×
যেভাবে স্বাগত জানাব মাহে রমজানকে: রমজান বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, যাতে রয়েছে রমজানের ফজিলত ও রোজার হাকীকত-মাহাত্ম্য সম্পর্কে আলোচনা। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা ও তা থেকে নিষ্কৃতির পথ ও পদ্ধতির বর্ণনা। রমজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উসওয়া-আদর্শের উপরেও আলোকপাত করা হয়েছে।

    কীভাবে স্বাগত জানাব মাহে রমযানকে

    كيف نستقبل رمضان؟

    < بنغالي >

    আব্দুর রহমান ইবন আব্দুল আযীয আস-সুদাইস

    عبد الرحمن بن عبد العزيز السديس

    —™

    অনুবাদক: আবু শু‘আইব মুহাম্মদ সিদ্দিক

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    ترجمة: أبو شعيب محمد صديق

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    কীভাবে স্বাগত জানাব মাহে রমযানকে

    সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার যিনি আমাদেরকে নি‘আমত হিসেবে দিয়েছেন সৎকাজ করার বিভিন্ন মৌসুম। যিনি রমযানকে করেছেন মহিমান্বিত, বরকতময়। যিনি উৎসাহ দিয়েছেন মাহে রমযানে ইবাদত-বন্দেগী যথার্থরূপে পালন করতে। পুণ্যময় কাজসমূহে অধিকমাত্রায় রত হতে। আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি তার অফুরান নি‘আমতের জন্য। শুকরিয়া করছি তাঁর অঢেল করুণার জন্য। সালাত ও সালাম তাঁর প্রতি যিনি সালাত ও সাওম আদায়কারীদের মধ্যে ছিলেন সর্বোত্তম। যিনি তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইল সম্পাদনকারীদের মধ্যে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তার প্রতি রহমত ও বরকত নাযিল করুন। তাঁর সাহাবীগণের প্রতিও রহমত বর্ষণ করুন। তাবে‘ঈন ও ঐকান্তিকতার সাথে, পৃথিবীতে আলো অন্ধকার যতদিন থাকবে, ততদিন যারাই তাদের অনুসরণ করবে তাদের সবার প্রতি বর্ষিত হোক আল্লাহর অফুরান রহমত।

    আল্লাহ তা‘আলা বড়-বড় উপলক্ষ্য রেখেছেন যা হৃদয়ে ঈমানকে শানিত করে, অন্তরাত্মায় আন্দোলিত করে উচ্ছ্বসিত অনুভূতি। অতঃপর বাড়িয়ে দেয় ইবাদত আরাধনার অনুঘটনা, সঙ্কুচিত করে দেয় সমাজে পাপ ও অন্যায়ের ক্ষেত্রসমূহ। রমযান মুসলিমদেরকে দেয় ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বচ্ছতা, সহমর্মিতা, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা, পবিত্রতা, উত্তমতা, সবর ও শৌর্যবীর্যের দীক্ষা। যা একটি সুমিষ্ট পানিয়ের প্রস্রবণ। ইবাদতকারীদের জন্য একটি নিরাপদ ভূমি, আনুগত্যকারীদের জন্য দুর্পার দুর্গ। যারা পাপী তাদের জন্য তা একটি সুযোগ, যাতে তারা তাদের গুনাহ থেকে তাওবা করতে পারে। তাদের জীবন-ইতিহাসে স্বচ্ছ কিছু অধ্যায় রচিত করতে পারে। তাদের জীবনকে ভরে দিতে পারে উত্তম আমলে, উৎকৃষ্ট চরিত্রে।

    রমযানের ফযীলত:

    কালের বিবেচনায় এসব উপলক্ষ্যের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট, সম্মানের বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ, প্রভাবের বিবেচনায় সুদূর বিস্তৃত উপলক্ষ্য হল সম্মানিত মাহে রমযান যার টলটলে রস আস্বাদন করে আমরা হই পরিতৃপ্ত। চুমুকে চুমুকে তুলে নিই তার মধু। নাক ভরে শুঁকে নেই তার সুগন্ধি। মাহে রমযান ছাওয়াব-পুণ্য বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার মাস। দরজা বুলন্দ হওয়ার মাস। পাপ-গুনাহ মোচন হওয়ার মাস। পদস্খলন থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও ছাওয়াব লাভের আশায় এ মাসে সাওম পালন করবে, তারাবীহ পড়বে, তার অতীত জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। সহীহ হাদীসে এভাবেই এসেছে: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাব তথা আল্লাহর কাছ থেকে ছাওয়াব প্রাপ্তির আশায় সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।[1]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবসহ রমযানের রাত্রির কিয়াম তথা রাতের সালাত আদায় করবে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।[2]

    মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দ! রমযান মুসলিমদের জন্য বিশাল এক আনন্দের মাস। সময়ের পরিক্রমায় ঘুরে ঘুরে আসে রমযান। আসে এই সম্মানিত মৌসুম। আসে এ মহান মাস। আসে প্রিয় মেহমান হয়ে, সম্মানিত অতিথি হয়ে। এ উম্মতের জন্য মাহে রমযান আল্লাহর এক নেয়ামত। কেননা এ মাসের রয়েছে বহু গুণাবলি, বৈশিষ্ট্য। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে:

    “যখন রমযান আসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে শিকল পরিয়ে দেওয়া হয়।[3]

    এটা নিঃসন্দেহে বড় সুযোগ। এটা এক সম্মানিত উপলক্ষ্য যেখানে স্বচ্ছতা পায় অন্তরাত্মা। ধাবিত হয় যার প্রতি হৃদয়। যাতে বেড়ে যায় ভালো কাজ করার উৎসাহ-উদ্যম। উন্মুক্ত হয়ে যায় জান্নাত, নাযিল হয় অফুরান রহমত। বুলন্দ হয় দরজা, মাফ করা হয় গুনাহ।

    রমযান তাহাজ্জুদ ও তারাবীহর মাস। যিকির ও তাসবিহর মাস। রমযান কুরআন তিলাওয়াত ও সালাতের মাস। দান সাদকার মাস। যিকির-আযকার ও দো‘আর মাস। আহাজারি ও কান্নার মাস।

    যে কারণে রমযান আমাদের প্রয়োজন:

    মুসলিম ভাইয়েরা! জাতির জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়া জরুরি যখন আত্মার পরিশুদ্ধি ও তৃপ্তি সম্পন্ন হবে। যখন ঈমানের মাইলফলকগুলো নবায়ন করা হবে। যা কিছু নষ্ট হয়েছে তা সংস্কার করা হবে। যেসব রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে তা সারিয়ে তোলা হবে। রমযান সেই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত যেখানে মুসলিম উম্মাহ তাদের বিভিন্ন অবস্থা সংস্কার করার সুযোগ পায়, তাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পায়। তাদের অতীতকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ পায়। এটা আত্মিক ও চারিত্রিক বল ফিরিয়ে আনার একটি মাস। আর এ আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনা প্রতিটি জাতিরই কর্তব্য। মুসলিমগণ এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে অধীর আগ্রহে। এটা ঈমান নবায়নের একটা বিদ্যাপীঠ। চরিত্র মাধুর্যমণ্ডিত করার সময়। আত্মাকে শানিত করার সময়। নাফসকে ইসলাহ করার সময়। প্রবৃত্তিকে কন্ট্রোল করার সময়। কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার সময়।

    রমযানে অর্জন হয় তাকওয়া। রমযানে বাস্তবায়ন হয় আল্লাহর নির্দেশমালা। শাণিত হয় ইচ্ছা। রমযানে একজন মুসলিম প্রশিক্ষণ নেয় আত্মদানের, শাহাতদত বরণের। রমযানে অর্জিত হয় ঐক্য, মহব্বত, ভ্রাতৃত্ব, ও মিলমিলাপ। এ মাসে মুসলিমগণ আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়ার অনুভূতি অর্জন করে। অনুভব করে ক্ষুধার্তের ক্ষুধা। সাওম ত্যাগ, বদান্যতা ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার সময়। এটা সত্যিই চরিত্রের জন্য সহায়ক। রহমতের প্রস্রবণ। যে ব্যক্তি সত্যি সত্যি সাওম রাখল তার রুহ পরিচ্ছন্ন হলো। তার হৃদয় নরম হলো। তার আত্মা পরিশুদ্ধ হলো। তার অনুভূতিসমূহ ঠিকরে পড়ল ও শাণিত হল। তার আরচরণসমূহ বিনম্র হলো।

    মুসলিমদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মোক্ষম সময় হল রমযান। সুতরাং তাদের উচিত রমযান এলে আত্মসমালোচনায় মনোযোগী হওয়া। রমযানের হিকমতসমূহ খোঁজে নেওয়া তাদের জন্য কতোই না জরুরি। রমাযানের দানসমূহ থেকে উপকৃত হওয়া তাদের জন্য কতোই না প্রয়োজন। রমযানের উত্তম ফলাফল আহরণ করা কতোই না প্রয়োজন।

    আমরা কীভাবে রমযানকে স্বাগত জানাব?

    প্রিয় ভাইয়েরা! আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে আমাদেরকে প্রথমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। সকল পাপ-গুনাহ থেকে তাওবার মাধ্যমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। সকল প্রকার যুলুম অন্যায় থেকে বের হয়ে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। যাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তাদের কাছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। ভাল কাজের মাধ্যমে রমযানের দিবস-রজনী যাপনের মানসিকতা নিয়ে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। এ ধরনের আবেগ অনুভূতির মাধ্যমেই আশাসমূহ পূর্ণ হয়। ব্যক্তি ও সমাজ তাদের সম্মান ফিরে পায়। এর বিপরীতে রমযান যদি কেবলই একটি অন্ধ অনুকরণের বিষয় হয়। কেবলই কিছু সীমিত প্রভাবের নিষ্প্রাণ আচার পালনের নাম হয়। যদি এমন হয় যে রমযানে, পুণ্যের বদলে, পাপ ও বক্রতা কারও কারও জীবনে বেড়ে যায়, তবে এটা নিশ্চয় একটি আত্মিক পরাজয়, এটা নিশ্চয় শয়তানের ক্রীড়া, যার বিরূপ প্রভাব ব্যক্তি ও সমাজের ওপর পড়তে বাধ্য।

    এ মহান মাসের আগমনে মুসলিমদের জীবনে আসুক সুখ ও সমৃদ্ধি। সারা পৃথিবীর মুসলিমদের জীবনে এ মহান মৌসুমের আগমনে বয়ে যাক আনন্দের ফল্গুধারা। যারা আনুগত্যশীল, এ মাস তাদের নেক কাজ বাড়িয়ে দেওয়ার মাস। যারা পাপী, তাদের জন্য এ মাস পাপ থেকে ফিরে আসার মাস। মুমিন জান্নাতের দরজাসমূহের উন্মুক্তিতে খুশি না হয়ে পারে না। পাপী, জাহান্নামের দরজাসমূহ এ মাসে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুশি হবে বই কি। এ এক বিশাল সুযোগ যা থেকে মাহরুম ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ বঞ্চিত হয় না। সিয়াম ও কিয়ামের মাস রমযানের আগমন মুসলিমদের জন্য বিরাট সুখের সংবাদ। অতঃপর হে আল্লাহর বান্দারা আপনারা সিরিয়াস হোন, ঐকান্তিক হোন, সাওমকে কখনো কঠিন ভাববেন না। সাওমের দিবসকে দীর্ঘ মনে করবেন না। সাওম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকুন। আত্মিক ও বস্তুকেন্দ্রিক সকল প্রকার সাওমভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত থাকুন।

    সাওমের হাকীকত:

    অনেক এমন রয়েছে যারা সাওমের হাকীকত সম্পর্কে বে-খবর। তারা সাওমকে কেবলই খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকার মধ্যে সীমিত করে দিয়েছে। তাদের সাওম মিথ্যাচারিতায় জবান দরাজ করতে বারণ করে না। চোখের ও কানের লাগাম তারা উন্মুক্ত করে দেয়। তারা গুনাহ ও পাপে নিপতিত হতে সামান্যও উৎকণ্ঠিত হয় না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, সে অনুযায়ী কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।”

    কবি সত্যই বলেছেন:

    রক্ষিত যদি না হয় কর্ণ

    দৃষ্টিতে না থাকে বাধা

    তবে বুঝে নিও

    আমার সাওম কেবলই তৃষ্ণা ও পিপাসা।

    যদি বলি আমি আজ সাওম,

    মনে করিও আমি আদৌ সাওমদার নই।

    রমযান ও উম্মতের হালত:

    প্রিয় ভাইয়েরা! মুসলিমরা বর্তমানে খুব কঠিন কালপর্ব যাপন করছে। সে হিসেবে তাদের উচিত এ সময়টাকে একটা কঠিন সময় হিসেবে নেওয়া। এ মাসটাকে একটা পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ হিসেবে গণ্য করা। এ মাসে ইখতিলাফ ও মতানৈক্য থেকে নিষ্কৃতির পাওয়ার উপায় খোঁজে নেওয়া জরুরি। ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যের বন্ধন মজবুত করা জরুরি। চিন্তা ও মনোজগৎ ও মতামতে পরিবর্তন জরুরি। এ মাসে আমাদের চলার পথ ও পদ্ধতি কুরআন ও সুন্নাহর চাঁচে গড়ে তুলতে হবে। সালাফে সালেহীনের নমুনায় ঢেলে সাজাতে হবে নিজেদেরকে। আর এভাবেই হারিয়ে যাওয়া সোনালি অতীতকে, সম্মান ও মর্যাদার অতীতকে ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে। যে অতীতের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের বহু ঘটনা অনুঘটনা নির্মিত হয়েছিল মুবারক এ মাহে রমযানে। বদর, ফতহে মক্কা, হিত্তিন যুদ্ধ, আইন জালুত যুদ্ধসহ আরো বহু অতি উজ্জ্বল ইতিহাস নির্মিত হয়েছিল এ মাসেই।

    প্রিয় ভাইয়েরা!

    আমাদের এ সম্মানিত মাস আমাদের দ্বারপ্রান্তে। অথচ মুসলিম উম্মাহর দেহে রয়েছে অঝর ধারায় ক্ষরিত হওয়া লহুর বহু জখম। বেদনাবিদ্ধ বহু ঘটনার অনুরণন।

    বায়তুল মাকদাসের পড়শী মুসলিমরা কী অবস্থায় এ মাসকে স্বাগত জানাবে? তারা তো ক্রিমিনাল জয়েনিস্টদের ধারালো কুঠারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত।

    যেসব মুসলিম ভাইবোনদেরকে তাদের ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, সম্পদ থেকে মূলোৎপাটিত করে দেশান্তরিত করা হয়েছে সেই মুসলিম ভাইয়েরা কী হালতে স্বাগত জানাবে মাহে রমযানকে?

    ফিলিস্তিন সমস্যার অব্যাহত থাকা, বায়তুল মাকদিস, যা দুই কেবলার মধ্যে প্রথম, যা জিন্ন-ইনসানের সরদারের ইসরার স্থল, যা পবিত্রতম তিন মসজিদের মধ্যে তৃতীয়, সেই বায়তুল মাকদাস এখনো ইসরাঈলদের দখলদারিত্বে থাকা মুসলিমদের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ, বুদ্ধি ও ধর্মীয় আদর্শের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ, আদল-ইনসাফ, শান্তি ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। মুসলিমরা বহু জায়গায় আধুনিক যুগের নৃশংস যুদ্ধের অনলে জ্বলছে, নিঃশেষ হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ক্ষুধা, হত্যা , ভিটামাটি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদির শিকার হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা কীভাবে যে রমযানকে স্বাগত জানাবে তা ভাববার বিষয়।

    রমযান প্রজন্ম গড়ার শিক্ষালয়:

    সাওমদার ভাইয়েরা! মাহে রমযানে মুসলিম উম্মাহ ঐকান্তিকতার শিক্ষা নেয়, খেল-তামাশা থেকে বিমুক্ত হয়ে সিরিয়াসনেস অবলম্বনের শিক্ষা নেয়, জিহ্বায় লাগাম লাগানো, যা কিছু বললে পাপ হয় সেসব থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা নেয় এই মাহে রমযানে। হৃদয় পরিচ্ছন্ন রাখার, হিংসা, দ্বেষ, রেষারেষি থেকে মুক্তি লাভের শিক্ষা নেয় রমযানের এই পবিত্র মাসে বিশেষ করে উলামা ও দাওয়াতকর্মীগণ। ফলে বিচ্ছিন্ন হৃদয়গুলো অভিন্ন সুতোয় নিজেদেরকে বেঁধে নেওয়ার সুযোগ পায়। বিচ্ছিন্ন মেহনত-প্রচেষ্টা একীভূত হয় গঠনমূলক কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে, কমন শত্রুকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে। এ মাসে আমরা সবাই খুঁটিনাটী ভুল ধরা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে নিতে পারি। কে কোথায় সামান্য হোঁচট খেল তা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ খোঁজে নিতে পারি। কে কোথায় ভুল করল তা ফুঁক দিয়ে ফুলিয়ে প্রচার করার প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে পারি। কার কি উদ্দেশ্য সে বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারি।

    রমযান মাসে আমাদের যুবকদের কাছে প্রত্যাশা, তারা তাদের ভূমিকা যথার্থরূপে পালন করবে। তারা তাদের মিশনকে ভালোভাবে আয়ত্ত করবে। তারা তাদের রবের অধিকার বিষয়ে সচেতন হবে। তারা তাদের সরকার প্রধানদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হবে। মাতা-পিতা ও সমাজের অধিকার বিষয়ে সচেতন হবে।

    রমযানে মুসলিমদের শাসক ও শাসিতের মাঝে যোগাযোগের একটি উপলক্ষ্য সৃষ্টি হয়। উলামা ও সাধারণ মানুষের মাঝে, ছোট ও বড়র মাঝে সেতুবন্ধনের লক্ষণসমূহ দৃশ্যমান হয়। সবাই একহাত হয়ে, একশরীর হয়ে কাজ করার সুযোগ আসে, ফিতনা ফাসাদ দূর করার স্বার্থে, নির্যাতনে নিপতিত হওয়ার উপলক্ষ্যসমূহ দূরে ঠেলে দেওয়ার স্বার্থে, নৌকা যাতে ফুটো করা না হয়, বিল্ডিং যাতে ভেঙ্গে না পড়ে, সামাজিক ও চিন্তাগত অস্থিরতা যেন জায়গা করে নিতে না পারে সে উদ্দেশ্যে কাজ করে যাওয়ার স্বার্থে।

    রমযানে ভাল কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়, হৃদয়ে ঝোঁক সৃষ্টি হয়। এটা দাওয়াতকর্মী ও সংস্কারকদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ। সৎকাজের নির্দেশদাতা ও অসৎ কাজ থেকে বারণকারীদের জন্য বিরাট সুযোগ, যারা অন্যদেরকে দীক্ষিত করে তুলতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে তাদের জন্য বিরাট সুযোগ যে তারা তাদের কল্যাণকর্মসমূহ এ মাসে উত্তমরূপে পালন করতে পারবে। কেননা সুযোগ দ্বারপ্রান্তে আর মানুষের হৃদয়েও রয়েছে প্রস্তুতি।

    অতঃপর আল্লাহকে ভয় করুন হে আল্লাহর বান্দারা! রমযানের হাকীকতকে জানুন। রমযানের আদব ও আহকামকে জানুন। রমযানের দিবস রজনীকে সৎ কাজ দিয়ে ভরে দিন। রমযানের সাওমসমূহকে ত্রুটি থেকে বাঁচান। তাওবা নবায়ন করুন। তাওবার শর্তসমূহ পূরণ করুন। আশা করা যায় আল্লাহ আপনার পাপসমূহ মার্জনা করে দেবেন। যাদেরকে তিনি তাঁর রহমত ও করুণায় ভূষিত করবেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন আপনাকে তাদের মধ্যে শামিল করে নেবেন।

    মাহে রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ:

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমধিক বদান্য ব্যক্তি ছিলেন। মাহে রমযানে তাঁর দানশীলতার মাত্রা আরো বেড়ে যেত বহুগুণে। ইবনুল কাইয়েম রাহ. বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ছিল পূর্ণাঙ্গতম আদর্শ, উদ্দেশ্য সাধনে সর্বোত্তম আদর্শ। মানুষের পক্ষে পালনযোগ্য সহজতর আদর্শ। আর রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে আদর্শ ছিল: সকল প্রকার ইবাদত বাড়িয়ে দেওয়া। এ মাসে জিব্রিল ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কুরআন পঠন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে দান-খয়রাত বাড়িয়ে দিতেন। কুরআন তিলাওয়াত বাড়িয়ে দিতেন। সালাত ও যিকির বাড়িয়ে দিতেন। এ মাসে তিনি ইতিকাফ করতেন এবং এমন ইবাদতে এ মাসকে বিশেষিত করতেন যা অন্য কোনো মাসে করতেন না।

    সালাফে সালেহীনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদর্শ অনুসরণে সচেষ্ট হয়েছেন। তারা উত্তমরূপে সাওম পালনের ক্ষেত্রে সুন্দরতম আদর্শ স্থাপন করেছেন। তারা সাওমের উদ্দেশ্য হাকীকতকে ভালোভাবে আয়ত্তে এনেছেন এবং মাহে রমযানের দিবস-রজনীকে আমলে সালেহ দিয়ে ভরে রেখেছেন।

    প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!

    আপনারা যেভাবে এ মাসটিকে স্বাগত জানিয়েছেন একইরূপে আপনারা তাকে অচিরেই বিদায় দেবেন। আমরা এ মাসকে স্বাগত জানিয়েছি তবে জানি না পুরো মাস সাওম রাখার ভাগ্য আমাদের সবার হবে কি-না। আমরা তো প্রতিদিন বহু মানুষের জানাযা পড়ছি, যাদের সাথে আমরা অতীতে সাওম রেখেছি তাদের সবাই কি আমাদের মাঝে আছে?

    বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি যে রমযানকে আত্মসমালোচনার সুযোগ হিসেবে নেয়। নিজের বক্রতাকে সোজা করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। মৃত্যু তাকে অতর্কিতে হামলা করার পূর্বেই নিজের নফসকে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি বাধ্য করে। আর মৃত্যু যদি চলে আসে তবে সৎকাজ ব্যতীত অন্য কিছু কোনো কাজে আসবার নয়। অতঃপর এ মাসে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হোন। তাওবা করুন, লজ্জিত হোন, পাপ-গুনাহ থেকে ফিরে আসুন। নিজের জন্য, আত্মীয়স্বজনদের জন্য ও গোটা মুসলিম উম্মার জন্য দো‘আ মোনাজাতে খুবই পরিশ্রমী হোন।

    وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه وسلم

    [1] সহীহ বুখারী ও মুসলিম

    [2] সহীহ বুখারী ও মুসলিম

    [3] সহীহ বুখারী ও মুসলিম