যেভাবে একজন হাজী তার সন্তানদের উপদেশ দেবে
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
যেভাবে একজন হাজী তার সন্তানদের উপদেশ দেবে
هكذا ينبغي أن تكون وصية الحجاج لأولادهم
< بنغالي >
নু‘মান আবুল বাশার
نعمان أبو البشر
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
مراجعة: د/أبو بكر محمد زكريا
যেভাবে একজন হাজী তার সন্তানদের উপদেশ দেবে
হে আমার সন্তানেরা! আমি তোমাদেরকে প্রশ্ন করব, তোমরা উত্তর দেবে।
এ ব্যাপারে কি তোমাদের কারো কোনো সন্দেহ আছে যে, তোমরা প্রত্যেকেই আমার অন্তরের একটি অংশ দখল করে আছো?
তোমাদের জবাব হবে: অবশ্যই এ ব্যাপারে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।
তবে জেনে রেখো, এ মুহূর্তে তোমাদের প্রত্যেককে বিদায় জানাতে গিয়ে আমার অন্তরের এক একটি অংশ উপড়ে যাচ্ছে। সুতরাং যার অন্তর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, যাকে কলজে ছেড়া টুকরোগুলোকে বিদায় জানাতে হচ্ছে, তাকে কি কোনো অপবাদ দেওয়া যায়, দোষ ধরা চলে?
হে আমার সন্তানেরা! তোমাদের পিতার অন্তরে তোমাদেরকে বিদায় জানানো কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, তা কীভাবে আমি বর্ণনা করব? কী করে এই রক্তক্ষরণের বেদনা তোমাদেরকে বোঝাবো?
আমার অন্তরের রক্তক্ষরণের যন্ত্রণাগুলো যদি শব্দে চিত্রায়ন করি, তাহলে হয়তো ভাববে, আমি অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিচ্ছি। কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলবো, সন্তানের জগত থেকে তোমরা পিতার আসনে এসে কিছুটা সময় অতিবাহিত করো। তাহলে কলজে ছেড়া টুকরোগুলোকে বিদায় জানানো পিতার অন্তরে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, তার কিছু মুহূর্ত তোমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
সুতরাং হে আমার সন্তানেরা, আমার এ অসিয়তের প্রতিটি শব্দের ভিতরে ও বাহিরে মিশে আছে আন্তরিক ও স্বচ্ছ ভালোবাসা। জীবিত কারো প্রতি ভালোবাসাই একে অতিক্রম করতে পারবে না।
হ্যা, এ হচ্ছে কথা ও কলম থেকে উৎসারিত ফোটা ফোটা বিন্দু; কিন্তু মনে রেখ, এ বিন্দুগুলোর উৎস হচ্ছে হৃদয়ের গভীরতর ভালোবাসার সফেদ ঝর্নাধারা। এগুলো আমি তোমাদের শ্রবণে ফোটায় ফোটায় ঢেলে দিচ্ছি। অন্তর থেকে উৎসারিত ফোটাগুলো কি তোমাদের অন্তরের গভীরে স্থান দেওয়াই কাম্য নয়?
হে আমার সন্তানেরা! অসিয়ত পরিত্যাগ আমাদের জন্য কখনোই যথপোযুক্ত হবে না। ইতোপূর্বে যদিও আমরা অসিয়ত পরিত্যাগ করে থাকি, তাহলে সে অভ্যাস পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। অন্যান্যরাও যদি এ ব্যাপারে উদাসীন থাকে কিংবা একে তুচ্ছ জ্ঞান করে, তাহলে তাদেরকে বোঝানো কর্তব্য। অসিয়ত কিতাব ও সুন্নাহ কর্তৃক স্বীকৃত। নবী ও তাদের অনুসারীগণও এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছেন। সালাফে সালেহীনের হিদায়াত ও বিবেক যৌক্তিক দাবীও এটি। বিশেষতঃ মানুষ যখন সফরে যাত্রা করে, একে উপেক্ষা করা কখনোই ঠিক হবে না।
হে আমার সন্তানেরা! এটি তোমাদের জন্য আমার লিখিত অসিয়ত, যা আমি এ খামে ভরে রাখছি। আমার যাবতীয় ঋণ, হক ও দেনা-পাওনা এতে লিপিবদ্ধ আছে। মায়ের প্রতি, বড় ভাইয়ের প্রতি, একে অপরের প্রতি, আত্মীয়, পড়শী, সমাজ এবং সর্বোপরি তোমাদের শত্রুদের প্রতি তোমাদের কী হক, তা এতে সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে। তোমাদের মায়ের কী কী দায়িত্ব, ইতোপূর্বেই আমি তাকে সে সম্পর্কে জানিয়েছি। এ ব্যাপারে তিনি ভালো ভাবেই জ্ঞাত।
প্রিয় সন্তানেরা! সফর দু ধরনের; দীর্ঘ সফর ও সংক্ষিপ্ত সফর। এ দু সফরের মধ্যে একটি মৌলিক মিল আছে। সে মিল হচ্ছে বিচ্ছেদ।
দীর্ঘ সফর হচ্ছে আখিরাতের সফর। এর বিচ্ছেদও দীর্ঘ। সংক্ষিপ্ত সফর হচ্ছে দুনিয়ার সফর। এর বিচ্ছেদও সংক্ষিপ্ত। কিন্তু আমি কায়মনোবাক্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আমার পার্থিব এ সংক্ষিপ্ত সফর তাঁর প্রতি এবং তাঁর উদ্দেশ্যেই হচ্ছে। আমি তাঁরই ডাকে সাড়া দিতে সফরের নিয়ত করেছি।
আগামীকাল আল্লাহ চাহে তো- আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদেরকে বিদায় জানাব। সুতরাং তোমরা এ ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রতারিত হয়ো না যে, ইতোপূর্বেও আমরা সফর করেছি এবং ফিরে এসেছি। এ বারও এর ব্যত্যয় হবে না। এ সফরে আমরা ফিরে আসব, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিচ্ছেদ যেমন গায়েব ও তাকদীর সংশ্লিষ্ট বিষয়, তেমনি ফিরে আসাও গায়েবী ও তাকদীর সংশ্লিষ্ট। পার্থিব ঘটনা অনুঘটনায় এর মধ্যে তারতম্য দেখলেও মৌলিকভাবে এর মধ্যে কোনো তারতম্য নেই।
আমি তোমাদেরকে সর্বোত্তম অসিয়ত করছি। তা হচ্ছে: তাকওয়া অর্জন। প্রতিটি বিষয়ে, প্রতিটি কথায় ও কাজে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের চেয়ে উত্তম কোনো বন্ধন তোমাদের জন্য আমি দেখছি না। সৎ সংসর্গের চেয়ে উত্তম কোনো সম্পর্ক, আল্লাহকে ভালোবেসে একে অপরকে ভালোবাসার চেয়ে ভালো কোনো ভালোবাসা, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধের চেয়ে কল্যাণকর কিছু, শাহাদাতের চেয়ে উত্তম কোনো আকাঙ্ক্ষা, ইলমের অনুসন্ধানের চেয়ে উত্তম কোনো পথ, একে অপর থেকে উপদেশ গ্রহণের চেয়ে উত্তম কোনো মানসিকতা আমি দেখছি না। প্রকৃতরূপে যে আল্লাহকে ভয় করে, তার কাছে পিতার উপস্থিতি-অনুপস্থিতি কোনো পার্থক্য তৈরী করবে না। তাকওয়া হলো সর্বক্ষেত্রে আল্লাহকে উপস্থিত জ্ঞান করা, কোনো সৃষ্টিকে নয়।
হে আমার সন্তানেরা! দায়িত্বশীল, বন্ধু, পিতা কিংবা এ শ্রেণীর গুরুজনদের বিদায়ে সাধারণত মানুষ অনেক কিছু হারায়। তবে পিতার বিদায়ে সবচেয়ে সমস্যায় আক্রান্ত হন যিনি, তিনি হচ্ছেন পরিবারের মা। কিন্তু মনে রাখবে, পিতার গমনের পর মা যদি সন্তানদের হাতে দুর্ভাগ্যপীড়িত হন -এর চেয়ে মন্দ আর কিছু হতে পারে না। এটি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল এবং তোমাদের পিতার নিকট কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন, দয়াবান কি এটি কোনোভাবে বরদাশত করতে পারে?
তবে এ কথা সত্য যে, আমার বিকল্প হিসেবে তোমরা তোমাদের মায়ের জন্য যথেষ্ট নও; কিন্তু তিনি যদি তোমাদের থেকে সান্তনাটুকুই না পান, তাহলে তা তার জন্য বিপদ হিসেবে দেখা দেবে। তোমরা তার জন্য বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এবং যাবতীয় বিপদাপদের ক্ষেত্রে তিনিই হয়ে যান একক বহনকারী- সন্দেহ নেই, এটি তার জন্য আরো কঠিন এক পরিস্থিতির তৈরী করবে।
প্রতিটি কাজে, ঘরে-বাইরে, কথায় ও আচরণে বোনদের সাথে রূঢ় আচরণ, কঠোরতা, সংশয় ও বাঁকা দৃষ্টিতে তাকানো কোনোভাবেই সম্মানজনক কাজ হতে পারে না। বোনদের ক্ষেত্রে ভাইদের জন্য সে আচরণই সর্বোত্তম ও সম্মানজনক, যা তাদেরকে মানসিক ও বাহ্যিক সুরক্ষা দেয়। ভাই-বোনদেরকে ভালোবাসা, সে ভালোবাসার আবহ তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াই হচ্ছে তাদের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষা। ভাই-বোনদের প্রতি স্নেহশীল ভাইয়ের ভূমিকাই তোমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমিকা। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, ভাই-বোনদের পারস্পরিক ভালোবাসা ও প্রীতির সম্পর্ক তাদের জন্য সর্বোত্তম সুরক্ষা বয়ে আনে। শয়তান বোনদের প্রতি অযথা কঠোরতা তৈরির মাধ্যমে সম্পর্কের ফাটল তৈরী করে। ভালোবাসার দাবী হচ্ছে বোনদের অন্তরের এক সহজাত প্রবৃত্তি। প্রয়োজন ও মানবিক টান হিসেবে তাদের অন্তরে এটি সর্বদা বিরাজ করে। যখন এ ভালোবাসা সে তার আপন গৃহে খুঁজে পায় না, তখন তার চোখ বাহিরে নিবদ্ধ হয়। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় অন্যান্যদের মাঝে। এভাবেই, অধিকাংশ মেয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক সময় পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যায় অন্ধকার জগতে। সুতরাং তোমরা সতর্ক থেকো, যেন তোমাদের কেউ পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার কারণ না হয়। বোনদের জগতে সুরক্ষা ও প্রতিরোধের দেয়াল হওয়াই তোমাদের জন্য শ্রেয় ও সম্মানজনক।
হে আমার মেয়েরা! ছেলেদের উদ্দেশ্যে আমি যা যা বলেছি, তোমাদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে তোমরা আলাদা কিছু নও। তোমরা সকলেই আমার সন্তান। তবে আমি তোমাদেরকে বিশেষভাবে উদ্দেশ্য করছি। কারণ, তোমরা আমার বাহ্য প্রতিবিম্ব সম্মান। সুতরাং সে হিসেবে তোমরা তোমাদের মনোভাব, আচরণ গড়তে সচেষ্ট হও। যে কোনো কারণেই হোক না কেন, যখন তোমরা মেয়েরা একে অপরে আলাপচারিতায় বসো, গীবত, কুটচর্চা, উপহাস ইত্যাদি পাপে নিজেদেরকে ও নিজেদের যবানকে কালিমাযুক্ত করো না। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে আলাপচারিতার গতি তোমরাই নির্ধারণ করো এবং তাকে একটি সুস্থ, কল্যাণময় চিন্তার দিকে ধাবিত করো। এতে সকলেই ভালো কাজে অংশগ্রহণ করবে।
হে আমার মেয়েরা! নারীদের ক্ষেত্রে মূর্খতা প্রকট আকার ধারন করে থাকে। উপরন্তু নানাবিধ আক্রমণ ও টানাহেচড়ায় তারা ক্রমাগত পর্যদুস্ত হয়ে উঠে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তোমাদেরকে খুবই বিশ্বস্ত হতে হবে, যতটা সম্ভব নারীদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে। তোমাদের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন তখনই সম্ভব, যদি তোমরা শরী‘আতের প্রয়োজনীয় ইলম অর্জনে সচেষ্ট হও, কুরআন হিফয করো এবং এ ব্যাপারে আলিম ও তালিবুল ইলমদেরকে সহযোগিতা করো। নিশ্চয় এ হচ্ছে প্রজন্মের আমানত, যে আমানত রক্ষার ব্যাপারে বিশ্বস্ততার অভাব রয়েছে।
সুতরাং অনর্থক আলাপচারিতায় ডুবে থাকা এবং নির্লজ্জ ফ্যাশন...ইত্যাদি থেকে তোমরা বিরত থাকো। এ ধরনের প্রবণতায় আক্রান্ত নারীদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকো। কারণ, যে বিভ্রান্ত নারীদেরকে রক্ষা করতে ব্রতী, তাকে অবশ্যই বিভ্রান্তির যাবতীয় কালিমা থেকে বিমুক্ত থেকে নিজেকে এক শক্ত ভূমিতে স্থাপন করতে হবে, যেন কোনো কারণে পদস্খলন না ঘটে।
হে আমার সন্তানেরা! আমি যেমন চেয়েছি, ঠিক তেমন সুন্দর করে যদি আমি তোমাদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষা না দিয়েও থাকি, তবে আমার প্রতি তোমাদের সর্বোত্তম ইহসান হচ্ছে, তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে সুন্দর, শোভাময় শিষ্টাচারে ভূষিত করো এবং তোমাদের ব্যাপারে আমার যেটুকু দূর্বলতা ছিল, তা পুরণ করে নাও। কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সেই ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করো, যে ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে এসেছে:
﴿يَوۡمَ لَا يَنفَعُ مَالٞ وَلَا بَنُونَ ٨٨ إِلَّا مَنۡ أَتَى ٱللَّهَ بِقَلۡبٖ سَلِيمٖ ٨٩ ﴾ [الشعراء: ٨٨، ٨٩]
“ওই যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো উপকারে আসবে না তবে যে আল্লাহর কাছে আসবে সুস্থ অন্তরে। [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ৮৮-৮৯]
আল্লাহর ওয়াস্তে আমি তোমাদের নিকট এই প্রার্থনাই করবো যে, তোমরা আমার ধ্বংসের কারণ হয়ো না। কারণ, কখনো কখনো আমি নিজেকে আপন নফ্সের প্ররোচনা থেকে সুরক্ষিত মনে করলেও পরিবার থেকে সুরক্ষিত মনে করি না। আমার নাজাতের কারণ না হতে পারলেও জেনে-বুঝে তোমরা আমার আযাবের কারণ হয়ো না। এমন একজন সন্তানের জন্য আমার মন-প্রাণ উদ্বেল হয়ে আছে, যার আমল আমার পাল্লাকে ভারি করে তুলবে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আকালে যে তার পিতার কথা বিস্মৃত হবে না। যার কারণে আমার কবরের ‘আযাব লঘু করা হবে এবং যার কারণে পার্থিবে আমার সম্মান ও মর্যাদা প্রভূত বৃদ্ধি পাবে।
সে সন্তানেই আমার মন ভরে উঠবে, চক্ষু শীতল হবে, কুরআন হিফয করার প্রতিদানস্বরূপ কিয়ামত দিবসে আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের সম্মুখে যার পিতাকে মর্যাদার তাজ ও অলংকারে ভূষিত করা হবে।
হে আমার সন্তনেরা! রাসূলের সে মন্তব্যের চেয়ে ভালো কোনো কর্মনীতিমালা আমি তোমাদের জন্য দেখছি না, যাতে তিনি ইরশাদ করেছেন:
«حَيْثُمَا أَدْرَكَتْكَ الصَّلاَةُ فَصَلِّ، وَالْأَرْضُ لَكَ مَسْجِدٌ».
“যেখানেই সালাতের সময় হবে, সালাত আদায় করে নাও। জমিন তোমার জন্য মসজিদ।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩২৪৩)
আল্লাহকে ভয় করো, সালাতের সময় হওয়া মাত্র তা আদায় করো। মসজিদে গিয়ে জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করো। সালাতের প্রতি যত্নবান হওয়া যদি তোমাদের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়, আরামদায়ক শয্যা ছেড়ে সালাতে দণ্ডায়মান হতে মন বিরুদ্ধ হয়ে উঠে, কাজের চাপ বেড়ে যায়, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে উক্তি স্মরণ করো, যাতে তিনি ইরশাদ করেছেন:
«الصَّلاَةُ خَيْرُ مَوْضُوْعٍ، فَمِنْ اِسْتَطَاعَ أَنْ يَسْتَكْثِرَ فَلْيَسْتَكْثِرْ».
“সালাত হচ্ছে সর্বোত্তম বিষয়। সুতরাং যে তা অধিক আদায় করতে পারবে, সে যেন অধিক আদায় করে।” (তাবরানী, হাদীস নং ২৪৩)
হে আমার সন্তানেরা! আল্লাহর ভালোবাসাকে তোমরা সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করো। প্রতিকূল ও অনুকূল প্রতিটি বিষয়েই একে বিচারের মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করো। যখন দু’টি বিষয়ের একটি গ্রহণের প্রশ্ন আসে, তখন নিজেকে প্রশ্ন করো, এ দু’টির কোনটি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় হওয়ার দাবীদার? এ মনোবৃত্তির অনুসরণের ফলে দেখতে পাবে এক সময়ে তোমাদের নিকট আল্লাহর ভালোবাসাই একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আল্লাহর ভালোবাসা এবং তাঁর বিধানকে মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করাই তোমার জীবনের সাফল্যের জন্য যথেষ্ট।
হে আমার সন্তানেরা! সালাত, যিকির-আযকার এবং মসজিদে অবস্থানের মূল্যবান সময়গুলো বাজারের কোলাহলমুখর পাপবিদ্ধ পরিবেশে বিনষ্ট করো না। মুখ, চোখ এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পাপ অর্জনের কারণ বানিয়ো না। পরকালে যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি তোমাদেরকে দাঁড়াতে হবে, তার সর্বাগ্রে থাকবে সালাতের বিষয়টি। সুতরাং সে প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপারে এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করো। কেবল সালাত আদায় সংক্রান্ত প্রশ্নই তোমাদেরকে করা হবে না; বরং বিশুদ্ধ ও সঠিক পন্থায় আদায় করেছো কি-না, প্রশ্নের অন্যতম বিষয় হবে এটি। হাদীসে এসেছে:
«فان صلحت صلح له سائر عمله، وإن فسدت فسد سائر عمله».
“সুতরাং সালাত যদি সঠিক হয়, তবে তার সব কর্মই সঠিক হবে। আর যদি তা বিনষ্ট হয়, বিনষ্ট হবে যাবতীয় কর্ম।” (তাবরানী, হাদীস নং ১৮৫৯)
সুতরাং সালাতের পূর্বে যখন অযু-ইস্তেঞ্জাসহ প্রয়োজনীয় কর্ম সমাধা করবে, তখন পবিত্রতার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ প্রদান করো। ধীরে-সুস্থে, পূর্ণ ধ্যান নিয়োগ করে অজু করো। সুন্নত ও নফলের প্রতি সজাগ হও। সালাতে খুশু-খুজু রক্ষা করো। সর্বোত্তম উপায়ে সালাত শেষ করো। সালাত শেষে তাসবীহ, তাহলীল এবং তাকবীর সঠিকরূপে আদায় করো। এর প্রভাব তোমাদের পুরো জীবনে ছড়িয়ে দাও। দেখবে, নাজাত তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করে থাকবে।
এমন একটি দিন অতিবাহিত হতে দিও না, যেদিন তুমি আল্লাহর রাস্তায় কিছু ব্যয় করো নি। বাড়ির অভ্যন্তরে আমরা যে বাক্সটি স্থাপন করেছি, দৈনিক আবশ্যকীয় খরচের কিছু রক্ষা করে হলেও তাতে কিছু জমাও। ধন্য সে যুবক, শৈশব থেকেই যে আখিরাতের জন্য কিছু কিছু সঞ্চয় করে। তাই সে ব্যক্তিগত ব্যয়ের কিছু অংশ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে। যৌবনের শক্তি ঢেলে দেয় ইবাদাতের জন্য। অবসর সময়গুলো যিকিরের আমলে ব্যয় করে, রাতের আধারে আরামদায়ক শয্যা ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে যায় আল্লাহর দরবারে। দৈনন্দিন খাদ্যগ্রহণের নিয়মতান্ত্রিকতা পরিহার করে সাওম পালন করে। এগুলোই কি সে ভয়ানক সময়ে তার জন্য প্রতিরক্ষা হবে না? আখিরাতের প্রখরতম রৌদ্রে তার জন্য আল্লাহর ‘আরশের ছায়া দেবে না?
«سبعة يظلهم الله تعالى في ظله يوم لا ظل إلا ظله...و شاب نشأ في عبادة الله».
“সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না। ...এমন যুবক, যে আল্লাহর ইবাদাতে লালিত হয়।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৫৭)
আমার আত্মীয় কিংবা অনাত্মীয় কারো পক্ষ থেকে এমন উক্তি আমাকে কখনো সুখী করবে না যে, অমুক ব্যক্তি মানুষ হিসেবে খুবই ভালো; কিন্তু তার সন্তানরা মন্দ চরিত্রের। সুতরাং তোমরা একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মীয়তা রক্ষা করো, এমনকি যারা তোমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তাদের সাথেও। যে আত্মীয়তার সম্পর্ক আমার কারণে কিংবা তোমাদের মায়ের কারণে অথবা অন্য কোনো সূত্র ধরে তোমাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে, তার সবগুলোর প্রতিই যত্নবান হও। মনে রেখো, আত্মীয়তা রক্ষার মূল বিষয় হচ্ছে যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখা। বনী ইসরাঈলের মজ্জাগত একটি মন্দ স্বভাব এখনকার নেককার ও অভিজাত পরিবারে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষতঃ এ রোগে আক্রান্ত এ সব পরিবারের যুবক সন্তানেরা। স্বভাবটি হচ্ছে- যেমন আল্লাহর বাণী কুরআনে এসেছে:
﴿كَانُواْ لَا يَتَنَاهَوۡنَ عَن مُّنكَرٖ فَعَلُوهُۚ﴾ [المائدة: ٧٩]
“তারা পরস্পরকে মন্দ থেকে নিষেধ করত না, যা তারা করত।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭৯]
সুতরাং নিজেদের পরিবারভুক্ত কারো কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণে তোমরা সঙ্কোচ বোধ করবে না। কারণ, নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক উপদেশ প্রদানই তোমাদেরকে বাইরের মানুষের নিন্দামন্দ থেকে হিফাযত করবে।
হে আমার সন্তানেরা! এ কী কখনো যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে যে, কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে প্রাত্যহিক সম্বোধনের সুযোগ লাভ করেও তা পরিত্যাগ করে কিংবা প্রতিদিন আল্লাহর সম্বোধন শ্রবণের সুযোগ লাভ করেও তা এড়িয়ে যায়? প্রতিদিন তোমরা আল্লাহর কালাম পাঠ করো, উপভোগ করো কুরআনের সুশীতল সংসর্গ। তা হিফয করার ব্যাপারে যত্নবান হও, তোমাদের সন্তানদেরকে তা হিফয করাও। কুরআন হিফযের আবেগ পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে দাও।
কারো পক্ষে কী এমন করা সম্ভব যে, আত্মা, জ্ঞান ও জীবনের খণ্ড খণ্ড উপসর্গসহ রাসূলের সান্নিধ্যে, পাক-পবিত্র নবীগণের সাথে জীবন যাপন, জান্নাত-জাহান্নাম এবং গায়েবী জগতের উন্মোচিত অনেক অলভ্য বিষয় দর্শনের সুযোগ লাভ করেও সে তা পরিত্যাগ করে? যখনি তোমরা রাব্বুল ‘আলামীনের দাসত্বের স্তরে নিজেদেরকে উন্নীত করার সুযোগ লাভ করবে, তখনি ইহসানের স্তরে নিজেকে স্থাপনে সচেষ্ট হবে। ইহসান হচ্ছে সালাতে, কুরআন তিলাওয়াতে, সাওম পালনে সচেতনে ও সজ্ঞানে এমন এক উপলব্ধির বিস্তার ঘটানো, যেন তোমরা আল্লাহকে দেখছো। এমনকি এক সময় আল্লাহ চাহে তো এ অনুভূতি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে বিস্তার লাভ করবে।
সুতরাং আমি আশা করব, তোমরা ইহসানের এই উদ্যান ও লালনক্ষেত্রে প্রবেশ করবে এবং এর কল্যাণ ও সৌভাগ্যে নিজেদেরকে বিধৌত করবে।
আমি তোমাদেরকে যে সকল বিষয়ে অসিয়ত করছি, সেগুলো হচ্ছে অসিয়তের নিদেনপক্ষ। অন্যথায় তোমাদের আসল কাজ হচ্ছে, যে কল্যাণের দিশা তোমরা লাভ করেছো, তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া, তাদেরকে এ পথে নিয়ে আসা। যেরূপ শুদ্ধতাসহ তোমরা সালাত আদায় করো, তা অন্যদেরকেও করতে উদ্বুদ্ধ করো। তোমাদের সাদাকাগুলোকে অন্যদের জন্য নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করো। তোমরা যেভাবে নিজেদের সম্পদ ও মর্যাদার সংরক্ষণ করো, ঠিক সেভাবে অন্যদেরকে উম্মতের সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোল। কল্যাণের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি অণু ও রেণুতে তোমাদের দৃষ্টির বিস্তার করো, যেন তা তোমাদের জীবনে এক ব্যাপকতর কল্যাণ বয়ে আনে। তা হয়ে উঠে স্থায়ী প্রভাব ও সুফল আনয়নকারী। যাতে তোমাদের জন্য, তোমাদের দেশ ও জাতির জন্য অঢেল প্রশান্তি বয়ে আনে। এ সবের মাধ্যমে সে মহান দিবসে আমাদের চোখ শীতল হয়, যেদিন আমরা রব তা‘আলার দর্শনে অভিভূত হবো।
আল্লাহ যা ফরয করেছেন, যাকে ভালোবাসতে বলেছেন, তার প্রতি ভালোবাসার দায় যদি না থাকত, তবে আমি তোমাদের থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হতাম না। কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসা যখন অন্তরে প্রবিষ্ট হয়, তখন তা ভালোবাসার অন্য সব বন্ধন মুহূর্তে বিচূর্ণ করে দেয় এবং অন্য সব প্রিয় ব্যক্তি থেকে তাকে কেড়ে নিয়ে এক আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করে।
হে আমার সন্তানেরা! আমি আমার রবের সান্নিধ্যে গমন করছি এবং তোমাদেরকে সমর্পণ করে যাচ্ছি তাঁর পূর্ণ হিফাযতে। তাঁর মুহাব্বাত ও ভালোবাসায় আমার অন্তর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে, সে চলে গিয়েছে তার পাক দরবারে, যদিও এ দেহ তোমাদের পাশে এখনো পড়ে আছে। সুতরাং হে রব! পৃথিবীর সুদূরতম কোণে অবস্থানরত কারো সম্মুখে যখন তোমার ভালোবাসার নিশানা চড়ে গিয়েছে, তোমার মোহময় সম্প্রীতির অলঙ্ঘ জাল বিস্তৃত হয়েছে তার আকাশ জুড়ে, তখন অন্য কারো প্রতি ভালোবাসা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় -এ কী সম্ভব, তোমার সৃষ্টির স্মরণ কি তোমার স্মরণ থেকে ভুলিয়ে রাখতে পারে?
وكان فؤادي خاليا قبل حبكم * وكان بذكر الخلق يلهو ويمرح
“তোমাকে ভালোবাসার পূর্বে আমার অন্তর ছিল শূণ্যপাত্র * মানুষের স্মরণেই তা মত্ত ও প্রফুল্ল হতো”
فلما دعا قلبي هواك أجابه * فلست أراه عن فنائك يبرح
“যখন তোমার ভালোবাসা অন্তরকে আহ্বান জানাল, সে সাড়া দিল * আমি মনে করি না, তোমার অলিন্দ থেকে সে দূরে থাকবে।”
رميت ببعد عنك إن كنت كاذبا * وإن كنت في الدنيا بغيرك أفرح
“যদি আমি মিথ্যাবাদী হই, কিংবা যদি তুমি ব্যতীত * এ জগতের কারোতে প্রীত ও উৎফুল্ল হই, তবে নিঃসন্দেহে তোমা হতে দূরে সরে যাওয়ার অপবাদে আমি বিদ্ধ হব”
وإن كان شيء بالبلاد بأسرها * إذا غبت عن عيني لعيني يملح
“*যদি আপনি আমার এ চোখের আড়াল হোন, তবে আমার চারপাশ বিস্বাদ লবণাক্ততায় ভরে যাবে।”
فإن شئت واصلني وإن شئت لاتصل * فلست أرى قلبي لغيرك يصلح
“তুমি চাও তো আমাকে তোমার সাথে সম্পর্কযুক্ত কর কিংবা কেটে দিতে পার সম্পর্কের সুতো * আমি মনে করি না, তুমি ভিন্ন কারোতে এ অন্তর কল্যাণের সন্ধান লাভে ধন্য হবে।”
বিদায়ী অসিয়ত
সিঞ্চনকারী ঝর্ণাধারা
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٣٢ ﴾ [البقرة: ١٣٢]
“আর এরই উপদেশ দিয়েছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়াকূবও (যে,) হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দীনকে চয়ন করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না।” [সূরা আল-বাকারাহ আয়াত: ১৩২]
অপর আয়াতে বলেন:
﴿وَلَقَدۡ وَصَّيۡنَا ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ مِن قَبۡلِكُمۡ وَإِيَّاكُمۡ أَنِ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ ﴾ [النساء: ١٣١]
“আর তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমরা নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৩১]
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَا حَقُّ امْرِئٍ ُمسْلِمٍ لَهُ شَيْءٌ يُرِيْدُ أَنْ يُوْصِيْ فِيْهِ يَبِيْتُ لَيْلَتَيْنِ إِلاَّ وَوَصِيَّتُهُ مَكْتُوْبَةٌ عَنْدَهُ».
“কোনো ব্যক্তির যদি কিছু থাকে এবং সে তাতে অসিয়ত করতে চায়, তবে তার এ অধিকার নেই যে সে তার অসিয়ত নিজের কাছে লিখিত রাখা ব্যতীত দু রাত যাপন করবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৫৮৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬২৭)
সমাপ্ত