বাংলাদেশের মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
- উপসংহার
- হাদীসের বর্ণনামতে, আদম ‘আলাইহিস সালামের বয়স এক হাজার বছরের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার মৃত্যুর দিনটি ছিল শুক্রবার। (ইবন মাজাহ, আস-সুনান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৮৫, হাদীস নং ১০৭৪; আহমাদ, আল-মুসনাদ, ৩১তম খণ্ড, পৃ. ১৩৩, হাদীস নং ১৪৯৯৭; তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪১১, হাদীস নং ৪৩৮৭।)
- আদম ‘আলাইহিস সালামকে কোথায় দাফন করা হয়েছিল সে সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের কোনো সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না। এক বর্ণনায় পাওয়া যায় আদম ‘আলাইহিস সালামের দফন স্থান হলো ভারতবর্ষ তথা সরন্দীপের যে পাহাড়ে সর্বপ্রথম তিনি অবতরণ করছিলেন, সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। (সাবূনী, মুহাম্মাদ আলী, আন-নবূওয়াহ ওয়াল আম্বিয়া’, পৃ. ১৪৬।)
- অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণ এ মতকে সমর্থন করেছেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, মক্কা শরীফের জাবালে আবূ কুবায়স নামক স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ভিন্নমতে, নূহ ‘আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনকালে আদম ‘আলাইহিস সালাম ও হাওয়া-এর কফিন জাহাজে রেখেছিলেন। প্লাবন শেষে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে তাদেরকে দাফন করেন। (তাবারী, আবূ জা‘ফার মুহাম্মাদ ইবন জারীর, জামি‘উল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, (দারুল ফিকর, তা.বি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬১।)
বাংলাদেশের মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
মুহাম্মাদ শাহিদুল ইসলাম
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
حركة اللغة الأم في بنغلادش وموقف الإسلام منها
(باللغة البنغالية)
محمد شهيد الإسلام
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সূচিপত্র
ভূমিকা... 3
ভাষা আন্দোলনের অর্থ. 4
বাংলাদেশে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য.. 7
ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য পর্যালোচনা.. 10
ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মূল্যায়ন ও আমাদের করণীয়. 42
উপসংহার. 47
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা............
ভাষা মহান আল্লাহর এক বড় উপহার। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নবীকেই তার জাতির ভাষায় পাঠিয়েছেন। সুতরাং ভাষার ভিন্নতা ইসলাম বিরোধী কোনো বিষয় নয়, যদি না ইসলামের আকীদা বা শরী‘আতের সাথে তা সাংঘর্ষিক হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে সেটিই সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ভূমিকা
মাতৃভাষা ব্যবহার এবং তার মর্যাদা রক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে। যথা তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মধ্যএশিয়ার অঞ্চলসমূহ এবং ভারতের উত্তর প্রদেশ কিন্তু ভাষার জন্য রক্তদান বা নিহত হওয়ার ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই ঘটেছে। বাংলা ১৩৫৯ সালের ৮ ফাল্গুন। যা আজ ৬০ বছর ধরে এ দেশ মাতৃকায় একুশে ফেব্রুয়ারি নামে ভাষা আন্দোলনের স্মরণ দিবস হিসেবে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও গাম্ভীর্যের সাথে উদযাপিত হয়ে আসছে। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথ নিয়ে বাংলার কিছু অকুতোভয় বীর সন্তান নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করে এক সূর্যস্নাত রক্তিম ইতিহাস। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। আলোচ্য নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও এ প্রসঙ্গে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হবে।
ভাষা আন্দোলনের অর্থ:
মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিই ভাষা। তা কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গর ইশারার মাধ্যমে হোক। ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে ড. রামেশ্বর বলেন, “মানুষের বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত কতকগুলো ধ্বনিগত ভাব সংকেত বা প্রতীক সমষ্টির নাম।”[1]
ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে Henry Sweet বলেন, "Language is the expression of ideas by means of speech-sounds combined into words. Words are combined into sentences, this combination answering to that of ideas into thoughts.[2]
ভাষাবিজ্ঞানী Edgar. H. Sturtevant বলেন, "A language is a system of arbitrary vocal symbols by which members of a social group Co-operate and interect.[3]
মানুষ সামজিক জীব। এজন্য তাকে অন্য মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করতে হয়। এভাবে বিনিময়ের জন্য যে সব সংকেত প্রতীক ব্যবহৃত হয় তাই ভাষা, এভাবে বিশ্লেষণ করলে ভাষার চারটি মূল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:
ক. এ কতগুলি ধ্বনির সমষ্টি
খ. এ ধ্বনি কণ্ঠনিঃসৃত
গ. এটি একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা
ঘ. এ ধ্বনিগুলো বস্তু বা ভাবের প্রতীক।[4]
ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, ভাষা হচ্ছে মানুষের ভাব বিনিময় ও প্রকাশের প্রতীকী প্রত্যয় বিশেষ। এটি ধ্বনি ও ইশারা ও ইঙ্গিত উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে। তবে পারিভাষিক অর্থে কারো কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনিকেই ভাষা নামে অভিহিত করা হয়।[5]
‘আন্দোলন’ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রচার বা আলোচনা দ্বারা উত্তেজনা সৃষ্টিকরণকেই আন্দোলন বলে।[6] সুতরাং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ইসলামে ভূমিকা কী? তা নির্ভর করে ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্যের ওপর।
বাংলাদেশে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য:
ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ধারণা থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথমত মূল উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা ব্যবহার এবং তার সার্বিক উৎকর্ষ সাধন ও চর্চা করার অধিকার আদায় করা। এছাড়া পূর্ববর্তী রাজাদের বিভিন্ন যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এটি বৌদ্ধ যুগের পর ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সেন রাজারা বাংলাভাষা চর্চা নিষিদ্ধ করেছিল। আর হিন্দু পুরোহিতরা এ কথা বলে বেড়াতো যে, যে ব্যক্তি বাংলাভাষায় কথা বলবে সে নরকে যাবে। তেমনি বৃটিশ ইংরেজরাও ইংরেজি ভাষা ও তাদের সংস্কৃতি এতদঞ্চলে চাপিয়ে দেওয়ার চরম ষড়যন্ত্র করেছিল।[7] বাঙ্গালী মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ নির্বিশেষে সকল ধর্মের বুদ্ধিজীবীরা সে নিষেধাজ্ঞা এবং ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বাংলাভাষায় বিবিধ সাহিত্য রচনা করে এ ভাষার ভাণ্ডার বিবিধ রতনে সমৃদ্ধ করেন। অতঃপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চীন ও রাশিয়ার স্টাইলে ভাষাগত ঐক্যের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য সুদঢ় করার লক্ষ্যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তোষণকারী অনুসারীরা উর্দূকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল ভাষাতত্ত্বের এক ভুল ব্যাখ্যার ছত্রছায়ায়। তারই প্রতিবাদে বাংলাভাষা আন্দোলন নতুনরূপে বেগবান হয় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য।[8]
বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনের অপর একটি উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে অফিস আদালতসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা, জাতীয় স্বকীয়তা ও পরিচিতি সারা বিশ্বে আরো উন্নত করা। এজন্য বাংলাভাষা আন্দোলনের অন্যতম শ্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।[9]
অপর একটি উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করার জন্য ভাষা আন্দোলন। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখের ভাষা উপেক্ষা করে অন্য একটি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা চরম অন্যায়, তথা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এ অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে বাংলাভাষা আন্দোলন শুরু হয়। যে জন্য এটি অবশেষে এতদঞ্চলের অবহেলিত জনতার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণ তথা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য পর্যালোচনা:
ভাষা আন্দোলনের পূর্বোল্লিখিত উদ্দেশ্যের মাঝে এখানে মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকারের বিষয়টি আসে। এর ব্যাখ্যা করতে গেলে আল-কুরআন ও সুন্নাহর দিকে দৃষ্টিপাত করলে মানুষের মাতৃভাষা ব্যবহার করা এবং এ ব্যবহারের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সম্পর্কে অনেকগুলো দিক পাওয়া যায়। সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
ইসলাম ঘোষণা করেছে, মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সৃষ্টিগত তথা জন্মগত অধিকার। কারণ, মহান আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সাথে সাথে তাকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلۡبَيَانَ ٤﴾ [الرحمن: ١، ٤]
“দয়াময় আল্লাহ। তিনিই শিক্ষা দিয়াছেন কুরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।” [সূরা আর-রহমান, আয়াত: ১-৪]
এ আয়াতে মানব সৃষ্টির সাথে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে। এটির কারণ হলো ভাষা মানুষ সৃষ্টির একটি অবিভাজ্য বিষয়। যে ভাষার মাধ্যমে পরস্পরে ভাব বিনিময় করবে, সে ভাষাই হবে পরস্পরের সম্পর্কের সেতুবন্ধন। মানুষের ভাষা মহান আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ নি‘আমত। আর মানুষের এ ভাষা কৌশল আল্লাহর ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির সাথে সাথেই তাকে ভাষাজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন:
﴿وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبُِٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢ قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئۡهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣﴾ [البقرة: ٣١، ٣٣]
“আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেই সমুদয় ফিরিশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করলেন এবং বললেন: ‘এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ তারা বলল: ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ব্যতীত আমাদের তো কোনো জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়।’ তিনি বললেন: ‘হে আদম! তাদেরকে এই সকল নাম বলে দাও।’ সে তাদেরকে এ সকলের নাম বলে দিলে তিনি বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে বলি নি যে, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা ব্যক্ত কর বা গোপন রাখ আমি তাও জানি?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩১-৩৩]
আলোচ্য আয়াতের “আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন অংশ দ্বারা পৃথিবীর সকল ভাষাকে বুঝানো হয়েছে।[10]
প্রত্যেক দেশের মানুষের সাথে ঐ দেশের মাতৃভাষার আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান। ইসলামও এ বিষয়টির প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সত্তাগত ও স্বভাবজাত তথা জন্মগত মৌলিক অধিকার। শুধু মৌলিক অধিকারই নয়। এটি মৌলিক অধিকার জরুরী অবস্থায় রাষ্ট্র কর্তৃক স্থগিত ঘোষিত হতে পারে; কিন্তু ভাষা এমন ধরনের অধিকার যা কখনো হস্তক্ষেপযোগ্য নয়। আর এটি করলে মানবসৃষ্টির কাঠামোতেই হস্তক্ষেপ করা হবে, তার অস্তিত্ব ও সত্ত্বাকে অস্বীকার করা হয়। সুতরাং এ যদি হয় ভাষা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলে তা ব্যবহার করার অধিকার আদায় আন্দোলনে নিঃসন্দেহে কোনোরূপ বাধা প্রদান করে না। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলন অধিকার আদায়ের আন্দোলন। আর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করতে ইসলাম বিভিন্নভাবে মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে।
অধিকার আদায়ের জন্য ইসলামে যুদ্ধের প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করে অধিকার আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَٰتَلُونَ بِأَنَّهُمۡ ظُلِمُواْۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ نَصۡرِهِمۡ لَقَدِيرٌ ٣٩﴾ [الحج: ٣٩]
“যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ নিশ্চয় তাদেরকে সাহায্য করতে সম্যক সক্ষম।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩৯]
আর এ অধিকার আদায় করতে যেয়ে সংঘর্ষ হলে তাতে যদি কেউ মারা করে তাহলে তাকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিয়ামতে যার প্রতিদান হবে জান্নাত। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, যায়িদ ইবন ‘আলী ইবন হুসাইন তার পিতা থেকে তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করে বলেন, “কোনো নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত (মুসলিম) নিজের অধিকার তথা হক আদায়ে যুদ্ধ করে নিহত হলে সে শহীদ।”[11]
অপর এক হাদীসের বর্ণনায় এসেছে যে, সত্যের পথে, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ও অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করাই সর্বোত্তম জিহাদ। এ প্রসঙ্গে আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক তথা সঠিক কথা বলা অর্থাৎ ন্যায় অধিকার প্রদান করার স্পষ্ট দাবী করাই শ্রেষ্ঠ জিহাদ।”[12]
মাতৃভাষার প্রতি প্রত্যেক ধর্মের একটি আলাদা অনুপ্রেরণা রয়েছে। আল-কুরআন আরবী ভাষায় এবং শেষ নবী সারা বিশ্বের মানুষের নবী আরবী ভাষাভাষী, সেহেতু সারা বিশ্বের মানুষের ভাষা হবে আরবী। তাদের মাতৃভাষা ত্যাগ করে শুধু ‘আরবী ভাষায় কথা বলতে হবে। ইসলাম কখনও এমন কথা বলে না। এর সমর্থনে প্রমাণস্বরূপ কুরআন ও হাদীসে অনেক দিক পাওয়া যায়। যেমন,
ইসলাম সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে ভাষার বিভিন্নতা ও বৈচিত্রতাকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে, এ বৈচিত্রতা মানুষের হাতে গড়া নয়। এটি আল্লাহ তা‘আলারই সৃষ্টিকুলে এক রহস্যময় নিদর্শনস্বরূপ। কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:
﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦ خَلۡقُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفُ أَلۡسِنَتِكُمۡ وَأَلۡوَٰنِكُمۡۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّلۡعَٰلِمِينَ ٢٢﴾ [الروم: ٢٢]
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণে বৈচিত্রতা। নিশ্চয় এতে পৃথিবীবাসীর জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২২]
কথা বলা বা ভাব প্রকাশের মাঝে একই রকম। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন কোকিলের সুরে যেমন সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তেমনি বিভিন্ন মানুষের সুরে ভাষায়ও সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। তা ছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতি তথা আবহাওয়াজনিত কারণে বাক্য বিন্যাস বৈচিত্রতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতার প্রেক্ষাপটে ভাষায় বিভিন্নতা অহরহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।[13]
ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ’র মতে, বর্তমান বিশ্বে ভাষার সংখ্যা ২৭৯৬টি। ক্রমান্বয়ে মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। এ ক্ষুদ্র বাংলাদেশেই বাংলা ভাষাতে বৈচিত্র লক্ষ্যণীয়। তাই পৃথিবীর অসংখ্য ভাষাকে একটি ভাষায় রূপ দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য নয় এ দুনিয়াতে। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, “আল্লাহ তা‘আলা সব ভাষাই জানেন।”[14]
আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য প্রায় লক্ষাধিক নবী প্রেরণ করেছেন। এমনকি প্রত্যেক সম্প্রদায় তথা জাতির জন্য আল্লাহ তা‘আলা নবী পাঠিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন:
﴿إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۚ وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤﴾ [فاطر: ٢٤]
“নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সত্য, সুসংবাদ ও সতর্ককারী রূপে। আর এমন কোনো জাতি নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয় নি।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ২৪]
এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, হিন্দুস্থান, চীন, আরব, গ্রিক তথা সারা বিশ্বের ভিন্ন ভাষা-ভাষী মানুষের নিকট আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর তাদের ভাষা ছিল মাতৃভাষা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوۡمِهِۦ لِيُبَيِّنَ لَهُمۡۖ فَيُضِلُّ ٱللَّهُ مَن يَشَآءُ وَيَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ﴾ [ابراهيم: ٤]
“এ পৃথিবীতে আমরা যত নবী রাসূল পাঠিয়েছি, প্রত্যেককে তার মাতৃভাষা তথা স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি এজন্য যে, তারা যেন মানুষের নিকট আমার দেওয়া দাওয়াত স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারেন।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪]
এ আয়াতের মাধ্যমেও পৃথিবীর সকল ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। আমরা যদি প্রাচীন নবী-রাসূলদের জীবনেতিহাস বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব যে, প্রসিদ্ধ আসমানী গ্রন্থগুলো বিভিন্ন ভাষায় নাযিল হয়েছে। যেমন, তাওরাত হিব্রু ভাষায়, যাবুর ও ইঞ্জীল সুরিয়ানী ভাষায় এবং মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম আরবী ভাষায়। এটাও ভাষা বৈচিত্র স্বীকৃতির জ্বলন্ত প্রমাণ।
এ প্রসঙ্গে আরো লক্ষ্যণীয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো-ভাষী নিয়োগ করতেন। সকল দেশের সকল ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বিদেশী ভাষা শিক্ষা করতঃ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বুঝে তাদের চিঠিপত্র পড়া, লিখা ও ভাব বিনিময়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন।[15]
মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে কিছু কিছু এলাকার অধিবাসীরা তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছে অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মাতৃভাষা ব্যবহার করার জন্য সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন করছে। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্দিষ্ট ভাষাভাষী জাতি তাদের পরিচিতি বা স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা জাতীয় প্রতীক ধারণ করা ইসলাম বৈধ হিসেবে দেখে। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতির সেই প্রতীকী স্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয়তাকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয়। আল-কুরআনে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا ٗا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ......﴾ [النساء: ١]
“হে মানব! তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর তোমাদের রবের, যিনি পয়দা করেছেন তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে এবং যিনি পয়দা করেছেন তার থেকে তার জোড়া, আর ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের দু’জন থেকে অনেক নর ও নারী।...” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ﴾ [الحجرات: ١٣]
“হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিতি হতে পার। তবে তোমাদের মধ্যে সে-ই অধিক মর্যাদাবান, যে আল্লাহর অধিক তকওয়া অবলম্বন করে।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে আদম ও তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবকুল ছড়িয়ে দেয়া প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতদ্বয়ের ‘তা থেকেই তাঁর জোড়া সৃষ্টি করেছেন’ এবং ‘আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক থেকে’ আয়াতাংশদ্বয় দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী আদম ‘আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার থেকে তাঁর সঙ্গিনী হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তাঁদের উভয় থেকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভেদে পৃথিবীর সকল মানব-মানবীকে সৃষ্টি করেছেন। আদম ‘আলাইহিস সালামকে[16] সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলার পরিকল্পনা ছিল তিনি এ পৃথিবীতে তাঁর খলীফা[17] পাঠাবেন। এর অপরিহার্য অবলম্বন হিসেবেই তিনি হাওয়াকে[18] সৃষ্টি করেছেন।
এ আয়াতে জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে সৃষ্টিকর্মের এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অতএব, ইসলামের দৃষ্টিতে জাতীয় পরিচয় মেনে নেওয়া হয়েছে পরিচিতি তথা বিভিন্ন রকম বিনিময় ও সহযোগিতায় সুবিধার্থ। তবে এটাকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হিসেবে ধরা যাবে না। কারণ, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করার বিষয়। আর সেটার মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া। আলোচ্য আয়াতে এটাই বলা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণেও এ ঘোষণা দিয়েছিলেন: জাবির ইবন আব্দিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইয়্যামে তাশরীকের দিন বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন: “হে মানুষেরা! তোমাদের প্রতিপালক একজন, তোমাদের পিতা একজন, সাবধান! অনারব লোকদের ওপর আরবীয় লোকদের, আরবীয় লোকদের ওপর অনারবের কোনো প্রাধান্য নেই, তেমনিভাবে লালের ওপর কালো আবার কালোর ওপর লাল বর্ণের লোকের কোনো প্রাধান্য নেই। তাদের মধ্যে সেই প্রাধান্য পাবে যে মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহর নিকট সেই সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সম্মানিত যে বেশি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে।”[19]
এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষগত শ্রেষ্টত্বের মনোবৃত্তির ঊর্ধ্বে তাকওয়াকে স্থান দিয়েছেন। কোনো অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করে স্বকীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে সে ভাষার সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন ইসলামের কাম্য। পূর্বে আমরা দেখতে পেয়েছি, মাতৃভাষা সম্পর্কে ইসলাম কতটুকু গুরুত্বারোপ করেছে। কোনো রকম জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কাজ করলেই তা ইসলাম বিরোধী হবে, এমন ধারণা করা ঠিক নয়। নবীগণের জীবনে জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়।
মূসা আলাইহিস সালাম স্বীয় জাতি বনী ইসরাঈলদের স্বার্থে তথা ফির‘আউনের নিপীড়ন থেকে স্বজাতির মুক্তির জন্য ফির‘আউনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং ফির‘আউনের জাদুকরদের সাথে জাদু যুদ্ধের বিরোধিতা করে জয়ী লাভ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ঘোষণা:
﴿ حَقِيقٌ عَلَىٰٓ أَن لَّآ أَقُولَ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡحَقَّۚ قَدۡ جِئۡتُكُم بِبَيِّنَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ فَأَرۡسِلۡ مَعِيَ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ١٠٥ قَالَ إِن كُنتَ جِئۡتَ بَِٔايَةٖ فَأۡتِ بِهَآ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّٰدِقِينَ ١٠٦ فَأَلۡقَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِيَ ثُعۡبَانٞ مُّبِينٞ ١٠٧ وَنَزَعَ يَدَهُۥ فَإِذَا هِيَ بَيۡضَآءُ لِلنَّٰظِرِينَ ١٠٨ قَالَ ٱلۡمَلَأُ مِن قَوۡمِ فِرۡعَوۡنَ إِنَّ هَٰذَا لَسَٰحِرٌ عَلِيمٞ ١٠٩ يُرِيدُ أَن يُخۡرِجَكُم مِّنۡ أَرۡضِكُمۡۖ فَمَاذَا تَأۡمُرُونَ ١١٠ ﴾ [الاعراف: ١٠٥، ١١٠]
“এটা স্থির নিশ্চিত যে, আমি আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলব না। তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে স্পষ্ট প্রমাণ আমি তোমাদের নিকট এনেছি, সুতরাং বনী ইসরাঈলকে তুমি আমার সঙ্গে যেতে দাও। ফির‘আওন বলল: ‘যদি তুমি কোনো নিদর্শন এনে থাক তবে তুমি সত্যবাদী হলে তা পেশ কর।’ অতঃপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল এবং তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হলো। আর সে তার হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হলো। ফির‘আওন-সম্প্রদায়ের প্রধানরা বলল: ‘এ তো একজন সুদক্ষ জাদুকর। এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায়, এখন তোমরা কী পরামর্শ দাও?” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১০৫-১১০]
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَأۡتِيَاهُ فَقُولَآ إِنَّا رَسُولَا رَبِّكَ فَأَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ وَلَا تُعَذِّبۡهُمۡۖ قَدۡ جِئۡنَٰكَ بَِٔايَةٖ مِّن رَّبِّكَۖ وَٱلسَّلَٰمُ عَلَىٰ مَنِ ٱتَّبَعَ ٱلۡهُدَىٰٓ ٤٧ ﴾ [طه: ٤٧]
“সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং বল: ‘আমরা তোমার রবের রাসূল, সুতরাং আমাদের সঙ্গে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিও না, আমরা তো তোমার নিকট এনেছি তোমার রবের নিকট থেকে নিদর্শন এবং শান্তি তাদের প্রতি যারা অনুসরণ করে সৎ পথ।” [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৪৭]
জাতীয় স্বার্থে কাজ করা ইসলামের পরিপন্থী নয়, যদি না সেটি ইসলামের মৌলিক আকীদা, বিশ্বাস, আচার-আচারণের সাথে দ্বান্দ্বিক হয়। যেমন, ইসলামী দাওয়াতের পথে বাধা নিরসনের লক্ষ্যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে প্রয়োজনে অস্ত্র ধরতে হবে। এটি ইসলামের মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
﴿قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٤﴾ [التوبة: ٢٤]
“বল: তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য -যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান -যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত।’ আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৪]
এ আয়াতে আল্লাহর দীন-ইসলামের মৌলিক স্বার্থকে পারিবারিক, অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এর পরিপন্থী কোনো ভূমিকার ব্যাপারেও মানব সমাজকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে কোনো ভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলে তার উৎকর্ষ সাধনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও বৃদ্ধি পাবে। সে অর্থে জাতীয় ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হলে সেটি ইসলামের মূল্যবোধ ও জীবনবোধের পরিপন্থী হবে না। কোনো এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখের ভাষা উপেক্ষা করে অন্য ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা চরম অন্যায়। এ অন্যায় প্রতিরোধ করতে হবে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে। বাংলাভাষা আন্দোলনে তাই ঘটেছে। যে জন্য এটা অবশেষে এ অঞ্চলের অবহেলিত জনতার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণ তথা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয়। সুতরাং স্বাধিকার আদায়ের অর্থে ভাষা আন্দোলনের ব্যাখ্যা করা হোক, আর প্রেরণা গ্রহণ করা অর্থে হোক, তা ইসলামের পরিপন্থী নয়; বরং এ সম্পর্কে ইসলামের ভূমিকা সুস্পষ্ট। বহুসংখ্যক আয়াত ও হাদীস রয়েছে এ ব্যাপারে। সবগুলোতে প্রত্যেকের ন্যায্য অধিকার প্রদান করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে। এ স্বল্প পরিসরে সূরা নিসার একটি আয়াতই যথেষ্ট মনে করছি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا وَإِذَا حَكَمۡتُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحۡكُمُواْ بِٱلۡعَدۡلِۚ إِنَّ ٱللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ سَمِيعَۢا بَصِيرٗا ٥٨﴾ [النساء: ٥٨]
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট! নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৮]
ইসলাম মাতৃভাষার ওপর পূর্ণ গুরুত্বারোপ করে থাকে, মাতৃভাষার অধিকার স্বীকার করে নিয়ে তার সমৃদ্ধিতে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে, বিভিন্ন ভাষার স্বীকৃতি দেয়, ভাষা বৈচিত্রকে সৃষ্টিকর্তার রহস্য মনে করে, বিভিন্ন ভাষায় ইসলামকে তুলে ধরার জন্য অনুপ্রাণিত করে। ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের মানুষের ভাষার বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। কোনো মুসলিম যদি ভুলবশতঃ এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তবে সেটা তার নিজস্ব।
আল্লাহ তা‘আলা এ পৃথিবীতে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন মানুষদেরকে পথভ্রষ্টতা থেকে হিদায়াতের দিকে পথ দেখানোর জন্য এবং এ নবী ও রাসূলদের মূল কাজ ছিল দাওয়াত দেওয়া। তাই দা‘ওয়াত দানের ক্ষেত্রে ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এ জন্য ভাষা চর্চা ও সমৃদ্ধির জন্য ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। সুতরাং ভাষা চর্চা বা সমৃদ্ধ করার লক্ষে ভাষা আন্দোলন করা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই পূণ্যের কাজ বলেই মনে হয়। কেননা কোনো জাতির নিকট দাওয়াত দিতে গেলে আগে ঐ জাতির ভাষা দা‘ঈকে অবশ্যই জানতে হবে এবং তাদের সামনে স্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। এজন্য মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর নিকট তার ভাষা অস্পষ্ট হওয়ার কারণে তার ভাইয়ের নবুওয়াতী দাবী করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَأَخِي هَٰرُونُ هُوَ أَفۡصَحُ مِنِّي لِسَانٗا فَأَرۡسِلۡهُ مَعِيَ رِدۡءٗا يُصَدِّقُنِيٓۖ ﴾ [القصص: ٣٤]
“আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে সুন্দরভাবে ও স্পষ্টভাষায় কথা বলতে পারে, সুতরাং আপনি তাকে আমার সাথে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন।” [সূরা আল-ক্বাসাস, আয়াত: ৩৪]
কাজেই ইসলামের দাওয়াতকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলন ছিল একটি জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মূল্যায়ন ও আমাদের করণীয়:
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন বাংলাভাষা আন্দোলন রক্তঝরা, অগ্নিক্ষরা এক মহান স্মৃতি বিজড়িত একটি দিনের নাম। যা যুগে যুগে সারা বিশ্বের মানবসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। ইতিহাসের সে অধ্যায় রচিত হয়েছিল এ পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) কিছু অকুতোভয় যুবক সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতের মতো আরো অনেক যুবকের তাজা রক্তের বিনিময়ে। মাতৃভাষা বাংলাভাষা, যে ভাষার সাথে এ দেশের মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। সে ভাষায় কথা বলা তথা মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তারা নিজেদের মহামূল্যবান জীবন নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাদের এ আত্মদানকে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে, তারা শহীদ কি-না?
উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের একক সার্বভৌমত্ব, শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত ও শেষ বিচারের দিনসহ পরকালীন অন্যান্য বিষয়র প্রতি অকুণ্ঠ চিত্তে নিজের আন্তরিক বিশ্বাসের মৌখিক ঘোষণাদান এবং রিসালাতের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রেরিত আল্লাহ প্রদত্ত মানবজীবনের বিধান সমাজ জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের সংগ্রামে ইসলামী বিরোধী শক্তির হাতে মৃত্যু বরণ করাকেই শহীদ বলে।
মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সৃষ্টিগত তথা জন্মগত অধিকার। কারণ, মহান আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সাথে সাথে তাকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلۡبَيَانَ ٤﴾ [الرحمن: ١، ٤]
“দয়াময় আল্লাহ। তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। তিনিই সৃষ্টি করিয়াছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।” [সূরা আর-রহমান, আয়াত: ১-৪]
আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে জানা যায় যে, মানুষ সৃষ্টির সাথে ভাষার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। তাই মাতৃভাষা মানুষের একটি সৃষ্টিগত অধিকার। কেউ যদি এ অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায় তার প্রতিরোধ করা অপরিহার্য। আর এ প্রতিরোধে কেউ নিহত হলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে শহীদের মর্যাদা পাবে। তবে শর্ত হলো, তাদেরকে প্রকৃতভাবে এমন মুসলিম হতে হবে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিহত হয়।[20]
আমরা বাংলাদেশের অধিবাসী, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। আমরা আজ মাতৃভাষায় কথা বলি। এর পেছনে এ সকল শহীদদের অবদানই সর্বাগ্রে। কাজেই এ ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যে সকল অকুতোভয় মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিল তারা যদি ইসলামী শহাদাতের শর্তগুলো পূরণ করে থাকেন, কুরআন-হাদীসের আলোকে তাদেরকে আমরা ইনশাআল্লাহ জান্নাতবাসীই বলব। তাদের নাজাতের ব্যাপারে আল্লাহই সর্বজ্ঞাত। অন্যথায় তাদের ভিতর যদি সে রকম শর্তাবলী অনুপস্থিত থেকেও থাকে, তবুও তারা যেহেতু আমাদের অধিকার আদায়ের জন্যেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সুতরাং মুসলিম হিসেবে তাদের জন্য আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর কাছে মাগফিরাত তথা ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া। কেননা এটি একটি সদকায়ে জারিয়ার মতো। আর এ সম্পর্কে হাদীসের একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, “যদি কেউ কোনো সদকায়ে জারিয়ার মতো সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাহলে যত প্রাণী তা থেকে উপকৃত হবে, সে ঐসকল মানুষের নেকীর একটি অংশ পেয়ে যাবে।”[21]
অবশ্য কোনো কোনো ধর্ম ও সমাজে গান বাজনার মাধ্যমে তাদের দেব-দেবীদেরকে স্মরণ করে থাকে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদেরকে খুশী করার চেষ্টা করে। সেটা তাদের ধর্মীয় ব্যাপার। আমরা মুসলিম, আমাদের ধারণা মতে শহীদরা আখেরাতে অবস্থান করছেন। তাই আমাদের উচিৎ যে সকল কাজ-কর্ম তাদের উপকারে আসে সে সকল কাজই বেশি বেশি করা।
উপসংহার
বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্য বিশ্বের প্রতিটি ভাষারই চর্চা করা ইসলামী দা‘ঈদের কর্তব্য। অতএব, প্রতিটি ভাষায় ইসলামী সাহিত্য গড়ে তুলে মানব কল্যাণে কাজ করতে হবে। জাতীয়তার প্রেক্ষিতে যেমন ইসলামের সার্বজনীনতা সীমিত করা ঠিক নয়, তেমনি ইসলামের বিশ্বজনীনতার কথা তুলেও কোনো অঞ্চরের ভাষার ওপর হস্তক্ষেপ করা বা তার গুরুত্ব উপেক্ষা করা আদৌ উচিৎ নয়। ইসলাম ভাষাগত জাতীয়তার ঊর্ধ্বে। বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে সকল ভাষাই তার নিজস্ব। মানবসমাজের সকলের মাতৃভাষা চর্চা ও সমৃদ্ধি সাধনে সে অনুপ্রাণিত করে। এটা মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে মনে করে। এতে কোনো রকম হস্তক্ষেপ ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তার মূল উৎস কুরআন সুন্নাহতে কী আছে সর্বপ্রথম তাই দেখা প্রয়োজন। পরিশেষে ভাষা আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে যার যতটুকু ভালো আছে তা গ্রহণ করে এবং মন্দটুকু বর্জন করে উদার মন নিয়ে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে মাতৃভাষার উৎকর্ষ সাধনে কাজ করা একান্ত আবশ্যক।
[1]. ড. রামেশ্বর, সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা, (কলিকাতা, ১৩৯৯ বাং), পৃ. ৮।
[2]. Encyclopedia of Britanica, (London: Encyclopedia Britanica, Inc.1980), Vol. 10, P. 642.
[3]. Edger H. Sturtevant, An introduction to languistic Science, (New Haven: Yale University Press, 1947), Chapter-1.
[4] ভাষাবিজ্ঞানীগণ উল্লিখিত প্রতীককে Agreed vocal system which is also arbitpary-বলে উল্লেখ করেছেন।
-Barnard Block & Goerge Tregar, Outline of linguistic Analysis, (America Baltimore, 1942); ড. মো. আব্দুল আউয়াল, ভাষাতত্ত্বের সহজকথা, (ঢাকা: গতিধারা প্রকাশনী, ২০০০ খ্রি.), পৃ. ১১।
[5] আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৫ খ্রি.), পৃ. ১।
[6] সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, সম্পাদনা: প্রফেসর আহমদ শরীফ, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯২), পৃ. ৪৫।
[7] খন্দকর কামরুল হুদা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শেখ মুজিব, ১৯৯৫ খ্রি., পৃ. ৩২।
[8]. মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের তারিখ, (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০১ খ্রি.), পৃ. ১৫।
[9]. রফিকুল ইসলাম, স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, (ঢাকা: ঐতিহ্য প্রকাশনী, ২০০৪ খ্রি.), পৃ. ৫১।
[10]. আলুসী, শিহাবুদ্দীন মাহমুদ ইবন আব্দিল্লাহ আল-হুসাইনী, রূহুল মা‘আনী ফী তাফসীরিল কুরআনিল ‘আযীম ওয়াস সাব‘য়িল মাছানী, (বৈরূত: দারুল ফিকর, তা.বি.), খ. ১, পৃ. ২৬১; ‘আব্দুল ‘আযীয ইবন আব্দিস সালাম ইবনিল আবিল কাসিম ইবনুল হুসাইন, তাফসীরু ইবন আব্দিস সালাম, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, তা.বি.), খ. ১, পৃ. ৩৫।
[11]. আবূ ইয়া‘লা, আহমাদ ইবন ‘আলী ইবন মাছনা, আল-মুসনাদ, (দামেস্ক: দারুল মা‘মূন লিত তুরাছ, ১৪০৪ হি.), খ. ১২, পৃ. ১৪৬, হাদীস নং ৬৭৭৫।
[12] আবূ দাঊদ, সুলাইমান ইবন আল-আশ-আশ, আস-সুনান, (বৈরূত: দারুল ফিকর, তাবি), খণ্ড ৪, পৃ. ২১৭, হাদীস নং ৪৩৪৬; ইমাম ইবন মাজাহ, আস-সুনান, (বৈরুত: দারুল কিতাবিল আরাবী, তা.বি.), খ. ২, পৃ. ১৩২৯; হাদীস নং ৪০১১; তিরমিযী, আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবন ঈসা, আস-সুনান, (বৈরূত: দারু ইহইয়ায়িত-তুরাছিল আরাবী, ১৪২১ হি.), খ. ৪, পৃ. ৪৭১, হাদীস নং ২১৭৪।
[13]. ইবন খালদূন, আল-মুকাদ্দিমা, (বৈরূত: দারুল ফিকর, ১৯৭৯ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৭১, ৩৫৮।
[14]. সহীহ বুখারী: ৪/১০১, আস-সহীহ।
[15]. সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ২৬৩১।
[16]. আদম ‘আলাইহিস সালাম: আদম ‘আলাইহিস সালাম একাধারে মানবজাতির পিতা, এ পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত খলীফা এবং প্রথম নবী। (আহমাদ, আল-মুসনাদ, (কায়রো: আল-মাকতাবাতুত তাওফীকীয়্যাহ, তা.বি), ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৭৮, হাদীস নং ২১৫৮৭। আলবানী এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। -তিবরীযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, তাহকীক: মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪০৫ হি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৪৬, হাদীস নং ৫৭৩৭।)
মানবজাতি এবং নবুওয়াতের সূচনা তার মাধ্যমে। আমরা সকলে তারই বংশধর। তারই স্ত্রী আমাদের সকলের মাতা বা ‘উম্মুল বাশার’। (তাবারানী, আল্-মু‘জামুল আওসাত, (কায়রো: দারুল হারামাইন, ১৪১৫ হি.), ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৪৩১, হাদীস নং ৬৩৫৩; আল-হাইছামী,‘আলী ইবন আবী বকর, মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ ওয়া মানবা‘উল-ফাওয়ায়িদ, সম্পাদনা: ইবন হাজার ও আল-‘ইরাকী (বৈরূত: দারুল কুতুবুল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪০৮ হি./১৯৮৮), ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৮।)
আদম শব্দটির উৎপত্তির ব্যাপারে বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এ সম্পর্কে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো: আদম শব্দটি হিব্রু ভাষা থেকে গৃহীত। যার অর্থ পৃথিবী। কেননা পৃথিবীর মাটি থেকে আদম ‘আলাইহিস সালামের সৃষ্টি। (বুতরুস আল-বুস্তানী সম্পাদনা, দায়িরাতুল মা‘আরিফ, (বৈরূত: দারুল মা‘আরিফ, তা.বি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫।)
বাইবেলে আদম শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। (বাইবেলে এসেছে: (And out of the ground the LORD God formed every beast of the field and every fowl of the air; and brought them unto Adam to see what he would call them: and whatsoever Adam called every living creature.Ó-Holy Bible, Genesis, 2: 7, P. 2.)
আদম ‘আলাইহিস সালাম আর মানব সৃষ্টির কথা আল-কুরআনের বর্ণনায় মূলতঃ এক ও অভিন্ন বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মধ্যে রূহ্ ফুঁকে দিয়ে ফিরিশতাদের সাজদাহ করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন যার দৈর্ঘ্য ছিল ষাট হাত। (বুখারী, আবু ‘আব্দিল্লাহ্ ইসমাঈল ইবন মুগীরাহ, আল-জামি‘উস সহীহ, (বৈরূত: দারু ইবন কাছীর, ১৪০৭হি.), খ.৩, পৃ. ১০৯৮, হাদীস নং ৫৮৫৯; মুসলিম, আস-সহীহ, (কায়রো: মাকাতাবাহ আল-কুদসী, ১৩৬৭ হি.), ১৩ তম খণ্ড, পৃ. ৪৮৫, হাদীস নং ৫০৭৫; আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, ১৬ তম খণ্ড, পৃ. ৩৬৬, হাদীস নং ৭৮২৪।)
এ সম্পর্কে বাইবেলেও বর্ণনা পাওয়া যায়: “The LORD God formed the man from the dust of the ground and breathed into his nostrils the breath of life, and the man became a living being.” ‘‘আর সদাপ্রভূ ঈশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে আদমকে (অর্থাৎ মনুষ্যকে) নির্মাণ করিলেন এবং তাহার নাসিকায় ফুঁ দিয়া প্রাণবায়ু প্রবেশ করাইলেন; তাহাতে মানুষ্য সজীব প্রাণী হইল”। (Holy Bible, Genesis, 2: 7, P. 2.)
আর আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পিছনে মুল কারণ ছিল পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দেওয়া। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩০]
তবে তিনি রাসূল ছিলেন কিনা এবং কাদের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন এ ব্যাপারে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। একদল ‘আলেম মনে করেন, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তাকে তার বংশধর ও পরিবার-পরিজনের কাছে রিসালাত প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অপর একদল ‘আলেম মনে করেন তিনি রাসূল ছিলেন না। তারা বলেন, যদি আদম ‘আলাইহিস সালাম প্রথম রাসূল হতেন তাহলে মানুষেরা কিয়ামতের দিন নূহ ‘আলাইহিস সালামকে এ কথা বলত না যে, আপনি আল্লাহর যমীনে প্রথম রাসূল। (সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, কিতাবুল আম্বিয়া, প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৭০, হাদীস নং ৩০৯২; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৮; তিরমিযী, আস-সুনান, প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬; ইবন মাজাহ, আবূ ‘আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইয়াজিদ, আস-সুনান, (বৈরূত: দারুল ফিকর, তা.বি.), পৃ. ৩২৯-৩৩০।)
এ হাদীসের জবাবে রিসালাতের পক্ষের ‘আলিমগণ বলেন, এখানে প্রথম রাসূল বলতে তুফানের পরবর্তী রাসূলদেরকে বুঝানো হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য কথা হলো, তিনি রাসূলও ছিলেন। (সাবূনী, মুহাম্মাদ আলী, আন-নবূওয়াহ ওয়াল-আম্বিয়া, (বৈরূত: আল-মাঝরা‘আ বিনায়াহ আল-ঈমান, ১ম সংষ্করণ, ১৪০৫ হি./১৯৮৫), পৃ. ১৩৮-১৩৯।)
বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থসমূহ হতে জানা যায় যে, আদম ‘আলাইহিস সালামের ওপর দশখানা সহীফা নাযিল হয়েছিল। (ইবন জারীর, তারীখুর রুসুলি ওয়াল মুলূক, ( বৈরূত: দারুল কালাম, তা.বি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৬-১০৭; ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাজাম, (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৫), ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭২-২৭৩।)
আদম ‘আলাইহিস সালামের বয়স লওহে মাহফুজে এক হাজার বছর লেখা ছিল। (তিরমিযী, আস-সুনান, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৩২৯০। ইমাম তিরমিযী অত্র হাদীসখানাকে হাসান গরীব বলেছেন। -আল-আলবানী রহ. অত্র হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন। -আলবানী, সহীহ ওয়া দ‘ঈফু সুনানিত-তিরমিযী, (আল্-ইসকান্দারিয়্যাহ: মারকাযু নূরিল ইসলাম লি আবহাছিল কুরআনি ওয়াস সুন্নাহ তা.বি.) ৭ম খণ্ড পৃ. ৩৬৮।
তৌরাত কিতাবের বর্ণনা মতে, মৃত্যুর সময় আদম ‘আলাইহিস সালামের বয়স ছিল ৯৩০ (নয় শত ত্রিশ) বছর। -কিতাবুল মুকাদ্দাস, তৌরত শরীফ: পয়দয়েশ, (ঢাকা: বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, ষষ্ঠ সংস্করণ ২০০৩), শ্লোক নং ৫: ৫, পৃ. ৭।
আর এ প্রসঙ্গে বাইবেলে এসেছে, “And all the days that Adam lived were nine hundred and thirty years: and he die.”-Holy Bible, Genesis, 5: 5, P. 6.)
হাদীসের বর্ণনামতে, আদম ‘আলাইহিস সালামের বয়স এক হাজার বছরের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার মৃত্যুর দিনটি ছিল শুক্রবার। (ইবন মাজাহ, আস-সুনান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৮৫, হাদীস নং ১০৭৪; আহমাদ, আল-মুসনাদ, ৩১তম খণ্ড, পৃ. ১৩৩, হাদীস নং ১৪৯৯৭; তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪১১, হাদীস নং ৪৩৮৭।)
আদম ‘আলাইহিস সালামকে কোথায় দাফন করা হয়েছিল সে সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের কোনো সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না। এক বর্ণনায় পাওয়া যায় আদম ‘আলাইহিস সালামের দফন স্থান হলো ভারতবর্ষ তথা সরন্দীপের যে পাহাড়ে সর্বপ্রথম তিনি অবতরণ করছিলেন, সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। (সাবূনী, মুহাম্মাদ আলী, আন-নবূওয়াহ ওয়াল আম্বিয়া’, পৃ. ১৪৬।)
অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণ এ মতকে সমর্থন করেছেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, মক্কা শরীফের জাবালে আবূ কুবায়স নামক স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ভিন্নমতে, নূহ ‘আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনকালে আদম ‘আলাইহিস সালাম ও হাওয়া-এর কফিন জাহাজে রেখেছিলেন। প্লাবন শেষে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে তাদেরকে দাফন করেন। (তাবারী, আবূ জা‘ফার মুহাম্মাদ ইবন জারীর, জামি‘উল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, (দারুল ফিকর, তা.বি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬১।)
[17]. পৃথিবীতে প্রতিনিধি প্রেরণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩০]
[18]. হাওয়া ‘আলাইহাস সালাম: পৃথিবীতে আল্লাহর বাণী প্রচারক হিসেবে আদম আলাইহিস সালাম-ই হলেন প্রথম পুরুষ ও হাওয়া হলেন প্রথম নারী। “নারীরা পুরুষদের মতোই পরস্পর ভ্রাতৃসুলভ মর্যাদার অধিকারী।” (তিরমিযী, আস-সুনান, (বৈরূত: দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবী), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৯, হাদীস নং ১০৫; আহমাদ, আল-মুসনাদ, (মিশর: কর্ডোভা, তা.বি.), হাদীস নং ২৪৯৯৯। আলবানী রহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। -আলবানী, সহীহ ওয়া দ‘ঈফু সুনানিত তিরমিযী, (আল্-ইসকান্দারিয়্যাহ: মারকাযু নূরিল ইসলাম লি আবহাছিল কুরআনি ওয়াস সুন্নাহ তা. বি.), ১ম খণ্ড পৃ. ১১৩।)
নারী-পুরুষের সমন্বয়ে আজকের এ পৃথিবী ভরপুর। আদম ‘আলাইহিস সালাম থেকে তার যে স্ত্রীকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা মূলতঃ তার মানসিক প্রশান্তি, ভালোবাসা ও নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ এবং পৃথিবীর সর্বত্র মানবকুল ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যেই।
উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর প্রথম নারী ও আদম আলাইহিস সালামের স্ত্রীর নাম হাওয়া। আদম ‘আলাইহিস সালাম নিজেই তার স্ত্রীকে হাওয়া (حَوَاءْ) নামে নামকরণ করেছেন। (ইবন হিব্বান, আস-সহীহ, (দারুল ফিকর, তা.বি.), ৯ খণ্ড, পৃ. ৪৮৫, হাদীস নং ৪১৭৭; যারকানী, মুহাম্মাদ ইবন আব্দিল বাকী, শারহুয-যারকানী, (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪১১ হি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯২।)
বাইবেলে হাওয়াকে ‘হবা’ এবং ইংরেজি ভাষায় হাওয়াকে ‘Eve’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। (‘‘She was beautiful and Adam loved her very much. He named her Eve.”) -Wallis C. Metts, Children’s, book of the Bible, (Publication International, Ltd.), P. 8.)
আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী সৃষ্টি করার পর আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তাঁর থেকে তাঁর সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একই ব্যক্তি থেকে। তারপর তা থেকেই তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন...।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬]
উপরোক্ত আয়াতে আদম ‘আলাইহিস সালামের সঙ্গিনী হাওয়া এর সৃষ্টি প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখিত আয়াতে “একই ব্যক্তি” বলতে আদম আলাইহিস সালামকে এবং “তা থেকেই তাঁর স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন” দ্বারা আদম ‘আলাইহিস সালামের স্ত্রীকে বুঝানো হয়েছে। (ইবন কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৫; আলুসী, শিহাবুদ্দীন মাহমূদ ইবন্ আব্দিল্লাহ আল-হুসাইনী, রূহুল মা‘আনী ফী তাফসীরিল কুরআনিল ‘আযীম ওয়াস সাব‘উল মাছানী, (বৈরূত: দারুস সাদির, তা.বি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৭৫; শানকীতী, আদওয়াউল বায়ান, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৯।)
এ প্রসঙ্গে ‘আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আদম ‘আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির পর তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এবং তার বাম পাঁজর থেকে হাড় নিয়ে সেই স্থানটি গোশতপূর্ণ করা হো। তখন আদম নিদ্রিত ছিলেন। ইত্যবসরে উক্ত হাড় দ্বারা তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করা হলো। (নাওয়াওয়ী, শারহুন নাওয়াওয়ী ‘আলা সহীহি মুসলিম, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৫৩; দায়লামী, আবী শাযা‘ শায়রুবিয়াহ ইবন শাহরাদার, (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৬), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪২২, হাদীস নং ৫২৯৩; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, (মিশর: দারুল ফিকরিল আরবী, তা.বি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৩।)
এ প্রসঙ্গে বাইবেল এর আদিপুস্তকে এভাবে এসেছে: ‘‘And the LORD God caused a deep sleep to fall upon Adam, and he slept: and he took one of his ribs, and closed up the flesh instead thereof; And the rib, which the LORD God had taken from man, made he a woman, and brought her unto the man.” “সদাপ্রভূ ঈশ্বর আদমকে ঘোর নিদ্রায় মগ্ন করিলে তিনি নিদ্রিত হইলেন, আর তিনি তার একখানি পঞ্জর লইয়া মাংস দ্বারা সেই স্থান পূর্ণ করিলেন। সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে একজন নারী নির্মাণ করিলেন ও তাহাকে আদমের নিকট আনিলেন।” (Holy Bible, Genesis, 2: 21-22, P. 3.)
‘আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদরাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, “আদম জান্নাতে অবস্থান করলেন এবং সেখানে ইচ্ছামত চলাচল করতে লাগলেন। সেখানে তার কোনো স্ত্রী ছিল না যার দ্বারা তিনি শান্তি লাভ করতে পারেন। অতঃপর তিনি সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন এবং যখন জাগ্রত হন তখন তার মাথার কাছে একজন নারীকে বসা দেখেন, যাকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার পাঁজরের হাড় হতে...।” (নববী, শারহুন নববী ‘আলা সহীহি মুসলিম, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৫৩; ইবন হিববান আস-সহীহ, ৯খণ্ড, পৃ. ৪৮৫, হাদীস নং ৪১৭৭; যারকানী, মুহাম্মাদ ইবন আব্দিল বাকী, শারহুয যারকানী, (বৈরূত: দারুল কুতুবুল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪১১ হি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯২।)
হাওয়ার মৃত্যুর ব্যাপারে কুরআনে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার বর্ণনা মতে আদম ‘আলাইহিস সালামের মৃত্যুর এক বছর পর হাওয়া মারা যান। (ইবন কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৩।)
এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, হাওয়াকে দাফন করা হয় জেদ্দায়। (আল-ফাকিহী, আবূ ‘আব্দুল্লাহ, মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক, আখবারু মক্কাহ, (বৈরূত: দারু খিদ্র, ১৪১৪ হি., ২য় সংস্কারণ), ৭ম খণ্ড, পৃ. ১০৭, হাদীসনং-২৫৩।)
অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, নূহ আলাইহিস সালাম মহা প্লাবনের পূর্বে আদম ‘আলাইহিস সালাম ও হাওয়া এর দেহ মুবারক কিস্তিতে উঠান এবং পরে তিনি তাদেরকে বায়তুল মোকাদ্দাসে পূনঃদাফন করেন। (মুকাবিবর, নিসাউন হাওলাল আম্বিয়া, ৩৪০; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খণ্ড, পৃ. ২২৬।) এ ব্যাপারে আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।
[19] বাইহাকী, আবূ বকর আহমাদ ইবনুল হুসাইন, শু‘আবুল ঈমান, (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১৪১০ হি.), খ. ৪, পৃ. ২৮৯, হাদীস নং ৫১৩৭।
[20]. ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান আন্ওয়ারী, মাতৃভাষা আন্দোলন ও ইসলাম, (ঢাকা: মুহাম্মাদ ব্রাদার্স, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ১০৪।
[21] সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, প্রাগুক্ত, খ. ৫, পৃ. ৭৩, হাদীস নং ৪৩১০।