আল-কুরআন: মর্যাদা, শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীতা : পর্ব-১
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
আল-কুরআনুল কারীম: মর্যাদা, শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা: পর্ব-১
القرآن الكريم، منزلته وضرورة العناية به علما وعملا (1)
< বাংলা - بنغالي - Bengali >
অনুবাদক: ইকবাল হুসাইন মাসুম
সম্পাদক:
আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
ترجمة: إقبال حسين معصوم
مراجعة:
عبد الله شهيد عبدالرحمن
د/ ابو بكر محمد زكريا
আল-কুরআনুল কারীম: মর্যাদা শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা: পর্ব-১
মানব অন্তর কালিমাযুক্ত হয়ে কঠিন হয়ে যায়। দুনিয়ার প্রাচুর্যের মোহ ও প্রবৃত্তির চাহিদা নফসকে দুর্বল ও অসাড় করে ফেলে। মানুষকে এ পৃথিবীতে নফস প্রবৃত্তি ও শয়তানের সাথে যুদ্ধ ও সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। একজন যোদ্ধাকে যদি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রকার অস্ত্রের মুখাপেক্ষী হতে হয় তাহলে চিরন্তন সফলতা যে যুদ্ধে বিজয় লাভের উপর নির্ভরশীল এমন যুদ্ধের যোদ্ধাকে অবশ্যই সক্রিয় ও কার্যকর অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে। আর তা হচ্ছে স্বীয় নফসকে সংশোধন ও পবিত্রকরণ। এ ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ ভিন্ন অন্য কোনো পথ ও পদ্ধতি নেই। কুরআন সম্পর্কে বলতে গেলে রমযান প্রসঙ্গে দু’টি কথা বলতে হয় কয়েক কারণে।
১. রমযান মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরআন অবতরণের সূচনা রমযান মাসেই হয়েছে তখন সূরা ‘আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়।
৩. জিবরীল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুরআন শিখাতেন আর তিনিও তাকে পূর্ণ কুরআন শুনিয়ে দিতেন। এ ব্যাপারটি রমযান মাসে কুরআন খতমের বৈধতাকে প্রমাণ করে। তাছাড়া কুরআন খতম সারা বছরেই গুরুত্বপূর্ণ মোস্তাহাব। তবে রমযানে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়।
প্রথমত: কুরআনের মর্যাদা, ফযিলত ও বৈশিষ্ট্য:
কুরআনুল কারীমের মর্যাদা, ফযিলত, অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনেই অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে যেমনি এ প্রসঙ্গে বহু হাদিস রয়েছে। কতক এখানে তুলে ধরা হল:
(১) কুরআন বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলার কালাম। তিনি তা স্বীয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর রূহুল আমীন জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَإِنۡ أَحَدٞ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٱسۡتَجَارَكَ فَأَجِرۡهُ حَتَّىٰ يَسۡمَعَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ أَبۡلِغۡهُ مَأۡمَنَهُۥۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَوۡمٞ لَّا يَعۡلَمُونَ ٦ ﴾ [التوبة: ٦]
“মুশরিকদের কেউ যদি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে আপনি তাকে আশ্রয় দিয়ে দিন যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬]
(২) কুরআন মানবতার জন্য দিক-নির্দেশনা ও আলোকবর্তিকা। তাদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট পথ-পানে পথ-নির্দেশ করে। আল্লাহ বলেন:
﴿إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَهۡدِي لِلَّتِي هِيَ أَقۡوَمُ ﴾ [الاسراء: ٩]
“নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথ-প্রদর্শন করে যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৯]
কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি যত সমস্যার সম্মুখীন হবে তাদের যা যা প্রয়োজন হবে সকল বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে এ কুরআনে, আল্লাহ বলেন:
﴿وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]
“এবং আমরা আপনার প্রতি এমন কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা। হিদায়াত রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৮৯]
৩. মহান আল্লাহ তা‘আলা এর নাম দিয়েছেন ফুরকান (পার্থক্যকারী) যা হালাল-হারাম হিদায়াত-গোমরাহি এবং হক ও বাতেলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে।
৪. কুরআনুল কারীম আমাদের পূর্ববর্তীদের ঘটনাবলী, পরবর্তীদের সংবাদ, মু’মিনদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নামের দুঃসংবাদের বর্ণনায় পরিপূর্ণ। বর্ণিত সকল বিষয়ের বর্ণনায় এটি ততোধিক সত্য বক্তব্য প্রদানকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَتَمَّتۡ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدۡقٗا وَعَدۡلٗاۚ﴾ [الانعام: ١١٥]
“আপনার রবের বাক্য পূর্ণ সত্য ও সুষম।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১১৫]
৫. আল-কুরআন বিশ্ববাসী সকলের জন্য রহমত। সে গাফেল হৃদয়কে জাগ্রত ও সক্রিয় করে অন্তরকে শির্ক-নিফাক এবং শরীরকে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে সুস্থ করে তোলে। যেমন এ কথা সূরা ফাতিহা ও সূরা নাস ফালাক ইত্যাদির ক্ষেত্রে সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ ﴾ [يونس: ٥٧]
“হে মানবকুল! তোমাদের কাছে উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময় হিদায়াত ও রহমত মুমিনদের জন্য।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৭]
তাই দেখা যায়, কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে অন্তর প্রশান্ত হয়। দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَتَطۡمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكۡرِ ٱللَّهِۗ أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ ٢٨﴾ [الرعد: ٢٨]
“যারা ঈমান আনে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখ আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।” [সূরা আর-রা‘আদ, আয়াত: ২৮]
কুরআনুল কারীম খুবই বরকতময়। তার উপকারিতা সু-বিশাল মানবকুল কুরআনের মাধ্যমে দুনিয়া আখেরাত-উভয় জগতের কল্যাণ ও উন্নতি লাভ করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَإِمَّا يَأۡتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدٗى فَمَنِ ٱتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشۡقَىٰ ١٢٣ وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِي فَإِنَّ لَهُۥ مَعِيشَةٗ ضَنكٗا وَنَحۡشُرُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ أَعۡمَىٰ ١٢٤ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِيٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرٗا ١٢٥ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَٰتُنَا فَنَسِيتَهَاۖ وَكَذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ ١٢٦﴾ [طه: ١٢٣، ١٢٦]
“এরপর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে হিদায়াত আসে তখন যে আমার বর্ণিত পথ অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং কষ্টে পতিত হবে না এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ করে উত্থিত করব। সে বলবে হে আমার পালন-কর্তা! আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমিতো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার কাছে আমাদের আয়াতসমূহ এসেছিল। অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনি আজ তোমাকে এখানে ছেড়ে যাওয়া হলো।” [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১২৩-১২৬]
৭. আল-কুরআন এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিতাব যা আল্লাহ তা‘আলার সংরক্ষণে সংরক্ষিত। আল্লাহ বলেন:
﴿إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩﴾ [الحجر: ٩]
“নিশ্চয় আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই তা সংরক্ষণ করব।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯]
৮. কুরআনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, যে ব্যক্তি এটি বুঝার ও অনুধাবন করার চেষ্টা করে সে তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে হৃদয়ে নাড়া দেয়। অন্তরকে মার্জিত ও পরিশীলিত করে। আত্মাকে করে সংশোধিত। মানুষকে নেক আমলের প্রতি উৎসাহী করে তোলে। তার প্রভাব ও আছর শুধু মানবকুল পর্যন্তই সীমিত নয়; বরং একে যদি খুব মজবুত ও শক্ত পাহাড়ে অবতীর্ণ করানো হত তাহলে অবশ্যই সেটি কেঁপে উঠত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لَوۡ أَنزَلۡنَا هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ عَلَىٰ جَبَلٖ لَّرَأَيۡتَهُۥ خَٰشِعٗا مُّتَصَدِّعٗا مِّنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِۚ وَتِلۡكَ ٱلۡأَمۡثَٰلُ نَضۡرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٢١﴾ [الحشر: ٢١]
“যদি আমরা এ কুরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে আপনি দেখতে পেতেন যে পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে, আমরা এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য বর্ণনা করি যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ২১]
৯. কুরআন এ উম্মতের জন্য উপদেশ ও সম্মানের বস্তু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَإِنَّهُۥ لَذِكۡرٞ لَّكَ وَلِقَوۡمِكَۖ وَسَوۡفَ تُسَۡٔلُونَ ٤٤ ﴾ [الزخرف: ٤٤]
“কুরআন তো আপনার ও আপনার জাতির জন্য উপদেশ সম্মান ও স্মরণের বস্তু। অবশ্যই এ বিষয়ে সত্ত্বর জিজ্ঞাসিত হবেন।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৪৪]
১০. সালাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ‘আমল কুরআনের সূরা ফাতিহা পড়া ব্যতীত সহীহ-শুদ্ধ হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«لاصلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب». (متفق عليه)
“যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ে না তার সালাতই হয় না।” (বোখারি ও মুসলিম)
(১১) যারা হিদায়াত প্রত্যাশা করে এবং এর জন্য চেষ্টা করে মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের উদ্দেশ্যে কুরআনের তিলাওয়াত বুঝা, হিফয করা, এর বিষয়বস্তু গভীরভাবে চিন্তা করে হৃদয়ংগম করা ও তার নির্দেশ অনুযায়ী ‘আমল করা খুব সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَقَدۡ يَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرٖ ١٧﴾ [القمر: ١٧]
“এবং আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বুঝা ও উপদেশ গ্রহণের জন্য। কোনো চিন্তাশীল উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?” [সূরা আল-ক্বামার, আয়াত: ১৭]
সুতরাং কুরআন আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশাল নি‘আমত ও বিশেষ অনুগ্রহ। তাই আমাদের সকলের এ কুরআন পেয়ে আনন্দিত হওয়া এবং সদা আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ٥٨﴾ [يونس: ٥٨]
“বলুন আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবাণীতে। সুতরাং এরই প্রতি তাদের আনন্দিত ও সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। তারা যা সঞ্চয় করছে তা অপেক্ষা এটিই অতি উত্তম।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৮]
দ্বিতীয়ত: কুরআনুল কারীমের মূল্যায়ন ও গুরুত্ব প্রদান:
পৃথিবীতে অনেক মুসলিম আছেন, যারা তার পক্ষে যতটুকু সহজ ততটুকু শুধু তিলাওয়াতকেই কুরআনের যথাযথ হক আদায় ও মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করেন। তাদের সম্পর্কে প্রখ্যাত আল্লাহওয়ালা আলেম ও আবেদ ইমাম ফুদাইল ইবন ‘আইয়াদ্ব রহ. চমৎকার বলেছেন:
إنما نزل القرآن ليعمل به، فاتخذ الناس قراءته عملا.
“কুরআন-তদনুযায়ী-আমল করার জন্য অবতীর্ণ হলো আর লোকেরা শুধু তিলাওয়াতকেই আমল বানিয়ে বসে আছে।” [আখলাকু হামালাতিল কুরআন লিল-আজুররী, ৩৮] বলা হলো, কিভাবে আমল করবে? তিনি বললেন, তার হালালকে হালাল করবে, হারামকে হারাম করবে, আদেশ পালন করবে, নিষেধ থেকে বিরত থাকবে, আশ্চর্য বিষয়গুলো যথাযথভাবে অবহিত হবে।” এ কথাটি হাসান বসরী রহ. থেকেও বর্ণিত আছে।
সুতরাং শুধু তিলাওয়াতই কুরআনের হক আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়; বরং যথাযথ মূল্যায়নের জন্য তিলাওয়াতের পাশাপাশি একে বুঝতে হবে, বুঝার চেষ্টা করতে হবে, হিফয করতে হবে, বর্ণিত বিষয়াদিতে চিন্তা-গবেষণা করতে হবে, তদনুযায়ী ‘আমল করতে হবে শাসন বিচার ও বিরোধ-মীমাংসার জন্য তার শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো লোকেরা এর তিলাওয়াতকেই যথাযথ মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করছে। এর চেয়েও দুঃখজনক হচ্ছে-যারা তিলাওয়াতকে যথেষ্ট মনে করছে তাদের অধিকাংশ এ তিলাওয়াতের ব্যাপারে অবহেলা-উপেক্ষা করছে।
ولا حول ولا قوة إلا بالله العلي العظيم.
বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে যায় অথচ পূর্ণ বৎসরে একবারও কুরআন খতম করতে পারে না। একটিমাত্র সূরাও মুখস্থ করে না। রমযান মাস যখন সকল মুসলিম পূর্ণোদ্দমে কুরআন অধ্যয়নসহ সকল ইসলামী কর্মকাণ্ড সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে সম্পাদন করে তখনও কিছু মুসলিমকে আপনি দেখতে পাবেন যারা এর তিলাওয়াত থেকে দূরে, এ বরকতময় মাসেও এর খতম পূর্ণ করার জন্য চেষ্টা করে না।
কুরআনুল কারীমের মূল্যায়নের দিকসমূহ:
প্রথমত: তিলাওয়াত করা
তিলাওয়াতের ফযিলত:
(১) কুরআনুল কারীমের যথাযথ তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ سِرّٗا وَعَلَانِيَةٗ يَرۡجُونَ تِجَٰرَةٗ لَّن تَبُورَ ٢٩ لِيُوَفِّيَهُمۡ أُجُورَهُمۡ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّهُۥ غَفُورٞ شَكُورٞ ٣٠ ﴾ [فاطر: ٢٩، ٣٠]
“যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে সালাত কায়েম করে এবং আমরা যা দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসা আশা করে যাতে কখনও লোকসান হবে না। পরিণামে তাদেরকে আল্লাহ তাদের সওয়াব পুরোপুরি দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশি। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল গুণগ্রাহী।” [সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ২৯-৩০]
(২) কুরআন তিলাওয়াতকারী প্রত্যেক অক্ষরের পরিবর্তে একটি করে সাওয়াব লাভ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من قرأ حرفا من كتاب الله فله حسنة، والحسنة بعشر أمثالها، لا أقول: (الم) حرف، ولكن ألف حرف، ولام حرف، وميم حرف». (رواه الترمذي)
“যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ থেকে একটি অক্ষর তিলাওয়াত করবে তাকে একটি সাওয়াব দেওয়া হবে। উক্ত এক সাওয়াব হবে দশ সাওয়াবের সমতুল্য। আমি একথা বলি না যে الم একটি অক্ষর বরং الف একটি অক্ষর لام একটি অক্ষর ميم একটি অক্ষর।( الم তিলাওয়াত করলে ন্যূনতম ত্রিশটি সাওয়াব প্রাপ্ত হবে)। (তিরমিযী)
(৩) কুরআন তিলাওয়াতকারী ভিতর বাহির উভয় দিক থেকে উত্তম-উৎকৃষ্ট। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مثل المؤمن الذي يقرأ القرآن مثل الأترجة: ريحها طيب، وطعمها طيب، ومثل المؤمن الذي لا يقرأ القرآن كمثل التمرة: لا ريح لها وطعمها حلو، ومثل المنافق الذي يقرأ القرآن كمثل الريحانة: ريحها طيب وطعمها مر، ومثل المنافق الذي لا يقرأ القرآن كمثل الحنظلة: ليس لها ريح، وطعمها مر». (متفق عليه)
“যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে সে জামীর সদৃশ যার সুগন্ধি বড় চমৎকার এবং স্বাদও সুমিষ্ট। আর যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে না সে খেজুর সমতুল্য। যার গন্ধ নেই কিন্তু স্বাদ বড় মিষ্ট। আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে সে রাইহান ফলের মত যার সুগন্ধি চমৎকার কিন্তু স্বাদ বড়ই তিক্ত। আর যে মুনাফিক কুরআন পড়ে না সে হানযালা বা কেদাঁ ফলের সমতুল্য যার কোনো ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদও তিক্ত।” (বুখারী ও মুসলিম)
৪. কুরআন পাঠে সাকীনা (বিশেষ রহমত) অবতীর্ণ হয়। সাহাবী বারা ইবন ‘আযিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেছেন,
«كان رجل يقرأ سورة الكهف وعنده فرس مربوط بشطنين (بحبلين) فتغشته سحابة، فجعلت تدنو، وجعل فرسه ينفر منها، فلما أصبح أتى النبي صلى الله عليه وسلم فذكر ذلك له، فقال: (تلك السكينة تنـزلت للقرآن)». (متفق عليه)
“জনৈক সাহাবী সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিলেন। তার নিকট রশি দিয়ে বাঁধা একটি ঘোড়া ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই একটি মেঘ তাকে ঢেকে নিল এবং ক্রমেই সেটি কাছে আসছিল আর ঘোড়া ছোটাছুটি করছিল। সকাল হলে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে পূর্ণ ঘটনা খুলে বললেন। শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন সেটি সাকীনা (এক প্রকার বিশেষ রহমত যা দ্বারা অন্তরের প্রশান্তি লাভ হয়) কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াতের কারণে অবতীর্ণ হয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম)
(৫) কুরআনের একটি আয়াত (পাঠ করা বা শিক্ষা দেওয়া) উটের মালিক হওয়া অপেক্ষা উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أفلا يغدو أحدكم إلى المسجد فيعلم أو يقرأ آيتين من كتاب الله عز وجل خير له من ناقتين، وثلاث خير له من ثلاث، وأربع خير له من أربع، ومن أعدادهن من الإبل)». (رواه مسلم )
“তোমাদের কেউ কেন সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কুরআন হতে দুটি আয়াত শিখে না বা পড়ে না? তাহলে সেটি তার জন্য দুটি উট লাভ করার চেয়ে উত্তম হতো। তিনটি আয়াত তিনটি উট অপেক্ষা উত্তম। চারটি আয়াত চার উট অপেক্ষা উত্তম হতো। অনুরূপ আয়াতের সংখ্যা অনুপাতে উটের সংখ্যা অপেক্ষা উত্তম হতো।” (মুসলিম)
৬. কুরআনুল কারীম নিয়মিত তিলাওয়াতকারী ও তদনুযায়ী আমলকারীর পক্ষে কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إقرؤوا القرآن، فإنه يأتي يوم القيامة شفيعا لأصحابه». (رواه مسلم)
“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর; কেননা কুরআন কিয়ামতের দিবসে তিলাওয়াত ও আমলকারীর জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আবির্ভূত হবে।” (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
»يؤتى يوم القيمة بالقرآن وأهله الذين كانوا يعملون به في الدنيا، تقدمه سورة البقرة وآل عمران تحاجان عن صاحبهما». (رواه مسلم)
“কেয়ামতের দিন কুরআন এবং পৃথিবীতে কুরআনের মর্মানুযায়ী আমলকারীদেরকে এমতাবস্থায় উপস্থিত করা হবে সূরা বাকারাহ ও সূরা আলে ইমরান আগে আগে চলবে এবং এদের তিলাওয়াত ও আমলকারীদের জন্য সুপারিশ করতে থাকবে।” (মুসলিম)
৭. কুরআনের পাঠক ও আমলকারী দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«خيركم من تعلم القرآن وعلمه». (رواه البخاري)
“যে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিক্ষা দেয় সে তোমাদের শ্রেষ্ঠতর।” (বোখারী)
কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি সাহাবীদের আগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। তিলাওয়াতের মর্যাদা জানার পর তাদের কেউ কেউ সব সময়ের জন্য সারারাত না ঘুমিয়ে কুরআন তিলাওয়াতে কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্প করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত সংকল্প সম্পর্কে জেনে এরূপ না করার পরামর্শ দিয়ে বললেন বরং প্রতি সাত দিনে একবার করে খতম করতে পার। তাইতো দেখা যায় তাদের অধিকাংশই প্রতি সাত দিনে একবার করে খতম করতেন।
তিলাওয়াতের প্রতি তাদের এরূপ যত্নশীল হওয়া সত্ত্বেও যদি কখনো কেউ অন্য কাজে ব্যস্ততা হেতু বা ঘুমের কারণে রাতে পড়তে না পারতেন তাহলে পরদিন সে অংশটুকু অবশ্যই পড়ে নিতেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
»من نام عن حزبه أو عن شيء منه ، فقرأه فيما بين صلاة الفجر وصلاة الظهر كتب له كأنما قرأه من الليل». (رواه مسلم)
“যে ব্যক্তি স্বীয় নির্ধারিত অংশ বা তার অংশ বিশেষ রাতে না পড়েই ঘুমিয়ে যায় অতঃপর পরদিন ফজর ও জোহরের মধ্যবর্তী সময়ে পড়ে নেয়। তাহলে রাতে পড়া হয়েছে ধরেই আল্লাহর নিকট ধর্তব্য হবে।” (মুসলিম)
আবার তাদের কেউ কেউ প্রতি দিনে একবার করে খতম করতেন। রমযান মাস আসলে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি তাদের চেষ্টা ও পরিশ্রম আরো বেড়ে যেতো। রমযানে সালাতের মধ্যে এবং অন্য সময় তিলাওয়াতের জন্য তারা কঠোর পরিশ্রম করতেন।
ইমাম বুখারী রহ. বলতেন:
إذا دخل رمضان فإنما هو تلاوة القرآن وإطعام الطعام.
“যখন রমযান আসবে তখন সেটি হবে একমাত্র কুরআন তিলাওয়াত ও অপরকে খাওয়ানোর মাস।”
ইমাম মালেক রহ. রমযান আসলে হাদিসের অধ্যয়ন ইলম শিক্ষার আসরসহ যাবতীয় কাজ ছেড়ে দিয়ে (রাতদিন শুধু) মাসহাফ থেকে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি বেশি মনোযোগী হতেন। এর অর্থ এই নয় যে, শুধু চিন্তা ও গবেষণার দিক ও তিলাওয়াতের হক প্রদানকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু তিলাওয়াতের প্রতিই গুরুত্ব দেওয়া হবে; বরং অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায় বা অক্ষর অস্পষ্ট থাকে এমন করে খুব দ্রুত বেগে তিলাওয়াত করার অনুমতি নেই। কালামুল্লাহ তিলাওয়াতের অনেক আদব আছে তিলাওয়াতকালে সেগুলোর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা খুবই জরুরী।
(বাকী অংশ পরবর্তী প্রবন্ধে আসবে)