দাড়ি রাখা ওয়াজিব
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
দাড়ি রাখা ওয়াজিব
এ.কিউ.এম মাসূম মজুমদার
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
وجوب إعفاء اللحية
(باللغة البنغالية)
أقيوم معصوم مجموعه دار
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............
দাড়ি রাখার আবশ্যকতা সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞ। অনেকেই দাড়িকে সাধারণ সুন্নাত বা আরবদের অভ্যাস করে থাকে। ফলে আজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদর্শটি সম্পর্কে মুসলিমরা উদাসীনতা দেখাচ্ছে। অনেকে এর অপব্যাখ্যা করছে। অথচ দাড়ি রাখার ওপর কুরআন, হাদীস ও উম্মতের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে।
বিসমিল্লাহির রাহিমানির রাহীম
সকল হামদ )সম্ভ্রমপূর্ণ প্রশংসা( আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের রব। আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাত ও সালাম পেশ করছি।
দাড়ি আল্লাহর একটি মহান ও বড় নি‘আমত। ইসলামের চিহ্ন বলে বিবেচিত। দাড়ি মানেই পুরুষত্ব, এটি পুরুষত্বের পরিচয়, মুসলিমের সৌন্দর্য। দাড়ি কেবল কিছুসংখ্যক চুল রাখা এমনটি নয়। এটি মহান আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন। এর দ্বারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢﴾ [الحج: ٣٢]
“আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটা তার হৃদয়ের তাকওয়া থেকে উদ্ভূত বা আল্লাহ সচেতনতার লক্ষণ।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩২]
শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসায়মীন রহ. বলেন, নবী-রাসূলদের সুন্নাত ও পথ নির্দেশনাই হলো দাড়ি রাখা। সকল নবীর দাড়ি ছিল। কেউই শেভ করে নি, দাড়িতে স্টাইল করেন নি। মহান আল্লাহ নবী হারূন আলাইহিস সালামের প্রসঙ্গ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যখন হারূন আলাইহিস সালাম তার ভাই মূসা আলাইহিস সালামকে বলেন,
﴿قَالَ يَبۡنَؤُمَّ لَا تَأۡخُذۡ بِلِحۡيَتِي وَلَا بِرَأۡسِيٓۖ إِنِّي خَشِيتُ أَن تَقُولَ فَرَّقۡتَ بَيۡنَ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ وَلَمۡ تَرۡقُبۡ قَوۡلِي ٩٤﴾ [طه: ٩٤]
“হারূন বললেন: ‘হে আমার সহোদর! আমার দাড়ি ও চুল ধরবেন না। আমি আশংকা করেছিলাম যে, আপনি বলবেন: তুমি বনী ইসরাঈলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছো ও আমার কথা শোনায় যত্নবান হও নি।” [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৯৪]
তাছাড়াও দাড়ির ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম এবং সালাফে সালেহীন তথা আমাদের নেককার উত্তরসূরীরাও আমাদেরকে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তাদের কেউই দাড়ি শেভ করতেন না।
সাহাবী কাইস ইবন সা‘দ রাদিয়াল্লাহু আনহুর দাড়ি উঠে নি। তার কাওম আনসাররা বলতো: “বীরত্ব ও সাহসিকতায় কতইনা সেরা মানুষ হলেন আমাদের নেতা কাইস ইবন সা‘দ; কিন্তু কষ্টের বিষয় হলো, তার কোনো দাড়ি নেই। দিরহাম দিয়ে যদি দাড়ি কেনা যেতো, তাহলে আমরা তার জন্য দাড়ি কিনতাম!!”
তদ্রূপ তাবে‘ঈ আহনাফ ইবন কায়েসেরও কোনো দাড়ি ছিল না, তিনিও তার গোত্রের নেতা ছিলেন। তার গোত্রের লোকেরা বলতেন: দাড়ি কিনতে ২০ হাজার দিরহাম লাগলেও, তা দিয়ে তার জন্য দাড়ি কিনতাম।” এটা এ জন্য যে, দাড়ি তাদের নিকট সৌন্দয্য ও পুরুষত্ব এবং পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতীক ছিল। তাদের গর্দান চলে যাক কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু দাড়ি যেন চলে না যায়, এ ব্যাপারে তারা আপোস করতেন না। আল্লাহ তা‘আলাই বেশি জানেন যে, পুরুষের জন্য কোনটি বেশি উপযোগী? তিনি পুরুষের জন্য দাড়ি চয়েস করেছেন, তাই এর দ্বারা তাকে সজ্জিত করেছেন। আল্লাহ যা চয়েস করেছেন, কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি কি সেটাকে অপছন্দ করতে পারে? কখনই না। আল্লাহ বেশি জানেন, নাকি বান্দা বেশি জানেন? কারণ, মানুষের জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা তাই বলেন,
﴿ءَأَنتُمۡ أَعۡلَمُ أَمِ ٱللَّهُۗ﴾ [البقرة: ١٤٠]
“তোমরা কি বেশি জান, না আল্লাহ?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৪০]
মহান আল্লাহ চাইলে পুরুষদেরকে সৃষ্টি করতে পারতেন দাড়ি ব্যতীত। কিন্তু তিনি দাড়ি দিয়ে পুরুষকে নারী থেকে স্বতন্ত্র (আলাদা) করে দিয়েছেন।
সম্মানিত ভাই, আপনি লক্ষ্য করুন, দাড়ি শেভ করে কী লাভ? এতে কি আপনার সাওয়াব হচ্ছে, না গোনাহ হচ্ছে? কেন আপনি মূল্যবান সময় ও অর্থ নষ্ট করছেন দাড়ি শেভের মত গোনাহের কাজে? দাড়ি কি আপনার নিকট একটি বোঝা? যদি বোঝা না হবে, তাহলে আপনি কেন শেভ করছেন? কেটে ছেটে খুব ছোট ছোট করে রাখছেন? দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাতকে বিক্রয় করা কি সঠিক কাজ?
চাকুরিজীবি অনেকের যুক্তি হলো: চাকুরি ঠিক রাখতে দাড়ি রাখি না। আপনি দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন যে, আপনার রিয্কের মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ, অন্য কেউ নয়। আবার কেউ বলেন, স্ত্রীর অনুমতি নেই, সে অসন্তুষ্ট হবে তাই দাড়ি শেভ করি। আপনার স্ত্রী অথবা যার অধীনে চাকুরি করছেন সে কি মহান আল্লাহ ও রাসূলের চাইতে আপনার নিকট বেশি প্রিয়?? কার সন্তুষ্টি, কার আনুগত্য করা আপনার বেশি দরকার? একবার চিন্তা করুন। আর হে প্রতিষ্ঠানের মালিক! আপনি আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহই আপনাকে প্রতিষ্ঠানের মালিক বানিয়েছেন। তার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে মানুষকে হারাম কাজে বাধ্য করবেন না। আর হে মুসলিম বোন! আল্লাহর শক্তির কথা ভুলে যাবেন না। সর্বদা মনে রাখুন যে, মহান আল্লাহ ও প্রিয় রাসূলের আনুগত্য করার প্রতিজ্ঞা করেই আমরা ইসলামে প্রবেশ করেছি। অতএব, আপনাদের নিকট মহান আল্লাহ তা‘আলা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন দুনিয়ার সব চাইতে প্রিয় হয়। এ ব্যাপারে সূরা আত-তাওবায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٤﴾ [التوبة: ٢٤]
“(হে নবী, আপনি তাদেরকে) বলুন, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের বাবারা, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভাইয়েরা, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে মন্দা পড়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর (আযাবের) বিধান (ও করুণ পরিণতি) আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৪]
আল্লাহকে ভয় করে ইসলামের বিধান মেনে চলুন। রূহ চলে গেলে মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউই আপনার কোনো উপকারে আসবে না, তিনি চাইলে আপনাকে অফুরন্ত সাওয়াব দিয়ে জান্নাতের অধিবাসী করে দিতে পারেন, আর এ জন্য দরকার তাঁর আনুগত্য ও আর তিনিই নির্দেশ করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করতে। মহান রব বলেছেন:
﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ عَلَيۡهِمۡ حَفِيظٗا ٨٠﴾ [النساء: ٨٠]
“যে রাসূলের আনগত্য করলো, সে আল্লাহরই আনগত্য করলো। আর যারা মুখ ফিরিয়ে নেয় আমরা আপনাকে তাদের ওপর রক্ষক নিযুক্ত করি নি”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০]
আর যে তিনটি ‘আমলের সাওয়াব মৃত ব্যক্তি পাবে, সেটাও আল্লাহর ইচ্ছামাফিক, যদি তিনি আমাদের যে কোনো নাফরমানী (অবাধ্যতা)। যেমন, দাড়ি শেভ করা অথবা নবীর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে দাড়ি না রাখার কারণে নারায বা অসন্তুষ্ট হয়ে সাওয়াব পৌছানো বন্ধ করে দেন অথবা কবরে বা হাশরে কঠিন সাওয়াল-জওয়াব এবং হিসাব নেন অথবা আমাদেরকে তাঁর রহমত বর্ষণ না করেন; যেহেতু শুধুমাত্র ‘আমল এককভাবে আমাদেরকে কখনোই জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না, তখন আমাদের অবস্থা কী হবে? সহীহ বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবে রয়েছে: বিখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«لَنْ يُدْخِلَ أَحَدًا عَمَلُهُ الجَنَّةَ» قَالُوا: وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: " لاَ، وَلاَ أَنَا، إِلَّا أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللَّهُ بِفَضْلٍ وَرَحْمَةٍ، فَسَدِّدُوا وَقَارِبُوا، وَلاَ يَتَمَنَّيَنَّ أَحَدُكُمُ المَوْتَ: إِمَّا مُحْسِنًا فَلَعَلَّهُ أَنْ يَزْدَادَ خَيْرًا، وَإِمَّا مُسِيئًا فَلَعَلَّهُ أَنْ يَسْتَعْتِبَ»
“তোমাদের কোনো ব্যক্তিকে তার নেক ‘আমাল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। লোকজন প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকেও নয়? তিনি বললেন, আমাকেও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে তাঁর করুণা ও দয়া দিয়ে আবৃত না করেন। কাজেই মধ্যমপন্থা গ্রহণ কর এবং নৈকট্য লাভের চেষ্টা চালিয়ে যাও। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। কেননা, সে ভালো লোক হলে বয়স দ্বারা তার নেক ‘আমাল বৃদ্ধি হতে পারে। আর খারাপ লোক হলে সে তাওবাহ করার সুযোগ পাবে”।[1]
তাঁর রহমত লাভ ব্যতীত আমরা কেউ কখনোই জান্নাতে যেতে পারবো না। যত বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হউক না কেন? মৃত্যুর পর বান্দা একমাত্র মহান রব ও একমাত্র মা‘বুদ আল্লাহকেই সাহায্যকারী পাবেন, সবাই চলে যাবে, আপনাকে কবরে আল্লাহর হিফাযতে ও রক্ষণাবেক্ষণে রেখে। আর নিয়ম মাফিক সবাই চাইবে মৃত্যুর পর দ্রুত দাফন করে রেখে যেতে। আল্লাহর ইচ্ছা না হলে সেদিন হতে আপনার মা-বাবা, স্ত্রী, পুত্র, সন্তান, ভাই-বোন কেউই আপনার কোনো উপকারে আসবে না।
তাই প্রকৃত ও সত্যিকার ঈমানদার হতে হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের জানের চাইতে এবং দুনিয়ার সবার চাইতে বেশি ভালোবাসতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ»
“কোনো বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ধন-সম্পদ ও অন্যসকল লোকদের চাইতে প্রিয় না হব”।[2]
নবীকে ভালোবাসা মানেই তার অনুসরণ করা অর্থাৎ যে কাজগুলো তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে করেছেন এবং করতে বলেছেন সেগুলো সবার আগে আমল করা।
এবার আমরা জানবো: পরিবারের কর্তা কে? পুরুষ নাকি নারী?
পরিবারের কর্তা কে? আপনার স্ত্রী না আপনি? মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “পুরুষরা নারীদের কর্তা” (সূরা আন-নিসা: ৩৪), নারীরা পুরুষের কর্তা নয়। ইসলাম ক্ষমতা দিয়েছে পুরুষের হাতে, পুরুষ তা ধরে রেখে প্রয়োগ না করতে পারলে সেজন্য পুরুষই দায়ী, নারী দায়ী নয়। আপনার স্ত্রীকে দীন ইসলাম সম্পর্কে জানানো, মানানো, সিরাতুল মুস্তাকিমে চলতে নসীহত করা, সহযোগিতা করা আপনারই দায়িত্ব, স্ত্রীর বাবা মা অথবা আপনার বাবা মায়ের দায়িত্ব এখন নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ المَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا».
“আল্লাহ ব্যতীত যদি অন্য কাউকে আমি সাজদাহ করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে তার স্বামীকে সাজদাহ করার অনুমতি দিতাম”।[3]
বয়স দাড়িতে নয়। দাড়ি রাখলেই মজাক করা বা বয়স্ক বলা অথবা দাড়ি বা দাড়িওয়ালা কাউকে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য অবজ্ঞা বা হেয় করা কুফুরী। আসলে দাড়ি না রাখতে পারার সমস্যাটা আমাদের নিজেদেরই সৃষ্ট। কেন আমরা বিয়ের পরবর্তী জীবনে আর দাড়ি রাখতে পারছি না?
জিজ্ঞাসা করলে বলে, আমি বিবাহিত, তাহলে দাড়ি রাখছেন না কেন? আরেকটা বিয়ে করবেন?
বলল: না।
তাহলে? এখনও শেভ করেন কেন? আর কী চাই?
জবাব নেই।
আমরা এর কারণ অনুসন্ধান করেছি মানুষ হতে:
প্রথমত: বিয়ের আগে দাড়ি না রাখলে পরে আর রাখা অনেকের ক্ষেত্রেই সহজে তা সম্ভব হয় না। কারণ, যে মেয়ের মধ্যে আল্লাহর ভয় নেই, সে মেয়ের পছন্দ হলো: দাড়ি শেভ করা বা দাড়ির স্টাইল করা পুরুষ। আবার অনেক ফাসেক বাবা-মায়েরাও যে ছেলে দাড়ি রাখে না তাকে পছন্দ করে তাদের মেয়ের জন্য। এখন স্ত্রীর ও তার পরিবারের পছন্দের বিরুদ্ধে গিয়ে পুরুষটি আর দাড়ি রাখতে পারছে না, কারণ সে জানে যে, তার স্ত্রী ও পরিবারটি কেমন? এভাবেই সে সর্বদা গোনাহ করছে। যদি ছেলেটি যুবক বয়স থেকেই দাড়ি রাখতো, তাহলে তার জন্য দাড়ি পছন্দ করে এমন পাত্রী ও পরিবার এগিয়ে আসতো। মনে রাখুন, আপনি যেমন দীনদার, ভালো স্ত্রী চান, আপনাকেও তারা দীনদার, আল্লাহকে ভয় করে, দাড়িওয়ালা ও ভালো দেখতে চায়।
ঠিক তেমনি ফাসেক কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান বা মালিক কোনো দাড়িওয়ালা পুরুষ বা বোরকাধারী দীনদার মেয়েকে চাকুরিতে নিয়োগ দিতে চায় না বলে অভিযোগ রয়েছে, যদি আমরা সবাই দাড়ি রাখতাম আর সব নারীরা বোরকা পরতো, তাহলে ঐ ফাসেক কোম্পানী বা নাফরমান বেটা চাকুরীর জন্য নাফরমান দাড়িহীন ব্যক্তি বা অর্ধউলঙ্গ নারী পেত কোথায়? বিয়ের বেলায় মেয়ের চয়েসও হতো দাড়িওয়ালা। চয়েস না করে যায় কই? যদি দাড়ি বিহীন পুরুষ পাওয়া না যায়। আর মানুষের শেভ করা নারীতুল্য তুলতুলে, ছাঁচা-ছোলা চেহারাটাই শুধু নয়, ভিতরটার খবর নেওয়া ও দেখা জরুরি। কয়দিন পর যৌতুক দাবী করে বসে কি না? বিড়ি, সিগারেট বা নেশা জাতীয় কিছু গ্রহণ করে কিনা? তবে দাড়িওয়ালা সবাই ভালো একথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না, যদি আল্লাহ সঠিক পথে না রাখেন। তাই, হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য আল্লাহর তাওফীক সর্বদা চাইতে হবে তবে, যে মানুষ যেমন, তার চয়েসও তেমন হয়ে থাকে। সেটাও ঠিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلۡخَبِيثَٰتُ لِلۡخَبِيثِينَ وَٱلۡخَبِيثُونَ لِلۡخَبِيثَٰتِۖ وَٱلطَّيِّبَٰتُ لِلطَّيِّبِينَ وَٱلطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَٰتِۚ﴾ [النور: ٢٦]
“দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য, দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্য, সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্রা পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্রা পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ২৬]
সমাজে ফাসেক থাকবেই। আমাদের কুরআন-সূন্নাহর দাওয়াতী কাজে গাফলতির কারণে। তার কারণ হলো: আমরা বসে থাকলেও, শয়তান তো বসে নেই। সে তার শয়তানী দাওয়াত চালাচ্ছেই, আল-কুরআনে রয়েছে:
﴿وَلَأُضِلَّنَّهُمۡ﴾ [النساء: ١١٩]
“(শয়তান বলল) আমি অবশ্যই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৯]
আমরা আশা করি যে, দীনের দাওয়াতের মাধ্যমে আমাদের এ সমস্যার সমাধান আসবে ইনশাআল্লাহ। সব কিছু আল্লাহই বেশি ভালো জানেন।
অনেকে মাথায় সবসময় টুপি রাখে, নফল ইবাদতও করেন; কিন্তু মুখে দাড়ি নাই। এটা সঠিক পদ্ধতি নয়। দাড়ি শেভ করা কবিরা গোনাহ। যদি সাগীরা গোনাহও বলা হয়, তাহলে বারবার সাগীরা গোনাহ করলে তা কবীরা গুনাহতে রুপান্তরিত হয়ে যায়।
ইমাম বাগাবী রহ. বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, পুরুষ চেনার মাধ্যম হলো দাড়ি, আর নারী চেনার মাধ্যম হলো মাথার ঝুটি। (মাথার সামনের দিকে চুল থাকলে বুঝতে হবে সে একজন নারী)”
শাইখ ইবন বায রহ. বলেন, দাড়ি আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরুষের জন্য এক সম্মানজনক বস্তু। এটা নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্যকারী। কাফের ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্যকারী, এটি চেহারার নূর। দাড়ি হলো গাল ও তার দুপাশের চুল ও নীম দাড়ি। এসবও কাটা, ছাটা বা শেভ করা কোনোক্রমেই জায়েয নেই ।
দাড়িবিহীন তাকওয়ার কাহিনী
মক্কাতুল মুকার্রামায় এক কুরাইশী ব্যক্তির সাথে কথা হলো: সে দাড়ি শেভ করে, চাকুরি করে এক প্রতিষ্ঠানে, আমিও কিছুদিন তার সাথে চাকুরি করেছি ছাত্র হিসেবে পার্ট-টাইম। আমি তাকে বললাম: আপনি দাড়ি রাখেন না কেন? সে বলল: আমার ক্বলব (অন্তর) ঠিক আছে, আমার অন্তরে তাকওয়া আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«التَّقْوَى هَاهُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ».
“তাকওয়া ‘এখানে’ একথা বলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বুকের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করলেন।”[4] কুরাইশী লোকটিও তার বুকের দিকে ইশারা করে বলল: তাকওয়ার জায়গা হলো: অন্তর (ক্বলব), দাড়ি নয়। অনেকে দাড়ি রাখে কিন্তু তাদের অন্তরে তাকওয়া নেই, (প্রসঙ্গতঃ বলি: আমাদের দেশের মানুষরা বলে, আমার অন্তর ঠিক আছে, সালাত, সাওম, ইবাদত, দাড়ি এগুলো না থাকলেও চলবে, আবার কেউ কেউ নিজেকে তুষ্ট রাখেন এভাবে: আমার অন্যান্য ‘ইবাদত তো ঠিক আছে, এটাই তাকওয়া, দাড়ি না থাকলেও চলবে।’ আল্লাহ মাফ করুন আমাদেরকে, এসব কথা শয়তানের প্রবেশপথ। এ জাতীয় মনগড়া কথা থেকে সাবধান।)
তখন আমি বললাম: অন্তরে তাকওয়া থাকলে, তার লক্ষণ হিসেবে মুখে দাড়ি থাকতো। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢﴾ [الحج: ٣٢]
“আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটা তার হৃদয়ের তাকওয়া হতে উদ্ভূত বা আল্লাহ সচেতনতার লক্ষণ।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩২]
আর দাড়ি হলো ‘আল্লাহর নিদর্শন’। অধিকাংশ মুসলিম দাড়ি রাখে ‘আল্লাহর নিদর্শন’কে সম্মান করেই। একথার আর কোনো জবাব দিতে পারে নি ঐ কুরাইশী ব্যক্তিটি।
কিন্তু মুসলিম সমাজে আল্লাহর অবাধ্য মুসলিমের কথা ভিন্ন। তারা স্টাইল করে দাড়ি রাখে, আবার কখনো রাখে, কখনো পরিস্কার করে শেভ করে, মন যা চায়, তা করে। সেটা দেখলেই চেনা যায়।
বর্তমানে দাড়ি নিয়ে খেল-তামাসা চলছে। কেউ কেউ এটাকে কেটে ছেটে থুতনির উপর নিয়ে রেখেছে, কেউ কেউ দাড়িকে হালকা সরল কালো রেখা, আবার কেউ বক্র রেখার মতো এঁকেছে। কেউ কেউ দাড়ি মোচ এক করে ফ্রেঞ্চ কার্টিন করে বৃত্ত অংকন করে রেখেছে, আবার কেউ দাড়ি মুণ্ডন করে হিটলার স্টাইলে মোচ রেখেছে শুধু নাকের ছিদ্র বরাবর নিচের জায়গাটুকু। আবার কেউ মোচ লম্বা করে রেখেছে বিখ্যাত হওয়ার বিশেষ চিহ্নস্বরূপ। আসলে এরা যেন নিজেকে ভাঁড়ের (jester) বা comedian এর মতো উপস্থাপন করতেই বেশি ভালোবাসে। তাদেরকে দেখলে ‘কে কত হাসতে পার’ কথাটি মনে পড়ে যায়। আবার দুঃচিন্তাও হয় তাদেরকে দেখলে। কেননা শরী‘আত নিয়ে তো তাদের এমনটি করার কথা নয়, তবুও করছে।
আবার অনেক যুবক কোনো খেলোয়াড় বা নায়কের নতুন ধরনের চুল বা দাড়ির কাটে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের চেহারাতেও সেরকম করার অযথা চেষ্টা চালায়। আবার কেউ কেউ স্টাইল করে কেটে-ছেটে খুব ছোট ছোট করে গালের সাথে মিলিয়ে রেখেছে। অনেকে ক‘দিন রাখে আবার ক‘দিন শেষ করে দেয়। এসব দাড়ি যে উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে, সেটাই হবে, সাওয়াব কখনও হবে না। (লা হাওলা ওয়ালা কুউয়্যাতা ইল্লাবিল্লা....) ।
শাইখ ইবন বায রহ. বলেন, কোনো পুরুষ যেন নিজেকে তার বোন, মেয়ে বা চাচী, খালা, মায়ের মত আকৃতি ধারণ না করে। তাছাড়া নিজেকে যেন বিজাতি কাফের, বে-দীনের মতো করে না ফেলে; বরং মুসলিম পুরুষ তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য বজায় রাখবে এবং ঘন করে দাড়ি রাখবে, যাতে তাকে পুরুষ মনে হয়। কাফের, মজুসী বা অগ্নি উপাসকের সাথে যেন নিজেকে এক করে না ফেলে। তারা লম্বা করে মোচ রাখে। অতএব, মোচকে কাটতে হবে এবং যত ছোট করে রাখা যায় তত ছোট করবে, আর দাড়ি রাখবে এবং একে লম্বা হতে দিবে। এটাই শরী‘আতের বিধান আর এটাই ওয়াজিব। (প্রশ্নোত্তর পর্ব: আল-জামেউল কাবীর, রিয়াদ)।
দাড়ি রাখা ওয়াজিব, শেভ করা হারাম। এ সংক্রান্ত শরী‘আতের দলীল নিচে বর্ণনা করা হলো,
১- দাড়ি শেভ করলে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করা হয়, যা করতে তিনি নিষেধ করেছেন। মহান রব আল্লাহ তা‘আলাকে মানবের সেরা শত্রু দুষ্ট ইবলিশ শয়তান বলল:
﴿وَلَأٓمُرَنَّهُمۡ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلۡقَ ٱللَّهِۚ﴾ [النساء: ١١٩]
“(শয়তান বলল) আর অবশ্যই আমি তাদেরকে নির্দেশ দিব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৯]
‘আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করা’ দ্বারা বুঝায়: যে সব নারী শরীরে উল্কি আঁকে ও ভ্রু কাটে এবং দাঁত কাটে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে।” আল্লাহ তা‘আলা এটি নিষেধ করেছেন।[5] এ ছাড়া ‘আলেমদের মতে, দাড়ি শেভ করা অথবা কাটছাট করে ষ্টাইল করে রাখাও আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করার মতো কাজ, যা হারাম।
২- সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে, ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«خَالِفُوا المُشْرِكِينَ: وَفِّرُوا اللِّحَى، وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ ».
“মুশরিকদের বিরোধিতা কর এবং মোচ খুব ছোট করে কাট ও দাড়ি লম্বা-ঘন কর”।[6]
তাছাড়া অন্য বর্ণনায় এসেছে,
«كان النبي صلى الله عليه وسلم كثير شعر اللحية رواه مسلم عن جابر ، وفي رواية كثيف اللحية»
জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়ি অধিক ও ঘন ছিল”।[7]
৩- সহীহ মুসলিমে রয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«جُزُّوا الشَّوَارِبَ، وَأَرْخُوا اللِّحَى , خَالِفُوا الْمَجُوسَ».
“তোমরা মোচ ভালো করে কাট ও দাড়ি রেখে দাও, অগ্নিপূজারীদের বিরোধিতা কর”।[8]
৪- সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় রয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«انْهَكُوا الشَّوَارِبَ، وَأَعْفُوا اللِّحَى»
“মোচ উত্তমরূপে কাট এবং দাঁড়ি লম্বা কর”।[9]
৫- বুখারীর অন্য এক বর্ণনায় আছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وفروا اللحى «
“দাড়ি বাড়াও (লম্বা-ঘন কর)”।[10]
৬- সাহীহ বুখারীতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:
«إِنَّ اليَهُودَ، وَالنَّصَارَى لاَ يَصْبُغُونَ، فَخَالِفُوهُمْ».
“ইয়াহূদী ও নাসারাগণ তাদের চুল বা দাড়ি সাদা হয়ে গেলে সেগুলোকে সাদা রেখে দেয়, তোমরা তাদের বিরোধিতা কর, তোমরা বার্ধক্যকে (কালো ব্যতীত) যে কোনো রং দিয়ে ঢেকে দাও”।[11]
৭- তিরমিযীতে রয়েছে, ‘আমর ইবন শুয়াইব তার বাবা থেকে, আর তার বাবা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَيْسَ مِنَّا مَنْ [ص:57] تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا، لَا تَشَبَّهُوا بِاليَهُودِ وَلَا بِالنَّصَارَى....
“যে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য বা মিল রেখে চলে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়, তোমরা ইয়াহূদী ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য রেখো না।” (চাল-চলন, বেশ-ভূষায় তাদের অনুকরণ করো না)।[12]
আর দাড়ি মুণ্ডানো বা ছাটা উভয়টিই গোনাহের কাজ। আর এটি মজুসী বা অগ্নি পূজাকারীদের কাজ, আর নবী আমাদেরকে বিজাতি, অমুসলিমদের অনুকরণ করতে নিষেধ করেছেন।
৮- অন্য হাদীসে রয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ».
“যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে”।[13]
৯- যারা অমুসলিমদের বেশভূষা বা চাল-চলন, চুল বা দাড়ির কাট-ছাট পছন্দ করে, তারা এটা বিজাতীদেরকে ভালোবেসেই করে, যদি এমনটি হয়, তাহলে তারা নিশ্চয় তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঈমানদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন
﴿وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَإِنَّهُۥ مِنۡهُمۡ﴾ [المائدة: ٥١]
“তোমাদের কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫১]
সম্মানিত ভাই! আপনি লক্ষ্য করুন যে, যে জিনিস বিজাতির প্রতীক, যা দেখলে তাদেরকে বিজাতি বলে সহজে চিহ্নিত করা যায়, কেবল সেই জিনিসেই সাদৃশ্য অবলম্বন নিষেধ।
বিজাতির অনুকরণ ও সাদৃশ্য অবলম্বনকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
প্রথমতঃ ইবাদতে বা দীনী বিষয়ে।
দ্বিতীয়তঃ আচার আচরণে।
তৃতীয়তঃ পার্থিব আবিষ্কার ও শিল্প বিষয়ে।
(কিতাবুস সুনান ওয়াল আসার আনিত তাশাব্বুহ বিল কুফফার, সুহাইল হাসান, পৃ. ৫৮-৫৯)
‘ইবাদতে বিজাতির অনুকরণ করা কোনো ক্রমেই বৈধ নয়। কারণ তাতে অনেক সময় মুসলিম ইসলাম থেকে খারিজও হয়ে যেতে পারে। আচার আচরণ ও লেবাস পোশাকেও বিজাতির অনুকরণ বৈধ নয়। কারণ, তাতে তাদের প্রতি মুগ্ধতা ও আন্তরিক আকর্ষণ প্রকাশ পায়।
আর আবিষ্কার ও শিল্প ক্ষেত্রে তাদের অনুকরণ করে পার্থিব উন্নয়ন সাধন করাতে কোনো দোষ নেই। এ অনুকরণ নিষিদ্ধ অনুকরণের পর্যায়ভুক্ত নয়। কারণ, শরী‘আত এটাকে নিষিদ্ধ করে নি, আর হালাল হারাম দেখতে হবে শরী‘আতের চশমা দিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত চশমা দিয়ে নয়।
১০- সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
«مَنْ بَنَى بِأَرْضِ الْمُشْرِكِينَ وَصَنَعَ نَيْرُوزَهُمْ وَمِهْرَجَانَهمْ وَتَشَبَّهَ بِهِمْ حَتَّى يَمُوت حُشِرَ مَعَهُمْ يَوْم الْقِيَامَة»
“যে ব্যক্তি মুশরিকদের দেশে বাড়ি তৈরি করল, তাদের নব বছরের উৎসব ও তাদের অন্যান্য উৎসব-দিবস পালন করল এবং তাদের সাথে সামঞ্জস্য বা মিল রেখে চললো তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহে অংশ নিল, আর এ অবস্থায় সে মারা গেল, তবে তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে”।[14]
কাফেরদের উৎসব পালন নাজায়েয হওয়ার কারণ বাহ্যিক ধরন-ধারণে সাদৃশ্যগ্রহণ ও আন্তর বিশ্বাস এই দুয়ের মাঝে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, এ বিষয়ে শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “সিরাতুল মুসতাকীম হৃদয়ে অবস্থিত, এটি: [এক] আন্তরিক বিষয়; যেমন আকীদা-বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি ইত্যাদি এবং [দুই] বাহ্যিক বিষয়; যেমন কথা-কাজ, হতে পারে তা ‘ইবাদত, হতে পারে তা খাবার, পোশাক, বিবাহ-শাদি, বাড়ি-ঘর, সম্মিলন ও বিচ্ছেদ, সফর-আরোহণ ইত্যাদি সংক্রান্ত। এইসব আন্তরিক ও বাহ্যিক বিষয়ের মাঝে সম্পর্ক রয়েছে। কেননা হৃদয়জগতে যে অনুভূতি আন্দোলিত হয়, তা বাইরের জগতে অবশ্যই বিভিন্নভাবে রূপায়িত হবে। আবার বাহ্যিক কাজকর্মও হৃদয়ের অনুভূতিকে জাগ্রত করে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন হিকমতসহ, যা হলো তাঁর সুন্নাত ও আদর্শ এবং তিনি তাঁর জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন সুনির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি। এই হিকমতের একটি হলো এই যে, তিনি রাসূলের জন্য এমন কথা ও কাজ বিধিবদ্ধ করেছেন, যা অভিশপ্তদের পথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অতঃপর তিনি বাহ্যিক বেশভূষায় তাদের উল্টো করতে বলেছেন, যদিও অনেকের কাছে বাহ্যত এতে কোনো প্রকার বিচ্যুতি বলে মনে হয় না। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে:
তন্মধ্যে একটি হলো, বাহ্যিক বেশ-ভূষায় সাদৃশ্য গ্রহণ, যে সাদৃশ্য গ্রহণ করল এবং যার সাদৃশ্য গ্রহণ করা হলো এদুজনের মাঝে ধরন-ধারণে এমন একটা সম্পর্ক কায়েম করে দেয়, যা আমল-আখলাকে একই রকম হওয়া পর্যন্ত নিয়ে যায়। এ বিষয়টি সহজেই অনুমেয়; ‘যে ব্যক্তি ‘আলেমদের পোশাক গ্রহণ করে সে নিজেকে ‘আলেমদের সাথে সম্পৃক্ত বলে অনুভব করতে থাকে। আর যে ব্যক্তি সৈনিকদের পোশাক পরে তার হৃদয়ে সৈনিকসংলগ্ন ভাব জন্মে। তার মেজাজও সৈনিকতুল্য হয়ে যায়। যদি না এ পথে কোনো বাধা থাকে।’
ইবন তাইমিয়াহ রহ. আরো বলেন, অমুসলিমদের সাথে এ সাদৃশ্য অবলম্বনে নিষেধাজ্ঞার হিকমতের মধ্যে আরেকটি হলো, বাহ্যিক ক্ষেত্রে উল্টো করা ভিন্নতা ও বিচ্ছেদ সৃষ্টির কারণ হয়, যা আল্লাহ নারাজ হওয়ার পথ এবং গোমরাহীর কারণ থেকে মানুষকে দূরে রাখে এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত ও আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্তদের প্রতি আগ্র্র্রহী করে। আর এর দ্বারা মুমিন ও আল্লাহর শত্রুদের মাঝে সম্পর্কচ্ছেদের যে বিধান আল্লাহ তা‘আলা রেখেছেন তা বাস্তবায়িত হয়। আর হৃদয় যত বেশি জাগ্রত ও জীবিত থাকবে, প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে যত বেশি জ্ঞানের অধিকারী হবে (এখানে প্রকৃত ইসলাম বলতে বোঝাচ্ছি সাধারণভাবে মুসলিমতুল্য প্রকাশ্য বেশ-ভূষা বা অপ্রকাশ্য বিশ্বাস পালনের কথা বলছি না), ততোই প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে ইয়াহূদী নাসারাদের থেকে আলাদা থাকার অনুভূতির পূর্ণতা পাবে। আর তাদের আচার-অভ্যাস, যা অনেক মুসলিমের মধ্যেই পাওয়া যায়, তা থেকে দুরে থাকার মানসিকতা তৈরি হবে।
অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য না করার হিকমতের মধ্যে আরেকটি হলো, প্রকাশ্য বেশভূষায় সাদৃশ্যগ্রহণ বাহ্যিক মেলামেশা ও সংমিশ্রণ-সম্মিলন সৃষ্টি আবশ্যক করে। হিদায়াতপ্রাপ্ত মুমিন এবং অভিশপ্তদের মাঝে ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্যের দেয়াল উঠে যায়। ইত্যাদি আরও অন্যান্য হিকমতও তাতে রয়েছে।
ধর্মীয় বিষয়ে নয় বরং সাধারণ বৈধ ক্ষেত্রে তাদের সাদৃশ্যগ্রহণের বিষয়টি যদি এরূপ ভয়ঙ্কর হয়, তাহলে যেসব বিষয় বিজাতীদের কাফের হওয়ার কারণ, সেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের অনুকরণের পাপ-অপরাধ তাদের পাপের মাত্রানুযায়ী নির্ধারিত হবে। এই মূলনীতিটি সবাইকে অনুধাবন করতে হবে।[15]
১১-সহীহ বুখারী, আবূ দাঊদ, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ’য় রয়েছে: ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ»
“যেসব পুরুষ নারীর সাথে এবং যেসব নারী পুরুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বেশ-ভূষা গ্রহণ করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত হওয়ার বদ-দো‘আ করেছেন”।[16]
এখানে উল্লেখ্য যে, পুরুষ যদি পোষাকে, বেশ-ভূষায়, সাজ-সজ্জায়, কথা-বার্তায়, চাল-চলনে, কাজ-কর্মে নারীর মতো আচরণ করে, তাহলে পুরুষও অভিশাপগ্রস্থ হবে, আর নারী যদি হুবহু এমনটি করে তাহলে সে নারীও অভিশপ্ত হবে যেমনটি বর্ণিত হাদীসে এসেছে। তদ্রূপ নারী কর্তৃক পুরুষের কন্ঠস্বর অনুকরণও এর আওতাভুক্ত। এ ছাড়াও নারী যখন পুরুষের মতো আঁটসাঁট, পাতলা ও শরীরের আবরণযোগ্য অংশ অনাবৃত থাকে এমন পোশাক পরিধান করে, তখন সে পুরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং অভিসম্পাতের যোগ্য হয়। তার এ আচরণ যদি তার স্বামী মেনে নেয় এবং তাকে এ থেকে বিরত না রাখে, তাহলে সেও অভিসম্পাতের যোগ্য হবে। কেননা স্ত্রীকে আল্লাহর আদেশের অনুগত রাখতে এবং তার নাফরমানী থেকে বিরত রাখতে সে আদিষ্ট। মহান আল্লাহ বলেছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ﴾ [التحريم: ٦]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর”। [সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬] (পরিবারের সবাইকে আল্লাহর আনুগত্য করতে আদেশ দান করুন এবং আল্লাহর নাফরমানী থেকে বিরত রাখুন)।
১২- দাড়ি রাখা আর মোচ কাটা শুধু অমুসলিমদের বিরোধিতাই নয় বরং এটা ফিতরাত বা স্বভাবজাত কাজও, এ ব্যাপারে উম্মুল মুমিনীন ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ، وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ، وَقَصُّ الْأَظْفَارِ، وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ، وَنَتْفُ الْإِبِطِ، وَحَلْقُ الْعَانَةِ، وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ " قَالَ زَكَرِيَّا: قَالَ مُصْعَبٌ: وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلَّا أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ زَادَ قُتَيْبَةُ، قَالَ وَكِيعٌ: " انْتِقَاصُ الْمَاءِ: يَعْنِي الِاسْتِنْجَاءَ ».
“দশটি বিষয় ‘ফিতরাতে’র অন্তর্ভুক্ত: মোচ কাটা, দাড়ি লম্বা রাখা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেওয়া, নখ কাটা, চামড়ার ভাঁজের জায়গাগুলো ধৌত করা, বগলের নিচের চুল তুলে ফেলা, নাভীর নিচের চুল মুণ্ডানো, (হাম্মাম বা বাথরুমের প্রয়োজন পূরণের পর) পানি দ্বারা পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। বর্ণনাকারী বলেন, দশম বিষয়টি আমি ভুলে গেছি, যদি না তা হয় ‘কুলি করা”।[17]
(আরবীতে ‘ফিতরাত’ শব্দের অর্থ স্বভাব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে উত্তম মানবীয় স্বভাব সৃষ্টি করেছেন তার সর্বোত্তম নিদর্শন নবী ও রাসূলগণ। এ কারণে ‘ফিতরাত’ শব্দটির অর্থ করা হয়েছে আদর্শ ও অনুকরণীয় স্বভাব তথা নবী ও রাসূলগণের স্বভাব)। তাই উপরোক্ত ‘আমলসমূহকে বলা হয়েছে,
الفطرة التي خلق الله الناس عليها،
এ হাদীস থেকে বোঝা যাচ্ছে, মোচ কাটা ও দাড়ি রাখাই হচ্ছে পুরুষের স্বাভাবিক অবস্থা এবং সকল নবী-রাসূলের সুন্নাহ ও আদর্শ, যাদের অনুসরণের আদেশ কুরআন মজীদে করা হয়েছে।
১৩- তাবারানী প্রণীত আল-মু‘জামুল কাবীরে রয়েছে, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ مَثَّلَ بِالشَّعْرِ، فَلَيْسَ لَهُ عِنْدَ اللهِ خَلَاقٌ».
“যে ব্যক্তি চুল-দাড়ি উঠিয়ে বা কেটে অথবা কালো করে নিজেকে বিকৃত করল, আল্লাহর নিকট তার কোনো অংশ নেই।” (আল্লাহর নিকট সে কিছুই পাবে না)।[18]
১৪- মুসনাদুল বায্যারে রয়েছে, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ تَشَبَّهُوا بِالأَعَاجِمِ غَيِّرُوا اللِّحَى».
“তোমরা অনারব তথা কাফেরদের সাথে মিল করো না (মোচ লম্বা করোনা), দাড়ি ঠিক করে রেখে দাও”।[19]
নিচের হাদীসটিও উপরোক্ত অর্থই বুঝায়:
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত,
«وَقَدْ رُوِيَ عَنْ اِبْن عُمَر عَنْ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ التَّشَبُّه بِالأَعَاجِمِ , وَقَالَ : مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ " وَذَكَرَهُ الْقَاضِي أَبُو يَعْلَى . وَبِهَذَا اِحْتَجَّ غَيْر وَاحِد مِنْ الْعُلَمَاء عَلَى كَرَاهَة أَشْيَاء مِنْ زِيّ غَيْر الْمُسْلِمِينَ» .
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনারবদের সাথে সাদৃশ্য বিধান থেকে নিষেধ করার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য বিধান করে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে।” যা কাযী আবু ইয়া‘লা উল্লেখ করেছেন। আর ওপর ভিত্তি করে আলেমগণ অমুসলিমদের বেশ কিছু বেশ-ভূষা ও পোশাক-আসাক গ্রহণ অপছন্দ করেছেন”।[20]
উপরোক্ত হাদীসসমূহ ও রেওয়ায়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোচ খু্ব ছোট ছোট করে কাটতে এবং দাড়ি লম্বা ও ঘন করে রাখার আদেশ করেছেন।[21]
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে কোর্টে সাক্ষ্য দিতে দেন নি, যে নিজ দাড়ি উপড়ে ফেলতো।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ করার ব্যাপারে আল-কুরআনের নির্দেশ:
১- আল-কুরআন ও সুন্নাহর এবং আলেমদের অভিমতের সার- সংক্ষেপ হলো: দাড়ি রাখা ওয়াজিব। দাড়ি শেভ করা বা কাটা হারাম ও নাজায়েয। কেননা, রাসূলের নির্দেশ দ্বারা এখানে ওয়াজিব বুঝায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ﴾ [الحشر: ٧]
“রাসুল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭]
২- দাড়ি শেভ করা আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা: আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন আল-কুরআনে বলেন,
﴿وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلٗا مُّبِينٗا ٣٦ ﴾ [الاحزاب: ٣٦]
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে ব্যাপারে তাদের নিজেদের কোনো রকম (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার থাকবে না। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, সে নিঃসন্দেহে সুস্পষ্টভাবে গোমরাহ (পথভ্রষ্ট) হলো।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৬]
৩- আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অবাধ্যতা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِلَّا بَلَٰغٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِسَٰلَٰتِهِۦۚ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ لَهُۥ نَارَ جَهَنَّمَ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًا ٢٣ ﴾ [الجن: ٢٣]
“শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে পৌঁছানো এবং তাঁর রিসালাতের বাণী প্রচারই আমার দায়িত্ব। আর যে- কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ২৩]
৪- আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য না করা আমল বরবাদ হওয়ার কারণ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَلَا تُبۡطِلُوٓاْ أَعۡمَٰلَكُمۡ ٣٣﴾ [محمد: ٣٣]
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসুলের আনুগত্য কর, আর তোমরা তোমাদের আমলগুলো বিনষ্ট করো না।” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৩]
৫- আল্লাহ ও তার রাসূলের বাধ্য মুমিনদের কাজ হলো আল্লাহ তা‘আলা ও তার রাসূলের ফয়সালা মেনে নেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا كَانَ قَوۡلَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذَا دُعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ لِيَحۡكُمَ بَيۡنَهُمۡ أَن يَقُولُواْ سَمِعۡنَا وَأَطَعۡنَاۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٥١﴾ [النور: ٥١]
“মুমিনদের উক্তি তো এই –যখন তাদের মধ্যে বিচার- ফায়সালা করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫১]
৬- নির্দ্বিধায় আল্লাহ তা‘আলার রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালা মানতে হবে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء: ٦٥]
“কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের ঝগড়া-বিবাদের বিচারের ভার আপনার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫]
৭- আল্লাহ তা‘আলা ও তার রাসূলের আনুগত্য না করলে ফিতনা ও শাস্তি অবতীর্ণ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সূরা নূরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴾ [النور: ٦٣]
“কাজেই যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপদ বা বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩]
মহান আল্লাহর অবাধ্যতায় মগ্ন হবার সময় আমাদের মনে রাখা উচিৎ, আল্লাহর একটি মাত্র আদেশের অবাধ্যতা করে ইবলিশ শয়তান জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।
৮- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের প্রতি বিরাগভাজন হওয়া দীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে আমার আদর্শের প্রতি বিরাগভাজন হয় সে আমার দলভুক্ত নয়”।[22]
৯- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যা আদর্শ নয় তা কখনও গ্রহণযোগ্য নয়। সহীহ মুসলিমে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ»
“যে কেউ এমন আমল করবে যা করতে আমরা নির্দেশ দেই নি, তা প্রত্যাখ্যাত।”[23]
দাড়ি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ। আদেশ, আমল এবং স্বীকৃতি ইত্যাদি সর্বোতভাবে তিনি বলেছেন দাড়ি বড় করার কথা, সেহেতু এটা কামিয়ে ফেলা তাঁর সম্মানিত আদর্শ তথা জীবনাচরণের প্রতি চরম অবমাননা।
১০- শুভ্র দাড়ির ব্যাপারে যত্নবান হতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন। আমর ইবন শু‘আইব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا تَنْتِفُوا الشَّيْبَ، فَإِنَّهُ نُورُ الْمُسْلِمِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ».
“বার্ধক্যে (সাদা চুলকে) উপড়ে ফেলো না। কেননা তা কিয়ামতের দিন মুসলিমের জন্য আলোকবর্তিকা হবে”।[24]
১১- দাড়ি রাখা অপছন্দ করা আর মোচ রাখা পছন্দ করার অর্থ সে রাসূলের দলভুক্ত লোক নয়। কারণ হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে আমার সুন্নাহ বা আদর্শকে অপছন্দ করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।[25]
শাইখ ইবন বায রহ. বলেছেন, মোচ কাটাও ওয়াজিব। মোচ ভালো করে কেটে নেওয়া উত্তম। এর অর্থ মোচ শেভ করা নয়। লম্বা, ঘন মোচ রাখা নাজায়েয ও গোনাহের কাজ, এটা করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজের বিরোধিতা করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে মোচ কাটতে বলা হয়েছে, কামিয়ে ফেলতে বলা হয় নি।
১২- মোচ না কাটার ব্যাপারে কঠিন সাবধানবাণী এসেছে। সুনান নাসাঈতে সহীহ সনদে রয়েছে, সাহাবী যাইদ ইবনুল আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ لَمْ يَأْخُذْ مِنْ شَارِبِهِ فَلَيْسَ مِنَّا»
“যে মোচ ছোট করে ছাটে না, সে আমার উম্মতের অর্ন্তভুক্ত নয়”।[26]
১৩- দাড়ি না রাখা অগ্নি উপাসকদের আদর্শ। ইমাম ইবন জারীর তাবারী রাদিয়াল্লাহু আনহু যায়েদ ইবন আবী হাবীব রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে, ইয়েমেনের শাসকের পক্ষ থেকে দু’জন লোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এল। তাদের দাড়ি মুণ্ডানো ছিল এবং মোচ লম্বা ছিল। তাদের চেহারার দিকে তাকাতেও আল্লাহর রাসূলের কষ্ট হচ্ছিল। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদের মরণ হোক! এ কাজ করতে কে তোমাদেরকে বলেছে? তারা বলল, আমাদের প্রভু (কিসরা) আমাদেরকে আদেশ করেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«وَلَكِنَّ رَبِّي أَمَرَنِي بِإِعْفَاءِ لِحْيَتِي وَقَصِّ شَارِبِي»
“কিন্তু আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন, দাড়ি লম্বা রাখার ও মোচ খাটো করার”।[27]
এখানে কয়েকটি বিষয় জেনে রাখা দরকার
দাড়ির বিধানটি শরীয়তের একটি মৌলিক ও সকলের পালনীয় বিধান। একে নিছক আরবীয় রীতি বা বিশেষ স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা মারাত্মক ভ্রান্তি।
১৪- অনেকে দাড়িকে অপছন্দ করে বা দাড়ি নিয়ে মজাক-মশকারী করে এটা কুফুরী কাজ। এটা দ্বারা তাদের দীন নষ্ট করে ফেলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَرِهُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأَحۡبَطَ أَعۡمَٰلَهُمۡ ٩﴾ [محمد: ٩]
“এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই তিনি তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৯]
১৫- দাড়ি নিয়ে মশকারী করা মুনাফিকদের কাজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُمۡ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلۡعَبُۚ قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ ٦٦﴾ [التوبة: ٦٥، ٦٦]
“আর আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করলে তারা অবশ্যই বলবে, ‘আমরা তো আলাপ- আলোচনা ও খেল-তামাশা করছিলাম।’ বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে বিদ্রূপ করছিলে?’ ‘তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরী করেছ।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৫ -৬৬]
দাড়ি মুসলিম জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য ও স্বকীয়তার প্রতিক:
পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতি বা গোষ্ঠির মধ্যে কিছু স্বাতন্ত্রবোধ বা স্বকীয়তা রয়েছে যা তাদের একান্ত নিজস্ব ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করে। যেমন আমেরিকাতে ইয়াহূদীদের চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। দাড়ি, দু’দিকে ছোট বেনী বিশিষ্ট জুলফি, কালো লম্বা পোষাক, মাথার তালুতে ছোট টুপি ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের অন্য জাতি থেকে আলাদা করা যায়। ইয়াহূদীরা তাদের এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো প্রকার হীনমন্যতায় ভোগে না। বরং এসবকে তারা তাদের গর্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ধারণ করে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত স্বল্প কিছু ইয়াহূদী সমগ্র আমেরিকার অর্থনীতি ও রাজনীতিকে প্রচ্ছন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ইয়াহূদী লবিকে সমীহ না করে আমেরিকায় কোনো সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে না।
ভারতের শিখজাতি সারা পৃথিবীতে তাদের পৃথক বৈশিষ্ট্যের জন্য সুপরিচিত। সকল শিখ তাদের ধর্মগুরু নানকের নির্দেশকে শিরোধার্য করে দাড়িমন্ডিত থাকেন এবং বিশেষ এক ধরণের পাগড়ি ব্যাবহার করেন। পাগড়ী ও দাড়ি গোঁফের জন্য তারা বিব্রতবোধ করেন না বরং তাদের এসব ধর্মীয় এতিহ্য তাঁরা সর্বাবস্থায় ধারণ করেন। যে কারণে খেলার মাঠ থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী পর্যন্ত সকল স্থানে তাদের একই রূপ দৃষ্টিগোচর হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ শিখদেরকে সেনাবাহিনীর ক্যাপ ব্যবহার করাতে কিংবা ক্লিন শেভড থাকতে বাধ্য করতে পারে নি। শিখরা তাদের ধর্মীয় চেতনা ও চিহ্নসমূহ ধারণ করেই গর্বের সাথে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রশংসিত অবদান রেখে যাচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা যারা মুসলিম তারা ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে প্রচণ্ড হীনমন্যতায় ভুগি। দাড়ি, টুপি, টাখনুর উপর পোষাক পরিধান আমাদের ইসলামী ঐতিহ্যের নিশান বা “শি‘আর” হলেও আমরা তা পালন করতে দ্বিধাবোধ করি এবং এসব পালনের ব্যাপারে নানা অজুহাতের অবতারনা করি।
দাড়ির ব্যাপারে বিখ্যাত ‘আলেমদের অভিমত:
এদের মধ্যে- শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যা রহ., ‘আল্লামা ইবন হাযম আয-যাহিরী রহ., ‘আল্লামা ইবন আবদুল বার্র, ‘আল্লামা আহমদ ইবন আবদুর রহমান আল বান্না রহ., মুহাদ্দিস শাইখ নাছের উদ্দিন আল-আলবানী রহ., সৌদি আরবের প্রধান মুফতি আব্দুল আযীয ইবন বায রহ., শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল উসায়মীন, ডা. জাকির নায়েক উল্লেখযোগ্য।
১- হাফেয ‘আল্লামা আবু মুহাম্মদ আলী ইবন হাযম (মৃত: ৪৫৬ হি.) বলেন,
اتفق العلماء على أن قص الشارب وإعفاء اللحية فرض.
“সমস্ত আলেম একমত যে, মোচ কাটা এবং দাড়ি রাখা ফরয (ওয়াজিব)।”
২- ইমাম ইবন আবদিল বার্র রহ. (মৃত: ৪৬৩ হি.) তার তামহীদ কিতাবে বলেন,
يحرم حلق اللحية ولا يفعله إلا المخنثون من الرجال يعني بذلك المتشبهين بالنساء
“দাড়ি শেভ করা হারাম। আর এ কাজটি মুখান্নাচ বা নারীর বেশ ধারণকারীই করে, কোনো পুরুষের কাজ নয় এটি।”
৩- ইমাম কুরতুবী (রহ.) (মৃত: ৬৭১ হি.) বলেন, দাড়ি শেভ করা বা উঠিয়ে ফেলা বা কাট-চাট করে ষ্টাইল করে রাখা নাজায়েয। দাড়ি রাখা, বাড়িয়ে ও ঘন করে রাখা ফরয। দাড়ি শেভকারী তার এ গোনাহকে সবার সামনে প্রকাশ করে, যা অতি কঠিন হারাম কাজ। সহীহ বুখারীর হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُلُّ أُمَّتِي مُعَافًى إِلَّا المُجَاهِرِينَ،».
“আমার উম্মতের সবাইকে আল্লাহর রহমতে মাফ করা হবে, তবে তারা ব্যতীত যারা গোনাহ ও নাফরমানীকে সকলের কাছে প্রকাশ করে বেড়ায়......”।[28]
৪- শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা রহ. (মৃত: ৭২৮ হি.) বলেন, দাড়ি শেভ করা হারাম।
৫- আবুল হাসান ইবনুল কাত্তান আল মালেকী রহ. বলেন, আলেমরা একমত যে, দাড়ি শেভ করা অঙ্গবিকৃতি করার মতো হারাম কাজ।”
৬- সৌদী আরবের সামাহাতুশ শাইখ আল্লামা শায়খ ইবন বায (রহ.) (মৃত: ১৪২০ হি.) বলেন, দাড়িকে সংরক্ষণ করা, পরিপূর্ণ, ঘণ রাখা ও ছেড়ে দেওয়া ফরয। এই ফরযের প্রতি অবহেলা করা জায়েয নয়। আর দাড়ি মুণ্ডানো (শেভ করা) ও ছোট করা হারাম।
৭- শাইখ ইবন উসাইমীন রহ. (মৃত: ১৪২১ হি.) বলেন, দাড়ি রাখা ওয়াজিব, তা শেভ করা হারাম (কবীরা গুনাহ)।
৮- আব্দুর রহমান আল বান্না তার প্রসিদ্ধ “আল–ফাতহুর রব্বানী” গ্রন্থে লিখেন ‘দাড়ি মুণ্ডানো (শেভ করা) হারাম’।
৯- শাইখ আলবানী রহ. তার “আদাবুয যিফাফ” গ্রন্থে দাড়ি মুণ্ডানো (শেভ করা) হারাম হওয়ার ওপর ৪টি দলীল উল্লেখ করে বলেন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, দাড়ি বৃদ্ধি করা ওয়াজিব এবং দাড়ি মুণ্ডানো (শেভ করা) করা হারাম।
১০- ‘আলেমে দীন হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. তাঁর বিখ্যাত “ইসলাহুর রুসুম” গ্রন্থে লিখেছেন যে সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে উল্লেখ রয়েছে-“আ‘ফুল লূহা ওয়া আহ্ফুস্ শাওয়ারেব” যার অর্থ: “তোমরা দাড়ি বড় কর ও মোচ ছোট কর।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুকুম করেছেন ছিগায়ে আমর দ্বারা অর্থাৎ হুকুমবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা। আর ‘আমর’ (আদেশ) হাকীকাতান (মূলত) ওয়াজিবের জন্য ব্যবহার হয়।
১১- শেখ আলী মাহফুয আল আযহারী বলেন, ৪ মাযহাবের আলেমগণ একমত যে, দাড়িকে ঘন রাখা ওয়াজিব, শেভ করা হারাম।”
প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফিকহবিদগণও দাড়ি ছেড়ে দেওয়া ওয়াজিব ও কেটে ফেলা বা শেভ করাকে হারাম বলে মত প্রকাশ করেছেন।
দাড়ির পরিমাপ:
দাড়ি রাখা ওয়াজিব এটা প্রমাণিত হলো। দাড়ি এক মুষ্টি বা চার আংগুল পরিমান লম্বা রাখতে হবে। এক মুষ্টির কম রাখা বা একেবারে তা মুণ্ডিয়ে ফেলা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম এবং কবীরা গুনাহ। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়ি রাখা এবং তার অসংখ্য হাদীসে উম্মতের প্রতি দাড়ি রাখার সাধারণ নির্দেশই প্রমাণ করে যে, দাড়ি রাখা ওয়াজিব এবং না রাখা হারাম। ফিকহ শাস্ত্রের একটি মূলনীতি হচ্ছে, ‘শরী‘আত প্রবর্তক কর্তৃক কোনো বিষয়ের প্রতি সাধারণ নির্দেশ আসলে তা পালন করা ওয়াজিব এবং বিপরীত করা হারাম’। এছাড়া সাহাবা, সালাফে সালেহীন এবং ফক্বীহগণের দাড়ি রাখার নিরবছিন্ন আমল এবং তাদের বিভিন্ন উক্তিসমূহের দ্বারাও এক মুষ্টি পরিমাপ লম্বা দাড়ি রাখা ওয়াজিব এবং এর বিপরীত করা হারাম সাব্যস্ত হচ্ছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে আজমা‘ঈন, তাবেঈ তাবে-তাবেঈ, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, চার মাযহাবের সকল ইমাম ও বুযুর্গবৃন্দ, আহলে হাদীস, আহলে যাহেরের আলেমগণ দাড়ি এক মুষ্টির চেয়ে বেশি বা কমপক্ষে একমুষ্টি বা ৪ আঙ্গুল রাখাকে ওয়াজিব কিংবা আবশ্যিক সুন্নাহ বলেছেন।
সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হোক আর ওয়াজিব হোক, সোজাকথা হলো: নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে কমপক্ষে এক মুষ্টি বা চার আংগুল বা কিছুটা লম্বা দাড়ি রাখা একজন মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য; কারণ এটা মুসলিমর পরিচয় বহন করে। একটি সূন্দর ব্যাপার হচ্ছে, লম্বা (কমপক্ষে এক মুষ্টি বা চার আঙ্গুল) এবং বড় দাড়ি রাখা যে অবশ্য কর্তব্য সুন্নাত এটি প্রমাণ করার জন্য ইজমা‘ বা কিয়াসের প্রয়োজন হয় না বরং কুরআন থেকে পরোক্ষভাবে এবং সুন্নাহ থেকে প্রত্যক্ষভাবে আমরা তা জানতে পারি।
হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়, আবু যুর‘আ রহ. বলেন, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার দাড়ি মুঠ করে ধরতেন। এরপর এক মুষ্ঠির অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন।[29]
‘আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যখন হজ কিংবা ওমরা করতেন, তখন দাড়ি মুঠো করে ধরতেন এবং মুঠোর বাহিরের যা বেশি হত তা কেটে ফেলতেন।[30]
নাফে‘ রহ. বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কেটে ফেলতেন।[31]
হাসান বসরী রহ. বলেন, তারা (সাহাবী-তাবেঈন) মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কাটার অবকাশ দিতেন।[32]
জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা হজ ও উমরা ছাড়া সবসময় দাড়ি লম্বা রাখতাম।”[33]
খলীফা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বড় দাড়ি বিশিষ্ট ছিলেন, জালালুদ্দিন সুয়ুতি “তারিখুল খুলাফা” গ্রন্থে লিখেছেন- আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু অনেক বড় দাড়িবিশিষ্ট ছিলেন।
হাফেয ইবন হাজার আসকালানীর প্রামাণ্যগ্রন্থ ‘আল-ইছাবা’তে আছে -এভাবে বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থে খুলাফায়ে রাশেদীনসহ সকল অনুসরনীয় সাহাবীদের যে লম্বা সুন্দর মানানসই দাড়ি ছিল, এব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সাহাবীগণের সেই আমলও সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মতি ছিল বা যা দেখে তিনি নিষেধ করেন নি।
দাড়ির ব্যাপারে চার মাযহাবের চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গি
হানাফী মাযহাব:
১. হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘দুররে মুখতারে’ (২য় খ. ৪৫৯ পৃ.) বলা হয়েছে: পুরুষের জন্য দাড়ি কর্তন করা হারাম। নিহায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, দাড়ি এক মুষ্টির বেশি হলে তা কেটে ফেলা ওয়াজিব। কিন্তু এর চাইতে বেশি কর্তন করা যেমনটি পশ্চিমা দেশের লোকেরা এবং খোঁজা পুরুষেরা করে তা কেউ বৈধ বলেন নি। আর দাড়ি সম্পূর্ণটাই কেটে চেঁছে ফেলা হিন্দুস্থানের ইয়াহূদী ও কাফের–মুশরিকদের কাজ।”
২. হানাফী মাযহাবের মশহুর ফকীহ ইবনুল হুমাম বলেন “এক মুষ্টির ভিতর দাড়ি কর্তন করা কারো মতেই বৈধ নয়।”
৩. হানাফী মাযহাবের কিতাব ‘শারহে মানজুমাতুল আদাবের’ মধ্যে লিখেছেন, নির্ভরযোগ্য ফাতওয়া হলো দাড়ি মুণ্ডানো হারাম।
মালেকী মাযহাব:
১. মালেকী মাযহাব মতেও দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম। অনুরূপভাবে ছুরত বিগড়ে যাওয়া মত ছেটে ফেলাও হারাম।
২. মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী আল-মালেকী সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “আল–মুফহিম” এ লিখেন ‘দাড়ি মুণ্ডানো ও উপড়ানো কোনোটাই বৈধ নয়’।
৩. মালেকী মাযহাব মতে দাড়ি কাটা হারাম। (আল আদাভী আলা শারহে কিফায়াতুত্ তালেব রাব্বানী ৮ম খণ্ড, ৮৯ পৃ.)
শাফেঈ মাযহাব:
১. ইমাম শাফেঈ রহ. তার প্রখ্যাত গ্রন্থ “আল উম্ম” উল্লেখ করেছেন যে, দাড়ি কর্তন করা হারাম।
২. শাফেঈ মাযহাবের আলেম আযরা‘ঈ বলেন, সঠিক কথা হচ্ছে কোনো কারণ ছাড়া সম্পূর্ণ দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম।[34]
৩. শাফেঈ‘ মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম ইবনুর রিফ‘আহ শাফিয়ী তার বিখ্যাত রচনা ‘আলকিফায়াতু ফি শারহিত তানবিয়াহ’তে লিখেন–ইমাম শাফেঈ রহ. তার “আল–উম্ম” পুস্তকে দাড়ি মুণ্ডনকে হারাম বলেছেন।”
হাম্বলী মাযহাব:
১. শাইখুল ইসলাম ‘আল্লামা ইবন তাইমিয়্যা রহ. বলেন, দাড়ি মুণ্ডানো বা শেভ করা হারাম।
২. ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের মাযহাবের ‘আলেমগণও দাড়ি শেভ করাকে হারাম বলেছেন। (আল-ইনসাফ, শরহে মুন্তাহাল ইরাদাত) অতএব দাড়ি মুণ্ডন করা কবীরা গুনাহ। এমন জঘন্য কাজ থেকে আজই তওবা করা আবশ্যক। ঐ মাযহাবের বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাব “শারহুল মুন্তাহা”তে উল্লেখ হয়েছে যে, ‘দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম’।
৪. ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. রচিত “কিতাবুয-যুহদে” ‘আকীল ইবন মোদরেক সুলামী থেকে উদ্ধৃতি করেন যে, আল্লাহ জাল্লা শানুহু বনী ইসরাঈলের এক রাসূলের নিকট এই অহী প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন নিজ কাওম বনী ইসরাইলকে এ কথা জানিয়ে দেন যে, তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার শত্রুদের বিশেষ খাদ্য শুকরের মাংস না খায় এবং তাদের বিশেষ পানীয় অর্থাৎ শরাব (মদ) পান না করে এবং তাদের দাড়িকে স্টাইল করে কোনো সুরত বা আকৃতি না বানায়। যদি তারা এমন করে অর্থাৎ শুকরের গোশত খায়, বা মদ পান করে অথবা দাড়ি মুণ্ডায় বা স্টাইল করে কাট-ছোট করে অথবা লম্বা লম্বা মোচ রাখে, তাহলে তারাও আমার শত্রু হবে। যেমন, তারা আমার শত্রু।[35]
কতিপয় মাসআলা: জেনে নিন
এক. বিশেষ কারণে দাড়ি কাটতে বাধ্য হলে কী করবেন?
আপনি কোথাও কারো অধীনে কাজ করলে, সে যদি দাড়ি ছোট ছোট করে রাখতে বলে, না হয় কাজে রাখবে না। যদি প্রতিষ্ঠানের মালিক বা কফিলকে দাড়ি কাটা হারাম বললে, সে আপনার উপর আরো বেশি রাগ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আপনি যদি পারেন অন্যত্র চাকুরি নিতে, তা উত্তম। আর যদি চাকুরি পাওয়া কঠিন হয়, বা সহজে পাওয়া যায় না, তাহলে আপনি অতীব প্রয়োজন জরুরতের কারণে দাড়ি যতটুকু ছোট করতে বলেছে, ঠিক ততটুকুই করবেন, এর বেশি নয়। এ পথটি ‘আলেমগণ জায়েয রেখেছেন অতীব জরুরতের কারণে। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ﴾ [التغابن: ١٦]
“তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর যথাসাধ্য”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬] (www.islamqa.info)
দুই. সেলুন দোকান দিতে হলে কী করবেন?
সেলুন দোকান দিতে হলে নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে দিতে হবে:
১- শুধুমাত্র যে সব চুল কাটা বা শেভ করা জায়েয, সেগুলো কাটবে। যেমন, মাথার চুল, অনুরূপভাবে মোচ ইত্যাদি।
২- কাফেরদের এবং নারীদের স্টাইলে চুলের কাট-চাট দেওয়া যাবে না।
৩- মাথার কিছু চুল ছোট করে কাটবে, কিছু লম্বা রাখবে, এমনটি করতে পারবে না, এটা শরী‘আতে হারাম কাজ।[36]
তিন. চাকুরির জন্য দাড়ি শেভ করার শর্ত দিলে কী করবেন?
চাকুরির জন্য দাড়ি শেভ করা শর্ত দিলে এ চাকুরী করবেন না: শাইখ ইবন বায রহ. বলেন, যদি কাউকে কোনো কোম্পানী বা মালিক এ শর্তে কাজ দেয় যে, দাড়ি শেভ করতে হবে, তাহলে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এ দাড়ি শেভের শর্তে একমত না হয় এবং এ কাজ না নেয়। কেননা, রিযিকের বহু পথ রয়েছে, এ পথ বন্ধ নয়, বরং সর্বদা খোলা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢ وَيَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَيۡثُ لَا يَحۡتَسِبُۚ وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ بَٰلِغُ أَمۡرِهِۦۚ قَدۡ جَعَلَ ٱللَّهُ لِكُلِّ شَيۡءٖ قَدۡرٗا ٣ ﴾ [الطلاق: ٢، ٣]
“আর যে কেউ আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য উত্তরণের বা বাঁচার পথ করে দেবেন এবং তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর ইচ্ছে পূরণ করবেনই, অবশ্যই আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন সুনির্দিষ্ট মাত্রা। [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত: ২-৩] যে কোনো কাজে আল্লাহর নাফরমানী করতে হলে সে কাজে যোগদান করবেন না। অন্য যে কোনো হালাল কাজ তালাশ করুন। তাদের সাথে আপনিও গোনাহ ও আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা লংঘনে সহযোগিতা করবেন না। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ﴾ [المائدة: ٢]
“তোমরা নেক কাজ ও তাকওয়ায় পরস্পর সাহায্য করবে এবং গোনাহ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ২]
আল্লাহ আমাদেরকে ও আপনাকে রিযিক উপার্জনের তাওফীক দিন। আর রাষ্ট্রের পরিচালক ও কর্তাগণ যেন আল্লাহকে ভয় করেন। মানুষকে হারাম কাজ করতে বাধ্য না করেন এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিধান ও ফায়সালা মাফিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
মাজমু‘ ফাতাওয়ায়ে ইবন বাযের ১০ম খণ্ডে আরো রয়েছে, দাড়ি কামানো ও কাটা হারাম, কোনো মুসলিম এটা যেন না করে, আর এ কাজে যেন কেউ কাউকে সহযোগিতা না করে। দাড়ি মুণ্ডিয়ে বা শেভ করে টাকা উপার্জন করা হারাম। আর এটা হারাম খাওয়ার (রোযগারের) সমান। যে এমন কাজ করে সে যেন তাওবা করে এবং এ কাজটি না করে। অতীতে দাড়ি কেটে যা রোজগার করেছে তা যেন সদকা করে দেয়, যেহেতু সে জানতো না। আর ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হয়ে যাও। আল্লাহ তা‘আলা সুদখোরদের বা হারামখোরদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন:
﴿فَمَن جَآءَهُۥ مَوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّهِۦ فَٱنتَهَىٰ فَلَهُۥ مَا سَلَفَ وَأَمۡرُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۖ وَمَنۡ عَادَ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ﴾ [البقرة: ٢٧٥]
“অতএব, যার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হলো, তাহলে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে, তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫]
অনেক মানুষ এ হারামটি করছে বলে আপনি যেন তাদের এমন কু-অভ্যাস দেখে প্রতারিত না হন। (প্রকাশকাল: ১০ জিলকদ, ১৪২৭)।
চার. দাড়িতে কি স্টাইল করে রাখা যাবে?
শয়তান বিভ্রান্ত করছে সারা দুনিয়াকে। বর্তমানে কোনো কোনো জায়গা থেকে এড দিয়ে বলছে: “দাড়িতেই করুন স্টাইল”। এ নিয়ে চলছে খেলতামাশা।
তারা বলে দিচ্ছে: আপনার চেহারা গোলাকার বা লম্বাটে হলে বা চতুর্ভূজাকৃতি হলে দাড়ির কাট কেমন দিবেন? আর যদি চেহারা বড় আকৃতি কিংবা ছোট ডিম্বাকৃতির হয়, তাহলেই বা দাড়ির কাট কেমন দিবেন? এসব কিছু তারা বলে দিচ্ছে। এসবই শয়তানের দেখানো পথ ও পন্থা। আমাদেরকে এসব থেকে সাবধান থাকতে হবে।
দাড়ি রাখার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা:
যে ৬টি কারণে পুরুষের দাড়ি রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো:
দাড়ি রাখা এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক ভালো। জানতে চান কী কারণে? চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক দাড়ি রাখার স্বাস্থ্যকর দিকগুলো। হবু স্বামীর দাড়ি দেখে মেয়েদের রাগ করার দিন এবার সত্যি ফুরালো!
১) অ্যালার্জি থেকে দূরে রাখে পুরুষদের মধ্যে যাদের ধুলো ময়লা এবং রোদে অ্যালার্জি রয়েছে তাদের জন্য দাড়ি রাখা অনেক উপকারী। এতে করে মুখের ত্বক সরাসরি ধুলো-বালি এবং রোদের সংস্পর্শে আসে না। সুতরাং অ্যালার্জি সংক্রান্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
২) শেভিং র্যাশ থেকে মুক্তি অনেকের ত্বক খুব সেনসিটিভ হয়ে থাকে। তারা যদি বারবার শেভ করেন তাহলে ত্বকের সেনসিটিভিটির কারণে শেভিং র্যাশের সৃষ্টি হয়। দাড়ি রাখার অভ্যাস এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে।
৩) স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় সরাসরি রোদ ত্বকে লাগা, শেভ করার সময় ও শেভ করার পর নানা ধরণের কেমিক্যাল জাতীয় প্রোডাক্ট ব্যবহার করা ইত্যাদি স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। তাই পুরুষদের ক্ষেত্রে ডারম্যাটোলজিস্টগণ স্কিন ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে দাড়ি রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
৪) ব্রণের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, পুরুষের ত্বকেও ব্রণ ওঠে থাকে। শেভ করার প্রোডাক্ট ও ধুলো-বালি এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে। যারা দাড়ি রাখেন তারা নিয়মিত দাড়ির যত্ন নিলে এই ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন খুব সহজেই।
৫) ত্বকে বয়সের ছাপ ধীরে পড়ে: যারা দাড়ি রাখেন তাদের ত্বকে বয়সের ছাপ ধীরে পড়ে। ডারম্যাটোলজিস্ট ড. অ্যাডাম ফ্রাইডম্যান বলেন, ‘মুখের ত্বক দাড়ি দিয়ে ঢাকা থাকার ফলে সূর্যের আলোর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হয়। এতে ত্বকের ক্ষতি কম হয়, রিংকেল পড়ে অনেক দেরিতে। সুতরাং ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেরি হয়’।
৬) দাড়ি রাখলে একজন পুরুষ অনেক স্বাস্থ্যগত সুবিধা পেয়ে থাকেন: পুরুষের দাড়ি রাখা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো। দাড়ি সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি ঠেকায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এটা দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া থেকে পুরুষকে বাঁচায় এবং স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। দাড়ি ধুলোবালি ও ক্ষতিকর বস্তু, রক্ষা করে। নিয়মিত শেইভ করলে আপনার দাড়ির মূলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটায় এবং ব্রণের সৃষ্টি করে। পুরুষদের দিনের বেলায় উত্তপ্ত সূর্যের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখুন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এবং কে কতটুকু রেডিয়েশান শোষণ করেছে এটা তুলনা করে দেখুন। তখনই দাড়ির উপকার আপনার কাছে ধরা পড়বে।
৭) অ্যাজমার প্রকোপ কমায়: গবেষণায় দেখা যায় দাড়ি রাখা নাকে মুখে ক্ষতিকর ধুলো-বালি ঢুকতে বাঁধা প্রদান করে। ফলে ডাস্ট মাইট, যার কারণে অ্যাজমার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, তা অনেকাংশে কমে আসে। এতে করে অ্যাজমা সংক্রান্ত ঝামেলা থেকেও মুক্ত থাকা সম্ভব হয়। [সুত্রঃ ডেইলি মিরর, দ্য ইন্ডিয়া টাইমস]।
৮) দাড়ি পুরুষের ত্বকের জন্য প্রাকৃতিক মশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। যারা নিয়মিত দাড়ি কামান, ঋতু পরিবর্তনে তাপমাত্রার তারতম্যের প্রভাবে তাদের ত্বক শুষ্ক হয়ে ওঠে। সেইসাথে শেভিং–ক্রিমসহ অন্যান্য প্রসাধনীর ব্যবহারে ত্বকের স্বাভাবিক আদ্রতা হারিয়ে যেতে থাকে। ত্বকের রয়েছে নিজস্ব আদ্রতা ধরে রাখার জন্য মেদবহুল গ্রন্থি। এর থেকে প্রাকৃতিক তেল নিঃসৃত হয়ে ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখে। রেজারের বারবার ব্যবহার ত্বকের এই গ্রন্থিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই দাড়ি রাখলে তা এই গ্রন্থির কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
৯) দাড়ি মুণ্ডানের কারনে ত্বক খুব সেনসিটিভ হয়। বারবার দাড়ি মুণ্ডন করলে ত্বকের সেনসিটিভিটির কারণে সৃষ্ট সমস্যা দাড়ি রাখার কারণে দূর হয়।
১০) ত্বকের নিচে ঠেলে ওঠা ইনগ্রোন হেয়ার আর নয়
যারা সবসময় শেভ করেন তারাই জানেন ত্বকের নিচে ফুলে ওঠা ইনগ্রোন হেয়ার কি বিরক্তিকর। কিন্তু দাড়ি ইচ্ছে মতো বাড়তে দিলে এগুলো দেখা যায় না। এছাড়াও শেভের কারণে ত্বকের যে ক্ষতি হয়, তা এড়ানো যায় দাড়ি বাড়তে দিলে।
১১) পৌরুষত্ব বেশি মনে হয়
আপনি যদি অন্যের চোখে নিজের পৌরুষ বাড়িয়ে তুলতে চান তাহলে সবচাইতে ভালো উপায় হলো দাড়ি গজানো। Evolution and Human Behavior জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, আপনি যদি দাড়ি রাখেন তাহলে অন্যান্য পুরুষ ও নারী উভয়ের চোখেই আপনি আগের চাইতে বেশি পুরুষালী হয়ে উঠবেন। মোটামুটি ১০ দিনের পুরনো দাড়িটাকে সবচাইতে বেশি আকর্ষণীয় বলে দেখা যায় এই গবেষণায়।
১২) সময় বাঁচায়: দাড়ি কামাতে গিয়ে ক্লিন-শেভড পুরুষেরা ব্যয় করে থাকেন গড়ে ৩,৩৫০ ঘন্টা, বলেন বস্টন ইউনিভার্সিটির ডক্টর হার্বার্ট মেসকন। যাদের দাড়ি থাকে তারা এই সময়টাকে নিশ্চিন্তে অন্য কোনো কাজে ব্যয় করতে পারেন।
১৩) আপনাকে গরম রাখবে: শীতকালে আপনার চুল যেমন আপনাকে গরম রাখে, তেমনই দাড়িও তার মাঝে উষ্ণতা আটকে রেখে আপনাকে গরম করে তুলবে।
তো এবার কী ভাবছেন? অনেক দিন ধরে যারা দাড়ি রাখার চিন্তা করছেন তারা এবার শেভ করা বন্ধই করে দিতে পারেন। আর যারা ক্লিন শেভড থাকতে পছন্দ করেন তারাও ভেবে দেখুন।
দাড়ির ওপর নিষেধাজ্ঞা ও যুলুম: দেশে-বিদেশে
পৃথিবীর বিভিন্ন কম্যুনিষ্ট দেশে যে সব মুসলিমগণ বাস করে, সেখানকার দেশে দাড়ি রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন চীনে। ২০১৪ সালে চীনের মুসলিম অধ্যুষিত জিনজিয়াং প্রদেশে লম্বা দাড়ি রাখা এবং বাসে ভ্রমণের সময় ইসলামী পোশাক পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আল-জাযিরার খবরে বলা হয়েছে- একই বছর আগস্টে জিনজিয়াংয়ের কারাম অঞ্চলে হিজাব, বোরকা ও লম্বা দাড়ি নিষিদ্ধ করা হয়। (এনটিভি অনলাইন: ১৮ জুন ২০১৫)।
আর চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া বুধবার এ তথ্য জানিয়েছে যে লম্বা দাড়ি ও ইসলামী পোশাক পরে গণপরিবহণে ভ্রমণ করা যাবে না। চীনের মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং এলাকার কারামা শহরে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। (৬ আগষ্ট ২০১৪)।
ব্রিটেনের দুই মুসলিম ছাত্র দাড়ি না কামানোয় তাদেরকে নতুন টার্মের ক্লাসে ভর্তি করা হয় নি। এমনকি ওই হাইস্কুলে অধ্যয়নরত সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলা ও যোগাযোগ করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাদের জন্য। ব্রিটেনের ল্যাংকশায়ারের অ্যাকরিঙ্গটোন শহরের মন্টকারমেল হাইস্কুলে এই ঘটনা ঘটেছে। স্কুলটির প্রিন্সিপাল হাভিয়ার বভার্স বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, আমাদের হাইস্কুলের রয়েছে বিশেষ বিধিমালা এবং এইসব বিধান সব ছাত্রকেই মেনে চলতে হবে। (১০/১০/২০১৩)
১০০% মুসলিমের দেশ তুরস্কেও ১৯২৩ সালে কামাল আতাতুর্ক নামক ইয়াহূদীদের দালাল হিজাব পরা ও দাড়ি রাখা সহ শরী‘আতের অসংখ্য আহকাম নিষিদ্ধ করে। দীর্ঘ ৯০ বছর পর ২০১৩ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব উর্দুগান এসব অবৈধ নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়। আল্লাহ তাকে উত্তম জাযা প্রদান করুন। আমিন।
মিশর একটি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম রাষ্ট্র। আমরা সৌদি আরব আসার পর দেখলাম হোসনী মোবারকের শাসনকালে মিসরীয়রা ছুটিতে ওদের দেশে যাওয়ার সময় পুরুষরা দাঁড়ি কামিয়ে ফেলতো এবং মহিলারা বিমানে উঠে বোরকা খুলে ফেলতো। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতো পুরুষরা দাঁড়ি রেখে এবং মহিলারা বোরকা পরে গেলে মিসরের বিমান বন্দরে প্রবেশ করা মাত্র জেলখানায় ঢুকাবে। এ কালো আইনটি চালু করেছিল কুখ্যাত জামাল আবদুল নাসের যে আলেম ও ইসলামী ব্যক্তিত্বকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দিয়ে দেয় এবং যেসব মাদ্রাসায় আলেম তৈরি হয় সেগুলিকে জঙ্গী তৈরির কারখানা আখ্যায়িত করে বন্ধ করে দেয়। মুরসি ক্ষমতায় আসার পর মিসরীয় নির্ভয়ে দাঁড়ি রাখে এবং মহিলারা নির্ভয়ে বোরকা পরে ওদের দেশে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
ভারত ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলে সন্ত্রাসী ও অপরাধী, খারাপ লোক হিসেবে অহরহ দাড়ি –টুপি পরিয়ে কোনো একজনকে দিয়ে নাটক সিনেমায় চোর, ডাকাত, লুচ্ছা-বদমাইশ ইত্যাদি খারাপ পার্ট বা অংশটি করানো হয়, এটা একটা বিরাট ষড়যন্ত্র, যাতে করে সাধারণ মানুষের মনে এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে, দাড়ি-টুপি ওয়ালারা সবচাইতে খারাপ, (আল্লাহ যেন জালেমদের বিচার করেন)। অতি দুঃখ ও আফসোসের বিষয় হলো: আমাদের দেশ ৯০% মুসলিমের দেশ। আজও যারা ইসলামী বিধান মাফিক তথা দাড়ি-টুপি নিয়ে চলবে, তারা খুব একটা ভালো নেই। বাংলাদেশে দাড়ি রাখা ও দীন ইসলাম মাফিক আমল করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ মানুষের জন্য।
বাংলাদেশের যুবক সমাজ কেন দাড়ি রাখছে না? কেনই বা তারা ইসলাম থেকে দূরে থাকছে? বিশেষ করে মক্কাতুল মুকার্রামার প্রবাস জীবনে অনেককে দেখি তারা তাদের প্রাণ প্রিয় দীন ইসলামের কোনো কিছুই মানছে না। কেন তারা ইসলাম সম্পর্কে গাফিল, আর সে মাফিক ‘আমলও করে না? এর একটা বড় কারণ হলো: তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, তারা টাকা-পয়সার জন্য এসেছে আরব দেশে। তারা মনে করে যে, আমরা এখানে জানা বা মানার জন্য আসি নি। অনেকে লেখাপড়া ও জানে না। আর একটা বিশাল সর্বনাশা কারণ হলো: তাদের নিজেদের মধ্যে অহংকার ও বড়াই বিরাজ করছে, পাশাপাশি বিনয় নম্রতার চরম অভাব। দাড়িহীন, বেনামাযী খারাপ লোককে সবাই ভয় করে, এমন লোকের দাপট বেশি। তারা দৃঢ়ভাবে মনে করে যে, নামাযী, সরল, নম্র, দাড়িওয়ালা ভদ্র লোকের কোনই মূল্য নেই তাদের কোম্পানীতে। তারা মনে করে নম্রতা, ভদ্রতা, ভালো হওয়া এটা দুর্বলদের কাজ ও তাদের হাতিয়ার। এভাবে চললে আমাকে ভালো হয়ে যেতে হবে, ভালো হয়ে গেলে আমাকে সালাত পড়তে হবে, তাহলে সালাতের সময় বিশ্রাম নেব, যাতে ওভারটাইমের কাজটি ঠিকভাবে করতে পারি, পয়সা উপার্জনের চাকা সচল থাকে। তাছাড়া, আমি ভালো হয়ে গেলে কেউ যদি আমাকে খারাপ কিছু বলে বা গালি দেয়, তাহলে আমি তাকে কিছু বলতে বা প্রতিশোধ নিতে পারব না। তাই আমি আমার যৌবনকাল এভাবে পরিচালিত করবো, আমাকে কেউ খারাপ কিছু বললে আমিও তাকে দেখে নেবো। আমি এখন ভালো হবো না, আরও সময় আছে, বৃদ্ধ হলে হবো, এখন কামাইয়ের সময়। ‘ইবাদত বন্দেগী করব, তবে এখন না, তখন সময়গুলো মসজিদে কাটিয়ে দিব, চিল্লা দেবো। মক্কা শরীফে সালাত পড়লে ১ সালাতে ১ লাখ সাওয়াব। এভাবে সকল গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ তো মাফ করবেনই। ইত্যাদি ইত্যাদি
আমি বলি: আপনি কি নিশ্চিত যে, এতো কষ্টের টাকা আপনি দুনিয়ায় ভোগ করে যেতে পারবেন? আপনার ভবিষ্যতে কি আছে? কি হবে? আপনি কি তা জানেন? আপনি কি আল্লাহর সাথে চুক্তি করে দুনিয়ায় এসেছেন? আল্লাহকে ভয় করুন, মনে রাখবেন: মৃত্যুর দুয়ার খোলা থাকে সর্বদা, বন্ধ করার কোনো নিয়ম নেই। কার কাফন কখন রেডি হয়ে গেছে সে জানে না, অথচ হায়াত- মাউতের মালিক মহান রব আল্লাহ ঠিকই জানেন।
অতএব, হে ভাই! যত বিপদই আসুক না কেন, আপনি সবর করুন এবং কমপক্ষে একমুষ্টি হলেও দাড়ি রেখে দিন, শেভ বা ষ্টাইলি কাট-চাট করবেন না। আপনি যদি আল্লাহর অন্যান্য আদেশ যেমন সালাত, সাওম, হজসহ অন্যান্য ফরয, ওয়াজিব মেনে চলতে পারেন, তাহলে কেন আপনি দাড়ির ব্যাপারে আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ মেনে চলছেন না? এ সবই তো তাদেরই নির্দেশ। একদিকে নির্দেশ পালন অন্যদিকে নির্দেশের লংঘন। কই আপনি মেনে চলছেন রহমানের নির্দেশ? কেন এ খেল-তামাশা? শরী‘আতের আদেশকে খাটো করে দেখছেন? ইয়াহূদী-নাসারারা এমন কাজ করতো, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের এমন ভূল কাজের সমালোচনা করে বলেন,
﴿أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ﴾ [البقرة: ٨٥]
“তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আন এবং কিছু অংশে কুফুরী কর? তাহলে তোমাদের যারা এরুপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে কঠিনতম শাস্তির দিকে। আর তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮৫]
والله ولي التوفيق، وصلى الله وسلم على نبينا محمد، وآله وصحبه.
২৯ রবিউল আউয়্যাল ১৪৩৭ হিজরী/৮-১-২০১৬
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৬৭৩, কিতাবুল মারদা, পরিচ্ছদ: ৭৫/১৯, রোগী কর্তৃক মৃত্যু কামনা করা; সহীহ মুসলিম হাদীস নং ২৮১৬।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫।
[3] তিরমিযী, হাদীস নং ১১৫৯। শাইখ আলবানী রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
[4] সহীহ মুসলিম, নং ২৫৬৪।
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৮৬।
[6] সহীহ বুখারী, কিতাবুল্লিবাস, হাদীস নং ৫৮৯; সহীহ মুসলিম: কিতাবুত্তাহারাত, বাবু খিচালিল ফিতরা, হাদীস নং ২৫৯।
[7] ফাতাওয়া লাজনায়ে দায়েমা: ৫/১৩৩।
[8] সহীহ মুসলিম, কিতাবুত্তাহারাত, নং ২৬০, বাবু খিচালুল ফিতরা।
[9] ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার সূত্রে, সহীহ বুখারী, হাদীদ নং ৫৮৯৩।
[10] সহীহ বুখারী, কিতাবুল্লিবাছ, হাদীস নং ৫৮৯২; সহীহ মুসলিম, কিতাবুত্তাহারাত, বাবু খিচালিল ফিতরা, হাদীস নং ২৫৯।
[11] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪৬২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১০৩।
[12] তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৯৫, হাদীসটি হাসান (আলবানী)।
[13] আবূ দাঊদ, পোষাক অধ্যায় (৩৫১২), শাইখ আলবানী বলেন, হাদীসটি হাসান সাহীহ, নং ৩৪০১। হাদীসটিকে শাইখ আলবানী অন্যত্র সহীহ বলেছেন: (হিযাবুল মারআ আল-মুসলিমা: পৃ. ১০৪)।
[14] সুনান বাইহাকী, ৯/২৩৪, হাদীসটি মাওকুফ।
[15] শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ (ইকতিদ্বাউ সিরাতিল মুসতাকিম ফী মুখালাফাতি আসহাবিল জাহীম, ১/৮০-৮২।
[16] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৮৮৫; আবূ দাঊদ, হাদীস নং ৪০৯৮; তিরমিযী, হাদীস নং ২৭৮৪; নাসাঈ, হাদীস নং ১৯০৪। সবগুলোই সহীহ হাদীস।
[17] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬১।
[18] (আত-ত্বাবরানী, হাদীস নং ১০৯৭৭, ১১ খ. ৪১ পৃ.) হাদীসটিকে শাইখ আলবানী রহ. দুর্বল বলেছেন। দেখুন, দয়ীফুল জামে‘, হাদীস নং ৫৮৫৪।
[19] মুসনাদুল বায্যার, হাদীস নং ৫২১৭।
[20] দেখুন, ‘আউনুল মা‘বূদ, শারহু সুনানি আবি দাঊদ।
[21] মাজুম‘ ফতোয়া ইবন বায রহ. ১০ম খণ্ড দ্র.। প্রকাশকাল: ২৪ সফর, ১৪২৯ হি.।
[22] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩২৩৬; সহীহ আল বুখারী; মুসনাদে আহমদ; সুনানে নাসাঈ।
[23] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৮।
[24] তিরমিযী, আবূ দাঊদ, রিয়াদুস সালেহীন।
[25] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৬৭৫।
[26] তিরমিযী, হাদীস নং ২৭৬১, হাদীসটি হাসান ও সহীহ। আলবানী তার সহীহ আল জামে‘ এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। আরও রয়েছে: মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৭৩৮।
[27] আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া (৪/২৭০) দারুল ফিকর সংস্করণ।
[28] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৬৯।
[29] মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা ১৩/১১২, হাদীস নং ২৫৯৯২, ২৫৯৯৯।
[30] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৪৩।
[31] ইবন আবী শাইবাহ, হাদীস নং ২৫৯৯৭।
[32] প্রাগুক্ত ১৩/১১২, হাদীস নং ২৫৯৯৫।
[33] আবূ দাঊদ, হাদীস নং ৪১৫৫।
[34] হাওয়াশী শারওয়ানী ৯ম খণ্ড, ৩৭৬ পৃ.।
[35] দালায়েলুল আ-সার।
[36] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৯২১।