×
বক্ষ্যমান প্রবন্ধে আল-কুরআনের অর্থানুবাদের জন্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

    বাংলা ভাষায় আল-কুরআনের বিশুদ্ধ অর্থানুবাদ: কিছু ভাবনা

    خواطر حول كيفية الوصول إلى ترجمة صحيحة لمعاني القرآن الكريم إلى اللغة البنغالية

    [ بنغالي – Bengali – বাংলা ]

    মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

    محمد شمس الحق صديق

    —™

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    বাংলা ভাষায় আল-কুরআনের বিশুদ্ধ অর্থানুবাদ: কিছু ভাবনা

    আল-কুরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ, বিষয়টি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আল-কুরআনের প্রকৃত স্বাদ-মর্ম-গন্ধ, আল-কুরআনের বাণী -সমগ্রের মৌল সুর-অলংকার-ঝংকার, অর্থের ব্যাপ্তি, বর্ণনা-পদ্ধতির নৈপুণ্য ও ইজায-অলৌকিকত্ব ইত্যাদির সঠিক অনুধাবন আরবী ভাষায় এই মহান গ্রন্থের পাঠ উদ্ধার ব্যতীত সম্ভব নয় -এ কথাটিও কোনো তর্কের অবকাশ রাখে না, তবে যেহেতু আল-কুরআন বিশ্বমানবতার একমাত্র মুক্তির সনদ এবং এতে সংরক্ষিত বয়েছে রাব্বুল আলামীনের অবিকৃত অহী, যা মানুষকে দিশা দেয় স্বচ্ছ-সরল পথের, উপস্থাপন করে পূর্ণাঙ্গতম জীবন ব্যবস্থার, বাতলে দেয় পরকালীন মুক্তি ও অনন্ত সৌভাগ্যের পথ-পদ্ধতি, আল-কুরআনের অর্থ ও ভাবা-দর্শ, তাই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়া একটি অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব বলে বিবেচিত।

    এ দায়িত্ব বাংলা ভাষার পরিমণ্ডলে, পালনের জন্য ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রয়াসী হয়েছেন অনেকেই, তবে বিশুদ্ধতার বিচারে অধিকাংশ প্রয়াস মানোত্তীর্ণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া দুষ্কর। অপূর্ণতা রয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। আরবী ভাষায় জ্ঞান রাখেন এমন যে কোনো ব্যক্তির কাছেই বহু অনুবাদ অতৃপ্তিকর বলে মনে হয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নীতি-আদর্শের অনুবর্তীতার ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় খুঁজে পাওয়া যায় কোথাও কোথাও, বিশেষতঃ সিফাত বিষয়ক শব্দমালার তাবীল না করার আবশ্যকতা বিষয়ে। সে হিসেবে আল-কুরআনের একটি বিশুদ্ধ অর্থানুবাদ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের হাতে আসা বহু দিনে প্রতীক্ষিত একটি বিষয়।

    তবে এই অনুবাদকর্ম যাতে সত্যিকার অর্থে, সকল দিক থেকে, মানোত্তীর্ণ হয় তার জন্য কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখা জরুরি বলে মনে করি।

    1. আল-কুরআনের অর্থানুবাদ কোনো অর্থেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বিষয়টি বরং দুঃসাধ্য না বললেও অনেকাংশেই জটিল ও কষ্টসাধ্য। কেননা অনুবাদকর্মে আরবী শব্দমালার সঠিক অর্থ উঠে না এলে তা প্রকারান্তরে বিকৃতি সাধন বলে বিবেচিত হবে, যা নিঃসন্দেহে মারাত্মক অপরাধ। অল-কুরআনের অর্থানুবাদে, তাই অবলম্বন করতে হয় সর্বোচ্চ সতর্কতা, অর্থাৎ তাকওয়া ও আল্লাহভীতির সর্বোচ্চ দাবি পূরণ করেই হাত দিতে হয় আল-কুরআনের অর্থানুবাদে।
    2. অনুবাদকর্ম যথার্থ ও নির্ভুল হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হলো, উভয় ভাষায় সমানভাবে পারঙ্গম হওয়া। আল-কুরআনের ক্ষেত্রে যেহেতু তা আল্লাহর কালাম, আরো কিছু শর্তের দাবি পূরণ জরুরি। আল-কুরআনের তদানীন্তন ব্যবহার বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজনে সেকালের আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি বলে মনে করি। প্রতিটি শব্দের অর্থ উদ্ধারের জন্য, তাই জাহেলী যুগের কবিতা সমগ্রের পাঠ উদ্ধারে সক্ষম হওয়া আবশ্যক। আরবী ব্যাকরণ (নাহু, সারফ) অলংকারশাস্ত্র (বালাগত) ও ভাষাবিজ্ঞান (ইলমুল লুগাহ) সম্পর্কেও ধারণা থাকা আবশ্যক, তবে ভাষাগত পাঠোদ্ধার আল-কুরআনে ব্যবহৃত শব্দমালার অর্থ ও ভাব নির্ণয়ে যথেষ্ট নয় -এ কথাও মনে রাখা দরকার। (আদ্দালালাতুল লুগাবিয়াহ, দালালাহ যান্নিইয়াহ) অর্থাৎ কেবল অভিধানলব্ধ অর্থ ও ভাব অকাট নয় বলে একটি কথা আছে। তাই আল কুরআনে ব্যবহৃত শব্দমালার সঠিক অর্থ নির্ধারণে, نص (নস) -এ ক্ষেত্রে হাদীস ও সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম-এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় নেওয়া বাঞ্ছনীয়। সে হিসেবে অনুবাদককে হাদীস বিষয়েও পারদর্শী হওয়া প্রয়োজন। أسباب النزول বা বিশেষ কোনো সূরা অথবা আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ ও পরিবেশ সঠিক অর্থ নির্ধারণে সহায়তা দেয়। তাই আসবাসে নুযুল ও কুরআনিক টেক্সট-এর সামগ্রিক পরিবেশ বিষয়েও সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তবে সুখের ব্যাপার হল, পূর্ববর্তী তাফসীরবেত্তা ও কুরআন-গবেষকগণ এ বিষয়গুলোর কোনোটিই পরিত্যাগ করেন নি। তাদের অক্লান্ত মুজাহাদায় লব্ধ ফলাফলসমূহ গ্রন্থভুক্ত হয়ে আমাদের হাতে পৌঁছায়, বলা যায়, অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে আমাদের দায়িত্ব পালন। নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন ব্যাখ্যা গ্রন্থের আশ্রয়ে, বর্তমানে, অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করা সম্ভব। অন্য কথায় বলতে গেলে, সম্পূর্ণ অর্থে মৌলিক অনুবাদকর্ম প্রডিউস করা আমাদের পক্ষে খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলেও, নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থসমূহরে আশ্রয়ে আংশিক অর্থে মৌলিক অনুবাদ প্রডিউস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রেও, অলঙ্ঘনীয় শর্ত হিসেবে থাকবে মূল ভাষায় বিভিন্ন তাফসীরের পাঠোদ্ধারের সক্ষমতা। এর অন্যথা হলে মৌলিক অনুবাদের সম্ভাব্যতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

    আরবী ভাষার রয়েছে নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি, বাক্যশৈলী, তান ও গতি। বাংলাভাষারও তাই। উর্দু ও পারসিক ভাষার বিপরীতে আরবী ও বাংলার মধ্যবর্তী দূরত্বও বিস্তর। সে হিসেবে বাংলায়, আরবীর অনুবাদককে পরিশ্রম করতে হয় প্রচুর। আর সেটি যদি আল-কুরআন সংক্রান্ত হয়, তবে তো কথাই নেই। আর নিখুঁত অর্থবোধক হওয়ার পাশাপাশি যদি সাবলীলতার প্রশ্ন আসে তবে তো বিষয়টি আরো জটিল হয়ে দাঁড়ায়। বলা যায়, এ জটিলতাকে অতিক্রম করাই হবে আমাদের প্রধান কাজ। অর্থাৎ আল কুরআনের শব্দমালার নিখুঁত ভাব ও অর্থ সাবলীল ভঙ্গিমায় অভিব্যক্তি ঘটাতে প্রয়াসী হওয়া। বাংলা ভাষার কলকব্জা বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখেন ও সাহিত্য রস সঞ্চারে দক্ষতা রাখেন এমন ব্যক্তির পক্ষেই মূলত মৌল, প্রাঞ্জল, সাবলীল অনুবাদ করা সম্ভব।

    1. অনুবাদকর্মে স্পষ্টতা অত্যন্ত জরুরি। কেননা আল-কুরআন বোধগম্য ভাষায় নাযিল হয়েছে। হ্যাঁ, যেখানে কঠিন শব্দ ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই সেখানে কঠিন শব্দের ব্যবহার দোষের কিছু হবে না। যেমন, ثم استوى على العرش আয়াতাংশের অনুবাদ ‘অতঃপর তিনি ‘আরশের ঊর্ধ্বস্থিত হলেন’ দিয়ে করলে যথার্থভাবে استوى على العرش - এর অর্থ উঠে আসে।
    2. আল-কুরআনের অর্থানুবাদের ক্ষেত্রে معاني الأدوات ‘অব্যয়সমূহের অর্থ’ জানা অবশ্য জরুরি। এ ক্ষেত্রে ইমাম সুয়ূতীর আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআনের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। শব্দে, বাক্যে অথবা বাক্যাংশে নানা ভাব প্রয়োগ, ব্যাকরণের ধারা অনুসরণ ইত্যাদির প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় حروف ، أسماء، و أفعال ،وظروف জাতীয় নানা আদাওয়াত, অব্যয়। ব্যবহার স্থলের ভিন্নতা অনুযায়ী এগুলোর অর্থও ভিন্ন হয়। সে হিসেবে এগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা অবশ্য প্রয়োজন। উদাহরণত عن অব্যয়টি مجاوزة ، بدل ، تعليل، على، من، بعد ইত্যাদির অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই কোনো ক্ষেত্রে কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে ব্যাপারে ধারণা না থাকলে সকল ক্ষেত্রে ‘হতে’ বা ‘থেকে’ ইত্যাদি অর্থ করার সম্ভাবনা থেকে যায়।
    3. অনুবাদকর্মে বস্ত্তনিষ্ঠতার পরিচয় অবশ্যই জরুরি। নিজের মাযহাব, আপনকৃত ধ্যান-ধারণা, দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে, সকল প্রকার একগুঁয়েমি থেকে দূরে অবস্থান নিয়ে আল-কুরআনের অর্থ উদ্ধারে মনোনিবেশ করা বাঞ্ছনীয়।
    4. আকীদা বিষয়ে সঠিক ধারণার অনুবর্তীতা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিজ্ঞ ওলামাদের নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে।

    আল-কুরআনের অর্থানুবাদে হাত দেওয়া একটি অতি-গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দেওয়া। তাই এ ক্ষেত্রে তাকওয়া ও ঈমানদারির সর্বোচ্চ পরিচয় দেওয়া আবশ্যক বলে মনে করি।