হিজাবের ওপর কেন এই পশ্চিমি হামলা?
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
হিজাবের ওপর কেন এই পশ্চিমি হামলা?
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
2012 - 1433
﴿ ما سبب هجوم الغرب على الحجاب؟ ﴾
« باللغة البنغالية »
علي حسن طيب
مراجعة: الدكتور محمد منظور إلهي
2012 - 1433
হিজাবের ওপর কেন এই পশ্চিমি হামলা?
ইউরোপে ফ্রান্সের পর হল্যান্ডেও বোরকা পরায় নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মিক্সিনের ভাষ্য মতে, বোরকা ছাড়া জনসমাগমস্থানে হেলমেট পরিধানেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। হল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামী বছর থেকে বোরকা, নেকাব বা হিজাব এবং চেহারা আবৃত রাখে এমন সব পোশাক পরিধানে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিক্সিন আমস্টার্ডমে মিডিয়াকে বলেন, এ নিষেধাজ্ঞা কেবল বোরকা বা অন্যান্য ইসলামী পোশাকের ওপরই নয়; বরং চেহারা আবৃত করার সব পোশাকের ওপর বলবৎ করা হবে। ইতোপূর্বে ফ্রান্স বোরকা ও হিজাবের ওপর নিষাধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এরপর হল্যান্ডই দ্বিতীয় রাষ্ট্র যা বোরকা বা হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। উল্লেখ্য যে, হল্যান্ডের সতের মিলিয়ন নাগরিকের মধ্যে এক মিলিয়ন নাগরিক মুসলমান।
ফ্রান্সের সংসদের নিম্নকক্ষ গত জুলাই ২০১০ ঈসায়ীতে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিল অনুমোদন করেছিল। অতপর ২০১১ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে পাশ হওয়া আইনের অধীনে মুসলিম নারীদের পুরোপুরি হিজাব পরিধানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। স্মর্তব্য যে, ফ্রান্স নেকাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম সদস্য রাষ্ট্র। সুতরাং এখন ফ্রান্সে সাধারণ স্থানসমূহে নেকাব আবৃতা যে কোনো মুসলিম নারীকে জরিমানা এবং কারাবাসের সাজার মুখে পড়তে হয়। ফ্রান্সের সংসদীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রস্তুত এই আইনের আওতায় রাষ্ট্রের সকল স্কুল, হসপিটাল, সরকারি পরিবহন এবং সরকারি দপ্তরসমূহে মুসলিম নারীদের সম্পূর্ণ হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। এ জায়গাগুলোয় হিজাব পরলে ১৫০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা আদায় করা হয়। উপরন্তু যেসব পুরুষ নিজেদের স্ত্রী, কন্যা বা বোনদের হিজাব পরতে বাধ্য করবেন এবং যে আলেমগণ এর প্রচার করবেন তাদেরকে ত্রিশ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা বা এক বছর কারাবাসের শাস্তি প্রদান করা হয়। এখানে এ কথাও উল্লেখ্য, ফ্রান্সেই বাস করে ইউরোপে মুসলিমদের সবচে বড় কমিউনিটি। এখানে স্থানীয় ও অভিবাসী মিলিয়ে মুসলমানের সংখ্যা ষাট লাখের অধিক।
ফ্রান্সের মুসলিম কমিউনিটি ও সরকারের মধ্যে যেখানে আগে থেকেই টানাপোড়েন চলছিল, সেখানে এই বিতর্কিত আইন কার্যকর হলে অবস্থা আরও জটিল আকার নেবে। মুসলিম কমিউনিটির প্রতিনিধিবৃন্দ (সাবেক) প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমানের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন। যখন উল্লেখিত আইন পাশ করা হয়েছিল, তখন বিরোধীরা বলেছিল, এই আইন কার্যকর করা কঠিন হবে। ফ্রান্সের উচ্চ আদালত একে বেআইনী ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে থেকে একে বেআইনী ঘোষণা করা হয় নি। ফ্রান্সের মুসলিমদের ভাষ্য মতে, এই আইন কার্যকর হওয়ায় ফ্রান্সের অন্য বড় ধর্মাবলম্বীগণ তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন। দেশে ইসলামোফোবিয়ার ঝুঁকি আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলমান ও তাদের মসজিদগুলো ধারাবাহিক ঘৃণার টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। প্রকাশ থাকে, গত বছর ফ্রান্সের পথ ধরে বেলজিয়াম ও অস্ট্রেলিয়াও মুসলিম নারীদের নেকাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ইউরোপে বোরকা ও হিজাবের বিরুদ্ধে যদিও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে; কিন্তু ওখানকার জ্ঞানী-গুণী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো পক্ষ থেকে এই নিষেধাজ্ঞার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইউরোপের মানবাধিকার কাউন্সিলের কমিশনার থমাস হামবুর্গ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই ধরনের পদক্ষেপের কারণে নারীদের স্বাধীনতা দেয়ার পরিবর্তে তাদেরকে সামাজিক জীবন থেকেই বের করে দেয়া হচ্ছে। বস্তুত বোরকার ওপর নিষেধাজ্ঞা ইউরোপের মানবাধিকারের মানদণ্ড এবং বিশেষত কারো ঘরোয়া জীবন ও ব্যক্তি পরিচয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চেতনা পরিপন্থী। মুসলিম নারীদের পোশাকের ব্যাপারটিকে যেভাবে সমালোচনার লক্ষ্য বানানো হচ্ছে, তা থেকে হাত গুটাতে হলে আলাপ-আলোচনা ও আইন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যে সমাজে পর্দাকে সামাজিক সম্পর্কের জন্য অন্তরায় আখ্যায়িত করে সমালোচনার লক্ষ্য বানানো হচ্ছে, সেখানকার নারীদের মধ্যে হিজাবের জনপ্রিয়তা কেবল বেড়েই চলেছে। কয়েকজন অমুসলিম নারী ইসলামের পোশাক ধারণ করে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তারা নিজেদেরকে এ বাস্তবতা স্বীকারে নৈতিকভাবে বাধ্য মনে করেছেন যে, আদতেই নারীরা হিজাব ও পর্দার ভেতরে সম্মান বোধ করেন। ‘নাউমি ওয়াল্ফ’ আমেরিকার এক খ্রিস্টান নারী। নারী স্বাধীনতা এবং সমাজে নারীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি কাজ করেন। এ বিষয়ে তিনি দুটো বইও রচনা করেছেন। নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির নারীদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নে তার বিশেষে আগ্রহ। হিজাব কেন্দ্রিক সমালোচনা সূত্রে একটি মুসলিম দেশে মুসলিম পোশাক পরার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। উদ্দেশ্য, এ পোশাকে খোদ নারীরা কেমন বোধ করেন তা জানা।
তাঁর ভাষ্য ছিল, ‘আমি মারাকেশে নিজের থাকার জায়গা থেকে যখন বাজারে যাবার জন্য বের হলাম, তখন আমি সেলোয়ার-কামিস পরেছিলাম। আমার মাথা ছিল স্কার্ফে ঢাকা। মারাকেশের মুসলিম মেয়েদের মধ্যে এর ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। সবখানে একে সম্মান দেখানো হয়। আর আমি যেহেতু তাদের স্বদেশী কেউ নই, তাই তাদের দৃষ্টিতে কিছুটা দ্বিধা ও সংশয় থাকবে বৈ কি। কিন্তু সন্দেহের কিছু দৃষ্টির কথা বাদ দিলে আমাকে উদ্বিগ্ন করার মতো কোনো কিছু নজরে আসে নি। আমি নেহাত আরামে ছিলাম। কোনো চিন্তার বিষয় ছিল না। আমি সব দিক থেকে নিজেকে নিরাপদ বরং এক প্রকার স্বাধীনতা অনুভব করেছি।’
‘মুসলিম নারী : পর্দা এবং জেন্ডার ইস্যু’ শীর্ষক নিজের এর্টিকেলে ‘নাউমি ওয়াল্ফ’ পশ্চিমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, ‘মুসলিম মূল্যবোধকে নিষ্ঠার সঙ্গে বুঝতে চেষ্টা করুন। পর্দার উদ্দেশ্য কখনোই নারীকে দমিয়ে রাখা নয়। এটি বরং ‘প্রাইভেটের মোকাবেলায় পাবলিকের’ বিষয়। পাশ্চাত্য বিশ্ব নারীকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়ে এক অর্থে বাজারের পণ্য বানিয়ে ছেড়েছে। পক্ষান্তরে ইসলাম নারীর সৌন্দর্য ও তার সত্তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়ে তাকে এক পুরুষের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। যে পুরুষের সঙ্গে ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসারে তিনি পুরো জীবন কাটিয়ে দেবেন বলে স্থির করেছেন।
কিছুদিন আগে আমেরিকার হিস্প্যানিক বংশদ্ভুত এক নও মুসলিম নারী লিখেন, ‘আমি যখন পাশ্চাত্যের পোশাকে ছিলাম তখন আমাকে নিজের চেয়ে অন্যের রুচির প্রতিই বেশি লক্ষ্য রাখতে হত। ঘর থেকে বেরুবার আগে নিজেকে দেখতে কেমন লাগছে তা নিশ্চিত হওয়া এক অপ্রিয় ও বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল। তারপর আমি যখন কোনো স্টোর, রেস্টুরেন্ট বা জনসমাগম স্থানে যেতাম তখন নিজেকে অন্যদের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় অনুভব করতাম। দৃশ্যত আমি যদিও নিজে স্বাধীন ও নিজ সিদ্ধান্তের মালিক ছিলাম কিন্তু বাস্তবে আমি ছিলাম অন্যের পছন্দ-অপছন্দের জালে বন্দি। তাছাড়া এ চিন্তাও মাথায় থাকত যে, যতদিন আমার রূপ-লাবণ্য ও বয়স অটুট থাকবে মানুষ আমার পেছনে ঘুরবে; কিন্তু বয়স গড়ানোর পর নিজেকে অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে আমাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। পক্ষান্তরে ইসলাম আমাকে এখন ওসব উটকো ঝামেলা থেকে একেবারে নিশ্চিন্ত ও স্বাধীন বানিয়ে দিয়েছে।’
অতিসম্প্রতি হলিউডের প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা লিয়াম নিসন ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। ঊনষাট বছর বয়েসী এই পরিচালক ক্যাথলিক খ্রিস্টান ছিলেন। বিদেশি পত্রিকা মারফত জানা যায়, লিয়াম নিসন জানান, তুরস্কে সিনেমার চিত্র ধারণ করতে গিয়ে সেখানকার মুসলমানের ইবাদতের ধরনে তিনি প্রভাবিত হন। এর মধ্যে তিনি আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করেন। তিনি আরও বলেন, মসজিদগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক। এসবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষ ইসলামের আরও কাছে চলে আসে।
ভাববার বিষয় হলো, পাশ্চাত্য কি এখন নিজের দিগম্বর সভ্যতা ও মাতা-পিতাহীন সংস্কৃতির বদৌলতে ধ্বংস ও পতনের অতি কাছে চলে গিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য একটি খবরের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট হতে পারে। এতে বলা হয়েছে, পাঁচ কোটি মার্কিনি নানা ধরনের মানসিক রোগে ভুগছে। প্রতি পাঁচজনের একজন আমেরিকান পরিপূর্ণ মানসিক রোগী হয়ে গেছেন। পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি জটিল মস্তিষ্কের রোগে আক্রান্ত। শতকরা ২৩ ভাগ নারীর মোকাবেলায় শতকরা ১৬.৮ ভাগ পুরুষ এই উপসর্গের শিকার। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের তুলনায় ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়েসী যুবকদের মধ্যে এই রোগের বিস্তার দ্বিগুণ। রিপোর্টে এ কথাও বলা হয় যে, এক কোটি ১৪ লাখ মার্কিনির মধ্যে জটিল কিসিমের মস্তিষ্কের রোগ পাওয়া যায়। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়েসী ১৯ লাখ তরুণ আমেরিকান ডিপ্রেশনের শিকার। উল্লেখ্য, এই রিপোর্টটি প্রস্তুত করা হয়েছে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে ১২ বা তদোর্ধ্ব বয়সের ৬ লাখ ৭৫ হাজার ব্যক্তির মধ্যে পরিচালিত জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে।
প্রকৃতপক্ষে তাগুতী শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে গ্রহণ করা ইসলাম বিরোধী পদক্ষেপগুলো পাশ্চাত্যে দ্রুত বর্ধিষ্ণু ইসলামের জনপ্রিয়তার পথ রুদ্ধ করবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। কারণ, গত এক দশকে যেভাবে পাশ্চাত্যে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়েছে তাতে জায়নবাদী কর্মকর্তাদের চোখের ঘুম হারাম হবার যোগাড়। শুধু আমেরিকাতেই প্রতি বছর ২০ হাজার ব্যক্তি ইসলামে দাখিল হচ্ছেন। এ পর্যন্ত যেই সভ্যতা-সংস্কৃতি বস্তুপূজা ও আল্লাহকে রুষ্ট করার পোশাকে উপস্থাপন করা হয়েছে আজ তা ঘুণে ধরা কাঠের মতো দৃশ্য তুলে ধরছে। গতকালও যে কালচার ও সভ্যতাকে উপমা বা আদর্শ বলা হচ্ছিল আজ তারই প্রাণপতি তার থেকে বিমুক্ত ঘোষণা করছে। পাশ্চাত্যে দিনদিন ইসলামের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ইসলামের সত্যতা এবং ইসলামের নবীর বস্তুনিষ্ঠতার সবচে বড় প্রমাণ।