×
এ প্রবন্ধে শরীয়াহ্ এর পরিচয়, উৎস এবং শরীয়াহ্ আইন যে কুরআনেরই বিধান এবং কুরআন থেকে উৎসারিত সে বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি শরীয়াহ্ যে প্রগতিশীল, আধুনিক ও উন্নয়নধর্মী সেটিও তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ।

    আল-কুরআন ইসলামী শরীয়াহ্-এর অন্যতম উৎস

    [ বাংলা – Bengali – بنغالي ]

    ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    2012 - 1434

    القرآن الكريم أحد مصادر الشريعة الإسلامية

    « باللغة البنغالية »

    الدكتور محمد منظور إلهـي

    مراجعة: الدكتور أبو بكر محمد زكريا

    2012 - 1434


    আল-কুরআন ইসলামী শরীয়াহ্-এর অন্যতম উৎস

    ভূমিকা :

    বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রয়োজনের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সমাজের প্রত্যেকের রয়েছে নানাবিধ চাহিদা। ব্যক্তি একাই নিজের সে সব চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সমাজের অন্যদের সহযোগিতার প্রতি তাকে মুখাপেক্ষী হতে হয়। ফলে স্বভাবতই মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সমাজবদ্ধ। সমাজের সকলের অধিকারকে সুশৃংখলভাবে সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ আইনী ব্যবস্থা ও বিধানের, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করবে, অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেবে ও প্রত্যেকের স্বেচ্ছাচারিতাকে আইনের দ্বারা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করবে। এ ব্যবস্থা না হলে মানুষের সামষ্টিক জীবন হয়ে পড়বে খুবই দুষ্কর। কেননা মানুষের একটা প্রবণতা হচ্ছে নিজের সুবিধা ও স্বার্থকে বড় করে দেখা। এ প্রবণতা যদি আইন দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে পারস্পরিক যুলুম-নির্যাতন বেড়ে যাবে, অধিকার ক্ষুন্ন হবে এবং সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। আর প্রতাপশালী ও কূটজাল বিস্তারকারীদের দৌরাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং মানুষ সবসময়ই সুশৃংখল আইন-কানুন সম্বলিত এমন এক জীবন-ব্যবস্থা মেনে চলার তীব্র প্রয়োজন অনুভব করেছে, যাতে সমাজের সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়, কেউ কারো অধিকার হরণ করতে না পারে এবং কেউ-ই তার নিজের সীমালঙ্ঘন করে অন্যের সীমায় অনুপ্রবেশ করতে না পারে। বস্তুত একটা সুষম, কল্যাণমুখী ও সর্বাত্মক ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের পক্ষে সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ-জীবন যাপন করা কোনমতেই সম্ভবপর নয়। এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানবজাতির প্রতি রহমত স্বরূপ নাযিল করেছেন এক মহান শরীয়াহ্ তথা সার্বিক আইন ও বিধান যার ভিত্তিতে হতে পারে মানুষের যাবতীয় সমস্যার সার্থক সমাধান ও তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের সুষ্ঠু মীমাংসা ও নিষ্পত্তি। তাঁর অবতারিত শরীয়ত তাঁর অগণিত অন্য সব নিয়ামতের মতই বিশ্বমানবতার প্রতি এক বিরাট রহমত হয়ে দেখা দিয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,

    ﴿ ثُمَّ جَعَلۡنَٰكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ فَٱتَّبِعۡهَا وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ ١٨ ﴾ [الجاثية : ١٨]

    ‘‘এরপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দীনের অন্তর্গত ‘শরীয়াহ্’ এর উপর, সুতরাং তুমি তার অনুসরণ কর। আর অজ্ঞদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না’’। [আল-জাসিয়াহ : ১৮]

    বস্তুত আল্লাহর শরীয়াহ্ই হচ্ছে তাঁর বান্দাদের মধ্যে পারস্পরিক ন্যায়পরায়ণতা স্থাপনের যথার্থ বিধান। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নিজ নিজ জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপারে কেবলমাত্র তাদের নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী করে ছেড়ে দেন নি। বরং তাদেরকে প্রবৃত্তির স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত করেছেন ইসলামী শরীয়াহ্-এর বিধান উপস্থাপন করে। মানব রচিত কোনো বিধানই প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত ও পবিত্র নয়। তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র হচ্ছে আল্লাহর শরীয়াহ্-এর বিধান। কেননা তিনিই মানবের স্রষ্টা। সুতরাং সৃষ্টির হাজত ও তা পূরণ করার পরিপূর্ণ বিধান তিনি ছাড়া আর কেউই যথাযথভাবে প্রদান করতে সক্ষম নয়।

    অতএব ইসলামী শরীয়াহ্ মেনে নেয়া ঈমান ও ইসলামেরই অনিবার্য দাবী। আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ ﴾ [الاحزاب : ٣٦]

    ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না।’’ [সূরা আল-আহযাব : ৩৬]

    তিনি আরো বলেন,

    ﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء : ٦٥]

    ‘‘কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্মন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।’’ [সূরা আন-নিসা : ৬৫]

    কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় মুসলিম দেশসমূহ দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিকতার করতলগত থেকে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আকীদাগত নানা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে; কেননা ঔপনিবেশবাদীরা মুসলিমদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের চালচিত্রকে ইসলামের মূলধারা থেকে সরিয়ে নেয়ার যাবতীয় চেষ্টা-তদ্বির করতে কোন ত্রুটি করে নি। তারা অবশেষে এ সকল মুসলিম দেশসমূহ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেও পেছনে রেখে গিয়েছে তাদের অনৈসলামী চিন্তা-চেতনার অত্যন্ত প্রভাবশালী স্বাক্ষর, যা রেখাপাত করেছে মুসলিমদের আমলী ও আখলাকী জীবনের বহু ক্ষেত্রে এবং পাল্টে দিয়েছে তাদের চিন্তা-ধারা ও আইনী প্রক্রিয়ার অনেক কিছূ। এর ফলে মুসলিম সমাজের বিরাট একটা অংশ হারিয়েছে তাদের বিবেকের স্বাতন্ত্র্যবোধ, মানসিকতায় ফুটে উঠেছে পরাধীনতা ও হীনমন্যতা।

    মিশনারি, প্রাচ্যবিদ এবং তাদের দোসর ও তল্পীবাহকদের মাধ্যমে যে চিন্তা-ধারা ও দর্শন মুসলিম দেশসমূহের শিক্ষিত সমাজে অত্যন্ত সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তন্মধ্যে একটি হল এই যে -‘‘ইসলামী শরীয়াহ্ একটি প্রাচীন জীবন পদ্ধতি, যা এ যুগে অচল এবং আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও প্রগতির বিভিন্ন উত্থান-পতনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সামর্থ তার নেই। অতএব শরীয়াহ্ অনুসরণে উন্নয়ন কর্মকান্ডে দেখা দেয় স্থবিরতা। কেননা শরীয়াহ্ আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর আগের পুরনো। সে যুগ আর বর্তমান যুগ এক নয়। সে পরিবেশ ও বর্তমান পরিবেশ অভিন্ন নয় এবং সে যুগের লোকেরা আজকের প্রগতিশীল লোকদের থেকে ছিল ভিন্ন প্রকৃতির’’। এভাবে তারা বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শন করেও যখন মুসলিমদের বৃহত্তর অংশকে বিচ্যুত করতে পারলো না, তখন আবারো আঘাত হানলো এ কথা বলে যে, ‘‘শরীয়াহ্ আইনের উৎস কুরআন নয়’’। এ প্রবন্ধে শরীয়াহ্ এর পরিচয়, উৎস এবং শরীয়াহ্ আইন যে কুরআনেরই বিধান এবং কুরআন থেকে উৎসারিত সে বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি শরীয়াহ্ যে প্রগতিশীল, আধুনিক ও উন্নয়নধর্মী সেটিও তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ।

    শরীয়াহ্ কি :

    ‘শরীয়াহ্’ একটি আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দীন, জীবন-পদ্ধতি, ধর্ম, জীবনাচার, নিয়ম-নীতি ইত্যাদি[1]। তবে আরবী ভাষায় শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল - পানির উৎসস্থল বা যে স্থান থেকে পানি উৎসারিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সেখানে এসে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করে[2]। শরীয়াহ্ যে জীবন পদ্ধতির অর্থে ব্যবহৃত হয়, কুরআনে সে ঘোষণা রয়েছে :

    ﴿ لِكُلّٖ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَةٗ وَمِنۡهَاجٗاۚ ﴾ [المائ‍دة: ٤٨]

    ‘‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরীয়াহ‌ ও জীবন-পদ্ধতি নির্ধারণ করেছি।’’ [সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৮]

    Wikipedia, the free Encyclopedia তে শরীয়াহ্ সম্পর্কে এভাবে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে- Sharia (Arabic: شريعة transliteration: Šarī`ah) is the body of Islamic religious law. The term means "way" or "path to the water source"; it is the legal framework within which the public and some private aspects of life are regulated for those living in a legal system based on Islamic principles of jurisprudence and for Muslims living outside the domain. Sharia deals with many aspects of day-to-day life, including politics, economics, banking, business, contracts, family, sexuality, hygiene, and social issues.

    পরিভাষায় ‘শরীয়াহ্’ এর সংজ্ঞায় প্রখ্যাত তাবেয়ী ক্বাতাদাহ রহ. বলেন, ‘‘শরীয়াহ্ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আরোপিত নির্দেশ, নিষেধাজ্ঞা, সীমারেখা ও ফারায়েয।’’[3]

    ইমাম ইবনু তাইমিইয়াহ রহ. বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা যে সব আকীদা ও আমল মানুষের জন্য প্রণয়ন করেছেন, তা-ই শারীয়াহ্’’[4]। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘‘শরীয়াহ্ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উলুল আমর (তথা মুসলিম প্রশাসক ও আমীর) এর আনুগত্য করা’’[5]

    ইসলামী শরীয়াহ্ এর সংজ্ঞা আরো সহজভাবে আমরা এভাবে দিতে পারি, ‘‘মহান আল্লাহ তা‘আলা জীবন ও জগত পরিচালনার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে স্বীয় বান্দাদেরকে যে সার্বিক হুকুম ও বিধান প্রদান করেছেন, তা-ই হল ইসলামী শরীয়াহ্’’। এ সংজ্ঞার আলোকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও এতদুভয়ের ভিত্তিতে ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত, মাকরুহ ও হারাম ইত্যাদি যে সকল বিধান প্রণয়ন করা হয় তা হচ্ছে শরীয়াহ্।

    ‘আশ-শরীয়াহ’ বলতে সাধারণত ‘আদ্-দীন’ তথা সার্বিক ইসলামী জীবন-বিধানকে বুঝানো হয়। তবে ‘শরীয়াহ্’ বলতে কখনো ইসলামের আইনগত দিককেও বুঝানো হয়। সেটি হচ্ছে শরীয়াহ্-এর খাস বা বিশেষ অর্থ।

    ইসলামী শরীয়াহ্ এর দলীল ও উৎসসমূহ :

    ইসলামী শরীয়াহ্ এর প্রধান উৎস ও দলীল চারটি। সেগুলো হলঃ

    • আল-কুরআন : ইসলামী শরীয়াহ্ এর সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে আল-কুরআনুল কারীম। এ ব্যাপারে সকল সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমায়ীন), সকল যুগের ইমামগণ, মুফাসসিরীন, মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা ও সকল উলামায়ে কিরামের ঐকমত্য ও ইজমা রয়েছে। ইসলামী শরীয়াহ্ এর সকল বিধানই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পবিত্র কুরআন কারীম থেকে উৎসারিত। ইতোপূর্বে উল্লেখিত দু’টো আয়াতে [সূরা আল-জাসিয়া : ১৮ ও সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৮] বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নিজেই শরীয়াহ্ প্রণয়নকারী।
    • আস-সুন্নাহ্ : রাসূলুল্লাহ সা. এর কথা, কাজ, সম্মতি ও অনুমোদনকে বলা হয় আস্-সুন্নাহ। আস্-সুন্নাহ্ মূলত কুরআনেরই ব্যাখ্যা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤ ﴾ [النحل: ٤٤]

    ‘‘আর আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।’’ [সূরা আন-নাহল : ৪৪]

    তিনি আরো বলেন,

    ﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ ﴾ [النجم : ٣، ٤]

    ‘‘সে মনগড়া কথা বলে না। এতো অহী যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’’ [সূরা আন-নাজম : ৩-৪]

    আল-কুরআন ও সুন্নাহ দু’টোই যে অহী, এ ব্যাপারে আলেমগণের ঐকমত্য রয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হাদীস শাস্ত্রের উসূল অনুযায়ী সুন্নাহ্-এর যে সকল হাদীস Authentic ও সহীহ শুধু সেগুলোই ইসলামী শরীয়ায় দলীল হিসেবে গৃহীত।

    • আল-ইজমা’ : ইজমা’ হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদগণ কোনো এক যুগে শরীয়াহ্ এর কোন এক বিধানের উপর একমত হওয়া।[6] ইজমা’র জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কুরআনের বিপরীত কোনো কিছুর উপর একমত না হওয়া। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

    إن الله لا يجمع أمتي على ضلالة

    ‘‘আমার উম্মাতকে আল্লাহ ভ্রষ্টতার উপর কখনো একমত করবেন না।’’[7] ইজমা’র বিধানের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে কুরআনে বলা হয়েছে,

    ﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء : ١١٥]

    ‘‘কারো নিকট হেদায়াত প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব।’’ [সূরা আন-নিসা : ১১৫]

    • আল-কিয়াস : কিয়াস হচ্ছে কোনো বিষয়ের জন্য সে বিধান নির্ধারণ করা, যে বিধান স্পষ্টভাবে অন্য একটি বিষয়ের জন্য কুরআন বা হাদীসে বর্ণনা করা আছে, উভয় বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানকারী ‘ইল্লাত’ বা হেতু থাকার কারণে।[8] কিয়াস যে শরীয়াহ্-এর উৎস ও প্রমাণ সে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহের বহু দলীল রয়েছে।[9]

    এগুলোর পাশাপাশি ইসলামী শরীয়াহ্-এর কয়েকটি আনুসাঙ্গিক ও গৌণ উৎস রয়েছে, যথাঃ মাসালিহ মুরসালাহ, ইস্তেহসান, ইস্তেসহাব ইত্যাদি। এগুলোর প্রত্যেকটিই কুরআন ও সুন্নাহ্ এর এর সমর্থনপুষ্ট ও এতদুভয়ের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।

    শরীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

    মহান রাববুল আ’লামীন মানব জাতির সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্যই ইসলামী শারীয়াহ্ এর সকল বিধান প্রণয়ন করেছেন। মানব জীবনের সর্বাধিক জরুরী বিষয়সমূহের সংরক্ষণ ও হেফাযত শরয়ী বিধানেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলামী শারীয়াহ্ এর পরিভাষায় এ বিষয়সমূহের নাম দেয়া হয়েছে ‘আদ-দারুরিয়্যাত’। ‘আদ-দারুরিয়্যাত’ পাঁচটি। সেগুলো হল :

    • দীনের হেফাযত
    • জীবনের হেফাযত
    • আকল বা বিবেকের হেফাযত
    • বংশধারা ও ইজ্জতের হেফাযত
    • সম্পদের হেফাজত

    এ পাঁচটি বিষয়কে বলা হয় আল-মাকাসিদ আল-খামসাহ্ বা শারীয়াহ্ এর পাঁচটি উদ্দেশ্য। ইসলামী শরীয়াহ এর দৃষ্টিতে এগুলো ছাড়া পৃথিবীতে মানব জীবন কোনোভাবেই চলতে পারে না। আর এ জন্যই দীন, জীবন, আকল, সম্পদ এবং বংশধারা ও ইজ্জতের হেফাযত ইসলামী শারীয়াহ এর একটি মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দীন, তারপর মানুষের জীবন, আকল, বংশধারা ও ইজ্জত এবং সর্বশেষে সম্পদ। ইসলামী শরীয়াহ এর অধিকাংশ নীতিমালা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রণয়ন করেছেন মূলতঃ এ পাঁচটি বিষয়ের হেফাযত ও সংরক্ষণের জন্য।

    শরীয়াহ্ কি আল-কুরআনের বিধান ?

    আল-কুরআন ও শরীয়াহ্-এর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। এটা সবযুগের সকল মুসলিম আলেমগণের ঐকমত্য ও ইজমা’ যে, ইসলামী শরীয়াহ্ কুরআনেরই বিধান। কেননা আল-কুরআনই শরীয়াহ্-কে সত্যায়ন করেছে। ইসলামী শরীয়াহ্-এর বিষয়গুলোর প্রতি যদি আমরা আলোকপাত করি তাহলে দেখব - আকীদা ও বিশ্বাসের মূল বিষয়গুলো যেমন তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত ইত্যাদি কুরআনের বিশাল অংশ জুড়ে আলোচিত হয়েছে। শির্ক ও কুফরির পরিচিতি ও পরিণতি সম্পর্কে কুরআনে বিশদ আলোচনা রয়েছে। আরকানুল ঈমানের মধ্যে আল্লাহ, মালাইকা, আসমানী কিতাব, নবী-রাসূলগণ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমানের অপরিহার্যতার কথা কুরআনে বলা হয়েছে। আরকানুল ইসলামের মধ্যে শাহাদাত, সালাত, সাওম, যাকাত ও হাজ্জের বর্ণনা কুরআনে রয়েছে। আকীদার পাশাপাশি শরীয়াহ্-এর বিভিন্ন আমল ও মুয়ামালাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাও রয়েছে। ব্যক্তির নিজের করণীয়, বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠন ও সংরক্ষণ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন, অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়, রাজনৈতিক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও করণীয়সহ শরীয়াহ্-এর সকল মৌলিক কিছুই স্পষ্টভাবে কুরআনে রয়েছে। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]

    ‘‘আর আমি মুসলিমদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম’’। [সূরা আন-নাহল : ৮৯] তিনি আরো বলেন,

    ﴿ مَّا فَرَّطۡنَا فِي ٱلۡكِتَٰبِ مِن شَيۡءٖۚ ﴾ [الانعام: ٣٨]

    ‘‘কিতাবে কোনো কিছুই আমি বাদ দেইনি’’। [সূরা আল-আন‘আম : ৩৮]

    আল-কুরআনে শরীয়াহ্ অনুসরণ করার সরাসরি নির্দেশ এসেছে।

    ﴿ ثُمَّ جَعَلۡنَٰكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ فَٱتَّبِعۡهَا ﴾ [الجاثية : ١٨]

    ‘‘এরপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দীনের অন্তর্গত ‘শরীয়াহ্’ এর উপর, সুতরাং তুমি তার অনুসরণ কর’’। [সূরা আল-জাসিয়াহ : ১৮]

    বিগত ১৪ শতক ধরে আজ পর্যন্ত মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত যে সব আয়িম্মাহ, আলেম ও স্কলার রয়েছেন, তাদের কোন একজনও একথা দাবী করেননি যে, ‘শরীয়াহ’ কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন। সাহাবীগণের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত রচিত তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উসূলে ফিকহসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী রেফারেন্স গ্রন্থসমূহে শরীয়াহ্-কে কুরআনের বিধানই বলা হয়েছে। কেননা শরীয়াহ্ সাব্যস্ত হয়েছে কুরআনের মাধ্যমে এবং কুরআনই শরীয়াহ্ এর প্রাথমিক উৎস ও দলীল। কুরআন ছাড়া শরীয়াহ্ এর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। শরীয়াহ্ থেকে কুরআনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো ইসলামের শত্রুদের হীন অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

    শরীয়াহ্ ও ইজতিহাদ

    ইসলামী শরীয়াহ‌-এর উজ্জ্বলতম দিক হল ইজতিহাদের অনুমোদন, যার দ্বার কিয়ামত পর্যন্ত উন্মুক্ত। শরীয়াহ্-কে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে ইজতিহাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে শরীয়াহ এর সকল বিধানের ক্ষেত্রে ইজতিহাদের প্রয়োজন পড়ে না। শরীয়াহ্-এর যে সব বিধান অত্যন্ত সুস্পষ্ট যেমন তাওহীদ ও রিসালাতের Concept এবং তার প্রতি ঈমান পোষণ করার ফরযিয়াত, যা কুরআন ও হাদীসে বহুবার আলোচিত হয়েছে, সেখানে ইজতিহাদ করার প্রয়োজন পড়ে না। অনুরূপভাবে শরীয়াহ্-এর যে সব বিষয় অপরিবর্তনীয় সেগুলোকেও ইজতিহাদ ও গবেষণা করে পরিবর্তন করা যায় না। যেমন তাওহীদের সকল বিষয়, শির্ক ও কুফরীসহ ঈমানের রুকনসমূহ, মূল্যবোধ সংক্রান্ত বিষয়গুলো ও চিরতরে হারাম ঘোষিত মন্দকাজসমূহ। অতএব তাওহীদের যে চিরন্তন ধারণা কুরআনে ও সুন্নায় এসেছে, তাতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসবে না। যে কাজ করা রাসূল সা. এর যুগে শির্ক ও কুফরি বলে বিবেচিত হতো তা আজো শির্ক ও কুফরি বলে গণ্য হবে। যেনা-ব্যভিচার, মদ্যপান, চুরি-ডাকাতি, সূদ, মানবহত্যা ইত্যাদি যা আগে হারাম ছিল, আজো তা হারাম বলে গণ্য হবে। সুন্দর গুণাবলী, সততা, সত্যবাদিতা আগে যেমন প্রশংসিত ছিল আজো তেমনি প্রশংসিত, অন্যদিকে মিথ্যা, ধোকা, প্রতারণা সব যুগেই ঘৃণ্য ও হারাম।

    তবে শরীয়াহ্-এর এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার বিধান স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। এ কারণেই শরীয়াহ্-তে বিভিন্ন রোখসাত দেয়া হয়েছে। তাছাড়া দ্বরুরতের কারণে শরীয়াহ্ ইতোপূর্বেকার নিষিদ্ধ বিধানকে অনুমোদন দান করে। এসব মূলনীতির দলীল কুরআনে রয়েছে। এছাড়া সার্বিক মূল্যবোধ ও আকীদা ঠিক রেখে মু‘আমালাতের বিষয়গুলো আঞ্জাম দেয়ার বিষয়টিও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। এগুলোর Implementation কিভাবে হবে সেটা হচ্ছে ইজতিহাদের অন্যতম একটি বিষয়। তবে যে কেউ ইচ্ছে করলেই নিজের মত করে ইজতিহাদ করে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করাকে ইসলাম সমর্থন করে না। মুজতাহিদ ব্যক্তিকে কুরআন, হাদীস ও আরবী ভাষায় যথেষ্ট পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি আরো বেশ কিছু গুণের অধিকারী হতে হবে। উসূলে ফিকহের গ্রন্থসমূহে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

    মোদ্দাকথা হল, শরীয়াহ্ এর অপরিবর্তনীয় বিষয়গুলো বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে সহীহ ও Authentic ইজতিহাদের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের প্রতি আল-কুরআন আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوۡمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنفُسِهِمۡۗ ﴾ [الرعد: ١١]

    ‘‘আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।’’ [সূরা রা’দ : ১১]

    কিয়াস, ইস্তেহসান, মাসালিহ মুরসালাহ্ ও শরীয়াহ্-এর এ জাতীয় দলীলসমূহ ইজতিহাদী প্রক্রিয়ারই অংশ। শরীয়াহ্ যে প্রগতিশীল এবং সব যুগের জন্য উপযোগী ইজতিহাদ মূলতঃ সে প্রমাণকে শক্তিশালী করেছে।

    শরীয়াহ্ কি উন্নয়ন ও আধুনিকতা বিরোধী?

    সৎ ও ন্যায়ভিত্তিক মূল্যবোধের আলোকে যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করতে ইসলামী শরীয়াহ্ উদ্বুদ্ধ করে। আল-কুরআনে আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ার উন্নতি চেয়ে দু‘আ করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٗ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ حَسَنَةٗ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ٢٠١ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ نَصِيبٞ مِّمَّا كَسَبُواْۚ ﴾ [البقرة: ٢٠١، ٢٠٢]

    “তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখিরাতেও কল্যাণ দাও। আর জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর।এরা যা করেছে তার অংশ তাদের জন্য রয়েছে”[সূরা আল-বাকারাহ : ২০১-২০২]

    শরীয়াহ্-এর দৃষ্টিতে উন্নয়ন বলতে বুঝায় সে সব উন্নয়নকে যার দ্বারা ব্যক্তি দুনিয়াতে উপকৃত হয়, ভাল ও সৎ মানুষে পরিণত হয়, দেশ, সমাজ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে এবং আখিরাতে নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে এবং প্রয়োজনীয় আমলে সালেহ করে জান্নাত লাভের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। অতএব শুধুমাত্র বৈষয়িক উন্নতিই ইসলামের দৃষ্টিতে একমাত্র উন্নয়ন নয়।

    আমরা লক্ষ্য করি - ইসলামী শরীয়াহ্-এর বিধানগুলো আল্লাহ সুবহানাহু মানবজাতির জন্য এমনভাবে প্রণয়ন করেছেন যার মাধ্যমে তাদের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন, চারিত্রিক উন্নয়ন এবং যাবতীয় বৈষয়িক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

    ইবাদাত পালনের নির্দেশ মূলতঃ মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন সাধন করে। মদ-যেনা, জুয়া, মিথ্যাকথা বলা, অন্যায় ও অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়া থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ তাকে চারিত্রিক উন্নয়ন দান করে। সুদ পরিহারের নির্দেশ, যাকাত-সদকা প্রদানের আদেশ এবং নানাবিধ ব্যবসায় কর্মকান্ড পরিচালনা করার অনুমতি উৎপাদন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেগবান করে। অতএব ইসলামী শরীয়াহ্ প্রচলিত আর সব মতবাদ থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে অনেক বেশী কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

    আমরা জানি যা গতিশীল, তা-ই যুগের সাথে সঙ্গতি রেখে চলতে পারে এবং যা যুগোপযোগী তা-ই আধুনিক। অতএব ইসলামী শরীয়াহ্ও আধুনিক। ইসলামী শরীয়াহ্ আধুনিক সমাজের সর্বস্তরের লোকদের ন্যায্য অধিকার যেমন সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি মৌলিক মূল্যবোধ ঠিক রেখে যুগের চাহিদা ও দাবীর সাথেও সঙ্গতি বিধান করেছে। যে কোন নতুন কিছু যদি ভাল ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়, শরীয়াহ্ তাকে গ্রহণ করেছে। আধুনিকতা বলতে যদি ঈমান ও মূল্যবোধ ঠিক রেখে যুগোপযোগিতা বুঝায়, যদি অন্যায়-অশ্লীলতা ও বেহায়পনা আধুনিকতার সংজ্ঞায় না পড়ে, তাহলে ইসলামী শরীয়াহ্ চির-আধুনিক।

    কতিপয় সংশয়ের অপনোদন

    খুবই সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষী মহল এবং তাদের তল্পীবাহক কিছূ বুদ্ধিজীবি মুসলিমদেরকে Confused করার জন্য ইসলামী শরীয়াহ্ ও কুরআনের মধ্যে পার্থক্য আবিষ্কার করেছেন এবং এ ব্যাপারে তারা পত্র-পত্রিকায় ও ইন্টারনেটে লেখালেখি করছেন। তাদের যুক্তিগুলো খুবই অপরিপক্ক। এগুলোকে যুক্তি না বলে সংশয় বলাই ভালো। কেউ যাতে এসব সংশয় দ্বারা প্রভাবিত না হন সেজন্য প্রধান কয়েকটি উল্লেখ করে সেগুলোর সন্তেষজনক উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।

    1. বলা হয়েছে, ‘রাসূল সা. এর যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে শরীয়াহ্ আইন বলে কিছু ছিল না। কেননা শরীয়া আইন প্রবর্তন করেছেন ফকীহগণ’। উত্তরে বলব, এ প্রবন্ধের শুরুতে আমরা সূরা আল-জাসিয়াহ এর ১৮ নং আয়াতে লক্ষ্য করেছি মহান আল্লাহ সুবহানাহু ‘শরীয়াহ্’ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এ আয়াতটি রাসূল সা. এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং আয়াতের নির্দেশ তাঁকে ও তাঁর সাহাবাগণকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অতএব ‘ফকীহগণ শরীয়া আইন প্রবর্তন করেছেন’ - কথাটি মোটেই শুদ্ধ নয়। কেননা আয়াতটিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শরীয়াহ আইন প্রবর্তন করেছেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা।

    2. তারা দাবী করেছেন যে, ‘শরীয়াহ্ আইনের অনেক কিছু জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে’। আমরা বলব, শরীয়াহ্ আইন প্রণয়ন সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞ লোকেরাই এ দাবী করতে পারেন। জাল হাদীস সর্বযুগে সকল আলেম, মুহাদ্দিস ও এমন কি সাধারণ মুসলিমদের কাছেও সর্বাঙ্গীনভাবে পরিত্যাজ্য। তাছাড়া শরীয়াহ্ আইন যদি জাল হাদীস তৈরীর যুগে রচিত হত তাহলে এমন প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া অসম্ভব ছিল না। একটু আগেই বলা হয়েছে, শরীয়াহ্ প্রণীত হয়েছে রাসূল সা. এর যুগে এবং প্রণেতা স্বয়ং আল্লাহ সুবহানহু।

    3. তারা আরো বলেছেন, ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অপরিবর্তনীয়, যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু দেখা যায় শরীয়াহ্ আইনের অনেক বিধান কখনো পাল্টে যায়।

    এর উত্তরে বলব, শরীয়াহ্ ও ইসলামের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইসলামী শরীয়াহ্ এর অনেক বিধান অপরিবর্তনীয় এবং কিছু বিধান স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে- তা ইতোপূর্বে বলা হয়েছে। অতএব এ যুক্তি দাঁড় করিয়ে শরীয়াহ্, কুরআন ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা বড় ধরনের অজ্ঞতা কিংবা নিতান্তই গোঁড়ামী।

    4. আরেকটি সংশয় হল, শরীয়াহ্-এর বিধান ইজমা’ ও কিয়াস এবং অন্যন্য আনুসাঙ্গিক উৎস দ্বারাও সাব্যস্ত হয়ে থাকে। ফলে সে সব বিধানকে কুরআনের বিধান বলা যাবে না।

    এর উত্তর হল, ইজমা’ ও কিয়াস এবং অন্যান্য আনুসাঙ্গিক উৎস স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো দলীল নয়। বরং কুরআনই এগুলোকে দলীল হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। অতএব ইজমা’ ও কিয়াসের দ্বারা সাব্যস্তকৃত বিধান কুরআনের বিধান বলেই গণ্য হবে।

    উপসংহার

    শরীয়াহ্ আইন ইসলামেরই আইন। আর ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত দীন, যার বিভিন্ন বিধান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর বিভিন্ন সময়ে নাযিল হয়েছে। সে সব বিধানের আইনী দিকটিই হল শরীয়াহ্। আর তার সম্মিলিত রূপ হল আল-কুরআন। অতএব শরীয়াহ্ আইন হচ্ছে আল-কুরআনেরই আইন। অন্য কথায় বলব, শরীয়াহ্ আইনের অন্যতম উৎস হল আল-কুরআন।

    [1] আস-সিহাহ,ইসমাইল ইবনু হাম্মাদ আল-জাওহারী, ৩/১২৩৬, লিসানুল আরব, ইবনু মানযূর, ৮/১৭৪

    [2] লিসানুল আরব, ৮/১৭৪

    [3] আল-জামি’ লিআহকামিল কুরআন ৬/২১১

    [4] মাজমু’ আল-ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়াহ, ১৯/৩০৬

    [5] প্রাগুক্ত, ১৯/৩০৯

    [6] আল-মুস্তাসফা, ইমাম গাযালী, ১/১৭৩, শারহি আল-কাওকাব আল-মনীর, ইবনুন নাজ্জার, ২/২১১

    [7] সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২০৯৩, এছাড়াও এ হাদীস বর্ণনা করেছে ইমাম আহমাদ ও হাকেম।

    [8] আল-বুরহান, ইমামুল হারামাইন, ২/৩৮৭, আল-মুস্তাসফা, ইমাম গাযালী, ২/২২৮, আল-মাহসূল, ইমাম রাযী, ৫/৫

    [9] বিস্তরিত দলীলসমূহ জানার জন্য দেখখুন, আল-কিয়াস ফিল ইবাদাত, পৃঃ ১৮৫-২২৫