×
যে স্বভাব বৈশিষ্ট্যকে আকড়ে একজন মুসলিম প্রকৃত মুসলিমে পরিণত হবে, তা জানা ও লালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মনোযোগের দাবিদার। এ বিষয়ে সবিশেষ আলোকপাতধর্মী এ লেখাটি নানা কারণে পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও অবশ্য পাঠ্য বলে মনে হবে।

    মুসলিমের আদব বা শিষ্টাচার

    آداب المسلم

    <بنغالي>

    আহমদ আল-মাযইয়াদ/আদেল ইবন আলী আশ-শিদ্দী

    أحمد المزيد/عادل بن علي الشدي

    —™

    অনুবাদক: সাইফুল্লাহ আহমাদ

    সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    ترجمة: سيف الله أحمد

    مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

    মুসলিমের আদব বা শিষ্টাচার

    ইসলাম এমন কিছু উন্নত শিষ্টাচার, সুন্দর স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের ওপর মুসলিম সন্তানদের গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে, যেটা মুসলিম প্রজন্মের শিক্ষা প্রশিক্ষণ, লালন-পালন ও তাদের চরিত্র বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করে থাকে। কথা কাজের ক্ষেত্রে উন্নত পন্থা অবলম্বন, সৎ স্বভাব গ্রহণ ও ঘৃণিত তথা মন্দ স্বভাব পরিত্যাগে নির্দেশনা দিয়ে থাকে।

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য আদব তথা শিষ্টাচারের সকল দিকগুলোই বর্ণনা করেছেন। এমনকি যুদ্ধের ময়দানের শিষ্টাচার কি হবে, তাও বলে দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে যুদ্ধের সময় নারী-শিশু এবং যে সকল বৃদ্ধ যুদ্ধ করে না তাদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। বারণ করেছেন গির্জা ও আশ্রমে আশ্রয় গ্রহণকারী পাদ্রী, ধর্মযাজক ও সন্নাসী এবং শষ্যক্ষেত্রে চাষাবাদরত চাষীকে হত্যা করতে। এবং মৃতের দেহ বিকৃত করতেও নিষেধ করেছেন। এমনিভাবে আরো অনেক আদব রয়েছে।

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বলে দেওয়া শিষ্টাচার তথা আদবের মধ্যে রয়েছে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, নিদ্রা, স্ত্রী মিলন ও দাম্পত্য জীবনের আদব ছাড়াও অনেক বিষয়। এমনকি তিনি পায়খানায় প্রবেশের আদবও বলে দিয়েছেন, যেমন, সালমান ফারেসী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা এসেছে, তিনি বলেন, ‘মুশরিকরা আমাদেরকে বলে,

    «قَدْ عَلَّمَكُمْ نَبِيُّكُمْ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلَّ شَيْءٍ حَتَّى الْخِرَاءَةَ قَالَ: فَقَالَ: أَجَلْ لَقَدْ نَهَانَا أَنْ نَسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةَ لِغَائِطٍ، أَوْ بَوْلٍ، أَوْ أَنْ نَسْتَنْجِيَ بِالْيَمِينِ، أَوْ أَنْ نَسْتَنْجِيَ بِأَقَلَّ مِنْ ثَلَاثَةِ أَحْجَارٍ، أَوْ أَنْ نَسْتَنْجِيَ بِرَجِيعٍ أَوْ بِعَظْمٍ »

    “এ কেমন কথা! তোমাদের নবী তোমাদেরকে সকল কিছুই শিক্ষা দেন, এমনকি পায়খানা করার নিয়মও?! তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ! তিনি আমাদেরকে পায়খানা-প্রস্রাবের সময় কেবলামূখী অথবা কেবলাকে পিছনে দিয়ে বসতে বারণ করেছেন। ডান হাতে ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার, তিনটির কম পাথর ঢিলা হিসাবে ব্যবহার অথবা হাড় কিংবা গোবর দিয়ে ঢিলা ব্যবহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।”[1]

    ইসলামই হচ্ছে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা যা সমগ্র মানব জীবনের জন্য একটি নির্ভুল পদ্ধতি এঁকে দিয়েছে। যার মাঝে রয়েছে জীবনের প্রতিটি স্তর ও বিভাগের সুষ্ঠু সমাধান। এটা মানব রচিত কোনো জীবন বিধান নয় যে, তার মাঝে সত্য মিথ্যার সম্ভাবনা থাকবে; বরং এটা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত জীবন বিধান, যা তার অনুসারীদের জন্য দুনিয়ার জীবনে বয়ে নিয়ে আসে কল্যাণ, শান্তি ও মানুষিক স্বস্তি, আর কিয়ামতের কঠিন দিনে পুরস্কৃত করে তার চিরস্থায়ী সুখের জান্নাত। মহান আল্লাহ বলেন,

    ﴿ مَّا فَرَّطۡنَا فِي ٱلۡكِتَٰبِ مِن شَيۡءٖۚ ﴾ [الانعام: ٣٨]

    ‘‘আমরা কিতাবে (কুরআনে) কোনো কিছুই বাদ দেই নি।’’ [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৩৮]

    আত্মার সুষ্ঠু গঠন ও পরিশুদ্ধি এবং সুন্দর চরিত্র বিনির্মাণে নবুওয়াতী আদবের একটি সুন্দর প্রভাব ও সুদূর প্রসারী ফলাফল রয়েছে। নবুওয়াতী আদব তথা ইসলামী শিষ্টাচার জাতির জন্য এমন কিছু ধারাবাহিক প্রজন্ম উপহার দিয়েছে, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কুলুষতা, পবিত্রতা, আদল ইনসাফ, ব্যক্তিত্ব, লজ্জাশীলতা, দয়া দাক্ষিণ্য এবং শক্তি-সামর্থ ও বীরত্বে যাদের তুলনা ইতিহাসে বিরল। হতাশাগ্রস্থ মযলুমের সহযোগিতায় ও তাদের জুড়ি নেই। ইসলামী শিষ্টাচার ও নবুয়তী চরিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়াই হচ্ছে বর্তমান মুসলিম উম্মার দুর্বলতার কারণ। মুসলিম উম্মাহ যদি অপর জাতির দাস সূলভ অনুসরণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, যদি ফিরে আসে তাদের সক্বীয়তা এবং সত্যিকার ইসলামী শিষ্টাচারের দিকে, তাহলে অবশ্যই তাদের হারানো গৌরব, সম্মান ও মর্যাদা ফিরে আসবে। মুসলিম জাতি কি এ ব্যাপারটি অনুধাবন করবে?

    আমরা সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং দীনের সাথে মুসলিমের আদব সম্পর্কে জানতে পারবো, জানতে পারবো তার নিজের সাথে এবং প্রতিবেশীদের সাথে তার আচরণবিধি এমনকি অমুসলিম ও অন্যান্য জীব-জন্তুর সাথে ও তাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ, সে সম্পর্কেও জানতে পারবো।

    ১. নিয়তের আদব

    প্রতিটি মুসলিম-ই অবগত যে, নিয়তের একটি অসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। নিয়তের বিশুদ্ধতার ওপর নির্ভর করে কাজের গ্রহণযোগ্যতা। নিয়ত শুদ্ধ না হলে আমল তথা কাজও বাতিল হয়ে যায়। নিয়ত হচ্ছে কোনো কাজের জন্য প্রগাঢ় ইচ্ছা পোষণ। যখন এ ইচ্ছাটা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর আদেশ পালনার্থে হয়, তখনই তা হয় বিশুদ্ধ এবং এর থেকে বেরিয়ে আসে উত্তম ও গ্রহণযোগ্য আমল। যখন এই নিয়ত হবে দুনিয়ার জন্য, অথবা মানুষের প্রশংসা ও বাহবা অর্জনের জন্য, অথবা খ্যাতির জন্য অথবা আলোকিত বিশ্বে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অথবা অপর কোনো অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য, তখন নিয়তও বাতিল হয়ে যাবে এবং তার ফলে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল যোগ্য কাজই বের হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى»

    ‘‘নিশ্চয়্ই সকল আমলই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সেটাই রয়েছে যার জন্য সে নিয়ত করেছে।’’[2]

    2. আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের সাথে শিষ্টাচার

    1. একজন মুসলিম এটা ভালোভাবে অবগত যে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনই তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তাকে রিযিক দিয়েছেন, তিনিই তাকে সকল নি‘আমত দিয়েছেন এবং তার উপর থেকে সকল প্রকার কষ্ট বিদূরিত করেছেন। সুতরাং তাকে অবশ্যই তার রবের সাথে সর্বোচ্চ শিষ্টাচার প্রদর্শন করতে হবে।

    2. আল্লাহর সাথে শিষ্টাচারের অন্যতম একটি দিক হলো- তাঁর শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণ, আর তা হবে আদিষ্ট বিষয়াবলী পালন এবং নিষেধকৃত বিষয়াবলী বর্জনের মাধ্যমে।

    3. আল্লাহর সাথে আদবের মধ্যে শরী‘আত বিধৃত কোনো কাজের বিপক্ষে যুক্তি পেশ করা থেকে বিরত থাকা। মহান আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ ﴾ [الاحزاب: ٣٦]

    4. ‘‘কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা নারীর উচিৎ নয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দেওয়া ফয়সালার ওপর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।’’ [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৬]

    5. আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আরো বলেন,

    ﴿ إِنَّمَا كَانَ قَوۡلَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذَا دُعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ لِيَحۡكُمَ بَيۡنَهُمۡ أَن يَقُولُواْ سَمِعۡنَا وَأَطَعۡنَاۚ ﴾ [النور: ٥١]

    6. ‘‘মুমিনদের কথাতো এমনই হবে যে, যখনই তাদের মধ্যকার কোনো ফয়সালার জন্য তাদেরকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হবে, তখন তারা বলবে: শুনলাম এবং মানলাম।’’ [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫১]

    আল্লাহর সাথে আদব রক্ষার অপর একটি দিক হলো- তার নি‘আমাতের শুকরিয়া আদায় করা এবং তার স্ত্ততি করা, তাঁকে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং অধিক পরিমাণে দো‘আ করা এবং তাঁর সকল কাজেই তাঁর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করা, তাঁকে ভালোভালোবাসা, তাঁর সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, তাঁর কাছে সাওয়াব তথা পূণ্যের আশা করা, তাঁর মহান কিতাব পবিত্র কুরআন অধিক তিলাওয়াত করা, সকল প্রকার কবীরা ও সগীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।

    3. কুরআনের সাথে আদব বা শিষ্টাচার

    একজন মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার কিতাব কুরআনে কারীমের সাথে ও আদব রক্ষা করে চলবে, একে সম্মান করবে, সকল কথার ওপর এ কালামকে প্রাধান্য দিবে। এমনিভাবে সে কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন আহকাম, আদব ও আখলাক অনুসরণ করে চলবে। কুরআন তিলাওয়াতের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখবে।

    1. পরিপূর্ণ পবিত্রতার সাথে, কিবলার দিকে বসে অত্যন্ত সম্মানের সাথে তিলাওয়াত করা।

    2. কুরআনের আয়াত এবং তার অর্থ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করা।

    3. শুধু জানা বা আমলের জন্য নয় বরং ইবাদাতের নিয়তে তিলাওয়াত করা।

    4. অত্যন্ত ধীরে তারতীল সহকারে তিলাওয়াত করা, তাড়াহুড়া না করা।

    5. স্বতন্ত্র আহকাম হিসেবে কুরআন তিলাওয়াতের ও অধ্যয়নের নিয়ম শিক্ষা করা।

    6. সুন্দর স্বরে তিলাওয়াত করা এবং কিতাবের মর্যাদা বিবেচনায় বিনম্র ও ভদ্রভাব তথা খুশূ‘ ও খুযূ বজায় রাখা।

    4. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে শিষ্টাচার

    একজন মুসলিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথেও যথোচিৎ আদব রক্ষা করবে। কেননা তিনিই হলেন সর্বশেষ নবী, যাকে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য প্রেরণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আদব রক্ষা করার দিকগুলো হলো:

    1. তার আদেশের অনুগত হওয়া, এবং তিনি যে সকল কাজ থেকে নিষধ করেছেন এবং ধমকি দিয়েছেন, সেগুলো থেকে বিরত থাকা।

    2. অপরিহার্যভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোভালোবাসা।

    3. তাঁর সুন্নাতের অনুগত হওয়া এবং আদব আখলাক তথা শিষ্টাচারে তাঁরই মতো হওয়া।

    4. তাঁর আনিত বিধান জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে যে কোনো বিবাদের ক্ষেত্রে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء: ٦٥]

    “কখণও নয়, আপনার রবের কসম, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের বিবাদমান বিষয়ে আপনাকে বিচারক মানবে, এবং আপনার দেওয়া ফয়সালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনো খুঁত পাবে না, এবং সে ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তেও মেনে নেবে।’’ [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৪]

    5. তাঁর অনুগামী, সাহাবী ও বন্ধুদেরকে ভালোবাসা এবং তাদের শত্রুদেরকে ঘৃণা করা।

    5. স্বীয় আত্মার সাথে শিষ্টাচার

    1. একজন মুসলিম সর্বদা মনে মনে হিতোপদেশ এবং শিষ্টাচারের দিকগুলো স্মরণ করবে, যাতে করে পবিত্র ও উন্নত রাখতে পারে তার নফসকে। নিজ আত্নাকে প্রবৃত্তির ও লালসার পেছনে ছেড়ে দিবে না, যাতে সে স্খলিত হয়ে যায় এবং অন্যায় করে। যারা নিজেদের নফসের হিসাব নিজেরা রাখে এবং নফসের তদারকি করে, তাদের প্রশংসায় আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,

    ﴿ قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩ وَقَدۡ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا ١٠ ﴾ [الشمس: ٩، ١٠]

    ‘‘সেই সফলকাম যে নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে, আর সেই ক্ষতিগ্রস্ত যে আত্মাকে কলুষিত করেছে।” [সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৯, ১০]

    2. মুসলিম মা’সূম তথা বেগুনাহ নয়, বরং সে কখনো কখনো ভ্রান্তি ও গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায় কিন্তু মুসলিম হিসেবে তাকে নফসের সাথে জিহাদ করতে হবে, যাতে সে অবাধ্য গুনাহগার হয়ে না যায়। যদি ও কখনো তার আত্মা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে সে মুষড়ে পড়বে না। সে হতাশ হবে না। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে না; বরং সে আল্লাহর দরবারে ফিরে আসবে এবং দ্রুত তওবা করবে এবং গুনাহের জন্য তাঁর নফসকে ভৎর্সনা করবে। সম্ভব হলে নফসকে অনুমোদিত খাহেশ থেকেও বিরত রাখতে হবে, যাতে করে সে পরবর্তিতে কোনো গুনাহের নির্দেশনা দিতে না পারে।

    মনে রাখা দরকার, তওবা তিনটি জিনিসকে শামিল করে।

    v গুনাহ থেকে ফিরে আসা।

    v গুনার কাজের জন্য অনুশোচনা।

    v কৃতগুনাহের দিকে ভবিষ্যতে ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত।

    যখন মুসলিম সত্যিকারার্থে তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন, তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন, তার মন্দ কাজগুলো মিটিয়ে দেন তিনি বলেন,

    ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ ﴾ [التحريم: ٨]

    ‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা খালেসভাবে আল্লাহর কাছে তওবা কর সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করাবেন জান্নাতে যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’’ [সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৮]

    ৬. মানুষের সাথে শিষ্টাচার

    একজন মুসলিম তার কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচার আচরণে মানুষের সাথে শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে। কেননা স্তর বা মর্যাদার বিবেচনায় প্রতি শ্রেণির মানুষেরই পৃথক আদব তথা শিষ্টাচার রয়েছে। মানুষের সাথে আচার-আচরণে শিষ্টাচার প্রদর্শনের প্রকৃতি ও নমুনা নিম্নরূপ হওয়া উচিৎ:

    ১) মুসলিম তার পিতা-মাতার সাথে সর্বক্ষেত্রে আনুগত্য প্রদর্শন করবে, তবে আল্লাহর অবাধ্যতায় নয়। সে তাদেরকে সমীহ করবে, মর্যাদা দেবে, এবং তাদের অনুগত থাকবে। কথা-কাজে তাদেরকে সম্মান দেখাবে। তাদের সাথে কর্কশ আওয়াজে কথা বলবে না। তাদের উপরে নিজের আওয়াজকে উচুঁ করবে না। তাদেরকে নাম ধরে ডাকবে না, বরং তাদেরকে সম্বোধন করবে সম্মানজনক শব্দে। তাদের প্রতি যথোচিৎ ইহসানসুন্দর আচরণ করবে এবং তাদের প্রয়োজনে তাদের জন্য অর্থ ব্যয় করবে।

    ২) মুসলিম মাত্রই একথা জানে যে তার সন্তানদের ওপর তার কিছু কর্তব্য রয়েছে। যেমন, তাদের জন্য স্ত্রী নির্বাচন করা, যারা তাদের সন্তানদের মা হবে, আর সন্তানদের প্রতি পিতার কর্তব্য হচ্ছে তাদেরকে উওম লালন-পালন, শিক্ষা প্রশিক্ষণ, এবং তাদের ব্যয়ভার গ্রহণ করা এবং তাদের প্রতি কোমল আচরণ করা, এটা তারা উপযুক্ত হয়ে কর্মক্ষম হওয়া পর্যন্ত।

    ৩) আর মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক শিষ্টাচার এর স্বীকৃতি দিবে।

    আর এটা এমন কয়েকটি দায়িত্ব যা প্রত্যেকের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন, আল-কুরআনের বাণী,

    ﴿ وَلَهُنَّ مِثۡلُ ٱلَّذِي عَلَيۡهِنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ وَلِلرِّجَالِ عَلَيۡهِنَّ دَرَجَةٞۗ ﴾ [البقرة: ٢٢٨]

    ‘‘নারীদের উপর যেমন পুরুষদের ন্যায় সংগত অধিকার রয়েছে তেমনি অধিকার রয়েছে নারীদের স্বামীদের উপরও। তবে পুরুষদের অধিকার স্ত্রীদের উপর বেশি।’’ [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮]

    আর ইসলাম ধর্ম স্বামীকে তার স্ত্রীর সাথে নিম্নলিখিত শিষ্টাচার বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছে:

    ক. ধৈর্যশীলতা ও কোমল আচরণ: যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلْعٍ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلْعِ أَعْلَاهُ، إِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ، اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا»

    ‘‘তোমরা মহিলাদের কল্যাণ কামনা করবে। কেননা তাদেরকে পাজর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি পাজরের কোনো একটি বেকে যায় তাহলে এটা আরো চওড়া হয়ে যাবে। তুমি এটাকে সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে। আর তুমি এটাকে ছেড়ে দিলে সর্বদাই বাকা থাকবে। সুতরাং মহিলাদের ক্ষেত্রে কল্যাণ কামনা কর।”[3]

    খ. ন্যায় সংগতভাবে তার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করা: এটা ইসলাম ধর্ম স্বামীর উপর ওয়াজিব করে দিয়েছে।

    গ. তার সাথে সদাচরণ করা: যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «خِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ»

    ‘‘তোমাদের সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’’[4]

    ঘ. তাকে ভালোবাসা এবং ঘৃণা না করা: যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী রয়েছে,

    «لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً، إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ»

    ‘‘কোনো মুমিন স্বামী যেন কোনো মুমিন স্ত্রীকে পৃথক না করে। যদি সে তার কোনো একটি আচরণ অপছন্দ করে তাহলে অপর একটি আচরণ তার পছন্দ হবে।’’[5]

    ঙ. ন্যায় বিচার করা এবং অত্যাচার না করা।

    চ. অশ্লীল কর্ম হতে পবিত্রকরণ এবং উপভোগের অধিকার দেওয়া।

    ছ. তার গোপনীয় কথা প্রকাশ করা হারাম।

    জ. তার পদস্খলন ও দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করা হারাম।

    ঝ. তাকে শিক্ষা দেওয়া এবং সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা।

    ঞ. তার সাথে খেলা করা এবং তাকে ভালোবাসা। যেমনিভাবে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «خَرَجْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ وَأَنَا جَارِيَةٌ لَمْ أَحْمِلِ اللَّحْمَ وَلَمْ أَبْدُنْ»، فَقَالَ لِلنَّاسِ: «تَقَدَّمُوا» فَتَقَدَّمُوا، ثُمَّ قَالَ لِي: «تَعَالَيْ حَتَّى أُسَابِقَكِ» فَسَابَقْتُهُ فَسَبَقْتُهُ، فَسَكَتَ عَنِّي، حَتَّى إِذَا حَمَلْتُ اللَّحْمَ وَبَدُنْتُ وَنَسِيتُ، خَرَجْتُ مَعَهُ فِي بَعْضِ أَسْفَارِهِ، فَقَالَ لِلنَّاسِ: «تَقَدَّمُوا» فَتَقَدَّمُوا، ثُمَّ قَالَ: «تَعَالَيْ حَتَّى أُسَابِقَكِ» فَسَابَقْتُهُ، فَسَبَقَنِي، فَجَعَلَ يَضْحَكُ، وَهُوَ يَقُولُ: «هَذِهِ بِتِلْكَ»

    “আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কোনো এক ভ্রমনে বের হলাম। তখন আমি ছোট বয়সী ছিলাম, মেদবহুল ছিলাম না, ভারী বা মোটা ছিলাম না। অতঃপর তিনি লোকজনকে বললেন, ‘‘তোমরা অগ্রসর হও।’’ অত:পর তারা অগ্রসর হলো। অত:পর আমাকে বললেন: ‘‘এদিকে আস। আমি তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করব তারপর আমি তার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করলাম। এ্বং আমি বিজয়ী হলাম। তখন তিনি চুপ হয়ে গেলেন। অত:পর যখন আমার মেদ বেড়ে গেল, আমি মোটা হয়ে গেলাম এবং পূর্বের ঘটনা ভুলে গিয়েছিলাম তখন আমি তাঁর সাথে কোনো এক ভ্রমণে বের হলাম। তিনি মানুষকে বললেন, ‘‘তোমরা অগ্রসর হও।’’ তারা অগ্রসর হয়ে গেল। পরে আমাকে বললেন, আয়েশা তুমি এসো আমি তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করবো। দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে তিনি বিজয়ী হলেন। তারপর তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, ‘‘এটি প্রথমবার তোমার বিজয়ের প্রতিশোধ।’’[6]

    ইনিই হচ্ছেন দীন ইসলামের নবী এবং এটাই তার স্ত্রীর সাথে আচরণ।

    ৪. মুসলিম ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয় ও রক্ত সম্পর্কীয় লোকদের সাথে ভদ্র সুলভ আচরণ করবে। তারা আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সে আত্মীয়তা বজায় রাখবে। তারা তাকে বিরক্ত করলেও সে তাদের সাথে সদাচরণ করবে। তারা তার সাথে দুর্ব্যবহার করলে সে তাদের সাথে সৎ ব্যবহার করবে।

    সে তাদের বড়দের সম্মান করবে এবং ছোটদের স্নেহ করবে। তাদের রোগীদের সেবা করবে এবং তাদের বিপদগ্রস্থ লোকদেরকে সমবেদনা জানাবে। এবং তাদের বিপদ আপদে এগিয়ে আসবে। কেননা আল্লাহর বাণী,

    ﴿ وَءَاتِ ذَا ٱلۡقُرۡبَىٰ حَقَّهُۥ وَٱلۡمِسۡكِينَ وَٱبۡنَ ٱلسَّبِيلِ ﴾ [الاسراء: ٢٦]

    ‘‘আত্মীয়কে তার অধিকার দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও পথিককে.... ।’’ [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৬]

    ৫. ইসলাম প্রতিবেশীদের হক নির্ধারণ করে দিয়েছে যেমনিভাবে নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে।

    এগুলো হচ্ছে, তাদের সাথে কথায় কাজে সদাচরণ করা এবং তাদেরকে কষ্ট না দেওয়া এবং তাদের ক্ষতি হবে এমন কোনো বিষয়ে জড়িত না হওয়া। তাদের সম্মান করা, সাক্ষাতে হাসিমুখে কথা বলা, তাদের খোজ খবর নেওয়া, তাদেরকে উপহার দেওয়া এবং তাদের মূল্যায়ন করা। ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করা। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ، حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ»

    ‘‘জিবরীল সর্বদাই আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অসিয়ত করতেন এমনকি আমি ধারণা করলাম যে, তিনি অচিরেই তাকে (প্রতিবেশীকে) উত্তরসূরী করে দিবেন।’’[7]

    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,

    «مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ جَارَهُ»

    ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে।’’[8]

    ৭. একজন মুসলমানের অপর মুসলিমের ওপর হক বা অধিকার। এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের প্রতি অনেক অধিকার রয়েছে। যেমন,

    ক. যখন তার সাথে দেখা করবে তখন তাকে সালাম দিবে এবং সে সালাম দিলে তার সালামের উত্তর দিবে, আর ইসলামের অভিবাদনের নিয়ম হচ্ছে: ‘‘আস্সালামু আলাইকুম’’

    খ. যখন সে হাঁচি দিবে তখন তার হাঁচির জবাব দিবে, যখন হাঁচি দাতা হাঁচির পরে ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর’ বলবে তখন তার হাঁচির জবাব হচ্ছে, ‘ইয়ারহামুকালল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ আপনাকে দয়া করুন’। আবার হাঁচিদাতা তার প্রতি উত্তরে বলবে, ‘ইয়াহদি কুমুল্লাহু ওয়াইয়ুসলিহু বা-লাকুম’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন ও আপনার বিষয়াদি সুন্দর করে দিন’।

    গ. অপর ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে।

    ঘ. সে তার মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করবে এবং তাকে লাঞ্ছিত বা অসম্মান করবে না। যেখানে সে তার সাহায্য-সহযোগিতা দরকার সেখানে তাকে সাহায্য করবে।

    ঙ. যে কোনো ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দিবে।

    চ. রুগ্ন হলে তার সেবা করবে বা দেখা করবে এবং মারা গেলে তার দাফন কাফন ও জানাযাতে অংশ গ্রহণ করবে।

    ছ. তার সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। কখনও অহংকারী হবে না।

    জ. তার গীবত বা পিছনে নিন্দা করবে না। তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না। তাকে উপহাস করবে না। তার দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করবে না। তার প্রতি কোনো ধরনের অপবাদ দিবে না। তাকে ধোকা দেবে না, প্রতারণা করবে না। তাকে গালি দেবে না। তাকে হিংসা ও ঘৃণা করবে না। তার প্রতি মন্দ ধারণা করবে না। তার গোপনীয় বিষয় জানার জন্য গোয়েন্দাগীরি করবে না। তার সাথে খিয়ানাত করবে না এবং তিন দিনের বেশি তার সাথে রাগ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখবে না।

    ঝ. তার পদস্খলন বা ত্রুটি ক্ষমা করবে। তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে। তার পিছনেও তার সম্মান রক্ষা করবে। তার প্রতি ন্যায় বিচার করবে এবং তার সাথে এমন আচরণই করবে যা সে পছন্দ করে। সে বড় হলে শ্রদ্ধা করবে। ছোট হলে স্নেহ করবে। সাহায্যের প্রয়োজন হলে তাকে সাহায্য করবে।

    ৮. অমুসলিমদের সাথে শিষ্টাচার

    যে আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি কুফুরী করে তাকে মুসলিম ঘৃণা করবে, তার প্রতি বন্ধুত্বপোষণ করবে না তাকে ভালোবাসবে না। অনুরূপভাবে তার কুফুরীতে সে সন্তুষ্ট হবে না এবং তাকে কুফুরী মেনে নেবে না।

    এতদসত্বেও সে তার প্রতি অত্যাচার করবে না; বরং তার সাথে ন্যায়পরায়ণতা দেখাবে ও ইনসাফ করবে। অনুরূপভাবে সে তার মাল, জীবন ও সম্মানের ক্ষেত্রে আঘাত হানবে না। তাকে কষ্ট দেবে না, যদি সে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে জড়িত না থাকে।

    এমনিভাবে সে তার সাথে সাধারণত: দয়া ও করুণা দেখাবে। যেমন, ক্ষুধার্থ হলে তাকে খাওয়াবে, পিপাসিত হলে পান করাবে, রুগ্ন হলে সেবা করবে, তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوا أَهْلَ الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ»

    ‘‘করুনাশীলদেরই রাহমান (দয়াময় আল্লাহ) করুনা করেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর করুণা কর। তাহলে আকাশবাসী তোমাদের ওপর করুণা করবেন।’’[9]

    এমনিভাবে অমুসলিমদের উপঢৌকন দেওয়া ও তার উপহার গ্রহণ করা ও তার খাবার গ্রহণ করা জায়েয যদি সে আহলে কিতাব (ইয়াহূদী বা খৃষ্টান) হয়।

    এগুলো মুসলিমের চরিত্র এবং শিষ্টাচার তার ধর্ম বিরোধী লোকেদের সাথে। তাহলে তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে তার আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ?

    ৯. জীবজন্তুর অধিকার

    জীব-জন্তুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শত শত বৎসর পূর্বেই ইসলাম জীবজন্তুর জন্য অধিকার নিরূপণ করেছে। তম্মধ্যে:

    ১. ক্ষুধায় ও পিপাসায় খাদ্য ও পানীয় প্রদান।

    ২. তার প্রতি দয়া ও মহানুভবতা দেখানো এবং তার কষ্ট হয় এমন ব্যবহার না করা।

    ৩. হত্যা বা যবেহ করার সময় তাকে কষ্ট না দেওয়া। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «إِنَّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ»

    ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক সকল জিনিসের প্রতি সদাচারণ করাকে ফরয করে দিয়েছেন। অতএব, যখন তোমরা হত্যা করবে তখন সুন্দর পন্থায় হত্যা করবে। আর যখন যবেহ করবে তখন সুন্দর করে যবেহ করবে। তোমাদের প্রত্যেকেই যেন তার ছুরিকে ধার দিয়ে নেয় এবং পশুকে প্রশান্তি দেয়।’’[10]

    ৪. তাকে কোনো প্রকার শাস্তি দেবে না। চাই তা বুভুক্ষু রাখার মাধ্যমে হোক বা প্রহার করে হোক অথবা তার দ্বারা অসম্ভব এমন বোঝা বহন করে হোক অথবা তার অংগচ্ছেদ করে অথবা তাকে আগুনে পুড়িয়ে কষ্ট দেওয়া হোক। সবগুলোই ইসলামে নিষিদ্ধ। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «دَخَلَتِ امْرَأَةٌ النَّارَ فِي هِرَّةٍ رَبَطَتْهَا، فَلَمْ تُطْعِمْهَا، وَلَمْ تَدَعْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الأَرْضِ»

    “এক মহিলা একটা বিড়ালকে কষ্ট দেওয়ার কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করেছে, সে তাকে আটকিয়ে মেরেছিলো তাকে খেতে দেয় নি তাকে পানীয় পান করতে দেয় নি, এমনকি তাকে ছেড়েও দেয় নি যাতে সে জমিনের ঘাস খেতে পারত।”[11]

    সমাপ্ত

    [1]. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬২

    [2]. সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯০৭

    [3]. সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৩৩১, ৫১৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪৬৮

    [4]. সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৯৭৮

    [5]. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪৬৯

    [6] . সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ২৫৭৮

    [7] . সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৪১

    [8] . সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০১৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৭

    [9]. সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৯৪১

    [10]. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৫৫

    [11]. সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ৩৩১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ২৬১৯