হজের সফরে একাধিক উমরা
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
হজের সফরে একাধিক উমরা
[বাংলা– Bengali – بنغالي ]
সংকলন: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
2014-1435
﴿حكم تكرار العمرة في سفر الحج﴾
« باللغة البنغالية »
تأليف: ذاكرالله أبو الخير
مراجعة:د/ أبو بكر محمد زكريا
2014 - 1435
হজের সফরে একাধিক উমরা
হজ করা মহান আল্লাহ তা‘আলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। অনুরূপভাবে উমরা করাও একটি ইবাদত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَأَتِمُّواْ ٱلۡحَجَّ وَٱلۡعُمۡرَةَ لِلَّهِۚ ١٩٦ ﴾ [البقرة: ١٩٦] “তোমরা হজ ও উমরা আল্লাহর জন্য পূর্ণ করো”[1]। তবে উমরা করা হজের মত আবিশ্যক কিনা এ ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। কেউ ওয়াজিব বলেছেন, আবার কেউ সুন্নাত বলেছেন। দলীল প্রমাণের বিবেচনায় দেখা যায়, উমরা করা ওয়াজিব হওয়াই অধিক সহীহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে মোট চারবার উমরা পালন করেছেন। প্রতিটি উমরাই ছিল জিল-ক্বদ মাসে।
প্রথমবার: হুদাইবিয়ার উমরা। এটি ছিল ষষ্ট হিজরিতে হুদাইবিয়ায় এসে পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি এ উমরা সম্পন্ন করতে পারেন নি। ফলে মাথা মুণ্ডন করে সেখানেই হালাল হয়ে যান।
দ্বিতীয়বার: উমরাতুল কাযা। পরবর্তী বছর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করে উমরা পালন করেন এবং মক্কায় তিনি তিন দিন অবস্থান করেন।
তৃতীয়বার: জা‘রানাহ্ থেকে। হুনাইনের যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করেন এবং জা‘রানাহ্ থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা আদায় করেন।
চতুর্থবার: বিদায় হজের সাথে যে উমরাটি করেন। তবে তিনি কিরান হজ আদায়কারী ছিলেন। প্রমাণ:-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: «اعْتَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعَ عُمَرٍ، كُلُّهُنَّ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، إِلَّا الَّتِي كَانَتْ مَعَ حَجَّتِهِ: عُمْرَةٌ مِنَ الْحُدَيْبِيَةِ أَوْ زَمَنَ الْحُدَيْبِيَةِ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، وَعُمْرَةٌ مِنَ الْعَامِ الْمُقْبِلِ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، وَعُمْرَةٌ مِنَ الْجِعْرَانَةِ حَيْثُ قَسَّمَ غَنَائِمَ حُنَيْنٍ فِي ذِي الْقَعْدَةِ، وَعُمْرَةٌ مَعَ حَجَّتِهِ» .
“আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি উমরা করেন। প্রতিটি উমরাই তিনি জিলক্বদ মাসে করেন। তবে যে উমরাটি তিনি তার হজের সাথে করেন। [তা শেষ করেন জিল হজমাসে, শুরু করেন জিল ক্বদ মাসে] হুদাইবিয়ার উমরা, পরবর্তী বছর জিল-ক্কদ মাসে উমরাতুল কাযা। জা‘রানাহ্ থেকে উমরা জিলক্কদ মাসে যখন হুনাইনের গণিমত বন্টন করেন এবং হজের সাথে পালনকৃত উমরা”।[2]
তবে হজের সফরে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবারের বেশি উমরা পালন করেন নি এবং তার সাথে যত সাহাবী হজ করেছেন, তাদের কেউ ঐ সফরে এক বারের বেশি উমরা করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যত বার উমরা করেছেন, তিনি মক্কার বাহির থেকে মক্কায় প্রবেশের পূর্বে মীকাত থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা করেছেন। কিন্তু মক্কায় প্রবেশের পর মক্কা থেকে বের হয়ে হারাম এলাকার বাইরে গিয়ে ইহরাম বেঁধে এসে, তিনি কখনো উমরা করেন নি। এমনকি হিজরতের পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেরো বছর মক্কায় অবস্থান করেন। এ সময় তিনি কখনো মক্বার বাইরে গিয়ে ইহরাম বেঁধে এসে উমরা করেন নি। হজের সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথী-তামাত্তু হজকারী-দের উমরা আদায়ের পর মক্কায় হালাল অবস্থায় অবস্থান করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, وَأَقِيمُوا حَلَالًا حَتَّى إِذَا كَانَ يَوْمُ التَّرْوِيَةِ فَأَهِلُّوا بِالْحَجِّ، অর্থাৎ, তোমরা হালাল অবস্থায় মক্কায় অবস্থান কর। অতঃপর আট তারিখ ইয়ামুত তারওয়িয়ার দিন তোমরা হজের ইহরাম বাঁধ।[3] তাই সুন্নাত হচ্ছে, হাজীগণ হজের সময় তামাত্তুর উমরা শেষ করে, হালাল অবস্থায় মক্কা অবস্থান করবেন; হজের সফরে একাধিক উমরা না করা। বার বার উমরা না করে, বার বার তাওয়াফ করাই হল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে যখন উমরাকারীদের খুব ভীড় থাকবে তখন বেশি বেশি তাওয়াফ না করে বেশি বেশি সালাত, কুরআন তেলাওয়াত ও যিকিরে ব্যস্ত থাকা।
হাজিদেরকে হজের সময় মক্কার বাইরে তান‘ঈম গিয়ে মসজিদে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে ইহরাম বেঁধে বার বার উমরা করতে দেখা যায়। হজের সফরে বিশেষ প্রেক্ষাপটে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তান‘ঈম থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা পালন করেছেন। জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত একটি হাদিস ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«أَهَلَّتْ عائشة بِعُمْرَةٍ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بِسَرِفٍ عَرَكَتْ، ثُمَّ دَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - عَلَى عائشة فَوَجَدَهَا تَبْكِي، فَقَالَ: " مَا شَأْنُكِ "؟ قَالَتْ: شَأْنِي أَنِّي قَدْ حِضْتُ وَقَدْ أَحَلَّ النَّاسُ وَلَمْ أَحِلَّ، وَلَمْ أَطُفْ بِالْبَيْتِ وَالنَّاسُ يَذْهَبُونَ إِلَى الْحَجِّ الْآنَ، قَالَ: إِنَّ هَذَا أَمْرٌ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَى بَنَاتِ آدَمَ، فَاغْتَسِلِي، ثُمَّ أَهِلِّي بِالْحَجِّ "، فَفَعَلَتْ وَوَقَفَتِ الْمَوَاقِفَ كُلَّهَا، حَتَّى إِذَا طَهُرَتْ طَافَتْ بِالْكَعْبَةِ وَبِالصَّفَا وَالْمَرْوَةِ. ثُمَّ قَالَ: " قَدْ حَلَلْتِ مِنْ حَجِّكِ وَعُمْرَتِكِ "، قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي أَجِدُ فِي نَفْسِي أَنِّي لَمْ أَطُفْ بِالْبَيْتِ حَتَّى حَجَجْتُ. قَالَ: " فَاذْهَبْ بِهَا يَا عبد الرحمن فَأَعْمِرْهَا مِنَ التَّنْعِيمِ»
“আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা উমরার ইহরাম বেঁধে ছারাফ নামক স্থানে আসলে, তার মাসিক আরম্ভ হয়। এ অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকট প্রবেশ করে দেখেন- আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কাঁদছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি হয়েছে? উত্তরে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ‘আমার মাসিক শুরু হয়েছে। সবাই উমরা শেষ করে হালাল হয়ে গিয়েছে। আমি হালাল হতে পারি নি এবং মানুষ এখন হজের উদ্দেশে বের হবে’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটি এমন একটি বিষয় যা আল্লাহ তা‘আলা আদম সন্তানের মেয়েদের উপর অবধারিত করেছেন। তুমি গোসল কর, অতঃপর হজের কার্যক্রম যথাযথ আদায় করতে থাক। তারপর তিনি হজের কর্মসমূহ যথাযথ পালন করেন, সব জায়গায় অবস্থান করেন। পবিত্র হয়ে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ ও সাঈ করেন। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তোমার হজ ও উমরা সম্পন্ন হয়ে গেছে এবং তুমি হালাল হয়ে গেছ। তখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার অন্তরে দুর্বলতা অনুভব করছি যে, আমি তাওয়াফ সম্পন্ন না করে হজ আদায় করছি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আব্দুর রহমান তাকে নিয়ে যাও, তান‘ঈম থেকে উমরা করিয়ে নিয়ে আস”।[4]
অপর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, আমার সাথীরা সবাই একটি হজ ও একটি পূর্ণাঙ্গ উমরা আদায় করে ফিরে যাবে, আর আমি শুধু একটি হজ নিয়ে ফিরে যাবো! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বার বার বুঝানোর চেষ্টা করেন যে তোমার হজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু তার অন্তরের উসখুস রয়েই গেল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অভ্যাস হল, তার স্ত্রীরা যখন তার নিকট কোন কিছু আবদার করত, তিনি তা রক্ষা করতেন। এ জন্য তিনি তার আবদার রক্ষার্থে এবং তাকে খুশি ও মন জয় করার উদ্দেশ্যে তার ভাইকে বললেন, হে আব্দুর রহমান! তুমি তাকে নিয়ে যাও। তান‘ঈম থেকে ইহরামের নিয়ত করিয়ে উমরা করিয়ে নিয়ে আস। তার ভাই আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে তান‘ঈম নিয়ে গেল এবং উমরা করালো। এ সময় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা একাই উমরা পালন করেন। তার সাথে যাওয়া তার ভাই আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজেও উমরা পালন করেন নি এবং ঐ সফরে একজন সাহাবীও উমরা পালন করেন নি। সুতরাং তান‘ঈম থেকে উমরা করার প্রচলনটি ছিল বিশেষ একটি প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে। অন্যথায় হজের সফরে বা একই সফরে বার বার উমরা করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত নয়।[5] সাহাবীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা একবার উমরা আদায় করার পর তাদের মাথার চুল কালো না হওয়া পর্যন্ত পূণরায় উমরা পালন করতেন না। চুল কালো হওয়ার পর উমরা করতেন। সুতরাং হাজি সাহেবদের প্রতি আহ্বান- বার বার উমরা নয়, বার বার তাওয়াফ করুন। তাওয়াফ শেষে মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, মুরব্বীদের জন্য দো‘আ করুন। কারো নামে উমরা করা বা কারো জন্য উমরা করা ইত্যাদি পরিহার করুন। কারণ, আপনি কত বেশি আমল করলেন, এটি আল্লাহর নিকট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আপনি কতটুক আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لِتَأْخُذُوا مَنَاسِكَكُمْ، فَإِنِّي لَا أَدْرِي لَعَلِّي لَا أَحُجُّ بَعْدَ حَجَّتِي هَذِهِ» “তোমরা আমার কাছ থেকে হজের বিষয়গুলো শিখে নাও। কারণ, হতে পারে আমি আমার এ হজের পর আর নাও করতে পারি”[6]। হাদিসের দাবী হল, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেছেন তা করা আর আল্লাহর রাসূল যা করেননি তা হতে বিরত থাকা। আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দিন। আমীন