×
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আদর্শ মা হিসেবে নারীর ভূমিকা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আদর্শ মা হতে হলে একজন নারীকে কি কি যোগ্যতা অর্জন করতে সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।

 আদর্শ জননী রূপে একজন নারী

চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ


﴿المرأة كأم مثالية﴾

أبو الكلام أزاد أنوار الله


 আদর্শ জননী রূপে একজন নারী

মা' কথাটি বা শব্দটি এই পৃথিবীর সবচেয়ে আপন। এই ধরনীর সকলে মায়ের আদরেই বেড়ে উঠতে চায়। সন্তানের প্রতি মায়েরই থাকে অকুন্ঠ ভালবাসা- সন্তানের জন্য ব্যাকুল থাকে মায়ের মন। ঠিক তেমনি ভাবে মায়ের আদর, স্নেহ, আর অকুন্ঠ ভালবাসা সকলের মানব হৃদয়কে উদ্বেলিত করে তুলে। একজন মা অনেক চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে সন্তানকে আদর, মমতা আর সোহাগে মানুষ করার প্রানান্তকর চেষ্টা করে থাকেন। মা ইচ্ছা করলে স্বীয় সন্তানকে ইসলামের পথে ধাবিত করতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে অন্য কোন বাতিল ধ্যান-ধারণার উপর গড়ে উঠাতে পারেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :

كل مولود يولد على الفطرة فأبواه يهودانه أو ينصرانه أو يمجسانه.

প্রতিটি নবজাতক ইসলামের সুন্দর প্রকৃতির উপর জন্মগ্রহণ করে, অতঃপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদি বানায়, অথবা খ্রীষ্টান কিংবা অগ্নিপুঁজক বানায়।

একজন মা তাঁর সন্তান জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হতে পারেন, আবার তাকে আদর-যত্নের মাঝে দ্বীনি পথে পরিচালনা করে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্বীয় পদতলে স্থান দিতে পারে। তাই আসুন আদর্শ জননী হওয়ার জন্য আমরা মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করি।

পারিবারিক জীবনে মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য

মুসলিম পারিবারিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক হলেও বাস্তবে নারী-পুরুষ যেন একই বৃক্ষমূলের দুটি শাখা। মহান আল্লহ বলেন-

وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا     (سورة النحل : 80)

"আল্লহ তোমাদের জন্য তোমাদের ঘরকে শান্তির আবাসস্থল বানিয়েছেন।" (নাহল-৮০)

অন্যদিকে আদর্শ পরিবার গঠনে মহান আলস্নাহর সাহায্য প্রার্থনার বাণী ও মহান আল্লাহই শিখিয়েছেন- 

وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا ﴿74﴾ (سورة الفرقان )

"আর তারা বলে: হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন, যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে।" (ফুরকান-৭৪)

পারিবারিক জীবনের পূর্ণতা আসে সন্তানের জন্ম ও লালন-পালনের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গের দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতার নির্দেশ দিয়ে প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, "কারো সন্তান হলে তার উত্তম নাম রাখবে, উত্তম শিক্ষা দিবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিয়ে দিবে।" (বায়হাকী) এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সাঃ) আরো বলেন, "তোমরা সন্তানের বিপক্ষে কখনো বদ-দুআ করো না।" (মুসলিম)

পারিবারিক জীবনে মাতার ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত। সন্তান গর্ভে ধারণ ও লালন-পালনের সামগ্রিক দায়িত্ব মাতার একার ওপর নির্ভরশীল। মহান আল্লাহ বলেন-

حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ (سورة لقمان : 14)

"মাতা সন্তানকে অতি কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করেন এবং প্রসব করেন।" (লুকমান-১৫) এখানেই শেষ নয়। মায়ের দায়িত্ব প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ (سورة البقرة : 233)

"মা সন্তানকে পূর্ণ দু‌’বৎসর মাতৃদুগ্ধ দান করবে।" (বাকারা-২৩৩)

ইসলামী পরিবার ব্যবস্থা দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য চেতনায় সুসমন্বিত। এখানে ভাইবোন পারস্পরিক সম্পর্কেও অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্যই হাদীসে আছে- "ছোট ভাইদের ওপর বড় ভাই-এর অধিকার ঠিক তেমন যেমন সন্তানের ওপর পিতার।" (বায়হাকী)

অন্যদিকে পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদার গুরুত্ব প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সাঃ) এর বিখ্যাত বাণী- "যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।"

বস্তুতঃ পারিরবারিক জীবন দর্শন মানবিক পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের অনুপম নিদর্শন। আর ইসলাম এ ব্যবস্থাকে আদর্শ শিক্ষায় করেছে পবিত্রতম।

 একজন আদর্শ জননীকে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হবে :

Ø মা সন্তানকে যে আদর্শে বড় করতে চান প্রথমে তাঁকে সে আদশে গড়ে উঠতে হবে।

Ø সর্বদা সন্তানদেরকে আল্লাহর ভয় দেখাবে।

Ø সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্ক নীবিড় হওয়া উচিত। মাকে সন্তান যেমন শ্রদ্ধা-সম্মান দেখাবে, তেমনি মায়েরও উচিত সন্তানের ব্যক্তিত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখা।

Ø ছেলে-মেয়েদেরকে ইসলামী সহি আকিদা শেখাবে।

Ø ছেলে-মেয়েদের নিদ্রা ও জাগ্রত অবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

Ø খারাপ বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত থেকে সন্তান হেফাজত করতে হবে।

Ø ছেলে-মেয়েদের উপস্থিতিতে কখনো স্বামীর সাথে তর্ক-বিতর্ক বা ঝগড়া করবে না।

Ø ঘরে কোন কুকুর অথবা খারাপ ছবি ঝুলিয়ে রাখা যাবে না।

Ø মাঝে মাঝে সন্তানদের নিয়ে চরিত্রগঠনমূলক সত্য ও উন্নত কাহিনীর মাধ্যমে গল্প করবে।

Ø ছেলেদেরকে বাবা, ভাই অথবা বন্ধুদের সাথে পাঁচওয়াক্ত নামাজে মসজিদে পাঠাবে।

Ø স্নেহ, মমতা, আদর ও ভালবাসা আদান-প্রদানের জন্য সময় নির্ধারণ করে তাদের নিয়ে বসবে। এ ব্যাপারে কোনো ভাবেই অবহেলা করা যাবে না।

Ø বিভিন্ন ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে মত-বিনিময় হওয়া উচিত। অনেক মা আছেন, যিনি নিজের সন্তান বলে, কিংবা ছোট্টবেলা থেকে বড়ো করে তুলেছেন বলে সন্তানকে বড়ো ভাবতে নারাজ। কেবল নারাজই নন, বরং কখনো কখনো এমনও বলে বসেন ‘‘সেদিনের ছেলে তুই,কী আর জানিস” "বড়োদের ব্যাপারে নাক গলাবেনা" ইত্যাদি। এরকম আচরণের ফলে সন্তানের ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে। পরিণতিতে মাকে সে অশ্রদ্ধা করে বসতে পারে। অথচ উচিত হলো, সন্তানের ব্যক্তিত্ব-বিকাশে মায়ের আচরণে ছেলের যেন সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। এ বয়সটা সন্তানের চিন্তার স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনের বয়স।

Ø সন্তান যত ছোটই হোকনা কেন, সেও কিন্তু পরিপূর্ণ একটি মানুষ। তার বোধ-বুদ্ধি, মেধা-মনন, চিন্তা ও বিবেক এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে । তার ঐ ব্যক্তিত্ব তথা সত্ত্বাকে কোনভাবেই খাটো করে দেখা ঠিক নয়। সন্তানের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করা হলে সন্তানও মায়ের ব্যক্তিত্ব খর্ব করতে দ্বিধা করবে না। ফলে সন্তান হয়ে যাবে মায়ের অবাধ্য।

Ø মাকে এমনভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সন্তান ধর্মীয় বিধি-বিধান, আইন-অনুশাসন পুরো মেনে চলে। সন্তানের সকল সঙ্গতি-অসঙ্গতির ব্যাপারে প্রথমতঃ মা-ই দায়ী। ফলে সন্তানের পরিশুদ্ধি, ধর্মের অনুশীলন ইত্যাদির ব্যাপারে প্রথমে মাকেই পরিশুদ্ধ হতে হবে, তাকে ধর্ম চর্চা করতে হবে। মা যদি ধর্মীয় ব্যাপারে উদাসীন হন তাহলে সন্তান কিছুতেই এ ব্যাপারে মায়ের নির্দেশ মানবে না। তাই মায়ের মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে কোন ত্রুটি থাকলে দ্রুত তা ঠিক করে ফেলা উচিত। নিজেরা ত্রুটিমুক্ত হলে সন্তানও ত্রুটিমুক্ত হবে। আর এটা তো খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার যে, মা যা করে না, তা সন্তানকে করতে বললে সন্তান সাথে সাথেই প্রতিক্রিয়া দেখাবে। সন্তানের এই প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে মুক্ত থাকা প্রত্যেক মায়ের কর্তব্য। কারণ এই প্রতিক্রিয়া না সন্তানের জন্যে মঙ্গলজনক, না মায়ের জন্য।

Ø মায়ের উচিত সন্তানের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাদের সাথে আচার আচরণ, কথাবার্তা, চলাফেরায় সচেতন ও সতর্ক হওয়া। আর এই সচেতনতার জন্যে মাকে সন্তানের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। সন্তানের মন-মানসিকতা বুঝতে হবে। তাদের চাহিদাগুলো পূরনের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। তাদের ব্যক্তিত্বকে সম্মানের সাথে দেখতে হবে। তবেই সন্তানও মাকে শ্রদ্ধা করবে, তাঁর প্রতি নির্ভরতা, বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করবে। নিজের মনের কথা, সমস্যা, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি সকল ব্যাপারে মায়ের সাথে আলাপ আলোচনা করবে, পরামর্শ করবে ।

মহান আল্লাহ আমাদের সমাজের সকল মা জননীকে ইসলামী আদর্শ সমুন্নত রাখার শক্তি দান করুন। আমীন।

সমাপ্ত