একজন সফল শিক্ষকের গুণাবলি
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
একজন সফল শিক্ষকের গুণাবলি
صفات المعلم الناجح
< বাংলা - بنغالي - Bengali >
মুহাম্মাদ শামসুল হক সিদ্দিক
محمد شمس الحق الصديق
সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
مراجعة: د/ محمد منظور إلهي
একজন সফল শিক্ষকের গুণাবলি
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আপনি যদি বলেন যে আমি ফিকহ শাস্ত্র অধিক পছন্দ করতাম, অথবা আরবি গ্রামার খুবই গুরুত্ব দিয়ে পড়তাম, তার অর্থ ফিকহ এবং আরবি গ্রামারের উস্তাদ শিক্ষকতার ক্ষেত্রে সফলতার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আচরণে এবং বিষয়বস্তুর উপস্থাপনায় তৃপ্তিকর এবং লোভনীয় পদ্ধতি অবলম্বন করতে তারা পারঙ্গম ছিলেন।
সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়কে ভালো লাগা ছাত্রের নিজস্ব ঝোঁক, মনোগতির অনুগামী, এ কথা অনস্বীকার্য। তবে শিক্ষকই তার ছাত্রকে কোনো বিষয় পছন্দ করতে প্রভাবিত করে থাকেন। কোনো বিষয়ের প্রতি তার আবেগ-আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলেন, অনুভূতিকে শাণিত করেন। যিনি একাজটি করতে পারেন তাকেই সাধারণত সফল শিক্ষকের খেতাবে ভূষিত করা হয়।
তালিমের পাশাপাশি তরবিয়ত - ছাত্রের চরিত্র গঠন- এর ক্ষেত্রেও একজন শিক্ষককে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়, তবে এ বিষয়টির আলোচনায় পরে আসছি। তালিমের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক কীভাবে সফলতার সাক্ষর রাখবেন এ বিষয়টি নিয়েই বরং আলোচনা শুরু করা যাক।
শিক্ষাবিদ জিন হল (Jean Hall) এ ক্ষেত্রে একটি চমৎকার পদ্ধতির কথা বলেছেন। অবশ্য এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হলে ফিরে যেতে হবে অতীতে, মন্থন করতে হবে ছাত্রত্বের নানা পর্ব। অতীতের আর্কাইভ ঘেঁটে বের করে আনতে হবে বেশ কয়টি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর-
· আপনি কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছেন?
· আপনি যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন সেগুলোর একটি অন্যটি থেকে স্বতন্ত্র কোন কোন বিষয়ে?
· শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার কাছে কি তৃপ্তিকর ছিল, না অপ্রীতিকর?
· আপনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতে যাচ্ছেন তার সাথে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে এসেছেন সেসবের কোন্ কোন্ বিষয়ে মিল রয়েছে?
· ছাত্র অবস্থায় যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাল লেগেছে তা কেন ভাল লেগেছে, এবং যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাল লাগেনি তা কেন ভাল লাগেনি তা নির্ণয় করুন।
· ছাত্রজীবনে পঠিত বিষয়সমূহের কী কী বিষয় সহজে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে এখনো মনে করতে পারেন সেগুলো একবার মন্থন করুন।
· ছাত্রজীবনের কী কী বিষয় স্মরণ করতে বিরক্তি লাগে, সেগুলোও লিপিবদ্ধ করুন।
· উস্তাদদের মধ্যে কাকে বা কোন্ কোন্ উস্তাদকে ভালবাসতেন, অধিক সম্মান করতেন, বস্তুনিষ্ঠভাবে নিরীক্ষা করে তাদেরকে স্মৃতির পাতায় হাজির করুন।
· কাদের কাছ থেকে বেশি শিখেছেন তাদেরকে সূচীবদ্ধ করুন।
· তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলো লিপিবদ্ধ করুন।
· তারা কি সফল শিক্ষক ছিলেন বলে আপনার মনে হয়?
· অন্য পক্ষে যেসব শিক্ষককে আপনার সব থেকে বেশি খারাপ লেগেছে তাদের কথাও স্মরণ করুন।
· আপনার বিবেচনায় তারা কেন খারাপ ছিলেন তা নির্ণয় করার চেষ্টা করুন।
· যেসব শিক্ষক আপনার বিবেচনায় খারাপ ছিলেন তাদের অভ্যাসগুলো স্মৃতির পাতায় হাজির করুন। তাদের পাঠদানের কিছু পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করুন। শিক্ষকতার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণগুলো খুঁজে পেতে সক্ষম হবেন। আপনার শিক্ষকদের ভালো ও মন্দ অভ্যাস ও পদ্ধতিগুলোর সূচীপত্র তৈরি করে আপনার অভ্যাস ও পদ্ধতির সাথে সময় সময় তুলনা করুন। একটি ডাইরিতে তা সংরক্ষণ করুন। শিক্ষকতার ক্ষেত্রে সফলতা অথবা ব্যর্থতার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ আপনার জানা হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
একজন সফল শিক্ষককে কি-কি গুণের অধিকারি হতে হয় এ বিষয়ে গবেষণা হয়েছে প্রচুর। লেখা হয়েছে বহু গ্রন্থ। এসব গবেষণার মধ্যে ছাত্রদের মতামতনির্ভর কিছু গবেষণা রয়েছে যা বর্তমানযুগের শিক্ষাবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে অধিক। গবেষক Hargreaves (১৯৭২), Dockin (১৯৮০) এবং নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেকাল্টি অফ এডুকেশন এ প্রকৃতির গবেষণার সফল উপস্থাপক বলে বিবেচিত। এসব গবেষণার আলোকে একজন সফল শিক্ষকের গুণাবলি নিম্নরূপ:
প্রথমতঃ ব্যক্তিগত গুণাবলি -
১. ভালো আদর্শ- আমাদের পরিভাষায় কুদওয়ায়ে হাসানা- বেশভূষায় পরিচ্ছন্ন ও উত্তম আচরণের অধিকারী হওয়া।
২. ছাত্রদের সাথে আচার-আচরণে উন্নত চরিত্রের অনুবর্তিতা।
৩. প্রসন্ন ও স্ফূর্তিময় হৃদয়ের অধিকারী হওয়া।
৪. ছাত্রদের কথা শোনায় মনোযোগ প্রয়োগ ও তাদের মতামত গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখা।
দ্বিতীয়তঃ নিয়মানুবর্তিতা-
১. নিয়ম-শৃঙ্খলা যথার্থরূপে পালন করে চলা।
২. অতিরঞ্জন ও আড়ম্বরবর্জিত কঠোরতা।
৩. অসদাচরণ বা নিয়ম ভঙ্গের কারণে রোষান্বিত না হওয়া।
৪. ছাত্রদের মাঝে ইনসাফ বজায় রাখা।
তৃতীয়তঃ সঠিক শিক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন-
১. পাঠ প্রস্তুতি এবং অধ্যয়নের মাধ্যমে যথার্থরূপে নিজেকে তৈরি করা।
২. যে বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া এবং ছাত্রদেরকে বোঝার জন্য সার্বিক সহায়তা দান।
৩. যেভাবে পাঠদান করলে ছাত্রদের উৎসাহ আগ্রহ বেড়ে যাবে সে ভাবে পাঠদান করা।
৪. শিক্ষকের একটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি সচেষ্ট হবেন। একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম সামনে হাজির রাখতে হবে যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি উৎসাহী হবেন।
অন্য এক গবেষণায় সফল গুণাবলি নির্ণয় করতে গিয়ে Trever Kdrry (১৯৮১) বলেন,
ক. শিক্ষক নিজের জন্য একটি স্পষ্ট টার্গেট নির্ধারণ করবেন যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি কাজ করে যাবেন।
খ. তিনি যা করতে যাচ্ছেন তার স্পষ্টাকারে বর্ণনা দেবেন।
গ. তিনি মনোযোগসহ ছাত্রদের কথা শুনবেন।
ঘ. তিনি সজাগ দৃষ্টির অধিকারী হবেন।
ঙ. ছাত্রদের মাঝে সামাজিক ও বৈষয়িক পার্থক্যসমূহ দূরীভূত করার জন্য উৎসাহী হবেন।
চ. শিক্ষক তার অভিমত ও রায় বস্তুনিষ্ঠ দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে দাঁড় করাবেন।
ছ. শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে এমন সব প্রশ্ন করবেন যার দ্বারা ছাত্রদের চিন্তাশক্তি শাণিত হয়, তাদের উদ্ভাবন ক্ষমতা বাড়ে।
জ. দলিল-প্রমাণ বিবর্জিত পূর্বনির্ধারিত যে কোনো সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবেন।
ঝ. আলোচনা-পর্যালোচনা, পাঠদান সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়ে সীমিত রাখবেন। বিক্ষিপ্ত হবেন না।
ঞ. শেখা ও জ্ঞানলাভের প্রতি ছাত্রদেরকে আগ্রহী করে তুলবেন।
ট. যেসব তথ্য ছাত্রদের জানা প্রয়োজন বা ছাত্ররা যেসব তথ্য জানতে আগ্রহী সেগুলো তিনি সরবরাহ করবেন।
ঠ. ছাত্রদেরকে বিচারের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার আশ্রয় নেবেন। ব্যক্তিগত রায় অথবা স্বেচ্ছাচারিতা বর্জন করবেন।
ইসলামি বিষয়বস্তু পাঠদানে সফলতার ক্ষেত্রে আরো কিছু গুণাবলীর কথা উল্লেখ যায়, আর তা হল:
১. ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হিসেবে সাব্যস্ত করা এবং এ বিষয়ে হৃদয়ে জাগ্রত অনুভূতি রাখা।
২. ইসলামি শরিয়া এবং শরিয়া সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞান সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জ্ঞান হিসেবে গভীর বিশ্বাস রাখা; কারণ আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়া ও বিধান সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত। আল কুরআন এর মূল উৎস, বাতিল যার সম্মুখ দিয়ে ও পশ্চাত দিয়ে আসতে অক্ষম। ছাত্রদের মাঝে এ বিশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর করা এবং উলুমে শরিয়ার জন্য তাদেরকে নিবেদিতপ্রাণ হতে উৎসাহ দেওয়া।
৩. তাকওয়া অর্থাৎ গোপনে ও প্রকাশ্যে, সকল অবস্থায় আল্লাহর ভয় হৃদয়ে জাগ্রত রাখা। আল্লাহর নির্দেশমালা যথার্থরূপে বাস্তবায়ন করা। শিক্ষক তাকওয়াপূর্ণ হৃদয়ের অধিকারি হলে, ক্লাসে উপস্থিতি, পাঠপ্রস্তুতি, পাঠদান, পরীক্ষা নেয়া ও উত্তরপত্র নিরীক্ষা এসব কিছুই সম্পন্ন হবে আল্লাহ-ভীতির বলয়ে। কর্মকর্তা অথবা নিয়ম-কানুনের ভীতি নয়, আল্লাহ-ভীতিই বরং একজন শিক্ষককে করতে পারে শিক্ষকতার সকল পর্যায়ে সফল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ أَتَخۡشَوۡنَهُمۡۚ فَٱللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخۡشَوۡهُ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ١٣ ﴾ [التوبة: ١٣].
“তোমরা কি তাদেরকে ভয় পাচ্ছ, আল্লাহ তো অধিক হকদার যে তোমরা তাকে ভয় করবে, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক”। [সূরা আততাওবা, আয়াত : ১৩]
৪. সত্যবাদিতা: উলুমে শরিয়ার শিক্ষকদের জন্য সত্যবাদিতা একটি মৌলিক গুণ। কেননা তারা যে কেবল ছাত্রদের কাছেই কুদওয়া বা উত্তম আদর্শ তা নয়, তারা বরং সাধারণ মানুষের কাছেও ইসলামি আদর্শের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত। তাই উলুমে শরিয়ার কোনো শিক্ষক কখনো মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে না। আল কুরআনে মুমিনদেরকে তাকওয়া অবলম্বন ও সত্যবাদীদের সাথে থাকার যে নির্দেশ এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَكُونُواْ مَعَ ٱلصَّٰدِقِينَ ١١٩ ﴾ [التوبة: ١١٩] .
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক”। [সূরা আততাওবা, আয়াত : ১১৯ ] তা উলুমে শরিয়ার শিক্ষকের ক্ষেত্রে আরও কঠিনভাবে বর্তায়। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى البِرِّ، وَإِنَّ البِرَّ يَهْدِي إِلَى الجَنَّةِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يَكُونَ صِدِّيقًا».
“সত্যবাদিতা কল্যাণের পথ দেখায়, আর কল্যাণ জান্নাতে নিয়ে যায়। আর যখন একজন ব্যক্তি সত্যানুবর্তী হয়ে চলতে থাকে, তাকে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করে নেয়া হয়”। (সহীহ বুখারি, হাদীস নং ৬০৯৪) সে হিসেবে একজন মুদাররিস থেকে কখনোই কোনো মিথ্যা কথা বা আচরণ আশা করা যায় না।
এবার আসা যাক পাঠদানের ক্ষেত্রে কলাকৌশল কী হওয়া উচিত সে আলোচনায়। ছাত্রের চরিত্রগঠন, মনোগঠন, জীবনযুদ্ধে সফলতা অর্জনের পথ নির্মাণ, জীবনের সুবিস্তৃত ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা অর্জনে উৎসাহ প্রদান ইত্যাদির পাশাপাশি একজন মুদাররিসকে যে বিষয়ে সব থেকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে তা হল যথার্থরূপে পাঠদান। যথার্থরূপে পাঠদান কীভাবে সম্ভব তার কিছু কৌশল নিম্নে বর্ণনা করা হল:
এক. পাঠপ্রস্তুতি: পাঠপ্রস্তুতি বলতে আমরা সাধারণত ‘অধ্যয়ন’ প্রক্রিয়াকে বুঝি। অর্থাৎ একজন শিক্ষক যে বিষয়টি পড়াতে যাচ্ছেন তা ক্লাসে ঢোকার পূর্বে অধ্যয়ন করে ভালো করে বুঝে নেয়া, কঠিন টেক্সটগুলোর অর্থ উদ্ধার করে নেয়া এবং নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ব্যাখ্যায় কি কি পয়েন্ট উপস্থাপন করা যায় তা আয়ত্ত করে নেয়া। আমাদের আরবী মাদারাসার ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া একটি ঐতিহ্য বলে পরিগণিত হলেও পাঠদানের আধুনিক পদ্ধতির বিবেচনায় তা পর্যাপ্ত নয়। ঐতিহ্যগত অধ্যয়ন পদ্ধতির সাথে আমাদের যোগ করতে হবে আরো কিছু অনুষঙ্গ যা ছাত্রদের মধ্যে ইলমী যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা দিতে পারে। সে হিসেবে পাঠপ্রস্তুতি পর্বে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে,
· পাঠপরিকল্পনা: পাঠপরিকল্পনা লিপিবদ্ধ আকারে হতে হবে। সে হিসেবে শিক্ষকের জন্য নোটবুক মেইনটেইন করা জরুরি। প্রতিটি দরসের জন্য আলাদা আলাদা পাঠপরিকল্পনা রচনা করা বাঞ্ছনীয়। পাঠপরিকল্পনায় যেসব পয়েন্ট থাকতে হবে তা হল:
· প্রতিটি দরসের পরিসর নির্ণয়: অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষের প্লান অনুযায়ী আজকে কতটুকু সবক পড়াতে হবে তা সুনিদিষ্টভাবে নির্ণয় করে নেয়া। পরীক্ষা আসার পূর্বেই যাতে পরিকল্পিত পুরো সিলেবাস ভাল করে পড়িয়ে শেষ করা যায় তা নিশ্চিত করার জন্য এ বিষয়টি খুবই জরুরি। বছরের শুরুতে ছাত্রও বোঝে শিক্ষকও বোঝেন, মাঝখানে শিক্ষক বোঝেন ছাত্র বোঝে না, আর শেষে ছাত্র শিক্ষক কেউ বোঝে না, এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিষয়টি খুবই জরুরি।
· প্রতিটি দরসের উদ্দেশ্য নির্ণয় : অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট অধ্যায় বা সবক পড়ানোর পর ছাত্ররা কি কি শিখতে সক্ষম হবে তা স্পষ্টাকারে নির্ণয় করে নিতে হবে। যেমন অযূ বিষয়ক দরসের উদ্দেশ্য হিসেবে লেখা যেতে পারে- দরসের পর ছাত্ররা অযূর গুরুত্ব, কুরআন-সুন্নায় অযূর দলীল, অযূর ফরজ-সুন্নাত-মুস্তাহাব ইত্যাদি বিষয় শিখতে সক্ষম হবে। উদ্দেশ্য নির্ণয় করে নিলে পাঠদানের পর প্রশ্ন করে ছাত্রদের অর্জন মেপে দেখা সম্ভব হয়। কারও কারও কাছে বিষয়টি তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বসহ দেখে।
· পাঠদান পদ্ধতি নির্ণয় করে নেয়া: যেমন শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে প্রথমে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে নেবেন আজকের দরসে ছাত্ররা কি কি শিখবে। এরপর হয়ত কোনো ছাত্রকে এবারত পড়তে বলবেন। এবারতের মূল বক্তব্য সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেবেন। কঠিন শব্দ বা বাক্যগুলো বিশ্লেষণ করে বোঝাবেন। এরপর হয়ত কোনো ছাত্রকে দরসের মূল পয়েন্টগুলো উল্লেখ করতে বলবেন। অথবা কোনো ছাত্রকে পুরো দরস সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে বলবেন। আধুনিক শিক্ষাসরঞ্জাম ব্যবহৃত হলে- যেমন, কম্পিউটার, প্রজেক্টর ইত্যাদি দরসের কোন পর্যায়ে ব্যবহৃত হবে তা নির্ণয় করে নেয়া। পাঠদান শেষে সুনির্দিষ্ট কোনো পয়েন্টের উপর প্রশ্ন করে ছাত্রদেরকে লিখতে বলা হবে কি-না তা নির্ণয় করে নেয়া।
দুই. সঠিক শুরু: ক্লাস শুরুর প্রথম ৫ মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে ছাত্রদের সচেতনতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। তাই এ সময়টুকু যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশের পূর্বেই যেন ছাত্ররা প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকে, ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে যেন কলম চোখানো, কেতাব বা খাতার পাতা উল্টানো, ব্যাগ থেকে কিতাবপত্র বের করা ইত্যাদি কর্ম বন্ধ হয়ে যায় এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
ক্লাসে প্রবেশের পর লিখিত প্লান অনুযায়ী শিক্ষক অগ্রসর হবেন। প্লান থেকে বিচ্যুত হবেন না। ক্লাসে প্রবেশ করে ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন। মুহূর্তকাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও এ কাজটি সম্পন্ন হতে পারে।
· পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে পুরো ক্লাসের প্রতি তাকান।
· ক্লাসের সকল ছাত্রের প্রতি নজর বুলান। পুরো ক্লাস আপনার নখদর্পনে ছাত্রদেরকে এ অনুভূতি দিন।
· বাড়ির কাজ দেওয়া থাকলে তা সংগ্রহ করুন।
· খুবই উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পাঠদান শুরু করুন।
· ধীরে ধীরে এগিয়ে চলুন। ছাত্ররা যা জানে তা দিয়ে শুরু করুন।
· বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলুন।
সঠিক শুরু নিশ্চিত করতে আপনি যা যা বর্জন করবেন:
· ক্লাসে কখনোই দেরি করে প্রবেশ করবেন না। হঠাৎ করে ক্লাসে ঢুকবেন না। আপনি ক্লাসে আসতে যাচ্ছেন এ বিষয়ে ছাত্রদেরকে জানান দিন, যাতে তারা প্রস্তুত হয়ে নীরবতা বজায় রেখে বসে থাকে।
· নির্দিষ্ট কোনো ছাত্র বা পুরো ক্লাসকে বকা-ঝকা দিয়ে ক্লাস শুরু করবেন না।
· পরিপাটি ও গোছানো আকারে নিজেকে উপস্থাপন করুন।
তিন. ছাত্রদেরকে চিনে নেয়া: ছাত্রদেরকে আলাদা আলাদাভাবে চিনে নেয়া সফল শিক্ষকতার ক্ষেত্রে একটি জরুরি বিষয়। প্রতিটি ছাত্রই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারি। যোগ্যতায়, বোঝার ক্ষমতায় একজন অন্যজন থেকে আলাদা। সে হিসেবে আলাদাভাবে প্রতিটি ছাত্রদের যোগ্যতা, গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি আয়ত্তে আনা জরুরি। কেননা শিক্ষকের উচিত প্রতিটি ছাত্রকেই সাহায্য করা। প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে আবিষ্কার না করলে এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে যা জানতে হবে তা হল ছাত্রের পড়া-লেখার ব্যাকগ্রাউন্ড, মেধাকেন্দ্রিক পর্যায়, ছাত্রের গুরুত্বের বিষয় কি কি। এসব তথ্য ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের মাঝে সেতুবন্ধের কাজ করে। বই পড়া যদি ছাত্রের নেশা হয়ে থাকে তবে সর্বশেষ কোন বইটি সে পড়েছে তা জিজ্ঞাসা করা। ডাকটিকিট সংগ্রহ করার অভ্যাস থেকে থাকলে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে সর্বশেষ ডাক টিকিট কোনটি। অসুস্থ হলে ছাত্রের স্বাস্থ্য বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা। এরূপ করতে পারলে ছাত্ররা শিক্ষক মহোদয়কে আপন বলে ভাববে। সে নিজেকে ক্লাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে জ্ঞান করবে।
শিক্ষক তার সকল ছাত্রের নাম মনে রাখার চেষ্টা করবে। প্রত্যেককে নাম ধরে ডাকবে। প্রত্যেক ছাত্রকে প্রতিদিন একই জায়গায় বসতে বললে, যে ছাত্রের নাম মনে থাকে না, হাজিরা নেয়ার সময় তার সাথে কথা বললে ছাত্রদের নাম মনে রাখাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ক্লাস ছোট হলে প্রত্যেক ছাত্রকে তার নাম লিখে টেবিলের উপর রেখে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে ক্লাস চলাকালীন সময়ে। ছাত্রের নাম মনে রাখার ক্ষেত্রে এটি একটি সহজ পদ্ধতি।
চার. ক্লাস নিয়ন্ত্রণ: ক্লাস নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা হেকমত ও দূরদর্শিতা দাবি করে। ক্লাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষককে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। বিনম্র স্বভাব ছাত্রের কাছে শিক্ষককে প্রিয় করে তুলবে অতঃপর শিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়তা দেবে, এ ধারণা ভুল। গবেষণা থেকে দেখা গেছে কঠিন প্রকৃতির শিক্ষককেই ছাত্ররা অধিক সম্মান করে থাকে । বিনম্র-আচরণ-প্রকাশক শিক্ষক ক্লাসে তার সম্মান-শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলতে পারেন; কেননা বিনম্র স্বভাবকে ছাত্ররা দুর্বলতা বলে ভাবে। সে জন্য শুরুটা হতে হবে কঠোরতা প্রয়োগ করে। তবে ছাত্রদের প্রতি যেন কোনো জুলুম-অন্যায় অথবা সীমালঙ্ঘন না হয় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পরবর্তীতে সময় সুযোগ বুঝে ছাত্রদের প্রতি এহসান ও বিনম্র আচরণ করে ভারসাম্য রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
ক্লাসের ছাত্রদের সাথে গভীর সম্পর্ক - যার আওতায় শিক্ষকের সম্মান মর্যাদা যথার্থরূপে বজায় থাকে - কায়েম করা হঠাৎ করে ঘটে-যাওয়া কোনো বিষয় নয়। তা বরং দাবি করে দীর্ঘ মেহনত ও প্রচেষ্টার। পড়ানোর ক্ষেত্রে, উত্তম আদর্শ হওয়ার ক্ষেত্রে আপনি ঐকান্তিক ও মুখলেস - এ বিষয়টি ছাত্রদের কাছে প্রমাণিত হওয়ার পর ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে সম্মান করবে, ফলে আপনার জন্য ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
ক্লাস নিয়ন্ত্রণের আরেকটি সহায়ক পদ্ধতি হল, ক্লাসে সম্পন্ন করতে হবে এমন কাজ দিয়ে ছাত্রদেরকে ব্যস্ত রাখা। ব্যস্ত রাখতে পারলে ছাত্ররা হৈ-চৈ করার সুযোগ পায় না। সে হিসেবে শিক্ষকের উচিত হবে পাঠপরিকল্পনায় এমন কিছু বিষয় রাখা যার দ্বারা ছাত্রদেরকে ব্যস্ত রাখা সম্ভব হবে।