×
মানুষ এমন এক সৃষ্টি যার মাঝে ঘটেছে বৈপরিত্যের বিপুল সমাহার। একই সঙ্গে সে প্রখর মেধা, তীক্ষ্ন জ্ঞান, নব সৃজন, নয়া উদ্ভাবন ও নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার মতো শক্তির অধিকারী। তেমনি সে রূপকথা ও কল্পকাহিনী নির্মাণ এবং তার যথেচ্ছ ব্যবহারেও সক্ষম। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে এ বিষয়টির উপরই আলোকপাত করা হয়েছে।

    অপূর্ণ জ্ঞান

    الرشد الناقص

    < بنغالي >

    ড. আব্দুল কারীম বাক্কার

    د/ عبد الكريم بكار

    —™

    অনুবাদক: আলী হাসান তৈয়ব

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    ترجمة: علي حسن طيب

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    অপূর্ণ জ্ঞান

    بسم الله الرحمن الرحيم

    মানুষ এমন এক সৃষ্টি যার মাঝে ঘটেছে বৈপরিত্যের বিপুল সমাহার। একই সঙ্গে সে প্রখর মেধা, তীক্ষ্ন জ্ঞান, নব সৃজন, নয়া উদ্ভাবন ও নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার মতো শক্তির অধিকারী। তেমনি সে রূপকথা ও কল্পকাহিনী নির্মাণ এবং তার যথেচ্ছ ব্যবহারেও সক্ষম। দক্ষ সে সকল যুগে সকল দেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে এবং তাতে ধোঁকা ও ভেজাল ঢুকাতে। এখানে একটা মৌলিক প্রশ্ন আছে, যার উত্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো, যে মানুষ আজ এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিস আবিষ্কার করছে, এক সেকেন্ডেরও হাজার গুণ কম সময়ে কোনো কোনো কাজ সম্পাদন করছে এবং কোটি বছর আগের কোনো প্রাণীর বয়স অনুমান করছে, সেই কি-না তার জীবনের পরতে পরতে বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির সহজ শিকার হয়! এমনকি তাকে বেপথু বা প্রবঞ্চিত করে, যা তার পতন বা মরণ ডেকে আনে, যা কোনো দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। আমি মনে করি না এ থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণের কোনো আশা আছে। তাহলে এ অবস্থার কারণগুলো কী? এ ব্যাপারে আমাদের করণীয়ই বা কী হতে পারে? হ্যা, আমি এ নিবন্ধে সে সম্পর্কেই আলোচনার প্রয়াস পাব।

    মানুষের জ্ঞান কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে তার স্রষ্টাপ্রদত্ত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে জগত সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারে না; বরং এজন্য তার দরকার পড়ে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যবাহী শিক্ষা গ্রহণের এবং আরও দরকার পড়ে এমন সব তথ্য ও বিবৃতিসমূহের যা দিয়ে সে তার বোধ, বক্তব্য এবং ইন্দ্রিয়গুলোকে নিরেট ও স্বচ্ছ-স্ফটিক বানাতে পারে। যা তার পথকে করবে আলোকিত এবং পদক্ষেপকে করবে ভ্রান্তিমুক্ত। এই স্থূল পার্থক্যটি সপ্রমাণ হয় উচ্চতর এবং প্রাথমিক শিক্ষারত দুই ছাত্র কিংবা নিরক্ষর, স্বল্প জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাশূন্য ব্যক্তির বিচার-জ্ঞানের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য দ্বারা। এদিকে আমাদেরকে এ কথাটিও মনে রাখতে হবে যে, সব মানুষই চিন্তা ও গবেষণা করে, সমাধান পেশ করে এবং ঘটনার কারণ ও অনুঘটক আবিষ্কারেরও চেষ্টা চালায়। আবার মানুষের মধ্যেও কেউ নির্বোধ, কেউ পাগল বা মানসিক রোগী, কেউ হাঁপানীগ্রস্ত, কেউ খুবই আবেগী আবার কেউ বদ মেজাজী। এরা সবাই কিন্তু যে কোনো অবস্থা বা যে কোনো সমস্যা নির্ভুলভাবে বুঝতে সক্ষম নয়। কারণ এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে সাধারণ মানবিক জ্ঞানকে বিশৃংখলায় পতিত করে এবং বিভ্রান্ত চিন্তা বা তথ্য উপস্থাপনে অংশ নেয়; কিন্তু সমস্যা হলো, আল্লাহ তা‘আলা যাদের এসব সমস্যা থেকে মুক্ত রেখেছেন তারাও এসব ত্রুটি এবং তার প্রভাব ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারে না। এতে করে বিভ্রান্ত চিন্তা ও বিকৃত বিধানসমূহের বিস্তার ত্বরান্বিত হয়।

    একবার আমাকে এক শিক্ষিত ব্যক্তি জানালেন, তিনি তার জেলার মেডিকেল কলেজের মাঠে এক নিহত ব্যক্তিকে দেখেছেন। সেখানকার পুকুরের দানব তাকে হত্যা করে পানির ওপরে নিক্ষেপ করেছে। দানব কর্তৃক অক্কা পাওয়ার এমন ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। উপরন্তু সে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। আমি অবাক হচ্ছিলাম এ কথা ভেবে যে, এ ব্যক্তির কথা অনুযায়ী বারবার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অথচ কেউ সেখানে গিয়ে তালাশ-সন্ধান করছে না যে, কে এমনটি করছে বারবার!! আমি তার কাছ থেকে চলে আসার পর এ ঘটনার কথা শোনা এক বন্ধু আমাকে জানাল, ঘটনাটি বাস্তব নয়। যে লোকটি এ ঘটনা বলে বেড়াচ্ছে সে মূলত তার অবাস্তব ধারণা এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বলছে।

    দেখবেন কিছু লোক অবশ্যই পাওয়া যাবে যারা ওই ব্যক্তির বর্ণিত ঘটনাটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে। এমনকি তা অন্যের কাছে বলে বেড়াবে। আর কিছু লোকের স্বভাবই এমন যারা এ ধরনের ঘটনা লুফে নেয়। উপরন্তু তাতে কিছু মিশ্রণ ও অতিরঞ্জন ঘটায়। তারপর সেটার প্রচারে নেমে পড়ে আদাপানি খেয়ে। আবার অনেক সময় জ্বরে পাওয়া ব্যক্তি ভুল বকে। বিশেষত যদি সে হয় বয়োপ্রাপ্ত। সেখানে কিছু লোক প্রস্তুত হয়ে যায় তার প্রলাপ ও অসংলগ্ন কথাবার্তার ব্যাখ্যা দিতে।

    আরবের একটি শহরে এমন ঘটনা ঘটেছে। এক রাখাল প্রচণ্ড জ্বরে আবোল-তাবোল বকতে শুরু করে। সে নানা রকম দুর্বোধ্য কথাবার্তা বলতে লাগে। এলাকার তথাকথিত কিছু আধ্যাত্মিক সাধক দাবি করতে লাগল এ ব্যক্তি যা বলছে তা আসলে তার ওপর অহি হচ্ছে। স্বভাবতই ব্যাপারটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে গড়াল। তারা এ সুযোগটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল। ফল এই দাঁড়াল যে, সে রব হবার দাবি করে বসল। অচিরে তার কিছু সংবাদবাহক বা পয়গম্বরও তৈরি হয়ে গেল। এভাবে এক নতুন ধর্মের আবির্ভাব ঘটল যা ওই রাখালের ইবাদত এবং তার জন্য কুরবানি করার শিক্ষা দেয়। গত শতাব্দীর মাঝামাঝির দিকে লোকটিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ওই ভণ্ডটিকে দমানো সম্ভব হলেও তাকে পবিত্র জ্ঞান করার মতো লোক কিন্তু বিলুপ্ত হয় নি একেবারে। আজো কিছু লোক পাওয়া যাবে যারা তাকে ভক্তি করে! এভাবেই অশিক্ষিত অকর্ষিত লোকেরা গাঁজাখোরী বক্তব্য বা প্রলাপ থেকে বিভিন্ন চটকদার এবং অন্তত কিছু লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গল্প ফাঁদে। আর সেই কল্পকথা ও অসার বক্তব্যই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গিয়ে অকাট্য সত্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে আজকের বিশ্বের অনেক কুসংস্কারই এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিশাল জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের এক বড় অংশ দখল করেছে।

    এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, আমাদের মস্তিষ্কটিকে খুব সুন্দরভাবে পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল সম্পর্কের তারতম্য বুঝার মত পর্যাপ্ত জ্ঞান দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। তাই আমরা সহজেই অসুখ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অবসর ও অবসাদ এবং আহার ও ক্ষুধাহীন অবস্থার মাঝে সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারি। কিন্তু শৃংখলা বহির্ভূত এবং দিক-দিগন্তহীন সম্পর্ক নিরূপণ করা এতটা সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন গবেষণা ও অভিজ্ঞতা। তারপরেও তা সম্পূর্ণভাবে জানা যায় না। এতদসংক্রান্ত জ্ঞান অপূর্ণই থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপঃ কখনো দেখা যায়, আফ্রিকার কোনো দেশে অজ্ঞাত রোগ ছড়িয়ে পড়ল, যার আরোগ্য রাখা হয়েছে শুধু চীনে জন্ম নেয় এমন এক গুল্মের মাঝে। তাহলে কীভাবে ওসব লোক দ্বারা এ গুল্ম আবিষ্কার এবং এর ব্যবহার সম্ভব, যারা রোগটির নামই শোনে নি কোনো দিন? আর কীভাবেই বা আফ্রিকার অসুস্থ লোকটি জানতে পারবে যে, তার রোগের চিকিৎসা রয়েছে চীন প্রজাতির এক গুল্মের মধ্যে?

    এ জন্যই এ রোগীর পক্ষে ভেলকিবাজ প্রতারক কবিরাজ দলের দেখা পাওয়া বিচিত্র নয়; যারা এর সফল চিকিৎসা জানে বলে দাবি করবে। তখন সেও তাদের দাবি মেনে না নিয়ে পারে না উপায়ন্তর হয়ে বা ঠেকায় পড়ে। কদাচিৎ দেখা যায় অজ্ঞাত কারণে সে আরোগ্যও লাভ করল। তখন সে আল্লাহর দান এ সুস্থতাকে এসব ভণ্ড কবিরাজেরই কৃতিত্ব বলে মনে করে। তারপর লোকেরা এ রোগের জন্য নিয়মিত তার শরণাপন্ন হতে লাগে। পরবর্তীতে এ থেকেই নানা গল্প ও উপকথা বিস্তার লাভ করে তা ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

    এভাবেই বস্তুজগতের অনেক কিছুই অনুদ্ঘাটিত ও অবোধ্য থেকে যায়। পরবর্তীতে সেসবই উৎসে পরিণত হয় নানা ভিত্তিহীন কথা ও সংস্কারের। এমনটি হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতি যুগে প্রতি কালেই।

    আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সসীম করে। তেমনি মানুষকেও বানিয়েছেন সসীম জ্ঞানের অধিকারী করে। মানুষের জ্ঞানের এ সসীমতা ও অনুধাবন শক্তির সীমাবদ্ধতা তার ঘটনার গভীরে পৌঁছা এবং বস্তু জগতের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ নির্ভুল হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুনিচয়কে আমরা যতটা সরল দেখি আসলে তেমন নয়। বরং তা জটিলতর। এমনকি বলা যায়, এ মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই বিভিন্ন স্তর সমন্বয়ে সুগঠিত। সেই জ্ঞান বা তথ্য ছাড়া যা তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আমাদের পক্ষে এর কোনো স্তর ভেদ করা সম্ভব নয়। আর এ কাজ যেহেতু সর্বযুগে সর্বজন দ্বারা সম্ভব নয় তাই আমরা বলতে পারি, আমরা মানুষের জ্ঞানের ব্যাপারে এমন আশা করতে পারি না যে, তা বড় বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ হবে কিংবা সর্বজনগ্রাহ্য বা অদ্বিতীয় দর্শনের মতো কোনো গ্রহণযোগ্য মর্যাদায় উন্নীত হবে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমরা এবং আমাদের যা দেখা উচিত তার মাঝে বিদ্যমান যবণিকাকে যথাযথভাবে ছিঁড়ে ফেলার কোনো বিকল্প নেই।

    এদিকে নিরক্ষর ও মৌখিকভাবে শিক্ষিত পরিবেশে ব্যাপকভাবে দেখা যায় ভাবের শীর্ণতা এবং বোধের ক্ষুদ্রতা। আর যখন ভাব অনুসন্ধান করা হয় বা সীমিত ভাব পাওয়া যায় তখন আমাদের জ্ঞান হয় এমন কম্পিউটার সদৃশ যাতে কোনো প্রোগ্রাম সেট করা হয় নি অথবা এমন সৈন্যদলের মতো যার সব অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে কিংবা ওই যাঁতাকলের তুল্য যাতে কোনো গম দানা রাখা হয় নি। এভাবে সম্মান বোধের ত্রুটি মানুষকে এমন বানিয়ে ছাড়ে যে, সে অজ্ঞাতে সহজেই লাঞ্ছনা মেনে নেয়, স্বাধীন বোধের ত্রুটি এমন বানায় যে, তাকে সীমাহীন দাসত্বের শেকলে বেঁধে ফেলে এবং ব্যক্তিত্ব বোধের শূন্যতা তাকে এমন পর্যায়ে দাঁড় করায় যে, সে অপমান ও লাঞ্ছনার অবস্থানে থেকেও নিজেকে উন্নত ও সভ্য মনে করে! তখন বোধের উন্নতি ঘটানো এবং তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব সত্ত্বেও ওসব চিন্তাগত অভ্যাস সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই যেগুলো মানুষের জ্ঞানকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে দেয় না। এমন অভ্যাস অনেক হলেও আমি তার মধ্যে দু’টি উপস্থাপন করছি।

    ১. জ্ঞানীদের প্রতি অতি বিনয়: বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য আলেমদের চারপাশে এক অদৃশ্য মহিমাবৃত্ত থাকে। এ মহিমা বৃত্তের কারণে মানুষ তার বিরুদ্ধে যেতে ভয় পায়। তারা দূরে রাখে নিজেদেরকে তাদের সমালোচনা থেকে। দার্শনিক এরিস্টটল প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দী যাবত তার চিন্তা ও গবেষণাগত রাজত্ব অব্যাহত রেখেছিলেন। যদিও তার চিন্তা ও গবেষণায় ব্যাপক স্ববিরোধিতা ছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য যখন এই পণ্ডিত প্রবরের সমালোচনা করার সাহস করল তখন তারা দেখতে পেল, এরিস্টেটল ও গ্রিক উত্তরাধিকারের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসাটাই তাদের গবেষণার উৎকর্ষ, প্রযুক্তি ও শিল্পের অগ্রগতির বিস্ময়কর বর্তমানে এনে উপনীত করেছে। আর আমরা মুসলিমরা আমাদের কোনো বড় আলেম বা ইমামের নিষ্পাপ না হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাসে বলীয়ান হওয়ার পরেও তাঁদের অনেক মতামতকে যুক্তিগ্রাহ্য না হলেও আঁকড়ে থাকি এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশে ভয় করি। কেননা তারা নিষ্পাপ ছিলেন মনে করতে থাকি। আর এটাই ইজতিহাদের আন্দোলনকে শ্লথ ও গতিহীন করে দিয়েছে।

    যেসব ইতিহাস, ব্যক্তি বা উক্তিকে আমরা বিনা তর্কে মেনে নেই এবং প্রমাণ হিসেবে পেশ করি সেগুলোর ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞানের উৎকর্ষ থেকে কতটা প্রভাবিত হচ্ছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেমন ধরুন মেঘমালার উদ্দেশে উচ্চারিত বাদশাহ হারুনুর রশিদের উক্তি “তুমি যেখানেই বৃষ্টি বর্ষণ কর না কেন আখেরে তার ট্যাক্স আমার কাছে আসবেই।” বাক্যটি সরলার্থে ইসলামি সাম্রাজ্যের বিশালতা নির্দেশ করে। কিন্তু এর ভিন্নার্থও হতে পারে। তা হলো, বাগদাদের শাসনের কেন্দ্রীয়তা এবং সেখানে সম্পদের একত্রিত হওয়ার বাস্তবতা। কারণ, খারাজ এবং ট্যাক্স হিসেবে সব সম্পদ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা হয়। অথচ জানা কথা যে, তাঁর শাসন কিন্তু পুরোপুরি জনকল্যাণকর ছিল না। কারণ, সমগ্র বাগদাদ বা তার অধিকাংশ বাসিন্দা যখন সুখ-প্রাচুর্যের মধ্যে জীবন যাপন করছে তখন গ্রাম ও মফস্বলের জনগণ ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল। কিছু লোক আছে যারা ইসলামের ইতিহাসের কোনো পর্বের ব্যাপারেই কোনো মন্তব্য বা টিকা সংযোজনকে সমর্থন করেন না। তারা যে কোনো ইসলামি ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করতে ভয় পান। এসব ব্যক্তি মূলত ভ্রান্তির সাগরে হাবুডুবু খেতেই পছন্দ করেন। অথচ এরা মুসলিম জাতির সভ্যতার পশ্চাতপদতা এবং তাদের শাসক থেকে শাসিত জাতিতে পরিণত হওয়ারও কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নন।

    ২. প্রাচীনত্বের আধিপত্য: অনেক লোক মানুষের উক্তিকে সুগন্ধি কাঠি জ্ঞান করে যে তা যত পুরান হয় তত উত্তম ও অভ্রান্ত সাব্যস্ত হয়। বস্তুত এটা সত্য ও বাস্তবতা থেকে যোজন দূরে। কারণ, ইতিহাস আমাদের সামনে নিত্য উদ্ধার করছে নানা ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অসত্য উক্তি। আর আমরা মুসলিমরা তো মানুষের উক্তির সত্যাসত্য বিচারে সবচে বেশি সক্ষম, চাই তিনি প্রথম শতাব্দীর ব্যক্তি হোন আর দশম শতাব্দীর। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নির্ভুল ও অকাট্য অহি দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এর সঙ্গে আমি যোগ করব যে, অনেক উক্তিই ছিল মানবেতিহাসের শৈশব পর্যায়ের। তাই তা যথেষ্ট পরিপক্ক ছিল না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইদানীং কিছু লোক বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ উল্টো করে বিবেচনা করে যেমন যদি অশীতিপর বৃদ্ধ তার নেতৃত্বকে বিনীত করে সর্ব বিষয়ে দশ বছরের বালকের জন্য!

    শরী‘আতের প্রমাণাদি, জাগতিক জ্ঞান এবং বিস্তৃত অভিজ্ঞতাও কারো উক্তির মূল্য নির্ধারণ ও তার সমালোচনায় বড় মাইলফলক হতে পারে যখন সে হয় তার সমসাময়িক।

    সমাপ্ত