আল্লাহর পথের অভিযাত্রী
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
আল্লাহর পথের অভিযাত্রী
المسافرون إلى الله تعالى
< بنغالي >
ড. লুতফুল্লাহ ইবন মোল্লা আব্দুল আযীম খাজা
د. لطف الله بن ملاّ عبد العظيم خوجه
অনুবাদক: ইকবাল হোছাইন মাসুম
المترجم: إقبال حسين معصوم
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
বায়তুল্লাহর অভিযাত্রী: আল্লাহ পানে সফরকারী
জীবন একটি সফর। আর মানুষ সম্পাদনকারী মুসাফির। গন্তব্য একটিই; পরকাল। তবে আবাস দুটি; চিরস্থায়ী জান্নাত, জাহান্নামের অগ্নি। মানুষ মাত্রই পরকালের যাত্রী। এতে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। এ যাত্রা পথের অভিযাত্রী না হয়ে কারো উপায় নেই। হ্যাঁ, পথ গ্রহণের স্বাধীনতা আছে বৈকি। কেউ জান্নাতের পথ গ্রহণ করে তাতে পৌঁছবার যাবতীয় শর্ত, সহায়ক নীতি ও সফল হবার উপায়-উপকরণ মেনে চলে। আবার কেউ কেউ জাহান্নামের রাস্তা এখতিয়ার করে তাতে পৌঁছানোর সহায়ক সব পথ-পদ্ধতি গ্রহণ করে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡإِنسَٰنُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَىٰ رَبِّكَ كَدۡحٗا فَمُلَٰقِيهِ ٦ فَأَمَّا مَنۡ أُوتِيَ كِتَٰبَهُۥ بِيَمِينِهِۦ ٧ فَسَوۡفَ يُحَاسَبُ حِسَابٗا يَسِيرٗا ٨ وَيَنقَلِبُ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦ مَسۡرُورٗا ٩ وَأَمَّا مَنۡ أُوتِيَ كِتَٰبَهُۥ وَرَآءَ ظَهۡرِهِۦ ١٠ فَسَوۡفَ يَدۡعُواْ ثُبُورٗا ١١ وَيَصۡلَىٰ سَعِيرًا ١٢ إِنَّهُۥ كَانَ فِيٓ أَهۡلِهِۦ مَسۡرُورًا ١٣ إِنَّهُۥ ظَنَّ أَن لَّن يَحُورَ ١٤ بَلَىٰٓۚ إِنَّ رَبَّهُۥ كَانَ بِهِۦ بَصِيرٗا ١٥﴾ [الانشقاق: ٦، ١٥]
“হে মানুষ, তোমার রব পর্যন্ত (পৌঁছতে) অবশ্যই তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ পাবে। অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেওয়া হবে, অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে। সে তার পরিবার-পরিজনের কাছে আনন্দিত হয়ে ফিরে যাবে। আর যাকে তার আমলনামা পিঠের পেছনে দেওয়া হবে, অতঃপর সে ধ্বংস আহ্বান করতে থাকবে। আর জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। নিশ্চয় সে তার পরিবার-পরিজনদের মধ্যে আনন্দে ছিল। নিশ্চয় সে মনে করত যে, সে কখনো ফিরে যাবে না। হ্যাঁ, নিশ্চয় তার রব তার প্রতি সম্যক দৃষ্টি দানকারী।” [সূরা আল-ইনশিকাক, আয়াত: ৬-১৫]
উদাসীনতা ও অমনোযোগিতার ব্যাধি মানব প্রকৃতির সাথে যেন মিশে একাকার হয়ে আছে। প্রতিটি মানুষের মাঝেই এ রোগ বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বিবৃতি হচ্ছে,
﴿ ٱقۡتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمۡ وَهُمۡ فِي غَفۡلَةٖ مُّعۡرِضُونَ ١ مَا يَأۡتِيهِم مِّن ذِكۡرٖ مِّن رَّبِّهِم مُّحۡدَثٍ إِلَّا ٱسۡتَمَعُوهُ وَهُمۡ يَلۡعَبُونَ ٢ لَاهِيَةٗ قُلُوبُهُمۡۗ ٣ ﴾ [الانبياء: ١، ٣]
“মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। যখনই তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের নিকট কোনো নতুন উপদেশ আসে তখন তারা তা কৌতুকভরে শ্রবণ করে। তাদের অন্তর থাকে অমনোযোগী...”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১-৩]
তাইতো মানুষ তাদের চিরন্তন এ সফরকে স্মরণ করে না। চিন্তা করে না তাদের শেষ পরিণতি ও ঠিকানা সম্বন্ধে। মরদেহ প্রত্যক্ষ করে ঠিকই, কিন্তু অন্তর তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে বলে মনে হয় না। অবচেতন অন্তর পরকাল বিষয়ে চৈতন্য ফিরে পেয়েছে বলে অনুভূত হয় না।
মহান আল্লাহ নিজ বান্দাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু। তাই তিনি সে সফর সম্বন্ধে তাদেরকে বার বার সজাগ করে দেন নানাভাবে। স্মরণ করিয়ে দেন শাশ্বত সে আবাসনের কথা। উদ্দেশ্য, তারা তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহর নীতি-বিধান মেনে চলবে...।
সে লক্ষ্যে তিনি স্থাপন করেছেন নানা স্মারক ও নিদর্শন, যা তাদের উদাসীনতা ও বিঃস্মৃতিকে দূরে ঠেলে, পাথেয় গ্রহণে উজ্জিবিত করবে প্রতিনিয়ত। স্মরণ করবে তারা চিরন্তন সে যাত্রাকে। যা চলছে আর চলছে। লাগাতার-বিরামহীনভাবে চলছে। বছরের পর বছর গণনা করছে আর একটি একটি করে বিয়োগ করছে। এ চলা কখনো ক্ষান্ত হবে না, হবে না পরিশ্রান্ত। সেসব নিদর্শনের একটি হলো হজ।
হজের রয়েছে নির্ধারিত কিছু রোকন, কতিপয় ওয়াজিব ও অনেকগুলো সুন্নত। ইহরাম, উকূফে ‘আরাফা, তাওয়াফে যিয়ারত হচ্ছে রুকন। জমহুর ফিকহবিদ আবশ্য হজের সা‘ঈকেও রুকনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
উল্লিখিত রুকনগুলো পুরো বা আংশিক অনাদায়ি থাকলে হজ সহীহ হবে না।
-ইহরাম ছাড়া হজের কার্যক্রম শুরু করা সার্বিক বিচারেই অগ্রহণযোগ্য।
-‘আরাফায় অবস্থান ব্যতীত হজের সাথে সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যাবে না কোনোভাবেই। এমতাবস্থায় হাদি জবাই ও ওমরাহ সম্পাদন করে হালাল হয়ে যেতে হবে এবং পরবর্তী বছর পুণরায় হজ করতে হবে।
-তাওয়াফে যিয়ারত ব্যতীত হজ সম্পূর্ণ হবে না এবং এ কারণে (দ্বিতীয় তাহাললুল বা) চূড়ান্ত পর্যায়ের হালাল হওয়া ঝুলে থাকবে। তাওয়াফ সমাপন অবধি স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ হবে না।
-জমহুর আলেমদের মতে সা‘ঈ সম্পাদন করা ব্যতীত হজ অসম্পূর্ণ থাকবে। যতক্ষণ তা অনাদায়ি থাকবে, হজও তার জিম্মায় বাকি থেকে যাবে।
হজের সফর একটি ক্ষুদ্র সফর; পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আখেরাত পানে বড় সফরের দৃষ্টান্ত বিশেষ। তবে এটি জান্নাতের পথ ধারণকারী মু’মিনের সফর, জাহান্নাম অভিমুখে অগ্রসরমানের সফর নয়।
হজের এ সফর সম্পন্ন হতে হলে যেমনি করে উপরিউক্ত রুকনের বাস্তবায়ন জরুরি। একইভাবে (জান্নাতে প্রবেশের) মহান আল্লাহ পানে বড় সফরটিও অনুরূপ চারটি রুকন বাস্তবায়ন ব্যতীত সম্পন্ন হবে না।
জান্নাত অভিমুখে সফরের রুকনসমূহ:
এক. ইসলামের ওপর মারা যাওয়া:
মৃত্যু ছাড়া দুনিয়া থেকে আখিরাত জগতে যাবার আর কোনো উপায় নেই। জান্নাতে প্রবেশের প্রথম ধাপই হচ্ছে মৃত্যু।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۗ وَإِنَّمَا تُوَفَّوۡنَ أُجُورَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۖ فَمَن زُحۡزِحَ عَنِ ٱلنَّارِ وَأُدۡخِلَ ٱلۡجَنَّةَ فَقَدۡ فَازَۗ وَمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلۡغُرُورِ ١٨٥ ﴾ [ال عمران: ١٨٥]
“প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর অবশ্যই কিয়ামতের দিনে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে। আর দুনিয়ার জীবন কেবল ধোঁকার সামগ্রী।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫]
হজের ইহরামের সাথে ইসলামের উপর মৃত্যুর অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন,
· উভয়টিতেই মানুষ আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি দেয়। মুখে উচ্চারণ করে ঘোষণা প্রদান করে আল্লাহর লা শরিকত্বের। ইহরামকারী লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক... বলে তালবিয়া পাঠ করে। আর মৃত্যু পথযাত্রী মুসলিমকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর তালকীন করা হয়।
· উভয় ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পোষাক খুলে, সেলাই বিহীন চাদর সদৃশ সাদা কাপড় পরিধান করতে হয়। মরদেহকে পরানো হয় কাফন। আর ইহরামকারী ইহরামের জন্য নির্দিষ্ট দু’টুকরো কাপড়।
· উভয়টিতে রয়েছে পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহারের বিধান।
· উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিমিত্তে সালাত আদায় করা হয়। পার্থক্য শুধু ইহরামের ক্ষেত্রে ইহরামকারী নিজে আদায় করে আর মৃত্যুর ক্ষেত্রে আদায় করে তার পরিজন ও মুমিন ভ্রাতৃবৃন্দ।
ইহরাম হজকারীকে তার শেষ ঠিকানা ও জীবনের পরিসমাপ্তি বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয়, কয়েক টুকরো কাফন ব্যতীত একেবারে শূন্য হয়ে কিভাবে বের হতে হবে তাকে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে। নিজ অভ্যাস পরিপন্থী পরিচ্ছদে কিভাবে দেখা করবে সে মহান আল্লাহর ঘরের সাথে। অনুরূপভাবে দেখা করতে হবে তাকে আল্লাহর সাথে নিজ আদত পরিবর্তিত বেশ-ভূষায়।
ইহরাম অবস্থায় একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে হয় একজন হাজি সাহেবকে। এটি তাকে কিয়ামতের ময়দানের সেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয়, তোমাকে অবশ্যই সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই সে দিনের ভয়াবহতা হতে রক্ষা পাবার জন্য তোমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে নানা উপায়ে। যেমন প্রস্তুতি নিয়েছ তুমি হজের দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি দূর করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ, নানাভাবে।
দুই. তাওবা ও ইস্তিগফার:
তাওবা ইস্তিগফার ব্যতীত কোনো ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে না। কারণ পাপ-পঙ্কিলতা প্রতিটি মানুষকে চারিদিক থেকে পরিবেষ্টন করার অপেক্ষায় থাকে। পাপ থেকে নিরাপদ নয় কেউই। পাপ নেই এমন মানুষও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং মানুষ যদি তাওবা ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজ পাপ (জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে) নিঃশেষ করতে না পারে, তাহলে পাপ তাকে চারিদিক থেকে বেষ্টন করে নিবে। আর বাধ্য হয়েই তাকে জাহান্নামে যেতে হবে, এ যাওয়া কেউ রোধ করতে পারবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿بَلَىٰۚ مَن كَسَبَ سَيِّئَةٗ وَأَحَٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيَٓٔتُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨١ ﴾ [البقرة: ٨١]
“হ্যাঁ, যে মন্দ উপার্জন করবে এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে নেবে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে হবে স্থায়ী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮১]
কিন্তু তাওবা-ইস্তিগফার পাপের বন্ধন খুলে দেয়, ভেঙ্গে ফেলে তার বেষ্টনি-বেড়ি। যাতে করে মুমিন তার রবের সন্তুষ্টি পানে পৌঁছতে পারে। তাঁর রেযামন্দি অর্জনে যেন আর কোনো বাধা না থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَٰحِشَةً أَوۡ ظَلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ ذَكَرُواْ ٱللَّهَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ لِذُنُوبِهِمۡ وَمَن يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ إِلَّا ٱللَّهُ وَلَمۡ يُصِرُّواْ عَلَىٰ مَا فَعَلُواْ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٣٥ أُوْلَٰٓئِكَ جَزَآؤُهُم مَّغۡفِرَةٞ مِّن رَّبِّهِمۡ وَجَنَّٰتٞ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ وَنِعۡمَ أَجۡرُ ٱلۡعَٰمِلِينَ ١٣٦﴾ [ال عمران: ١٣٥، ١٣٦]
“আর যারা কোনো অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না। এরাই তারা, যাদের প্রতিদান তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর আমলকারীদের প্রতিদান কতই না উত্তম!” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৫-১৩৬]
তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে হজে ‘আরাফার ময়দানে অবস্থান।
-‘আরাফার ময়দানে অবস্থান মূলত: মহান মাওলার দরবারে ক্ষমা, মার্জনা ও মাফি প্রার্থনার অবস্থান। লোকেরা পূর্ণ দিন ও রাতের কিয়দাংশ এ দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান করে মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমার জন্য ফরিয়াদ করে। তাঁর নি‘আমত ও করুণা প্রার্থনা করে। অতীত জীবনে হয়ে যাওয়া অন্যায় অপরাধের কারণে যেন শাস্তি না দেওয়া হয় সে আরজি পেশ করে কান্না ভরা কণ্ঠে মহান মা‘বূদকে ডাকাডাকিতে ব্যস্ত থাকে। আর আল্লাহ তাদের সে সব ডাকে সাড়া প্রদান করে থাকেন, ক্ষমার ঘোষণা দেন অতীতে কৃত যাবতীয় অন্যায়ের। গর্বভরে ফিরিশতাদের বলে থাকেন,
“চেয়ে দেখ আমার বান্দাদের দিকে, আলু-থালু কেশে ধূলোয় ধূসরিত হয়ে তারা আমার নিকট এসেছে, সাক্ষী থেকো, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম।”
-আরাফাতে অবস্থানই হচ্ছে হজ, মর্মে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ আরাফাতে অবস্থান করা হজের প্রধান রুকন। এটি যার ছুটে যাবে তার হজ হবে না। আর তাওবা ইস্তিগফারের অবিদ্যমানতায় আল্লাহর প্রতিদান ও সন্তুষ্টি ছুটে যায় এবং তাঁর ক্রোধ ও শাস্তি আরোপিত হয়। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ يَسۡتَغۡفِرۡ لَكُمۡ رَسُولُ ٱللَّهِ لَوَّوۡاْ رُءُوسَهُمۡ وَرَأَيۡتَهُمۡ يَصُدُّونَ وَهُم مُّسۡتَكۡبِرُونَ ٥ ﴾ [المنافقون: ٥]
“আর তাদেরকে যখন বলা হয় এসো, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে।” [সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ৫]
ধ্বংসপ্রাপ্ত সেসব মুনাফিকদের ধ্বংসের একমাত্র কারণ অহঙ্কারবশত তাওবা-ইস্তিগফার থেকে বিমুখ হওয়া।
﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ إِذ ظَّلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ جَآءُوكَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ ٱللَّهَ وَٱسۡتَغۡفَرَ لَهُمُ ٱلرَّسُولُ لَوَجَدُواْ ٱللَّهَ تَوَّابٗا رَّحِيمٗا﴾ [النساء: ٦٤]
“আর যদি তারা- যখন নিজদের প্রতি যুলুম করেছিল তখন তোমার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইত তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবা কবুলকারী, দয়ালু পেত।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৪]
﴿وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمۡ وَأَنتَ فِيهِمۡۚ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ مُعَذِّبَهُمۡ وَهُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ٣٣﴾ [الانفال: ٣٣]
“আর আল্লাহ এমন নন যে, তাদেরকে ‘আযাব দিবেন এ অবস্থায় যে, তুমি তাদের মাঝে বিদ্যমান এবং আল্লাহ তাদেরকে আযাবদানকারী নন এমতাবস্থায় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করছে।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৩]
নিয়মিত ইস্তিগফারকারীদেরকে ‘আযাব না দেওয়ার কারণ হচ্ছে তাদের ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা।
আব্দুল্লাহ ইবন জাদ‘আনকে শাস্তি প্রদান ও জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হিসাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেছেন, সে শত বছরের মাঝে একটি বারের জন্যও বলে নি, হে আল্লাহ প্রতিদান দিবসে তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও।
মোটকথা: ‘আরাফার অবস্থান সার্বক্ষণিক তাওবা-ইস্তিগফারকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয় রহমত ও সন্তুষ্টির দার উন্মোচন এবং বে-ইজ্জতি ও ক্রোধ উঠিয়ে নেয়া অবদি দরজায় বসে থাকার আবশ্যিকতাকে।
যারা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কড়া নাড়া নাড়ি করে, দরজা মূলতঃ তাদের তরেই খোলা হয়। কল্যাণ সেই পায় যে ধৈর্য্য ধারণ করে...।
ক্ষমা, মার্জনা, মাফি চেয়ে হাজি সাহেব দিবা-রাত্রির দীর্ঘ সময় কষ্ট ও অপেক্ষার ধৈর্য্য ধারণ করেন, অনুরূপভাবে ধৈর্য্য ধারণ করে থাকে আল্লাহর নৈকট্য ও করুণা প্রার্থী আখিরাতের মুসাফির।
তিন. অন্তর আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করা ও সার্বক্ষণিক তাঁর যিকিরে নিবিষ্ট থাকা:
তাঁর স্মরণ ও যিকিরে যার অন্তর সদা মশগুল। অনুরাগ, ভক্তি, ভালোবাসায় তাঁর প্রতি যে অনুরক্ত। শতভাগ উজাড় করে যে ব্যক্তি নিজ হৃদয়কে করেছে তাঁর প্রতি নিবিষ্ট, সেই মূলতঃ তাঁর নৈকট্য পেয়ে হয়েছে ধন্য। সুতরাং ঈমানের শর্ত হচ্ছে অন্তর আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট করা অর্থাৎ মন-প্রাণ উজাড় করে তাঁকে ভালোবাসা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗا لِّلَّهِۗ وَلَوۡ يَرَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓاْ إِذۡ يَرَوۡنَ ٱلۡعَذَابَ أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا وَأَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعَذَابِ ١٦٥﴾ [البقرة: ١٦٥]
“আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মত ভালোবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় দৃঢ়তর। আর যদি যালিমগণ দেখে- যখন তারা ‘আযাব দেখবে যে, নিশ্চয় সকল শক্তি আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আল্লাহ ‘আযাব দানে কঠোর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৫]
মুমিনরাই হচ্ছেন যিকিরকারী দল, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ قِيَٰمٗا وَقُعُودٗا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمۡ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ رَبَّنَا مَا خَلَقۡتَ هَٰذَا بَٰطِلٗا سُبۡحَٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٩١﴾ [ال عمران: ١٩١]
“যারা আল্লাহকে স্মরণ করে (তাঁর যিকির করে) দাঁড়িয়ে, বসে ও কাত হয়ে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে। (বলে) হে আমাদের রব, তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি কর নি। তুমি পবিত্র মহান। সুতরাং তুমি আমাদেরকে আগুনের ‘আযাব থেকে রক্ষা কর।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯১]
তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ:
-তাওয়াফ পাক খাওয়া ও ঘূর্ণন-এর নাম। ভালোবাসা ও সান্নিধ্য প্রত্যাশী, অনুরাগী- প্রেমিকদের অবস্থাও তাই। প্রেমাষ্পদের চতুরপার্শ্বে ঘুরপাক খায়। প্রদক্ষিণ করে তার বাসস্থান, স্মৃতিচিহ্ন ইত্যাদি বার বার, নিরলস, বিরামহীন। প্রহরের প্রহর অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয়। ক্লান্তি কভু পরাজিত করতে পারে না এদের, পরিশ্রান্তও হয় না তারা কখনো। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ফিরে যায় না প্রেমাষ্পদের সান্নিধ্য থেকে। প্রেমাষ্পদের সন্তুষ্টি, ভালবাসা, তার সাথে কথা বলা, তার দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে নিজেকে ধন্য ও গৌরবান্বিত করা অবধি সে চেষ্টা অব্যাহত থাকে অনাবরত...।
-তাওয়াফ অবস্থায় সম্পাদনকারীর হৃদয়-মন জুড়ে থাকে যার জন্য তাওয়াফ করা হচ্ছে তার নাম। অন্তর কেবল তাকেই স্মরণ করে। মেজাজ-মস্তিষ্ক থাকে শুধু তার চিন্তায়ই বিভোর। মানসপটে ভেসে ওঠে বার বার তার প্রতিচ্ছবি। মহান আল্লাহ তা‘আলাকে যারা অধিক হারে স্মরণ করে, তাঁর প্রেমে যারা আত্মহারা তাদের অবস্থাও তা-ই।
সুতরাং তাওয়াফ এমনই এক ইবাদত যা দীনের মূল ও মগজ আল্লাহর প্রেম ও যিকিরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। নির্ভেজাল প্রেম, নিখাদ অনুরাগ ও বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে তাওয়াফকারী তাওয়াফ সম্পাদন করে। আর শিক্ষা গ্রহণ করে যে পার্থিব জীবনে প্রকৃত মুমিনের অবস্থা এমনটিই। কোনো কিছুকেই সে মহান মাওলার উপর প্রাধান্য দেয় না। না ভক্তি-ভালবাসায়, না অনুরাগ-স্মরণে। এটিই তালবিয়ার মূলকথা,
لبيك اللهم لبيك لبيك لا شريك لك لبيك.......
“আমি হাযির হে মা‘বূদ আমি হাযির, আমি হাযির তোমার কোনো শরীক-সমকক্ষ নেই, আমি হাযির...।”
যা উচ্চারিত হয় প্রতিটি হাযির মুখে ইহরামের সময়, তারবিয়ার দিন, ‘আরাফা ও মুযদালিফায়, এমনকি ঈদের দিন জামরায়ে ‘আকাবার প্রাককালে। এ কথা বলে হাজী সাহেব নিজ উপস্থিতি ঘোষণা করে, ভালোবাসা ব্যক্ত করছেন মহান প্রেমাষ্পদ সকাশে; হে প্রেমময় মাওলা, তোমার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ধন্য হতে আমি তোমার দরবারে এসে উপস্থিত হয়েছি সব কিছুকে পেছনে ফেলে। মন-প্রাণ-দেহ সব নিয়েই উপস্থিত হয়েছি আমি। প্রতিজ্ঞা করছি তোমার অনুগত হয়ে চলার। তোমার সন্তুষ্টি ও ভারবাসায় সব কিছু উৎসর্গ করার...।
চার. ইখলাস ও নিরবচ্ছিন্ন আনুগত্য
নিষ্ঠাবান, আন্তরিক ও নিরবচ্ছিন্নভাবে, সঠিক পন্থায় ইবাদত সম্পাদনকারীরাই কেবল জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ﴾ [الكهف: ١١٠]
“সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।” [সূরা কাহফ, আয়াত: ১১০]
আমল প্রসঙ্গে বলছেন,
﴿ٱدۡخُلُواْ ٱلۡجَنَّةَ بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ﴾ [النحل: ٣٢]
“জান্নাতে প্রবেশ কর, যে আমল তোমরা করতে তার বিনিময়ে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩২]
আর ইস্তিকামাত প্রসঙ্গে বলছেন,
﴿وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٥٣﴾ [الانعام: ١٥٣]
“আর এটিতো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৫৩]
আর এর উদাহরণই হচ্ছে সাফা মারওয়ার সা‘ঈ।
-সা‘ঈ বলা হয়, বারংবার যাওয়া-আসাকে। নিষ্ঠাবান-আন্তরিক-মুখলিস ব্যক্তি কবুলের আশায় প্রাণান্তকর শ্রম ব্যয় করে, যদি প্রথম বারে না হয় তাহলে দ্বিতীয় বার, না হয় তৃতীয় বার...
-সঠিক পন্থায় নিরবচ্ছিন্ন সা‘ঈ, দুনিয়াতে জান্নাতের রাস্তাও এমনই; সিরাতে মুস্তাকীম- তথা বক্রতা বিহীন সঠিক-সরল রাস্তা।
-সা‘ঈতে রয়েছে দীর্ঘতা, উর্দ্ধারোহন, অধগমন...। অনুরূপ জান্নাতের রাস্তাও দীর্ঘ এবং কষ্ট সঙ্কুল। আল্লাহর সামগ্রী মহা মূল্যবান।
-হজের সা‘ঈতে নিদর্শনদ্বয়ের মাঝে শ্রম ব্যয় করতে হয় নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করে। তেমনি করে জান্নাতের রাস্তায়ও চলতে গেলে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। কষ্ট-শ্রম ব্যয় করে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, চেষ্টা ও শ্রম ব্যয়ের মাধ্যমে সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। ধারণা লাভ হয় ঐ রাস্তার গুণাগুণ, ইখলাস, ইস্তিকামাত ও তালবিয়ার সারকথা -হে আল্লাহ আমি তোমার নিরবচ্ছিন্ন আনুগত্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সার্বক্ষণিক তাতেই থাকব নিমজ্জিত- সম্বন্ধে। এবং সে রাস্তার পরিচয় ও নির্ধারিত যে কার্যাদি রয়েছে সে সম্পর্কেও অবহিত হওয়া যায় নির্ভুলভাবে।
অতএব, বর্ণিত রুকন চতুষ্টয়ের অনুপুঙ্খ বাস্তবায়ন ভিন্ন হজের সফরকে যেমন সাওয়াব, মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর ন্যায় পাপমুক্তি ও কবুলিয়াতের বন্দরে নোঙ্গর করানো যায় না। অনুরূপভাবে উল্লিখিত চার কাজের বাস্তবায়ন ভিন্ন দুনিয়ার সফরকেও জান্নাতের বন্দরে নোঙ্গর করানো যাবে না।
বাকি থাকল ওয়াজিবসমূহের সম্পাদন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জন প্রসঙ্গ। ওযরের কারণে কোনো ওয়াজিব বাদ পড়ে গেলে ফিদিয়া প্রদান আবশ্যিক করে বিষয়টিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ভুল করে বা অজ্ঞতা বশতঃ কিংবা বাধ্য হয়ে কোনো নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদনের বিষয়টিকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে আর ইচ্ছাকৃতভাবে করলে ফিদিয়া বা কাফফারা আবশ্যক করে ছাড় দেওয়া হয়েছে। উভয় প্রকার সফরেও বিষয়টি একই রকম।
সুতরাং পার্থিব জীবন ছেড়ে জান্নাত পানে সফরের সাথে হজের সফরের বড়ই চমৎকার মিল রয়েছে। সঠিক বুঝ ও উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য সুযোগটি খুবই ফলপ্রদ। গভীর মনোযোগ সহকারে উপলব্ধি ও চিন্তা-গবেষণার জন্যই মহা গ্রন্থ পবিত্র কুরআনকে নাযিল করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩﴾ [ص: ٢٩]
“আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে।” [সূরা সাদ, আয়াত: ২৯]
﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ ٢٤﴾ [محمد: ٢٤]
“তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ২৪]
সবচেয়ে বড় মূলনীতি:
দুই সফরের মাঝে সবচেয়ে বড় মূলনীতি হচ্ছে, মহান আল্লাহর তাওহিদ ও একত্ববাদ। এ একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যই অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। অবতীর্ণ হয়েছে অগণিত কিতাব। মহান আল্লাহর সৃষ্টিকুল সৃষ্টির উদ্দেশ্য এটিই। এর মাধ্যমেই তিনি মানুষের মাঝে মর্যাদাগত তারতম্য নির্ধারণ করেছেন। তাদের জীবন, সম্মান ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেছেন। প্রবেশ করিয়েছেন তাদেরকে চিরন্তন জান্নাতে ।
তাওহীদের সারকথা হচ্ছে, ইবাদতের হকদার হিসাবে এককভাবে আল্লাহ তা‘আলাকেই নির্ধারণ করতে হবে। সাথে সাথে শির্ক ও তার যাবতীয় রাস্তা পরিহার করতে হবে।
দুনিয়ার জীবনে মানবজাতিকে এই নির্দেশই দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিদান অর্জন করতে পারে এবং নিজেদের বাঁচাতে পারে তাঁর কঠিন শাস্তি থেকে। প্রতিটি মানুষকে এ বিধান মান্য করতে হবে, বালেগ হওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣﴾ [الانعام: ١٦٢، ١٦٣]
“বল, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির রব। তাঁর কোনো শরীক নেই এবং আমাকে এরই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬২-১৬৩]
হজ আলোচিত মূলনীতিকে তার যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আরো পাকাপোক্ত ও শানিত করে। মানবান্তরের একেবারে গহীনে প্রোথিত করে দেয় দৃঢ়ভাবে। আর নিম্নোক্ত আমলগুলোর মাধ্যমে তাদেরকে উক্ত মূলনীতির ওপর গড়ে উঠতে সাহায্য করে:
এক. তালবিয়া
জাহেলি যুগে মুশরিকরাও হজ করত। তারা তাদের তালবিয়ায় বলত,
لبيك لا شريك لك ، إلا شريكا هو لك ، تملكه وما ملك.
“আমি উপস্থিত, তোমার কোনো শরিক নেই, তবে এমন শরিক যা তোমরই জন্য, যার মালিক তুমি, আর সে মালিক নয়।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে শির্কপূর্ণ এ তালবিয়া বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং নিম্নোক্ত তালবিয়া পাঠের আদেশ জারি করলেন,
لبيك اللهم لبيك ، لبيك لا شريك لك لبيك ، إن الحمد والنعمة لك والملك ، لا شريك لك .
“আমি হাযির হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাযির তোমার কোনো শরীক নেই আমি হাযির, নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা ও নি‘আমত তোমার এবং রাজত্বও, তোমার কোনো শরীক নেই।”
এ হচ্ছে তাওহিদের নিদর্শন, তাওহিদের কালেমা। প্রতিটি হজকারীকে ইহরাম থেকে শুরু করে হজ সমাপন পর্যন্ত আওয়াজ করে এ ঘোষণা উচ্চারণ করতে হয়।
দুই. নিয়ত ও সংকল্প
হজ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে সম্পাদন করা হয়। অমুক কিংবা অমুকের জন্য নয়। না কোনো নবীর উদ্দেশ্যে, না কোনো ওলীর। হাজি সাহেব আপন পরিজন ও ঘর-বাড়ী ছেড়ে বের হন কেবল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি কামনায়। তিনি ব্যতীত নবী পর্যন্ত তার নিয়তে অন্তর্ভুক্ত থাকেন না। এমনকি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদের যিয়ারতও, না হজের শর্ত না আবশ্যিক কোনো কর্ম।
তবে মসজিদে নববীর যিয়ারত হজের সাথে সম্পৃক্ত না হলেও স্বতন্ত্রভাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব আমল।
তিন. হজের কার্যাদি
হজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় আমল কেবল আল্লাহর জন্য সম্পাদিত হয়। কোনো আমলেই তিনি ব্যতীত আর কারো অংশ নেই। ইহরাম, মিনায় রাত্রি যাপন, ‘আরাফায় অবস্থান, মুযদালিফায় রাত্রি যাপন এরপর তাওয়াফ-সা‘ঈ-পাথর নিক্ষেপ সব আমল কেবল আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।
চার. দো‘আ
হজ সম্পাদন কালে পাঠ করার জন্য শরিয়ত অনুমোদিত সকল দো‘আতেই আল্লাহর তাওহীদ ও শির্ক বর্জনের ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছে বার বার। যেমন সাফা-মারওয়ার দো‘আ, আরাফার সবোর্ত্তম দো‘আ ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَإِذَا قَضَيۡتُم مَّنَٰسِكَكُمۡ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَذِكۡرِكُمۡ ءَابَآءَكُمۡ أَوۡ أَشَدَّ ذِكۡرٗاۗ فَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖ ٢٠٠ ﴾ [البقرة: ٢٠٠]
“তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০০]
আল্লামা কুরতুবী রহ. বলেন,
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আতা, দাহহাক, রবি‘ প্রমুখ তাফসীরবিদগণ এ আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, শিশুরা নিজ মাতা-পিতাকে যেভাবে মা...মা... বাবা...বাবা... বলে ডাকাডাকি করে তোমরাও অনুরূপ আল্লাহকে ডাকো, তার নিকট ফরিয়াদ কর, সাহায্য চাও, এবং তার আশ্রয় গ্রহণ কর। যেমনটি তোমরা শিশুকালে তোমাদের পিতার সাথে করতে।
অন্য একদল আলেম বলেছেন,
আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর যিকির কর, তাঁকে ডাক, তাঁর বড়ত্ব বর্ণনা কর, তাঁর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা কর, কেউ তাঁর দীনের মাঝে শিরক প্রবর্তণে উদ্যোগী হলে তাকে প্রতিহত কর। যেমনটি তোমরা নিজ পিতা-মাতাকে ভালো ও কল্যাণের সাথে স্মরণ করে থাক। তাদের মর্যাদা রক্ষা করে চল।
পাঁচ. মাখলুকের কোনো অংশ নেই
হজে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো মাখলুক হতে তাবাররুক তথা বরকত নেওয়ার কোনো বিধান নেই। না কোনো যিয়ারতের স্থান হতে, না কবর, গম্বুজ কিংবা কোনো ব্যক্তি থেকে। অনুরূপভাবে হজে আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট দো‘আ করারও অনুমতি নেই, অনুমোদন নেই গাইরুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনার কিংবা ওসিলা দেওয়ার। মাখলুকের জন্য কেবল দো‘আ ও সহযোগিতার মাধ্যমে অনুগ্রহ করারই সুযোগ আছে। যেমন হজে অনুমোদন করা হয়েছে, মৃত ও অক্ষম ব্যক্তিবর্গের পক্ষে জীবিতদের হজ করা, দুর্বল ও মুহতাজদের সাহায্য করা।
সুতরাং হজে মাখলুকের অংশ কেবল এতটুকুই যে অক্ষম-আপারগতার অবস্থায় তার প্রতি ইহসান-অনুগ্রহ করা যাবে। তাদের মাধ্যমে বরকত অর্জন বা তাদের দারস্থ হবার প্রতি উৎসাহ প্রদান বুঝায় এমন ন্যূনতম কিছুও পাওয়া যায় না। জাহেলি যুগে মুশরিকরা হজে নিজ বাপ-দাদাদের নিয়ে গর্ব করত, তাদেরকে স্মরণ ও ডাকাডাকি করত। তাই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের নির্দেশ দিলেন,
﴿فَإِذَا قَضَيۡتُم مَّنَٰسِكَكُمۡ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَذِكۡرِكُمۡ ءَابَآءَكُمۡ أَوۡ أَشَدَّ ذِكۡرٗاۗ فَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖ ٢٠٠﴾ [البقرة: ٢٠٠]
“তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০০]
আয়াতে তিনি তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, মহান আল্লাহকে নিজ বাপ-দাদাদের চেয়েও অধিক স্মরণ করার জন্য। যাতে তারা বুঝতে পারে, এ জায়গাটি কেবল আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশের জন্যই নির্ধারিত। অন্যের কোনো আলোচনা বা যিকির এখানে চলবে না।
সুতরাং হজে একজন ব্যক্তি তাওহিদের শিক্ষা গ্রহণ করে নিখুত ও পরিশুদ্ধভাবে। তাওহীদের শিক্ষা নিয়েই সে প্রত্যাবর্তন করে, যাতে তার বাকি জীবনও হজের দিনগুলোর মতো এ শিক্ষার আলোকেই অতিবাহিত হয়।
হজ জিহ্বা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অন্তরের সমন্বিত আমলের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। মানুষ সাধারনত জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই আমি অন্তরের আমল সম্বন্ধে একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছি, যাতে ইবাদতটি পূর্ণাঙ্গরূপে সম্পাদিত হয় আর সম্পাদনকারী লাভ করতে পারে প্রতিশ্রুত প্রতিদান পরিপূর্ণরূপে।
সমাপ্ত