×
এ প্রবন্ধে লিখক হারাম মাল ভক্ষণের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি তিনি শর‘ঈ দলীলের আলোকে হারাম মাল ভক্ষণ কেন নিষিদ্ধ সে বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

    হারাম খাবার যে জন্য নিষিদ্ধ

    تحريم أكل الحرام

    <بنغالي>

    আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান

    أختر الزمان محمد سليمان

    —™

    সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

    مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

    عبد الله شهيد عبد الرحمن

    হারাম খাবার যে জন্য নিষিদ্ধ

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

    হারাম খাবার যে জন্য নিষিদ্ধ

    সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার, তার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি, তার নিকট ক্ষমা চাই, আমাদের অন্তরের অনিষ্ট এবং মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ তা‘আলা যাকে হেদায়েত দেবেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করবেন সে কাউকে তার সাহায্যকারী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে পাবে না।

    আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ এক, তার কোনো শরীক নেই এবং একথারও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর দয়া ও অধিক পরিমাণ সালাম তার ওপর এবং তার পরিবারবর্গ ও সাহাবাদের উপর বর্ষিত হউক।

    হে মুসলমানেরা!

    আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির সবাইকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে এবং তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আল্লাহ তা‘আলা যা রিযক দিয়েছেন তার মধ্য থেকে হালাল ভক্ষণ করে, অপবিত্র এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلۡأُمِّيَّ ٱلَّذِي يَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ يَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ ﴾ [الاعراف: ١٥٧]

    “যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী, যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে”[সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ১৫৭]

    হে আল্লাহর বান্দারা!

    প্রত্যেক মুসলমানের উপর হালাল উপার্জন করা ওয়াজিব যদিও তা কষ্টকর হয়। বাস্তবে হালাল উপার্জন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু দ্বীন থেকে দূরে থাকা, বস্তুগত মাধ্যমের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হওয়া এবং নীতিবোধ উঠে যাওয়ার কারণে তা আমাদের কাছে কঠিন মনে হয়। মানুষের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসার কারণে অনেক মানুষ হারামের দিকে পতিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের হালাল চিনতে অসুবিধা হচ্ছে, তারা মনে করছে এখন হালাল হারিয়ে গেছে। হালাল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। হারামের দিকে রাস্তা ধরা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। আর যিনি আমাদেরকে সত্য দ্বীনের উপর রেখে গেছেন তিনি বলেছেন,

    «إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ، وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ، وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ، كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى، يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ، أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى، أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللهِ مَحَارِمُهُ، أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً، إِذَا صَلَحَتْ، صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ، فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ»

    “নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট আর এ উভয়ের মধ্যে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয়, অনেক লোকই সেগুলো জানে না। যে ব্যক্তি এ সব সন্দেহজনক বিষয় থেকে দুরে থাকে সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে, আর যে লোক সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হবে সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে। যেমন কোন রাখাল সংরক্ষিত চারণভূমির পার্শে পশু চরায়, আশংকা রয়েছে সে পশু তার অভ্যন্তরে গিয়ে ঘাস খাবে। সাবধান! প্রত্যেক বাদশাহরই সংরক্ষিত এলাকা থাকে, সাবধান! আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হল তার হারামকৃত বিষয়সমূহ। জেনে রাখো, দেহের মধ্যে এক টুকরা পিন্ড আছে। যখন তা সুস্হ থাকে তখন সমস্ত শরীরই সুস্হ থাকে । আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায় তখন সমস্ত শরীরই নষ্ট হয়ে যায়। স্মরণ রেখো, তা হল কালব- হৃদয়”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫২ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৯৯)

    যে ব্যক্তি দ্বীন রক্ষার ব্যাপারে যত্নবান তার নিকট যদি কোনো বিষয় হারাম হালাল হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ হয় তবে না জানা থাকলে জ্ঞানী লোকদের থেকে জেনে নেবে যেমন আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿فَسۡ‍َٔلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلذِّكۡرِ إِن كُنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ﴾ [النحل: ٤٣]

    “সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জান”[সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৪৩]

    ঐ সকল লেন-দেন যা শরী‘আতভিত্তিক নয়, তা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করার পর্যায়ে পড়ে, যাকে আল্লাহ তা‘আলা হারাম এবং নিষিদ্ধ করেছেন। মানুষ আজকাল হারাম উপার্জনের ব্যাপারে অনেক বেশি উদাসীন হয়ে গেছে। শ্রমিক তার কাজ সঠিকভাবে করে না। আবার অনেক সময় মালিক পক্ষ কাজের পারিশ্রমিক দেয় না। দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার কর্ম সঠিকভাবে পালন করে না। ব্যবসায়ী তার দ্রব্যের মধ্যে ভেজাল দেয়। সুদী কারবারী সাহসী হয়ে উঠে। মানুষের ক্ষতি করে এমন জিনিসের তারা ব্যবসা করে। এমনকি অনেক ব্যবসায়ের বস্তু মানুষের জীবন ধংস করে দেয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল সেই ব্যক্তি যে হেদায়াতের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে শয়তানের সাথে আপোষ করল।

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থাতো এই ছিল, ঘরের কোণে একটি খেজুর তার বিছানায় পড়ে থাকা অবস্থায় পেলেন। সেটি উঠালেন খাওয়ার জন্য, অতঃপর আশঙ্কা করলেন এটি সাদকাহওতো হতে পারে, পরে ফেলে দিলেন। ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنِّي لَأَنْقَلِبُ إِلَى أَهْلِي، فَأَجِدُ التَّمْرَةَ سَاقِطَةً عَلَى فِرَاشِي، فَأَرْفَعُهَا لِآكُلَهَا، ثُمَّ أَخْشَى أَنْ تَكُونَ صَدَقَةً، فَأُلْقِيهَا»

    “আমি আমার পরিবারের নিকট গেলাম। আমার বিছানায় খেজুর পড়ে থাকা অবস্থায় পেলাম, আমি সেটি খাওয়ার জন্য উঠালাম। অতঃপর ভয় হল তাতো সাদাকাহ হতে পারে, তাই ফেলে দিলাম”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৩২, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৭০)

    তার সাহাবীরাও হারাম থেকে এমন ভয়ে থাকতেন। দেখুন না আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর অবস্থা। তার একজন ক্রীতদাস ছিল যে তার ট্যাক্স আদায় করত। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ট্যাক্সের পয়সায় তার সংসার চলত। সে একদিন তাঁর জন্য একটা জিনিস আনল। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তা থেকে খেলেন। ক্রীতদাসটি তাকে বলল, এটা কি তা আপনি জানেন? তিনি প্রশ্ন করলেন, এটা কি? সে বলল, আমি ইসলামপূর্ব যুগে এক ব্যক্তির রাশিফল গণনা করেছিলাম। আর এ রাশিফল গণনা করতে গিয়ে আমি তার সাথে ধোঁকাবাজী করতাম। তার সাথে আজ আমার সাক্ষাত হওয়ার পর সে আমাকে ঐ জিনিস দিয়েছিল। তার থেকেই আপনি খেয়েছেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুখের ভিতর হাত দিলেন এবং পেটের ভিতর যা ছিল সব বমি করে দিলেন। (আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর ঘটনা ইমাম বুখারী রহ. মানাকেব অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।)
    কা‘ব ইবন আজরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন,

    «أُعِيذُكَ بِاللَّهِ يَا كَعْبَ بْنَ عُجْرَةَ مِنْ أُمَرَاءَ يَكُونُونَ مِنْ بَعْدِي، فَمَنْ غَشِيَ أَبْوَابَهُمْ فَصَدَّقَهُمْ فِي كَذِبِهِمْ، وَأَعَانَهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ فَلَيْسَ مِنِّي وَلَسْتُ مِنْهُ، وَلَا يَرِدُ عَلَيَّ الحَوْضَ، وَمَنْ غَشِيَ أَبْوَابَهُمْ أَوْ لَمْ يَغْشَ وَلَمْ يُصَدِّقْهُمْ فِي كَذِبِهِمْ، وَلَمْ يُعِنْهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ، فَهُوَ مِنِّي وَأَنَا مِنْهُ، وَسَيَرِدُ عَلَيَّ الحَوْضَ، يَا كَعْبَ بْنَ عُجْرَةَ الصَّلَاةُ بُرْهَانٌ، وَالصَّوْمُ جُنَّةٌ حَصِينَةٌ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ المَاءُ النَّارَ، يَا كَعْبَ بْنَ عُجْرَةَ، إِنَّهُ لَا يَرْبُو لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ إِلَّا كَانَتِ النَّارُ أَوْلَى بِهِ».

    “হে কা‘ব ইবন আজরা! আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট তোমার জন্য ঐ সমস্ত শাসক থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যারা আমার পরে আসবে। যে ব্যক্তি তাদের দরবারে যাবে, তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করবে, তাদের অত্যাচারে সাহায্য করবে- সে আমার সাথে নয়, আমিও তার সাথে নই। সে হাউজে আসতে পারবে না। আর যে তাদের দরবারে গেল অথবা না গেল, তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে সত্যায়ন করল না, তাদের অত্যাচারে সাহায্য করল না- সে আমার সাথে, আমিও তার সাথে এবং সে হাউজের কাছে আমার সাথে সাক্ষাত করবে। হে কা’ব ইবনে আজরা, নামাজ হল দলিল-প্রমাণ। সিয়াম হলো শক্ত ঢাল। দান সদকা গুনাহকে তেমনই মিটিয়ে দেয় যেমন পানি আগুনকে মিটিয়ে দেয়। হে কা‘ব ইবন আজরা! ঐ মাংস বৃদ্ধি পায় না যা হারাম দ্বারা তৈরী হয়। বরং জাহান্নাম এর থেকে উত্তম”। (ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, হাদীসটি হাসান এবং গরিব, হাদীস নং ৬১৪। আলবানি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

    আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, হে বৎস! তোমার ধ্বংস হোক। তুমি আমাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলে। আমি ভয় পেয়েছিলাম এই হারাম মালের দ্বারা আমার গোস্তের বৃদ্ধি ঘটবে। যদি এমন হয়ে যেত তাহলে আমার কি হত? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,

    إِنَّهُ لَا يَرْبُو لَحْمٌ نَبَتَ مِنْ سُحْتٍ إِلَّا كَانَتِ النَّارُ أَوْلَى بِهِ.

    “ঘুষের মাধ্যমে যে গোস্ত তৈরী হয় তা বৃদ্ধি পায় না বরং তা আগুনের জন্য বেশি উপযুক্ত”

    ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন,

    إِنَّكُمْ لَتَغْفُلُوْنَ عَنْ أَفْضَلِ الْعِبَادَةِ هُوَ الْوَرْعُ.

    “তোমরা সবাই উত্তম ইবাদত থেকে অমনোযোগী হয়ে আছো, আর তা হল: আল্লাহভীরু হয়ে চলা”(ইহইয়া উলূমিদ্দীন, ২/৯১)

    আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,

    لَوْ صَلَّيْتُمْ حَتَّى تَكُوْنُوْا كَالْحَنَايَا وَصُمْتُمْ حَتَّى تَكُوْنُوْا كَالْأَوْتَارِ لَمْ يَقْبَلْ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلاَّ بِوَرْعٍ حَاجِزٍ.

    “তোমরা যদি সালাত পড়তে পড়তে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যাও আর সাওম পালন করতে করতে তারের মতো কঙ্কাল হয়ে যাও তোমাদের পক্ষ থেকে তা ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হবে না যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহভীরু হয়ে তা পালন না করবে”(ইহইয়া উলূমিদ্দীন, ২/৯১)

    উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা হালাল উশরের এক নবম অংশ এ ভয়ে নিতাম না যদি আমরা হারামের মধ্যে পড়ে যাই। পূর্বসুরীদের অবস্থা তো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল কোনো ওয়ায়েয মানুষের উদ্দেশ্যে ওয়াজ করতে চাইলে তার মধ্যে তিনটি বিষয় খুঁজে দেখতে বলতেন: যদি সে বিদআতের আকিদা পোষণ করে তবে সে শয়তানের ভাষায় কথা বলবে, তার ওয়াজে বসবে না। আর যদি হারাম ভক্ষণ করে তবে সে প্রবৃত্তি অনুযায়ী কথা বলবে। আর যদি তার বুদ্ধি কম থাকে তবে সংশোধন করার চেয়ে অধিক পরিমাণে পথভ্রষ্ট করবে, তার কাছে বসবে না।

    ইয়াহইয়া ইবনে মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আনুগত্য আল্লাহর ভাণ্ডারের মধ্য থেকে একটি ভাণ্ডার, তার চাবি হল দো‘আ। কিন্তু হালাল খাদ্য তা নষ্ট হয়ে যাওয়া রোধ করে।

    সবচেয়ে বিপদ জনক বিষয় হল মানুষ দুনিয়ার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর দুনিয়া উপার্জন করছে যে কোনো পন্থায়, হালাল হারাম বাছবিচার করছে না। তাদের চিন্তা একটাই- সম্পদ কিভাবে হাতে আসবে। এটা দেখছে না তা হারাম না হালাল? কিভাবে ধনী হতে পারবে সেটাই চিন্তা করে সারাজীবন। এ কারণে অনেকে হিদায়াতের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ أَفَمَن يَمۡشِي مُكِبًّا عَلَىٰ وَجۡهِهِۦٓ أَهۡدَىٰٓ أَمَّن يَمۡشِي سَوِيًّا عَلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ٢٢ ﴾ [الملك: ٢٢] .

    “যে ব্যক্তি উপুড় হয়ে মুখের উপর ভর দিয়ে চলে সে কি অধিক হিদায়াতপ্রাপ্ত নাকি সেই ব্যক্তি, যে সোজা হয়ে সরল পথে চলে”? [সূরা আল-মুলক, আয়াত : ২২]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنَّ اللَّهَ قَسَمَ بَيْنَكُمْ أَخْلَاقَكُمْ، كَمَا قَسَمَ بَيْنَكُمْ أَرْزَاقَكُمْ، وَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يُعْطِي الدُّنْيَا مَنْ يُحِبُّ وَمَنْ لَا يُحِبُّ، وَلَا يُعْطِي الدِّينَ إِلَّا لِمَنْ أَحَبَّ، فَمَنْ أَعْطَاهُ اللَّهُ الدِّينَ، فَقَدْ أَحَبَّهُ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا يُسْلِمُ عَبْدٌ حَتَّى يَسْلَمَ قَلْبُهُ وَلِسَانُهُ، وَلَا يُؤْمِنُ حَتَّى يَأْمَنَ جَارُهُ بَوَائِقَهُ» ، قَالُوا: وَمَا بَوَائِقُهُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ؟ قَالَ: «غَشْمُهُ وَظُلْمُهُ، وَلَا يَكْسِبُ عَبْدٌ مَالًا مِنْ حَرَامٍ، فَيُنْفِقَ مِنْهُ فَيُبَارَكَ لَهُ فِيهِ، وَلَا يَتَصَدَّقُ بِهِ فَيُقْبَلَ مِنْهُ، وَلَا يَتْرُكُ خَلْفَ ظَهْرِهِ إِلَّا كَانَ زَادَهُ إِلَى النَّارِ، إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَمْحُو السَّيِّئَ بِالسَّيِّئِ، وَلَكِنْ يَمْحُو السَّيِّئَ بِالْحَسَنِ، إِنَّ الْخَبِيثَ لَا يَمْحُو الْخَبِيثَ».

    “অল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মধ্যে তোমাদের চরিত্রকে বন্টন করেছেন যেমন তোমাদের রিযক তোমাদের মধ্যে বন্টন করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার সম্পদ দান করেন যাকে ভালবাসেন এবং যাকে ভালো না বাসেন তাকেও। আর দ্বীন দান করেন যাকে তিনি ভালবাসেন শুধু তাকে। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার অন্তর এবং জিহবা মুসলমান হবে। আর ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ তার প্রতিবেশি তার বাওয়ায়েক থেকে নিরাপদে থাকবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন বাওয়ায়েক কি জিনিস হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন: তার যুলুম অত্যাচার। আর এটা কখনো হবে না যে, কেউ হারাম উপার্জন করবে তার থেকে খরচ করবে আর আল্লাহ তাতে বরকত দেবেন এবং তার থেকে দান করবে আর আল্লাহ সে দান কবুল করবেন। আর সে তার থেকে যা কিছু রেখে যাবে তা তার আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়ার বস্তু হবে। আল্লাহ তা‘আলা খারাপ দ্বারা খারাপের প্রতিকার করেন না। কিন্তু ভালো দ্বারা খারাপ মিটিয়ে দেন। খারাপ কখনও খারাপকে মিটাতে পারে না”(মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৩৬৭২, হাদীসের সনদটিতে দুর্বলতা রয়েছে)

    সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنَّ أَكْثَرَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ مَا يُخْرِجُ اللَّهُ لَكُمْ مِنْ بَرَكَاتِ الأَرْضِ» قِيلَ: وَمَا بَرَكَاتُ الأَرْضِ؟ قَالَ: «زَهْرَةُ الدُّنْيَا» ثُمَّ قَالَ وَإِنَّ هَذَا المَالَ خَضِرَةٌ حُلْوَةٌ، مَنْ أَخَذَهُ بِحَقِّهِ، وَوَضَعَهُ فِي حَقِّهِ، فَنِعْمَ المَعُونَةُ هُوَ، وَمَنْ أَخَذَهُ بِغَيْرِ حَقِّهِ كَانَ كَالَّذِي يَأْكُلُ وَلاَ يَشْبَعُ وَيَكُونُ عَلَيْهِ شَهِيدًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ »

    “তোমাদের জন্য আমি সবচেয়ে যে বিষয়টির বেশী ভয় করি তা হল, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যে ‘বারাকতুল আরদ’ বের করবেন। প্রশ্ন করা হল, ‘বারাকাতুল আরদ’ কি জিনিস? তিনি বললেন, দুনিয়ার চাকচিক্য। অতঃপর বললেন, এই মাল সম্পদ সবুজ এবং মিষ্ট। এই মালের অধিকারসহ যে গ্রহণ করবে এবং জায়গামত তা ব্যয় করবে, সে এর মাধ্যমে উত্তম সাহায্য পাবে। আর যদি অন্যায় ভাবে সম্পদ গ্রহণ করে, তাহলে তার দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে খাদ্য গ্রহণ করে কিস্তু তৃপ্ত হয় না। আর ঐ সম্পদ কিয়ামতের দিন তার বিপক্ষে সাক্ষী হবে”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৬৫ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৫২)

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আমরা দেখতে পাই, যে ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে লোভ লালসা তার মনের মধ্যে অনেক বেশি বাসা বাঁধে। সে মনে কখনও শান্তি পায় না। সব সময় কৃপণতা করে। তাদের হাত ভর্তি কিন্তু মন খালি। মানুষ তাদের সম্পর্কে বলে, ধনীরা গরিবদের সম্পদের প্রতি বেশি লোভাতুর হয়। কেননা হাদীসের ভাষা অনুযায়ী তারা হল এমন যে, খাবার গ্রহণ করে তবে তাদের পেট ভরে না। আর যে সুদের কারবারের মধ্যে পড়ে যায়, সে তার থেকে তওবা করে না। ফলে সুদ গ্রহণ করা থেকে তার মধ্যে অনুশোচনা আসে না। আর যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, অন্যায় কাজ তার জন্য সুন্দর করে দেখানো হয়। সে নিজে সেটিকে ভালো মনে করে। ফলে কোনো বাহানা বা ষড়যন্ত্র করতে ত্রুটি করে না। আমরা দেখতে পাই তাদেরকে, যারা মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করে মিথ্যার আশ্রয় নেয়, অথবা শুনতে পাই তাদের সম্পর্কে যারা কোনো কাজ করে দিয়ে তার পরিবর্তে ঘুষ নেয় অথবা জমির দালালি করে পয়সা নেয়- তাদের এই হারাম উপায়ে অর্জন করতে অন্তর কাঁপে না। তারা মানুষের ন্যায্য অধিকার দিতে কার্পণ্য করে, শ্রমিকের মজুরি ঠিকমত দেয় না। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর রব বলে ঈমান এনেছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী বলে মেনে নিয়েছে, ইসলামকে দ্বীন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে- তার পক্ষে এমন করা কিভাবে সম্ভব? সে কি করে হারাম খেতে পারে? সে তো জানে যে এর পরিণতি কি হবে আখেরাতে? দুনিয়াতেও এর শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হারাম উপায়ে মাল সম্পদ উপার্জনে কীভাবে রাজি হতে পারে সে? সে তার দীনকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে কীভাবে বিক্রি করে দিতে পারে? এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

    ﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا بِٱلۡأٓخِرَةِۖ فَلَا يُخَفَّفُ عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابُ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٨٦ ﴾ [البقرة: ٨٦] .

    “তারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে খরিদ করেছে। সুতরাং তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না”[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮৬]

    সবশেষে এই দো‘আ করি যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন,

    «اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ».

    “হে আল্লাহ! হারাম থেকে বাঁচিয়ে হালাল আমাদের জন্য যথেষ্ট করে দিন। অনুগ্রহ করে আমাদেরকে আপনি ভিন্ন অন্যের কাছ থেকে মুখাপেক্ষীহীন করে দিন।

    সমাপ্ত