×
এ প্রবন্ধে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন যে, সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমান নয় যে রমযান মাস চলে গেলে ইবাদাত ছেড়ে দেয় এবং পাপের পথে ফিরে যায়। বরং বুদ্ধিমান হল সেই ব্যক্তি যে তার নিকট মৃত্যু আসা পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদাত করে।

    রমযান চলে গেল কিন্তু আমাদের খবর কী?

    ومضى رمضان وكيف حالنا ؟

    < بنغالي >

    সাঊদ ইবন ইবরাহীম আশ-শুরাইম

    سعود بن إبراهيم الشريم

    —™

    অনুবাদক: চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ

    সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    ترجمة: أبو الكلام أزاد

    مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

    রমযান চলে গেল কিন্তু আমাদের খবর কী?

    মাহে রমযানে দীনের প্রতি সাধারণ মুসলিমের আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখে অন্তরে খুশির বন্যা বয়ে যায়। কারণ, যে দিকেই সে চোখ ফিরায় সেদিকেই দেখে নেক আমলের ঢল। মনে হয় ইসলামের জয় জয়কার।

    কিন্তু...?

    ঈদ ও তার পরবর্তী দিনগুলো উক্ত সুধারণার সত্যায়ন করে না; বরং সব ধারণা গুনাহমিশ্রিত আনন্দে ভেস্তে যায়।

    মাহে রমযান ও রমযান পরবর্তী মানুষের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করলে কেউই আশ্চর্য না হয়ে পারবে না; কেননা রমযানের পর লোকজন ইবাদতে অলসতা বরং ইবাদত থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। মনে হয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে- ইবাদত, তাওবা ও সকল নেক আমল শুধুমাত্র মাহে রমযানের সাথেই সম্পৃক্ত। তারা এ কথা জানেনা যে, আল্লাহ তাআলা রমযান সহ সব কয়টি মাসের রব। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমযান হলো আনুগত্য ও ধৈর্যের অনুশীলন মাত্র। এ মাসে ঈমানী শক্তি সঞ্চয় করে বাকি এগারো মাস চলতে হবে।

    হ্যাঁ, তবে রমযান মাসে ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব আছে এবং রমযান অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু রমযান মাসই কেবল ইবাদাতের জন্য খাস নয়। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময়ই দান-সদকা করতেন, তবে রমযানে তার দানের পরিমাণ অন্যান্য মাসের তুলনায় বেড়ে যেত। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে এ দো‘আ পাঠ করে আশ্রয় চেয়েছেন-

    «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْحَوْرِ بَعْدَ الْكَوْرِ»

    “হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি ভালো-এর পর মন্দের দিকে ফিরে যাওয়া থেকে[1]

    পবিত্র কালামে আল্লাহ তাআলা বলেন,

    ﴿ وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّتِي نَقَضَتۡ غَزۡلَهَا مِنۢ بَعۡدِ قُوَّةٍ أَنكَٰثٗا﴾ [النحل: ٩٢]

    “তোমরা ঐ নারীর মত হয়ো না, যে সুতা দিয়ে মজবুতভাবে কাপড় তৈরি করার পর সুতাগুলো কাটতে শুরু করল।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৯২]

    অতএব, কল্যাণমূলক কাজগুলো কেবল রমযানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময়ই আমাদের রবের ডাকে সাড়া দিতে হবে। বলা হচ্ছে-

    ﴿وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ ٩٩﴾ [الحجر: ٩٩]

    “মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদতে নিয়োজিত থাক।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯৯]

    অতএব, মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত ও নৈকট্য অর্জনের সমাপ্তি নেই।

    ঈদে মানুষের বৈধ-অবৈধ পন্থায় আনন্দ-উল্লাস ও শরী‘আতের সীমালঙ্ঘনের প্রতি দৃষ্টি দিলে মনে হবে না যে, তারা তাদের রমযানের নেক আমলগুলো প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ব্যাপারে ভয় করছে, অথবা যে ঈদের মাধ্যমে আল্লাহ তাদের সম্মান দান করেছেন তার ব্যাপারে তারা শুকরিয়া আদায় করছে। আর এ কারণেই তাদের অবস্থা ঐ নারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে যে সুতা বোনার পর তা কেটে ফেলে।

    মানব প্রকৃতি হলো যদি সে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যস্ত থাকে তাহলে কখনো আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কোনো কাজে সে লিপ্ত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

    ﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱرۡتَدُّواْ عَلَىٰٓ أَدۡبَٰرِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلۡهُدَى ٱلشَّيۡطَٰنُ سَوَّلَ لَهُمۡ وَأَمۡلَىٰ لَهُمۡ ٢٥﴾ [محمد: ٢٥]

    “নিশ্চয় যারা হিদায়াত স্পষ্ট হওয়ার পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, শয়তান তাদের প্ররোচিত করে এবং আশা দেয়”[সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ২৫]

    আসলে যদি তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যকে ভালোবাসত তাহলে চোখের এক পলকের জন্যও তা থেকে দূরে থাকত না। পূর্ব যুগে বলা হত :

    «من عشق طريق اليمن لم يلتفت إلى الشام»

    “যে ব্যক্তি ইয়ামানের রাস্তার আশেক, সে কখনো সিরিয়ার দিকে তাকাবে না।”

    শুনে রাখুন, কেউ অলস ও দুর্বল হয়ে গেলে কিন্তু সাধনা করতে পারবে না। আর যদি কেউ তারাবী নামাজ নিয়ে গর্ব করে তাহলে নিজে নিজে শেষ হয়ে যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিজেকে ইবাদত ও দৃঢ়তার উপর সংযত রাখা, কঠিনভাবে নিজেকে ইবাদতে আটকে রাখা।

    হে মুসলমান, খবরদার! রমযানে কুপ্রবৃত্তি দমন করে ধোঁকায় পড়ো না, তাতে তুমি রমযানের পর আবার ফিতনায় জড়িয়ে পড়বে। কেননা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে চক্রান্তে ফেলে দেয়। যুদ্ধের ময়দানে এমন অনেক বীর পুরুষ ধোঁকায় পড়ে, ফলে সে এমন এক পরিস্থিতির শিকার হয়, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। এখানে হামযা রা. এর সাথে ওয়াহশির ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে। যে ব্যক্তি আমল করে কিছদূর গিয়ে আবার অলস হয়ে স্থির হয়ে যায় সে ব্যক্তি কখনো শান্তি পায় না। কেননা প্রবাদ বাক্যে বলা হয়-

    «إن أردت ألا تتعب فاتعب لئلا تتعب»

    “যদি তুমি ক্লান্ত হতে না চাও তাহলে তুমি পরিশ্রম করতে থাক, যাতে তুমি সর্বসান্ত না হও।”

    এক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার বাণী সবচেয়ে অর্থবহ, বলা হচ্ছে-

    ﴿فَإِذَا فَرَغۡتَ فَٱنصَبۡ ٧﴾ [الشرح: ٧]

    “অতঃপর তুমি যখন অবসর হবে, তখন তুমি সালাতে দাঁড়িয়ে যাও।” [সূরা আশ-শরহ, আয়াত: ৭]

    কেননা অলসতা কখনো কারো হক আদায়ের সহায়ক হতে পারে না। যে ব্যক্তি হাহুতাশ করে সে কখনো হকের উপর অটল থাকতে পারে না। নফসকে শাসন করার মূলমন্ত্র হলো আমলের প্রতি দৃঢ় সংকল্প করা। কেননা সংশয়ের কারণেই কোনো কাজ ধ্বংস হয়ে যায়।

    মুজাহাদা একটি আশ্চর্যজনক পদক্ষেপ। তাইতো দেখা যায় যারা নফসকে যা ইচ্ছা তা-ই করার জন্য ছেড়ে দেয়, নফস তাদেরকে অপছন্দনীয় কর্মকাণ্ডে ফেলে দেয়। আর যারা সর্বদা নফসের বিরোধিতা করে তাদের নফস কষ্ট পেলেও তারা সফল হয়ে যায়। আরবী কবি যথার্থই বলেছেন,

    والنَّفسُ كَالطّفلِ إِنْ تُهمِلْه شَبَّ عَلَى :: حُبِّ الرّضَاع وَإِنْ تَفْطِمْهُ يَنفَطِــمِ

    “নফস হলো ছোট্ট শিশুর মতো, তাকে ছেড়ে দিলে সে দুধ পান করার জন্য উদগ্রীব থাকে, আর তাকে দুধ পান ছাড়িয়ে ফেললে ছেড়ে দেয়।”

    একথা সত্য যে দুনিয়ার জীবন কষ্ট-ক্লেশ থেকে কখনো পৃথক হয় না। জীবন চলার পথে অনেক মুসীবতের সম্মুখীন হতে হয়। মানবজীবনে সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো পরিণতি সম্পর্কে অনুভূতি না থাকা। বরং এর চেয়েও নিকৃষ্ট হলো পূর্ণমাত্রায় ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত হওয়ার পর ইবাদত কমিয়ে দিয়ে তার উপর সন্তুষ্ট থাকা, অথবা গুনাহ থেকে তাওবা করে আবার গুনাহে ফিরে আসা। যার অবস্থা এমন সে কখনো ইবাদত করে কামিয়াব হতে পারে না। যদি কেউ মৌসুমী ইবাদতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে তাহলে সে কঠিন শাস্তিতে নিমজ্জিত হবে, আর তা হলো ইবাদাতের মজা ও আল্লাহর সাথে নিবিড় মোনাজাতের মিষ্টতা আস্বাদন করার সুযোগ না পাওয়া। মু’মিন নারী ও পুরুষ যারা প্রতিটি মাসের রবের ইবাদত করে প্রত্যেক মাসে, তাদের বাহির ও ভিতর সমান। তাদের শাওয়াল মাস রমযানের মতোই।

    মানুষকে কষ্ট ক্লেশের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ তার রব পর্যন্ত পৌঁছতে কঠোর পরিশ্রম করবে। অতঃপর তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। নেক আমল নিয়মতান্ত্রিক করার ব্যাপারে মুসলিমকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে তা হলো সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ শুরু না করা। সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করে আমল শুরু করতে হবে। কঠিন পথ যথাসম্ভব ধীরস্থিরতার সাথে অতিক্রম করতে হবে। কাজ করার জন্য বিশ্রাম গ্রহণও কাজ করার শামিল। মণিমুক্তা অন্বেষণে সমুদ্রে ডুব দেয়া উপরে উঠারই নামান্তর। সহজ পন্থায় নেক আমল করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেন,

    «إِنَّ هَذَا الدِّينَ مَتِينٌ، فَأَوْغِلُوا فِيهِ بِرِفْقٍ»

    “নিশ্চয় এ দীন বড়ই শক্তিশালী। অতএব, তাতে তোমরা নম্রভাবে প্রবেশ কর”[2]

    সহীহ বুখারীর বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

    «إِنَّ الدِّينَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلَّا غَلَبَهُ»

    “নিশ্চয় দীন বড় সহজ, যে ব্যক্তি দীনকে কঠিনভাবে নেবে তার বেলায়ই দীন কঠিনভাবে আরোপিত হবে”[3]

    অল্প আমল নিয়মিত করার মাঝে বরকত আছে। এটি আল্লাহ তা‘আলা খুব পছন্দ করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «يَا أَيُّهَا النَّاسُ، خُذُوا مِنَ الأَعْمَالِ مَا تُطِيقُونَ، فَإِنَّ اللَّهَ لاَ يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوا، وَإِنَّ أَحَبَّ الأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ»

    “হে লোক সকল! তোমরা যতটুকু আমল নিয়মিত করতে পারবে তা-ই গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদান দিতে বিরক্ত হন না, বরং তোমরাই বিরক্ত হয়ে যাও। নিশ্চয় আল্লাহর নিকট প্রিয় আমল হলো যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়”[4]

    তবে আমল নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার অর্থ আবার এই নয় যে, অবহেলা করে আমল ছেড়ে দেবে। বরং এর উদ্দেশ্য হলো মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে আমল চালিয়ে যাওয়া। আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেন,

    «يَا عَبْدَ اللَّهِ، لاَ تَكُنْ مِثْلَ فُلاَنٍ كَانَ يَقُومُ اللَّيْلَ، فَتَرَكَ قِيَامَ اللَّيْلِ»

    “হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুক ব্যক্তির মতো হয়ো না, যে রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করতো। অতঃপর তাহাজ্জুদ ছেড়ে দেয়”[5]

    আল্লাহ তা‘আলা মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত নেক আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। বলা হচ্ছে,

    ﴿وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ ٩٩﴾ [الحجر: ٩٩]

    “আর তুমি তোমার রবের ইবাদাত কর, তোমার নিকট মৃত্যু আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯৯]

    তাই আসুন আমরা সবাই আল্লাহর ইবাদাতে নিমগ্ন হই। এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাতে অটল থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমীন!!

    [1] সুনান নাসাঈ, হাদীস নং ৫৪৯৮

    [2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৩০৫২

    [3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৯

    [4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৮৬১

    [5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৫২