মিয়ানমারে মুসলিম গণহত্যা : নীরব বিশ্ববিবেক
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
মায়ানমারে মুসলিম গণহত্যা : নীরব বিশ্ববিবেক?
[বাংলা– Bengali – بنغالي ]
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
2013-1434
مأساة مسلمي الروهينجا في ميانمار
« باللغة البنغالية »
علي حسن طيب
مراجعة:د/ أبو بكر محمد زكريا
2013 - 1434
মায়ানমারে মুসলিম গণহত্যা : নীরব বিশ্ববিবেক
পৃথিবীর মানচিত্রে চোখ রেখে যে প্রান্তেই নজর দেবেন মুসলিম নির্যাতন কোথাও খুব বিরল নয়। বর্তমান দুনিয়ার সবচে স্বল্পমূল্য জিনিসগুলোর তালিকায় চলে এসেছে মুসলিমদের রক্ত। ধরাপৃষ্ঠের অন্য কোনো জাতি বা ধর্ম ইসলাম বা মুসলিমের মতো নির্যাতিত নয়। জগতের সবচে বড় নিগৃহিত জাতির নাম মুসলিম। আধুনিক দুনিয়ায় বসনিয়া-চেচনিয়া-জিংজিয়াং ও মিন্দানাওয়ের পর কাশ্মির-গুজরাট-আসাম, ফিলিস্তিন-আফগান-ইরাক ও মায়ানমারে চলছে মুসলিম নিধনযজ্ঞ। জাতিসঙ্ঘের ঘোষণা অনুযায়ী পৃথিবীতে সবচে নির্যাতিত সংখ্যালঘু জাতির নাম রোহিঙ্গা মুসলিম।
একটি কুকুর না খেয়ে মারা গেলে যে সভ্য দুনিয়ায় চোখের পানির স্রোত বয়ে যায়, বন্য প্রাণী বাঁচাতে যেখানে কোটি কোটি ডলারের ফান্ড অনায়াসে সংগৃহীত হয়, মায়ানমারে মাসের পর মাস নির্বিচারে নিরপরাধ নারী-শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করার পরও সেখানে কোনো সাড়া পড়ে না। কোনো কুলাঙ্গার ইসলামের নবী বা ধর্মকে কটাক্ষ করে প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরিত হলে সভ্য দুনিয়ায় তার আশ্রয়ের অভাব হয় না। তার স্বদেশ ত্যাগের বেদনায় সমব্যথী ব্যক্তি বা দেশের অভাব হয় না। অথচ নিজ দেশে পরবাসী রোহিঙ্গা মুসলিমদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হলেও এ নিয়ে তাদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। মানববন্ধন, টকশো কিংবা জাতিসঙ্ঘের কোনো বিশেষ বৈঠক নেই। এই বিশ্বে বাঘ সংরক্ষণের আহ্বানে পত্রিকার শিরোনাম করা হয়, সম্মেলন হয় কিন্তু সারাবিশ্বে ৫৭টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে কোনো সম্মেলন হয় না।
অন্তহীন নির্যাতনের পরম্পরা :
১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয় বার্মা সরকার। কয়েকশ বছরের পিতৃভূমিতেই তাদের বলা হচ্ছে অবৈধ অভিবাসী। নিজেদের দেশে তাঁরা বর্তমানে প্রবাসী। এদের রোহিঙ্গা বলতে নারাজ বার্মা সরকার এবং বার্মার বৌদ্ধরা। তারা এদের ডাকে বাঙালি বলে। সে থেকেই বার্মায় মুসলিমদের গণহত্যা চলে আসছে। প্রায়ই রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি কখনো সরকার, কখনো স্থানীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধরা আবার কখনো উভয়পক্ষ মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। যখনই নির্যাতনের কিছু চিত্র সামরিক জান্তার জান্তব নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত আলোয় আসে, তখনই এ নিয়ে কিছুটা কথাবার্তা হয়। আবার কদিন পরেই সব আলোচনা থেকে যায়। স্থায়ী সুরাহা হয় না রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যার।
সর্বশেষ ব্যাপক গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বছরের জুন মাসে। রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মূলত মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের ঘটনাপ্রবাহ। দাঙ্গাটির সূত্রপাত হয় জাতিগত কোন্দলকে কেন্দ্র করে এবং উভয়পক্ষই এতে জড়িত হয়ে পড়ে। অক্টোবর মাসে এটি সকল নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঙ্গা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এতে কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হয়, বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ২০,০০০ মানুষ এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে যায়।
১০ জুন রাখাইনে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক বাহিনীকে ওই অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। চলমান দাঙ্গায় অনেকেই নিহত হয়। ২২ আগস্ট সরকারিভাবে ৪৪ জনের নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়। ৯০,০০০০ লোক বাস্তুচ্যূত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রায় ২,৫২৮টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যার বেশিরভাগই রোহিঙ্গাদের। দাঙ্গায় বার্মিজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পাওয়া যায়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একতরফাভাবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক গণগ্রেফতার এবং ধরপাকড়ের অভিযোগ ওঠে।
চলতি বছরের ২১ মার্চ আবার দাঙ্গা শুরু হয়েছে। বার্মার মেইকতিলা শহরে বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় ধরনের দাঙ্গা শুরু হয়েছে। স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য বলেছেন সহিংসতায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং কয়েকটি মসজিদের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ১ মে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের হামলায় নতুন করে অন্তত দু'টি মসজিদ ও প্রায় দুশ' বসতবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। মুসলিমদের এসব ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
অসহায় রোহিঙ্গা :
একবার চিন্তা করে দেখুন তো হঠাৎ যদি বলা হয় আপনি এ দেশের নাগরিক নন, অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্বও নেই আপনার কাছে-তাহলে কেমন লাগবে? বার্মার রোহিঙ্গা মুসলিমদের বর্তমান কোনো মাতৃভূমি নেই। এতসব মানবাধিকার আর আন্তর্জাতিক সঙ্ঘের যুগে তাদের বাসস্থল রিফিউজি ক্যাম্প! কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ক্যাম্পগুলো পাহারা দিচ্ছে চেকপোস্ট বসিয়ে বার্মার মিলিটারি। বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সার্বক্ষণিক অভাব-বঞ্চনায়, দুঃখ-কষ্টে ও দুর্ভোগে অনিশ্চিত জীবন কেটে যাচ্ছে শরণার্থী শিবিরবাসী রোহিঙ্গাদের। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা ৬৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলি সংবাদ ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলতে লাগলেন, আমার বাবা, দাদা সবার জন্ম এই মাটিতেই। বরুদা ক্যাম্পে আশ্রিত হয়েছেন ১৫ হাজার রোহিঙ্গা। মুসলিম সিতবেতে ছিল এদের নিজস্ব ঘরবাড়ি। ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
৩৮ বছর বয়সী মুসলিম নারী মনিয়ন খাতা জানালেন, তাদের বসতের আশপাশ পুলিশ ও বৌদ্ধরা ঘিরে ফেললে পালিয়ে গিয়ে তারা জান বাঁচান ঝিলের পানিতে লুকিয়ে। বৌদ্ধরা কেন তাদের ওপর হামলা করলো- জানেন না এই ভয়ার্ত নারী। তার ধারণা, তাদের জমি ও সম্পত্তি বৌদ্ধরা কেড়ে নিতে চায়। আমরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাই- এটাই চায় বৌদ্ধরা। বৌদ্ধদের সহিংস হামলা থেকে বাঁচার গরজে রাখাইন অঞ্চলের অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলিম ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোয় দিন কাটিয়ে চলেছেন গত বছরের জুন থেকে। বার্মায় একের পর এক বৈষম্য-যন্ত্রণা সয়ে চলেছে এই মুসলিম সম্প্রদায়।
গত ৩ ডিসেম্বর আকিয়াবের একটি মুসলিম শিবিরে হাজির হয়ে বর্মী সৈনিকরা মুসলিমদের একটি ছাপানো ফর্মে সই করতে বলে। ফর্মে নাগরিকত্বের জায়গায় বাংলাদেশী লেখা দেখে শিবিরের লোকজন ফর্মে সই করতে অস্বীকার করলে সৈন্যরা এরপর চার মহিলাসহ আট ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়।
গণতন্ত্রের নেত্রীও নেই রোহিঙ্গাদের পাশে :
বার্মার গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী সুচি গত বছর কয়েক দশকের গৃহবন্দিত্ব ঘুচিয়ে মুক্ত দুনিয়ায় পা ফেলেন। তার ত্যাগ আর সংগ্রামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সারাবিশ্বের মিডিয়া। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে লড়াইয়ের জন্য একেরপর এক তিনি লাভ করছেন নানা আন্তর্জাতিক সম্মাননা। অথচ গত এক বছরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দুর্যোগের ঘনঘটা বিরাজ করলেও প্রতিবাদে স্বজাতীয়দের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন নি তিনি। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তার নীরবতার সমালোচনা হয়েছে মুসলিম বিশ্বজুড়ে। স্বদেশী রোহিঙ্গারাও অসন্তুষ্ট তার প্রতি। বাস্তুভিটাহারা রোহিঙ্গা নারী মৌং বলেন, তিনি (সুচি) কোনো কথা বলছেন না, সম্ভবত আরও বেশি বৌদ্ধ ভোট তিনি পেতে চান বলে। কিন্তু শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত হয়েও ভবিষ্যৎ প্রশ্নে রোহিঙ্গারা আতঙ্কমুক্ত নন। গত বছরের জুন ও অক্টোবরে বৌদ্ধ সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঁচাবার জন্য কোনো অবলম্বনের উপায় খোঁজা সম্ভব হচ্ছে না। কাঁটাতারের বেড়ায় এবং পুলিশ ও সেনা তথা সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর পাহারায় তাদের দিন কাটছে। খাদ্যাভাবে, রোগে, চিকিৎসার অভাবে ও শীতের প্রাদুর্ভাবে অস্থায়ী ক্যাম্পে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য আজও তাদের কাছে পৌঁছায়নি। অন্যদিকে শিবিরাশ্রিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বর্মী নিরাপত্তা বাহিনীর হামলা ও হয়রানি আজও অব্যাহত রয়েছে।
কারা এই রোহিঙ্গা?
রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ধর্মে মুসলিম। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস। বর্তমান ২০১২ সালে, প্রায় ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করে। মায়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫ লাখ সৌদি আরবে বাস করে বলে ধারণা করা হয়। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে- সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।
ইতিহাসের আলোয় রোহিঙ্গা জাতি :
বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস 'মগ' ও 'রোহিঙ্গা'। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে 'মগ'দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।
তবে ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ওই রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। এক সময় ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। আমাদের 'প্রাক্তন প্রভুরা'! মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের কত যে গোলমাল করে গেছে ব্রিটিশরা!
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। শুরু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা। সে সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের ভিন্নপথে যাত্রা শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। মায়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী 'কালা' নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা 'কালা' বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।
বাঙালী-বার্মিজ সম্পর্ক :
নিকট প্রতিবেশী এবং ভাতৃপ্রতিম জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গারা আজ আমাদের আশ্রয়প্রার্থী। অথচ ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় এই আরাকানি মুসলিমরা আমাদের সাহায্য করে আসছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আলাউল আরাকান রাজসভার সভাকবি ছিলেন। এখানে বসেই তিনি হিন্দি কবি মালিক মোহাম্মদ জায়সীর পদুমাবৎ অবলম্বনে পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষার গবেষকরা সবাই একমত যে, আরাকান রাজসভাতেই বাংলা ভাষার নব উৎকর্ষের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তী ঘটনা সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কালের। সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে যখন ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ শুরু হলো, মেঝো পুত্র শাহ শুজা যিনি এ বাংলার শাসক ছিলেন। কিন্তু তার ভাই আওরঙ্গজেবের দাপটে তারই সেনাবাহিনীর চাপে বাংলায় টিকতে না পেরে জীবন বাঁচাতে তিনি সপরিবারে আরাকানে চলে গিয়েছিলেন। তৎকালীন মগরাজা রাজপুত্র শাহ শুজার কন্যাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলে শাহ শুজার সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে এই রোহিঙ্গা মুসলিমরাই সেদিন মুসলিম রাজকন্যার সম্ভ্রম বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও তারা সফল হননি। কিন্তু তাদের সাহস, সহমর্মিতা ও মুসলিম হিসেবে আত্মমর্যাদা ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা আছে।
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে আমাদের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা আরাকানি মগদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। ওই অঞ্চলের জনজীবনে আরাকানি ডাকাতদের অত্যাচারের মূর্তিমান আতঙ্ক এখনো শরীরে কাঁপন ধরায়। বাংলার নবাব তখন শায়েস্তা খান। তিনি বুজুর্গ উমেদ খানকে চট্টগ্রামের শাসক হিসেবে পাঠান মগ জলদস্যুদের দমনে। বুজুর্গ উমেদ খান তখন আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিমদের কূটনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতায় আরাকানি জলদস্যুদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছিলেন।
মায়ানমার সরকারের দ্বিমুখী আচরণ :
৩০ এপ্রিল ২০১৩ মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উগ্র বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে শরণার্থীতে পরিণত হওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমের জন্য সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছে।
গত মাসে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের আদালতে সাতজন মুসলিমের বিচার চলছে। অথচ উগ্র বৌদ্ধরা যে শত শত মুসলিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে সরকার সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। একজন বৌদ্ধকেও এ পর্যন্ত বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। এ থেকেই মুসলিমদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের দ্বিমুখী আচরণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং প্রমাণিত হয়েছে সরকার ন্যায়বিচার করছে না।
শেষ কথা
মিয়ানমার বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানের সদস্য। এ জোটের বাইরে নিজ ইচ্ছামত তারা চলতে পারবে না। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। আসিয়ানের অন্যতম প্রভাবশালী এ দেশটির হুমকির পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক সব সংগঠন বিশেষত ওআইসিকে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। সাধারণভাবে সকল মুসলিম দেশ এবং বিশেষভাবে আরববিশ্বকে মায়ানমানের অসহায় মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেবল যৎসামান্য আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতায় সীমিত না থেকে আন্তর্জাতিক সকল ফোরামে বিশেষত জাতিসঙ্ঘে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিয়ে আওয়াজ তুলতে হবে। মায়ানমারের বিবেকহীন সরকারকে বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে এবং তাদের সকল নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে।
হে আল্লাহ, আপনি তাবৎ বিশ্বের মজলুমদের সাহায্য করুন। আপনার আসমানী সাহায্য আর অদৃশ্য শক্তিকে তাদের সহায়ক বানিয়ে দিন। দিকে দিকে উড্ডীন করে দিন ইসলামের বিজয় পতাকা।