যিয়ারতের বিধি-বিধান
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
যিয়ারতের বিধি-বিধান
আখতারুজ্জামান মুহাম্মাদ সুলাইমান
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
أحكام الزيارة
(باللغة البنغالية)
أختر الزمان محمد سليمان
مراجعة: د/ محمد منظور إلهي
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............
নিম্নবর্ণিত বিষয়াবলি বক্ষ্যমান প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে:
(১) যিয়ারতের প্রকারভেদ,
(২) যিয়ারতের আদব,
(৩) অনুমতি গ্রহণের রহস্য।
যিয়ারতের বিধি-বিধান
আল-হামদুলিল্লাহ ওয়াসসলাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ.....
যিয়ারতের প্রকারভেদ: যিয়ারত তিন প্রকার।
ক) বৈধ ও অনুমোদিত যিয়ারত:
প্রত্যেক ঐ যিয়ারত শরী‘আতে অনুমোদিত যার মাধ্যমে উপকার হয় অথবা যার মধ্যে জাতির কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং যা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসার উদ্দেশ্যে হয়। কখনো তা ফরয হয়ে থাকে যেমন, নিকট আত্মীয়ের যিয়ারত; আবার কখনো মুস্তাহাব। যেমন, আলেমদের সাথে সাক্ষাৎ।
এ ধরনের সাক্ষাতের কিছু উদাহরণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের মাঝে আমরা পাই যার দ্বারা এর মর্যাদা বুঝা যায়। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যিয়ারতের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِي اللَّهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ مَنْزِلًا»
“যে ব্যক্তি কোনো রুগীকে দেখতে গেল অথবা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার কোনো ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করল কোনো ঘোষণাকারী তখন ডেকে বলতে থাকে তুমি ভালো কাজ করেছো, তোমার চলা শুভ হোক এবং জান্নাতের মাঝে তুমি তোমার একটা ঘর বানিয়ে নিয়েছো।”[1]
খ) অবৈধ যিয়ারত:
প্রত্যেক ঐ যিয়ারত যার মাধ্যমে ধর্মীয় অথবা চারিত্রিক ক্ষতি হয়। যেমন, কোনো হারাম কাজের জন্য যিয়ারত করতে যাওয়া অথবা অহেতুক কোনো খেলার জন্য একত্রিত হওয়া। এগুলো শরী‘আতের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ।
গ) মুবাহ যিয়ারত:
এ এমন যিয়ারত যার দ্বারা কোনো ক্ষতি বা উপকার কিছুই হয় না এবং যার মাধ্যমে কোনো হারাম কাজও সঙ্ঘটিত হয় না। যেমন, শুধু সময় কাটানোর জন্য যিয়ারত করা অথবা মুবাহ কথাবার্তা বলার জন্য সাক্ষাৎ করা। তবে কোনো কোনো সাক্ষাৎ আছে যা প্রকৃত পক্ষে প্রশংসনীয় এবং জায়েয; কিন্তু তার সাথে এমন কিছু জড়িয়ে যায় যে তার মূল বিধানকেই পরিবর্তন করে দেয়। যেমন, সাক্ষাতের সাথে কোনো অন্যায় কাজ যুক্ত হয়ে গেল। এখানে আবশ্যক হলো ঐ নিষিদ্ধ কাজটি দূর করা যাতে সাক্ষাৎ তার নিজের অবস্থানে নিজ অবস্থানে ঠিক থাকে। যদি সেই নিষিদ্ধ কাজকে বাদ দেওয়া সম্ভব না হয় তখন উক্ত জায়েয সাক্ষাৎ নাজায়েযে পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং সাক্ষাৎ কারীকে তা বাদ দেওয়া জরুরী হয়ে যাবে।
যিয়ারতের আদবসমূহ:
যিয়ারতের অনেক আদব রয়েছে। যথা,
১। যিয়ারতের নিয়ত এবং উদ্দেশ্যকে সঠিক করতে হবে। যেমন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখার নিয়ত করা এবং তাদের অধিকার আদায় করা অথবা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত করবে বা সাক্ষাতের দ্বারা যে পুণ্য লাভ হয় তার নিয়ত করবে অথবা পরস্পরে উপদেশ গ্রহণের নিয়ত বা সময়কে কাজে লাগানোর নিয়ত করা ইত্যাদি।
২। সাক্ষাতের জন্য যথোপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা। পানাহারের নির্ধারিত সময়, আরাম অথবা ঘুমের সময় সাক্ষাৎ করা উচিৎ নয়। অনুরূপভাবে কারো নির্ধারিত কোনো সময় থাকে যখন কারো যিয়ারত সে পছন্দ করে না তখন সাক্ষাতের মাধ্যমে তার উপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া এবং বিরক্ত করা ঠিক নয়।
৩। যিয়ারতকারী অধিক সময় থেকে বা অন্য কোনো মাধ্যমে যার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে তাকে বিরক্ত করা ও তার কাজের ব্যঘাত ঘটানো উচিৎ নয়। হ্যাঁ, যদি সাক্ষাৎকারী জানতে পারে যে, তার সাথী অধিক সময় কাটানো অপছন্দ করেন না, তাহলে বিলম্ব করাতে দোষ নেই। সাক্ষাৎকারীকে তার সাথীর অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। হয়তো সে কোনো কাজে ব্যস্ত আছে বা কারো সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ আছে। আর এগুলো ব্যক্তির অবস্থা দ্বারা প্রকাশ পায়। যেমন, চেহারায় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে অথবা বারবার ঘড়ির দিকে তাকায় বা বারবার আসা যাওয়া করতে থাকে এবং কখনো প্রকাশ্যেই বলে যে আমি ব্যস্ত। তখন সাক্ষাৎকারী অনুমতি নিয়ে বের হয়ে আসবে।
৪। সাক্ষাৎকারী সাজগোজ করে পরিপাটি হয়ে যিয়ারতে আসবে, সাথে সাথে নিজ পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বেশ-ভূষা বিন্যস্ত করে নিবে। সুগন্ধি ব্যবহার করে নিজের দুর্গন্ধ দূর করবে।
৫। সাক্ষাৎপ্রার্থী অনুমতি প্রার্থনা করলে সাক্ষাৎদাতার অনুমতি দেওয়া ও না দেওয়া উভয়টিরই অধিকার রয়েছে। এখন যদি তিনি সাক্ষাতের অনুমতি না দিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন তাহলে সাক্ষাৎপ্রার্থীর সেটি সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা ও মনে কষ্ট নেওয়া বা তার সম্পর্কে মনে বিরূপ ভাব পোষণ করা ঠিক হবে না। কারণ, কখনো কখনো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ করতে হয়।
আল্লাহ বলেন,
﴿وَإِن قِيلَ لَكُمُ ٱرۡجِعُواْ فَٱرۡجِعُواْۖ هُوَ أَزۡكَىٰ لَكُمۡۚ﴾ [النور: ٢٨]
“তোমাদেরকে যদি বলা হয় ফিরে যাও, তবে ফিরে যাবে। এটি তোমাদের জন্য পবিত্রতর।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ২৮]
কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, কোনো কোনো মুহাজির বলেছেন, সারা জীবন (অন্তত একবারের জন্যে হলেও) এ আয়াতের ওপর আমল করতে চেয়েছি; কিন্তু পারি নি, আমার কোনো ভাইয়ের নিকট প্রবেশের অনুমতি চেয়েছি, অতঃপর তিনি বলেছেন ফিরে যাও আমি ফিরে এসেছি আর আমার হৃদয় তার ওপর সন্তুষ্ট।
৬। সাক্ষাৎকারীর কর্তব্য হলো: ঘরে প্রবেশ করে দৃষ্টি সংযত রাখবে, কানের হিফাযত করবে এবং অসংগত ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। বাড়িওয়ালা যেখানে বসতে বলবে সেখানে বসবে তার অনুমতি ছাড়া বের হবে না। যখন বের হবে সালাম দিবে।
৭। অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে প্রবেশ করা কারো পক্ষেই জায়েয নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَدۡخُلُواْ بُيُوتًا غَيۡرَ بُيُوتِكُمۡ حَتَّىٰ تَسۡتَأۡنِسُواْ وَتُسَلِّمُواْ عَلَىٰٓ أَهۡلِهَاۚ ﴾ [النور: ٢٧]
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যদের গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে সালাম না করে প্রবেশ করো না।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ২৭]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا اسْتَأْذَنَ أَحَدُكُمْ ثَلاَثًا فَلَمْ يُؤْذَنْ لَهُ فَلْيَرْجِعْ»
“তোমাদের কেউ তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর অনুমতি না মিললে ফিরে আসবে।”[2]
অনুমতি চাওয়ার এ বিধান আরোপের তাৎপর্য:
ক) ঐ সময় বাড়িতে কারো প্রবেশ করা বাড়িওয়ালাদের জন্য কষ্টের কারণ হতে পারে, তাই অনুমতি চাওয়ার এ বিধান দেওয়া হয়েছে যাতে বাড়িওয়ালা অবাঞ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে।
খ) এর মাধ্যমে ঘরের গোপন বিষয়গুলো সংরক্ষিত থাকবে। ঘরের লোকদের পর্দা হবে।
গ) অনুমতি প্রার্থনা দ্বারা হঠাৎ প্রবেশের মাধ্যমে ঘরের লোকদের ঘাবড়ে যাওয়া থেকে নিরাপত্তা লাভ হয়।
৮। অনুমতি প্রার্থনার গুরুত্ব অনেক আর তাই তার কিছু আদব এবং বিধান রয়েছে:
ক) অনুমতি প্রার্থনার বৈধ পদ্ধতি হচ্ছে তিনবার প্রার্থনা করবে, যদি অনুমতি দেয় তো প্রবেশ করবে অন্যথায় ফিরে আসবে। অনুমতি প্রার্থনার সময় একবার অনুমতি চাওয়ার পর পাওয়া না গেলে সামান্য বিরতি দিয়ে পরের বার চাইবে অর্থাৎ মাঝখানে কিছু সময় বিরতি দিয়ে অনুমতি চাইবে।
খ) অনুমতি প্রার্থনাকারীর দরজায় কড়াঘাত বা শব্দ করে ডাক দেওয়াটা অত্যন্ত ভদ্রচিত ও কমলতার সাথে হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ»
“কমলতা ও নম্রতা যার সাথেই যুক্ত হবে সেই সুন্দর ও মর্যাদাবান হবে, আর যার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে সেই অসুন্দর ও অসম্মানিত হবে।”[3]
গ) যখন বলা হবে: দরজায় কে? বলবে! অমুকের পুত্র অমুক নিজের ঐ নাম বলবে যার দ্বারা সহজে চেনা যায়। বলবে না ‘আমি’। কেননা এই শব্দ প্রত্যেকের ওপর বর্তায়। সে বুঝতে পারবে না যে কে দরজা নাড়া দিচ্ছে। জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে এসেছে তিনি নবীর দরজা নাড়া দিলেন নবী বললেন, কে?
«فَقُلْتُ: أَنَا، فَقَالَ: أَنَا أَنَا، كَأَنَّهُ كَرِهَهَا»
“আমি বললাম, ‘আমি’। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি’ ‘আমি’। মনে হয় তিনি অপছন্দ করলেন।”[4]
ঘ) অনুমতি প্রার্থনাকারী দরজার একেবারে সামনে দাঁড়াবে না, ডানে অথবা বামে সরে দাঁড়াবে, দরজা খুললেই যাতে বাড়ির ভিতরের অবস্থা সামনে এসে না পড়ে।
ঙ) অনুমতি প্রার্থনার বিষয়টি ব্যাপক, প্রত্যেকের জন্যেই সর্বাবস্থায় এটি প্রযোজ্য। সুতরাং কেউ যদি নিজের পিতার ঘরে বা মায়ের ঘরে বা বোনের ঘরে প্রবেশ করতে চায় তখনও অনুমতি নিতে হবে।
চ) অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে নারীরাও পুরুষের মতো, উভয়ের জন্যে একই বিধান প্রযোজ্য। অনেক নারীরা এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করে থাকেন, ঘরে অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেন। এটি মানুষের মাঝে বহুল প্রচলিত ভুলের মধ্য থেকে একটি।
সমাপ্ত