আমাদের সমাজে মজুদদারি : ইসলামি দৃষ্টিকোণ
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
আমাদের সমাজে মজুদদারি: ইসলামি দৃষ্টিকোণ
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
الاحتكار وحكم الإسلام فيه
(باللغة البنغالية)
علي حسن طيب
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা............
এ নিবন্ধে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বাজারের সবচেয়ে বড় অশুভ প্রবণতা মজুদদারি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলাম এ ব্যাপারে কী বলে তাও তুলে ধরা হয়েছে অতি সংক্ষেপে।
আমাদের সমাজে মজুদদারি : ইসলামি দৃষ্টিকোণ
প্রায়শই দেখা যায়, দেশে পর্যাপ্ত পণ্যের উৎপাদন সত্ত্বেও দ্রব্যের মূল্য অযৌক্তিক পর্যায়ে থাকে। এর অনেকগুলো কারণের অন্যতম মজুদদারি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাসে মজুদদারি একটি প্রাচীন এবং পরিচিত ধারণা। এর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ধরা যাক, এ বছর দেশে প্রচুর আদা উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু সাধারণ কৃষকের উৎপাদিত এই আদা বাজারে সরাসরি আসে না বললেই চলে। পণ্যের বিপণনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। এই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মজুদদারি করেন। কৃষক থেকে আদা কিনে তারা সেটা বাজারে সরবরাহ না করে গুদামজাত করে রাখেন। ফলে বাজারে গিয়ে ক্রেতারা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আদা পায় না। আর কোনো পণ্যের সরবরাহ যখন চাহিদার থেকে কম হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই পণ্যটির দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। এতেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর কৃত্রিম সঙ্কটের ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ ক্রেতাদের। পণ্য কিনতে হয় বেশি দাম দিয়ে।
ইসলাম এসব অসাধুতার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অধিক মুনাফার লোভে মজুদদারি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারি একটি ঘৃণ্য অপরাধ।
মা'মার ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا يَحْتَكِرُ إِلَّا خَاطِئٌ»
“পাপাচারী ছাড়া অন্য কেউ মজুদদারি করে না[1]।"
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا ٢٩﴾ [النساء: ٢٩]
“হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান।" [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯]
এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদের শরী'আত অননুমোদিত পন্থায় অন্যের সম্পদ ভক্ষণ থেকে বারণ করেছেন। পাশাপাশি বৈধ কেনাবেচায় জুড়ে দিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রতা উভয়পক্ষের লাভ ও উপকারিতার ভিত্তিতে স্বতস্ফূর্ত সম্মতির শর্ত। মজুতদারি যেহেতু ব্যবসার অনুমোদিত কোনো পন্থা নয়, তাই এর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ অবৈধ পন্থায় উপার্জিত বলে তা আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে।
বাংলাদেশে যে দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে তা তৈরিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে মজুদদার, সিন্ডিকেটকারী, ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। গ্রামের যে কৃষকরা রোগ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘর্মাক্ত শরীরে শস্য ফলান, যাদের অবদানে জঠরজ্বালা নিবারিত হয়ে সারা দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটে, তাদের ভাগ্যের কোনো হেরফের হয় না। অসাধু চক্রের ভাগ্যবদল হয় অতিদ্রুত। এরাই মুটে-মজুর-চাষীদের ভাগ্যবদলে সবচে বড় বাধা।
অথচ হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ تَلَقِّي الْجَلَبِ»
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বহিরাগত বিক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছেন[2]।"
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও মজুদদারী অবৈধ। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং মজুদদারীর অপরাধে কঠোর সাজার বিধান বলা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২(ঙ) ধারায় মজুদদারীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মজুদদারী বলতে বোঝায় কোনো আইন দ্বারা বা আইনের আবর্তে কোনো ব্যক্তি মজুদ অথবা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুদ বা সংরক্ষণ করা। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(১) ধারায় মজুদদারী বা কালোবাজারি ব্যবসার শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেউ মজুদদারী বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে সে মৃত্যুদণ্ড[3] বা আজীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছর পর্যন্ত ব্যপ্ত হতে পারে এমন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। তবে উল্লেখ্য, মজুদদারীর অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রমাণ করে, সে আর্থিক বা অন্যভাবে লাভের জন্য মজুদ করে নি, সে ক্ষেত্রে তাকে সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। আদালত মজুদদারী বা কালোবাজারে লেনদেন করার অপরাধে শাস্তি প্রদান করার সময় যা সম্পর্কে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা সরকার বরাবর বাজেয়াপ্ত করার আদেশ প্রদান করবে।
২৮ ডিএলআর-এর (পৃষ্ঠা ৩৭১) এর উল্লিখিত 'মো. আমির হোসেন বনাম রাষ্ট্র' মামলার সিদ্ধান্ত: মজুদদারের দখলে কোনো মালামাল থাকলে তা মজুদদারির অপরাধ সংঘটন করবে না, যদি না মজুদের পরিমাণ সরকারকর্তৃক নির্ধারিত অনুমোদিত মজুদের পরিমাণের অতিরিক্ত না হয়।
আইন থাকলেও এদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না প্রচলিত আইন বা আইন প্রয়োগকারীর হাত। তবে মানুষের আইনে পার পেয়ে গেলেও আল্লাহর আইনে কোনো রেহাই নেই। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ লঙ্ঘন করায় পরকালে যেমন তাদের শাস্তি অবধারিত, তেমনি ইহকালেও ক্ষণিকের জন্য লাভবান হলেও অচিরেই আল্লাহ তাদের পাকড়াও করেন। কুরআনের ভাষায় রোগ-শোক, প্রাণ ও সম্পদক্ষয়ের মাধ্যমে আল্লাহ পার্থিব শাস্তি দেন।
ইসলামী আইনবিদদের মতে মজুদদারি হলো, সঙ্কটকালে বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করে এ উদ্দেশে মজুদ করা যে চাহিদা আরও বাড়লে বেশি দামে বিক্রি করা হবে। অতএব, নিম্নোক্ত অবস্থাগুলো মজুদদারির অন্তর্ভুক্ত নয়:
১. আদমানীকারকের সংগ্রহ যারা বাজার থেকে পণ্য ক্রয় না করে বিদেশ থেকে আমদানী করেন।
২. পণ্য সস্তা থাকতে তা ক্রয় করা যখন বাজারে সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকে।
৩. পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সময় ক্রয় করা যখন লক্ষ্য থাকে মজুদ না গড়ে তখনই বিক্রি করা।
৪. রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা ও আপৎকালীন সময়ের জন্য যে খাদ্য মজুদ করেন তাও মজুদদারি নয়।
৫. তাছাড়া একজন মানুষ তার নিজস্ব সম্পদ দাম বাড়লে বিক্রি করবে এ আশায় রেখে দিলে সেটাও মজুদদারি হবে না।