×
রজব মাস সম্পর্কে জ্ঞাতব্য : বিভিন্ন সময় ও মাসকে কেন্দ্র করে এবাদত কেন্দ্রিক যে সমস্ত অপসংস্কার ও বেদআত গড়ে উঠেছে- রজব মাস, তাতে নানাবিধ এবাদত পালন, রোজা রাখা, রাত জাগা, সামাজিকভাবে উদযাপনের আয়োজন করা তার অন্যতম। শরিয়তের সুস্থ বিচারে এ ব্যাপারে আমরা কোন প্রকার দলীল পাই না। বিষয়টি নিয়ে কুরআন ও হাদিস দ্বারা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এটি। পাঠক খুবই মুগ্ধ হবেন আশা করি।

    রজব মাস সম্পর্কে জ্ঞাতব্য

    تنبيهات حول شهر رجب

    <بنغالي>

    সানাউল্লাহ নজির আহমাদ

    ثناؤ الله نذير أحمد

    —™

    সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

    রজব মাস সম্পর্কে জ্ঞাতব্য

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ ﴾ [القصص: ٦٨]

    “আপনার পালনকর্তা যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন এবং পছন্দ করেন।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৮]

    অর্থাৎ স্বীয় সৃষ্ট বস্তু হতে কিছু মনোনীত করেন, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার ঘোষণা দেন। যেমন তিনি মনোনীত করেছেন কয়েকটি দিন, কয়েকটি মাস; সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রদান করেছেন অন্য সব দিন ও মাসের ওপর। মহান আল্লাহ ঘোষণা দেন,

    ﴿ إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡرٗا فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ يَوۡمَ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ مِنۡهَآ أَرۡبَعَةٌ حُرُمٞۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُۚ فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٣٦]

    “আসমান-জমিনের সৃষ্টি ও সূচনা লগ্ন হতেই আল্লাহর বিধান মতে মাসের নিশ্চিত সংখ্যা বারটি। তার মাঝে চারটি সম্মানিত। এ অমোঘ ও শাশ্বত বিধান ; সুতরাং এর মাঝে তোমরা (অত্যাচার-পাপাচারে লিপ্ত হয়ে) নিজেদের ক্ষতি সাধন করো না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৬]

    হাদীসে মাস চারটির নাম উদ্ধৃত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «الزَّمَانُ قَدْ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاَثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ: ذُو القَعْدَةِ وَذُو الحِجَّةِ وَالمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ، الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ»

    “যুগ বা কাল চক্রাকারে ঘুরে আসমান-জমিন সৃষ্টির প্রথম দিনের অবস্থায় ফিরে এসেছে। বারো মাসে বছর, তার ভেতর চারটি সম্মানিত। তিনটি একসাথে জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম। অপরটি মুযার সম্প্রদায়ের রজব- যা জুমাদাল উখরা ও শাবানের মধ্যবর্তী”[1]

    আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত চারটি মাস বিশেষ মর্যাদা এবং প্রভূত সম্মানে ভূষিত। যার অংশীদার রজবও, যেহেতু রজব তার একটি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُحِلُّواْ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ وَلَا ٱلشَّهۡرَ ٱلۡحَرَامَ ﴾ [المائ‍دة: ٢]

    “হে মু’মিনগণ! আল্লাহর নিদর্শনসমূহ (নিষিদ্ধ বস্তু) হালাল মনে করো না এবং সম্মানিত মাসসমূহকে।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ২]

    অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সংরক্ষিত, নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ- যেগুলোকে তিনি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং অনধিকার চর্চা হতে বারণ করেছেন, সেগুলোকে তোমরা হালাল মনে কর না। যার ভেতর ভ্রান্ত বিশ্বাস, নিষিদ্ধ কাজ- উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٣٦]

    “এতে তোমরা নিজেদের ওপর অত্যাচার (ক্ষতিসাধন) করো না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৬] অর্থাৎ সম্মানিত মাসগুলোতে। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা এ মাসগুলোকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন, তাই এর সম্মান যথাযথ রক্ষা করা এবং এর মর্যাদা ও পবিত্রতা লক্ষ্য করতঃ এতে কোনো গুনাহে লিপ্ত না হওয়া সবার জন্য সঙ্গত। তদুপরি যুগের পবিত্রতার কারণে, অপরাধ হয় জঘন্য ও মারাত্মক। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা উল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে নিজেদের ওপর যুলম না করার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যথায় স্বীয় নফ্‌সের ওপর যুলম করা বা অন্য কোনো গুনাহে জড়িত হওয়া, সব মাসেই হারাম ও নিষিদ্ধ।

    রজব মাসকে কেন্দ্র করে কতিপয় নতুন আবিষ্কৃত আমল বা বিদ‘আত

    ১. রজব মাসের সাওম :

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবাদের থেকে রজব মাসের সাওমের ফযীলতের ব্যাপারে প্রামাণ্য কোনো দলিল নেই। তবে অন্যান্য মাসের মত এ মাসেও সপ্তাহের সোমবার, বৃহস্পতিবার, মাসের তেরো, চৌদ্দ, পনেরো তারিখ সাওম রাখা বৈধ ও সুন্নত। ওমর রা. রজব মাসের সাওম হতে নিষেধ করতেন। কারণ, এতে ইসলাম-পূর্ব কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাহেলি যুগের সাথে সামঞ্জস্য বিদ্যমান।

    হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, রজবের নির্দিষ্ট-অনির্দিষ্ট দিনের রোজা, কিংবা রজবের নির্দিষ্ট কোনো রাতের সাওমের ব্যাপারে প্রমাণ যোগ্য কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। যে কয়টি সুস্পষ্ট অর্থবহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তা দুভাগে বিভক্ত। যয়ীফ বা দুর্বল, মওদু‘ বা (বানোয়াট) জাল হাদীস। তিনি সব কয়টি হাদীস একত্র করেছেন। দেখা গেছে, ১১টি দুর্বল হাদীস, ২১টি জাল হাদীস।

    ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাগাতার তিন মাস (রজব, শাবান, রমযান) সাওম রাখেন নি- যেমন কিছু লোক করে থাকে। রজবে কখনো সাওম রাখেন নি, সাওম পছন্দও করেন নি।

    সৌদী আরবের স্থায়ী ফাতওয়া কমিটির ফাতওয়াতে আছে, রজবের কতক দিনকে সাওমের জন্য নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে আমাদের কোনো দলিল জানা নেই।

    ২. রজব মাসে ওমরা:

    কোনো হাদীসে প্রমাণ নেই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব মাসে ওমরা করেছেন। এ জন্য নির্দিষ্টভাবে রজবে ওমরা করা কিংবা এতে ওমরার বিশেষ ফযীলত আছে- বিশ্বাস করা বিদ‘আত।

    শাইখ মুহাম্মাদ ইবরাহীম রহ. তার ফাতওয়াতে বলেন, রজব মাসকে যিয়ারত ইত্যাদির মত আমল দ্বারা নির্দিষ্ট করার পিছনে কোনো মৌলিক ভিত্তি নেই। কারণ, ইমাম আবু শামা স্বীয় كتاب البدع والحوادث গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন, শারিয়াহকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ কোনো সময়ের সাথে কোনো ইবাদত নির্দিষ্ট করা অনুচিত, অবৈধ। কারণ, শারিয়াহ যদি বিশেষ কিংবা সাধারণ আমলের জন্য কোনো সময় নির্ধারণ না করে, তবে সব দিন-ক্ষণ-সময় সমান মর্যাদার বলে বিবেচিত। এ জন্যই ওলামায়ে কেরাম রজব মাসে বেশি বেশি ওমরা করতে নিষেধ করেছেন। তবে কেউ যদি স্বাভাবিক নিয়মে (ফযীলতের বিশ্বাসবিহীন) রজব মাসে ওমরা করে, তাতে দোষ নেই। কারণ, এ সময়েই তার জন্য ওমরা করার সুযোগ হয়েছে।

    ৩. সালাতে রাগায়েব:

    হাদীস শাস্ত্রে কতিপয় মিথ্যাচারের দ্বারা এ সালাতের সূচনা হয়। এ সালাত রজবের প্রথম রাতে পড়া হয়। এ ব্যাপারে ইমাম নববী রহ. বলেন, “এটি নিন্দনীয়, ঘৃণিত, জঘন্যতম বিদ‘আত। যা কয়েকটি অপরাধ ও নিষিদ্ধ কর্মের সমন্বয়ে রচিত। সুতরাং একে পরিত্যাগ করা, এর থেকে বিরত থাকা এবং এর সম্পাদনকারীকে নিষেধ করা কর্তব্য।

    শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, ইমাম মালেক, শাফে‘ঈ, আবু হানিফা, সাওরি, লাইস প্রমুখের মতে সালাতে রাগায়েব বিদ‘আত। হাদীস বিশারদগণের দৃষ্টিতে এ ব্যাপারে বর্ণিত সকল হাদীস জাল, বানোয়াট।

    ৪. রজব মাসের ২৭ তারিখের রাত লাইলাতুল মি‘রাজ মনে করে জমায়েত হওয়া ও মাহফিল করা:

    মি‘রাজের রজনী কিংবা মি‘রাজের মাস নির্ধারণের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ দাঁড় করানো সম্ভব হয় নি। এ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে, সত্য অনুদঘাটিত। তাই এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয়। মি‘রাজের রজনী নির্দিষ্টকরণের ব্যাপারে কোনো বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণিত হয়নি। যা বিদ্যমান আছে, সব জাল, ভিত্তিহীন।[2] অতএব, এ রাতে অতিরিক্ত ইবাদত ধার্য করা, যেমন রাত জাগা, দিনে সাওম রাখা, অথবা ঈর্ষা, উল্লাস প্রকাশ করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা, গান-বাদ্যসহ মাহফিলের আয়োজন করা -নাজায়েয-হারাম, এখানে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপরন্তু মি‘রাজের রাত্রি ঐতিহাসিকভাবেও সুনির্দিষ্ট নয়। প্রমাণিত মনে করলেও এতে মাহফিল করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং আদর্শ পূর্বসূরীগণ হতে এ ব্যাপারে কোনো দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায় নি।

    ৫. রজব মাসে গুরুত্বসহকারে কবর জিয়ারত করা:

    এটিও বিদ‘আত। কারণ, কবর জিয়ারত বছরের যে কোনো সময় হতে পারে।
    ৬. রজব মাসে পশু জবাই বা এ জাতীয় কিছু উৎসর্গ করা:

    জাহেলিয়াতে রজব মাসকে নির্দিষ্ট করে এ ধরনের আমল সম্পাদন করা হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিষেধ করেন। ইমাম ইবনে রজব বলেন, রজব মাসে পূণ্য মনে করে জবাই করা, এ মাসে ঈদ-উৎসব উদযাপন করার মতই অবৈধ।

    রজব মাসে করণীয় ও বর্জনীয়:

    নিজের কিংবা অন্যের ওপর যুলম করা হতে বিরত থাকা, যার অর্থ- ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা, বেশি বেশি নেক আমল করা, আল্লাহ কর্তৃক সংরক্ষিত ও নিষিদ্ধ বিষয় বস্তু পরিত্যাগ করা। অর্থাৎ নিখাদ তওবা করা, আল্লাহ তা‘আলার শরণাপন্ন হওয়া, রমযান মাসের ভাগ্যবান ও লাইলাতুল কদরের মুক্তিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।

    সুপ্রিয় পাঠক, আসুন বর্তমান মাস থেকেই নিজেদের তৈরি করি। আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য, অনুসরণে ব্রত হওয়ার জন্য অন্তর ও শরীরের অনুশীলন গ্রহণ করুন।

    সমাপ্ত

    [1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৯৭

    [2] বেদায়া নেহায়া ২: ১০৭, মাজমুউল ফতওয়া ২৫: ২৯৮