুদ্ধে।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ১৫]

    এই ঘটনা ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে যিনি মূসা আলাইহিস সালামের নিকট সাহায্য চেয়েছিল তার শত্রুর বিরুদ্ধে। আর তিনি সাহায্যও করেন। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ فَوَكَزَهُۥ مُوسَىٰ فَقَضَىٰ عَلَيۡهِۖ ﴾ [القصص: ١٥]

    “সে তাকে মুষ্টিঘাত করে, ফলে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ১৫]

    কিন্তু কোনো অবস্থাতে মৃত ব্যক্তির নিকট বিপদে সাহায্য চাওয়া জায়েয নয়। কারণ, সে দো‘আ শ্রবণ করে না। আর যদি শ্রবণ করত, তথাপি জবাব দেয়ার কোনো ক্ষমতা তার নেই। এ সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ ﴾ [فاطر: ١٤]

    “তোমরা তাদেরকে আহবান করলে তারা তোমাদের দো‘আ শুনবে না এবং যদি শুনতেও পেত তথাপি তোমাদের আহ্বানে সাড়া দিবে না। তোমরা তাদেরকে যে শরীক করছ, তা তারা কিয়ামত দিবসে অস্বীকার করবে।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৪]

    এ আয়াত হতে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হলো যে, মৃতদের নিকট দো‘আ চাওয়া শির্ক-এর পর্যায়ভুক্ত। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَخۡلُقُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ ٢٠ أَمۡوَٰتٌ غَيۡرُ أَحۡيَآءٖۖ وَمَا يَشۡعُرُونَ أَيَّانَ يُبۡعَثُونَ ٢١ ﴾ [النحل: ٢٠، ٢١]

    “যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যদের ডাকে তারা কোনো জিনিস সৃষ্টি করেনি, বরঞ্চ তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। মৃতরা কখনই জীবিতদের সমতুল্য নয়। আর তাদের এতটুকু ধারণা নেই যে, কখন আবার তাদের পুনরুত্থান করা হবে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ২০, ২১]

    ৯। সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, লোকেরা কিয়ামতের দিন নবীদের নিকট আগমন করবে এবং তাদের নিকট শাফায়াত প্রার্থনা করবে। এভাবে শেষ পর্যায়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে তারা যে বিপদে আছে, তা হতে উদ্ধারের জন্য শাফায়াতের অনুরোধ করবে। তখন তিনি বলবেন: হ্যাঁ আমি তা করব। তারপর তিনি আরশের নীচে সিজদা করবেন এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট ঐ বিপদ হতে উদ্ধার এবং শীঘ্র বিচার প্রার্থনা করবেন। এই শাফায়াত এমন সময় তাঁর নিকট চাওয়া হবে, যখন তিনি জীবিত হবেন এবং তাঁর সাথে লোকেরা কথা বলবে এবং তিনিও তাদের সাথে কথা বলবেন। তারা আর্জি জানাবে যে, তিনি যেন তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ (শাফায়াত) করেন এবং তাদের জন্য বিপদমুক্তির প্রার্থনা করেন। আর এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করবেন। (আমার মাতা পিতা তার জন্য কুরবান হউক)

    ১০। সবচেয়ে বড় দলীল যা দ্বারা মৃতদের ও জীবিতদের মধ্যে চাওয়ার প্রভেদ করেছেন তা হলো উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ঐ ঘটনা- যখন তাদের মধ্যে দুর্ভিক্ষের প্রসার ঘটেছিল। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর নিকট তাদের জন্য দো‘আ চেয়েছিলেন। তিনি তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দো‘আ চান নি। কারণ, ততদিনে তিনি উপরের বন্ধুর নিকট প্রত্যাবর্তন করেছেন।

    ১১। বহু আলেম মনে করেন অসীলা এবং বিপদে সাহায্য চাওয়া একই ধরনের। আসলে উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অসীলা হলো আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থনা করা কোনো মাধ্যম ধরে। যেমন, বলা - হে আল্লাহ! আপনার প্রতি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আমাদের যে ভালবাসা আছে, তার অসীলায় আমাকে বিপদমুক্ত করুন। এভাবে দো‘আ করা জায়েয। অপরদিকে বিপদে মুক্তি চাওয়া হলো- কোনো গাইরুল্লাহর নিকট কিছু চাওয়া। যেমন, হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাদেরকে বিপদ হতে উদ্ধার করুন, এটা কোনো ক্রমেই জায়েয নয়। উহা বড় শির্কের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَلَا تَدۡعُ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَۖ فَإِن فَعَلۡتَ فَإِنَّكَ إِذٗا مِّنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٠٦ ﴾ [يونس: ١٠٦]

    “আর আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কাউকে ডেকো না, যে না তোমার কোনো উপকার করতে পারবে, আর না কোনো ক্ষতি করতে পারবে। যদি তা কর অবশ্যই তুমি যালিমদের (মুশরিক) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৬]

    আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অন্যদের বলতে বলেছেন,

    ﴿ قُلۡ إِنِّي لَآ أَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا رَشَدٗا ٢١ ﴾ [الجن: ٢١]

    “বল: আমিতো কোনো ক্রমেই তোমাদের ক্ষতি বা ভালো করার ক্ষমতা রাখি না।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ২১]

    অন্যত্রে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

    ﴿ قُلۡ إِنَّمَآ أَدۡعُواْ رَبِّي وَلَآ أُشۡرِكُ بِهِۦٓ أَحَدٗا ٢٠ ﴾ [الجن: ٢٠]

    “বল: আমি তো একমাত্র আমার রবকে ডাকি, আর তার সাথে কাউকে শরীক করি না।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ২০]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,

    « إذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللَّهَ وَ إذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ »

    “যখন কিছু চাও একমাত্র আল্লাহর নিকট চাও, আর সাহায্য চাইলেও তাঁর নিকটে চাও।”[3]

    কবি বলেন,

    বিপদে একমাত্র আল্লাহর নিকটেই আশ্রয় চাই। কারণ, তিনি ব্যতিত কেউ বিপদ দূর করতে পারে না।

    [1] সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ১৪৭৯, হাদীসটি হাসান ও সহীহ।

    [2]. সহীহ বুখারী, হাদীস নং 4920

    [3] সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ২৫১৬