×
আত্মসমালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। বক্ষমান প্রবন্ধে আত্মসমালোচনার নিম্নবর্ণিত দিকসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ১/ মুহাসাবার অর্থ, ২/ মুহাসাবার ধরন, ৩/ মুহাসাবার সহায়ক উপকরণসমূহ, ৪/ সালাফে সালেহীনদের মুহসাবার ধরন, ৫/ মুহাসাবার ফলাফল, আশা পাঠক মাত্রই এর মাধ্যমে উপকৃত হবেন।

    মুহাসাবা

    المحاسبة

    [ بنغالي – Bengali – বাংলা ]

    নু‘মান ইবন আবুল বাশার

    نعمان بن أبو البشر

    —™

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    মুহাসাবা

    আল-মুহসাবা ও শাব্দিক অর্থ আত্মসমালোচনা। নিজের হিসাব নিজে করে নেওয়া। পরিভাষায় মুহাসাবা শব্দের অর্ধ হলো, মানুষ তার কৃতকর্ম ও কথাগুলোর প্রতি তাকাবে। যখন দেখবে সে কোনো ভালো কথা বা কাজ করেছে তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে এবং সে কথা ও কাজের ওপর অটল থাকবে। আর যদি দেখে কোনো খারাপ কথা বা কাজ করে ফেলেছে তাহলে সে তা ছেড়ে দেবে ও তাওবা ইস্তেগফার করবে।

    জ্ঞানী ও সচেতন ব্যক্তি মাত্রই কাজ করার পূর্বে চিন্তা করে দেখবে এ কাজটি তার জন্য কতটা ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে। যখন দেখবে যে, কাজটি ভালো ফল নিয়ে আসবে তখন সে তা করবে। আর যদি দেখে ফলাফল ভালো হবে না তখন সে করবে না।

    মানুষ দুনিয়ার ব্যাপারে কোনো কাজ করতে এ নীতিই অবলম্বন করে থাকে। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাকুরীজীবি, কৃষক, গবেষক সকলেই এ নীতি অনুসরণ করে। প্রতিটি পদক্ষেপেই চিন্তা করে কাজটি কতটুকু সফল হবে।

    একজন মুসলিম তো দুনিয়াকে আখিরাতের ক্ষেত্র বলে বিশ্বাস করে। আরো বিশ্বাস করে আজ সে যা করে যাচ্ছে কালকে তার হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে। এ দিকের বিবেচনায় মানুষ যা কিছু আল্লাহর বিধি-নিষেধের আওতায় যা করবে তা আরো বেশি মুহাসাবার দাবী রাখে।

    আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালন ও বর্জন হলো সবচেয়ে বড় ব্যবসা। দুনিয়ার কোনো ব্যবসা বা কাজ কর্মে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব, কিন্তু আখিরাত সম্পর্কিত কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কখনো সম্ভব হয় না। আখিরাতে যে কেউ সফলকাম হলে সেটাই হবে স্থায়ী সফলতা আর যে কেউ ব্যর্থ সেটাই হবে স্থায়ী ব্যর্থতা।

    হাসান বসরী রহ. বলেন, আল্লাহ ঐ বান্দার প্রতি রহম করুন, যার সামনে কোনো কাজ আসলে সে চিন্তা করে এটা আল্লাহর জন্য না কি তার পার্থিব স্বার্থ আদায়ের জন্য। যদি আল্লাহর জন্য হয় সে তাড়াতাড়ি পথ চলতে শুরু করে। আর যদি পার্থিব স্বার্থের জন্য হয় তাহলে সে গড়িমসি করে।

    আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুহাসাবা করতে নির্দেশ দিয়েছে:

    ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَلۡتَنظُرۡ نَفۡسٞ مَّا قَدَّمَتۡ لِغَدٖۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ١٨﴾ [الحشر: ١٨]

    “হে মুমিনগন! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামী কালের জন্য সে কী পাঠিয়েছে।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১৮]

    ইবন কাসীর রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তোমাদের নিজেদের হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বে নিজের হিসাব নিজে করে নাও এবং তাকিয়ে দেখ তুমি নিজের চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য, তোমার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের জন্য কী সঞ্চয় করেছ।

    মুহাসাবার প্রতি পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের গুরুত্ব প্রদান :

    উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন :

    «حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وزنوا أنفسكم قبل أن توزنوا، فإنه أهون عليكم في الحساب غدا أن تحاسبوا أنفسكم اليوم، وتزينوا للعرض الأكبر، يومئذ تعرضون لا تخفى منكم خافية».

    “তোমরা হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে নিজেদের হিসাব করে নাও। আমল ওযন করার পূর্বে নিজেদের আমলের ওযন নিজেরা করে নাও। আজকের হিসাব আগামী কালের হিসাব প্রদানকে সহজ করে দিবে। মহা হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্ততি নাও। সে দিন উপস্থিত করা হবে তোমাদেরকে আর তোমাদের কিছুই গোপন থাকবে না।”

    মায়মুন ইবন মেহরান বলেন,

    «لايكون الرجل تقيا حتى يكون لنفسه أشد محاسبة من الشريك لشريكه».

    “নিজের অংশীদার থেকে মানুষ যে রকম হিসাব করে পাওনা বুঝে নিয়ে থাকে, নিজের আমলের হিসাব তার চেয়ে কঠিনভাবে না করলে কেউ মুত্তাকী হতে পারবে না।”

    হাসান বসরী রহ. বলেন,

    «المؤمن قوام على نفسه، يحاسب نفسه لله عز وجل، وإنما خف الحساب يوم القيامة على قوم حاسبوا أنفسكم في الدنيا، وإنما شق الحساب يوم القيامة على قوم أخذوا الأمر من غير محاسبة».

    “আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে এ ভয় করে যে নিজের কর্মের হিসাব নিজে করবে সে সত্যিকার সাহসী মুমিন। যারা দুনিয়াতে নিজেদের কর্মের হিসাব নিজেরা করেছে পরকালে তাদের হিসাব-নিকাশ হালকা ও সহজ হবে। আর যারা পৃথিবীতে নিজেদের হিসাব করে নি পরকালে তাদের হিসাব দেওয়া হবে অত্যন্ত কঠিন।’’

    মুহাসাবা কীভাবে করবেন :

    মুহাসাবার জন্য শরী‘আত নির্দেশিত নিদিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। মুমিন ব্যক্তি নিজে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যেটা ভাল মনে করবেন সেটার হিসাব করতে চেষ্টা করবেন। যত বেশি নিজের কর্ম-কাণ্ডগুলো মুহাসাবা করবেন ততই কার কল্যাণ। কী কী বিষয়ে মুহাসাবা করা যেতে পারে এর এর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

    (ক) প্রথমে হিসাব নিতে হবে আল্লাহ আমার প্রতি যে সকল কাজ, আকীদা-বিশ্বাস ফরয করে দিয়েছেন আমি সেটা আদায় করছি কিনা? আদায় করে থাকলে সেটা কি ইখলাসের সাথে আদায় করছি ? সেটা আদায় করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ করছি কিনা? এ সকল প্রশ্নের উত্তরে যদি কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তাহলে তা দূর করতে হবে এবং এর জন্য তাওবা ও ইস্তেগফার করতে হবে।

    এ ক্ষেত্রে প্রথমে তাওহীদকে প্রাধ্যান্য দিবে। দেখতে হবে আমি তাওহীদের পরিপূর্ণ আকীদা পোষণ করছি কি না? সকল প্রকার ছোট বড় শির্ক থেকে পাক-পবিত্রতা অর্জন করতে পেরেছি কি না? সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর ভরসা, তাওয়াক্কুল, তার কাছে আশ্রয় নেওয়া ও তার কাছেই দো‘আ-প্রার্থনা করছি কি না? অতঃপর ফরয কাজের হিসাব নিতে চেষ্টা করা; পাঁচ ওয়াক্ত সালাতসমূহ সময়মত, তার সকল শর্ত, রুকন, ওয়াজিব, সুন্নাতের সাথে আদায় হচ্ছে কি না?

    (খ) আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু নিষেধ করেছেন তা আমি কতখানি পরিহার করতে পেরেছি। এই বিষয়টার হিসাব নেওয়া।

    (গ) আমার আচার-আচরণ সম্পূর্ণভাবে ইসলামী চরিত্রে পরিণত হয়েছে কি না? যদি না হয়ে থাকে তবে তা অর্জনের জন্য কোনো প্রচেষ্টা চালিয়েছি কি না? আর চরিত্রের খারাপ দিকগুলো পরিত্যাগ করতে পেরেছি কি না? এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে থাকলে তা কতটা সফল হয়েছে ?

    (ঘ) সুন্নাত ও নফল আমলগুলো আদায়ের ব্যাপারে কতখানি যত্নবান হয়েছি তা হিসেব করে দেখা।

    (ঙ) উল্লি­খিত বিষয়গুলো ছাড়া অন্য সকল কাজ-কর্মগুলো আমি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য করতে পেরেছি কি না তার হিসোব নেওয়া।

    এভাবে মুহাসাবা করে, নিজের হিসাব নিজে নিয়ে যে কোন মুসলিম নিজেকে উন্নত করতে পারে। পূর্ণতা ও সফলতার শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে।

    মুহাসাবার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়:

    (ক) জ্ঞান অর্জন করা। জ্ঞান বলতে শর‘ঈ জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। যা ঈমান ও কুফর, হক ও বাতিল, সরল পথ ও ভ্রান্তপথ, লাভ ও ক্ষতির, কল্যাণ ও অকল্যাণ এর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। যে ব্যক্তি এ জ্ঞানে যত উন্নতি লাভ করতে পারবে তার মুহাসাবা তত পূর্ণতা লাভ করবে।

    (খ) নিজের ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা। নিজেকে ভালো মনে করে আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন হওয়া উচিৎ নয়। কোনো ভালো কাজ করে যদি মনে করেন আমি অনেক কিছু করে ফেলেছি তাহলে মুহাসাবা করা সম্ভব হবে না। আমাদের সকলের বুঝতে হবে যে আমরা যতই ভালো কাজ করে থাকি না কেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে তা ত্রুটিপূর্ণ। তিনি এ ক্রটি ক্ষমা করে যদি কাজটা কবুল করে নেন তাহলে এটা তাঁর অনুগ্রহ। আর যদি তিনি কাজটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে কবুল না করেন তাহলে এটা হবে তার ইনসাফ।

    ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে সে ই নিজের সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখে। আর যে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞ, সে নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকে।

    শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘মানুষেরা সর্বদা ভুল-ত্রুটি করে আল্লাহর ক্ষমার মুখাপেক্ষী থাকে। আর যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, আমি আমার দায়িত্ব পূর্ণভাবে আদায় করেছি এবং আল্লাহর ক্ষমার প্রয়োজন নেই, সে পথভ্রষ্ট।

    আমাদের পূর্ববর্তীদের মুহাসাবার উদাহরণ:

    আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি একদিন দেখলাম উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটা দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন, হে উমার! তুমি মুমিনদের শাসক, তোমার ধ্বংস অনিবার্য! তুমি অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করবে, নয়তো তিনি তোমাকে শাস্তি দিবেন।

    মুহাসাবার ফলাফল:

    মুহাসাবার উপকারিতা অনেক। এর কয়েকটি নিম্নে আলোচনা করা হল :

    (ক) মুহাসাবাকারী নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হয়। আর যে নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হতে না পারে, সে তা সংশোধন করতে পারবে না।

    (খ) কু-প্রবৃত্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তার চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া।

    (গ) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ধৈর্য অনুধাবন করা। এভাবে যে, আমি কত বড় অন্যায় করেছি অথচ তিনি আমাকে তৎক্ষনাৎ শাস্তি না দিয়ে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।

    (ঘ) যে দুনিয়াতে নিজের হিসাব নিজে করবে পরকালে আল্লাহর কাছে তার হিসাব দেওয়া সহজ হবে।

    সমাপ্ত