নির্দিষ্ট পাত্রে পান করা প্রসঙ্গে
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
নির্দিষ্ট পাত্রে পান করা প্রসঙ্গে
حول الشرب في إناء معين
< بنغالي- Bengal - বাঙালি>
সানাউল্লাহ নজির আহমদ
ثناء الله نذير أحمد
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
নির্দিষ্ট পাত্রে পান করা প্রসঙ্গে
প্রশ্ন: আমি এক মসজিদে ছিলাম, সেখানে তাবলীগের একটি জামাত আসে। খানার সময় তাদের সাথে বসে দেখলাম পান করার জন্য নির্দিষ্ট পাত্র তারা সাথে নিয়ে এসেছে। বাটির মত গোলাকার, প্রায় আধা লিটার বা সামান্য কম পানি ধরে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম গ্লাসের পরিবর্তে এ পাত্র কেন? তাদের থেকে একজন বলল: এতে পান করা সুন্নত। ব্যাপারটা আমার নিকট একেবারে নতুন ও আশ্চর্য ঠেকল! নির্দিষ্ট কোন পাত্রে পান করা কি সুন্নত? জানিয়ে বাধিত করবেন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
উত্তর: নির্দিষ্ট কোনো পাত্রে পান করা সুন্নত নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন তা অনুসরণ করে যে কোন পাত্রে বা যেভাবে সম্ভব পান করা সুন্নত স্বর্ণ-রূপার পাত্র ব্যতীত। নির্দিষ্ট আকৃতির পাত্রে পান করা সুন্নত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। এটা মানুষের সাধ্যেরও অতীত, কারণ এর অর্থ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জাতীয় পাত্রে পান করেছেন তাতে পান করা। এটা নির্দিষ্ট আকৃতির হতে পারে যেমন প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছে, আবার নির্দিষ্ট ধাতুর তৈরিও হতে পারে বা উভয় অর্থাৎ নির্দিষ্ট ধাতুর তৈরি নির্দিষ্ট আকৃতির পাত্র। আমরা দেখছি স্থান-কাল ও মানুষের পছন্দের ভিন্নতার কারণে এসব বস্তুতে নিত্য পরিবর্তন আসছে, যা মানুষের স্বভাব ও আল্লাহর দেওয়া প্রকৃতি। মক্কা-মদিনায় যেসব পাত্র রয়েছে অন্যত্র তা নাও থাকতে পারে। তাই ইসলাম নির্দিষ্ট কোনো পাত্রে পান করার বিধান দেয় নি। কতক পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে তা অনুসরণ করে পান করাই সুন্নত। যেমন স্বর্ণ-রূপার পাত্রে পান না করা, পান করার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা, ডান হাতে পান করা, প্রয়োজন ব্যতীত দাঁড়িয়ে পান না করা ইত্যাদি।
স্বর্ণ-রূপার পাত্রে পান করা নিষেধ:
উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«الَّذِي يَشْرَبُ فِي إِنَاءِ الْفِضَّةِ إِنَّمَا يُجَرْجِرُ فِي بَطْنِهِ نَارَ جَهَنَّمَ») متفق عليه. وفي رواية لـمسلم : (إن الذي يأكل أو يشرب في آنية الفضة والذهب...
“রূপার পাত্রে যে পান করে, সে মূলত তার পেটে জাহান্নামের আগুন গলাধঃকরণ করে"।[1] হাদীসটি সহীহ বুখারী থেকে নেওয়া। আলী ইবন মুসহির সূত্রে মুসলিমের অপর বর্ণনায় রয়েছে: “যে ব্যক্তি স্বর্ণ ও রূপার পাত্রে খায় অথবা পান করে..."। অর্থাৎ যে স্বর্ণ-রূপার পাত্রে পান করে সে নিজের ওপর জাহান্নাম অবধারিত করে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, স্বর্ণ ও রূপার পাত্র ব্যতীত তামা, পিতল, সীসা, মাটি অথবা অন্য কোনো ধাতব পদার্থের তৈরি পবিত্র পাত্রে পান করা বৈধ। কারণ আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:
﴿هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا ٢٩﴾ [البقرة: ٢٩]
“তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন"। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৯]
পান করার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা:
উমার ইবন আবু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়িতে বড় হই, আমার হাত খাবারের পাত্রে এদিক সেদিক যেত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন:
«يَا غُلَامُ، سَمِّ اللَّهَ وَكُلْ بِيَمِينِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ، فَمَا زَالَتْ تِلْكَ طِعْمَتِي بَعْدُ»
“হে বৎস, বিসমিল্লাহ বল, ডান হাতে খাও এবং তোমার সামনে থেকে খাও। অতঃপর তাই আমার খাওয়ার নিয়মে পরিণত হল"।[2]
ডান হাতে পান করা:
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيَأْكُلْ بِيَمِينِهِ وَإِذَا شَرِبَ فَلْيَشْرَبْ بِيَمِينِهِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْكُلُ بِشِمَالِهِ وَيَشْرَبُ بِشِمَالِهِ».
“যখন তোমাদের কেউ খায়, যেন ডান হাতে খায় এবং যখন পান করে, যেন ডান হাতে পান করে, কারণ শয়তান বাঁ হাতে খায় ও বাঁ হাতে পান করে"। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৭৭১; আবু দাউদ, হাদীস নং ৩২৮৫)
প্রয়োজন না হলে বসে পান করা:
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন:
«أَنَّهُ نَهَى أَنْ يَشْرَبَ الرَّجُلُ قَائِمًا»، قَالَ قَتَادَةُ فَقُلْنَا: فَالْأَكْلُ فَقَالَ: «ذَاكَ أَشَرُّ أَوْ أَخْبَثُ».
“তিনি কোনো ব্যক্তির দাঁড়িয়ে পান করাকে নিষেধ করেছেন"। কাতাদা রহ. বলেন: আমরা বললাম: (দাঁড়িয়ে) খাওয়া কেমন? তিনি (আনাস) বললেন: “দাঁড়িয়ে খাওয়া আরো খারাপ অথবা আরো নিন্দনীয়"। হাদীসটি আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেছেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদিম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় আগমনের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দশ বছর তিনি খিদমত করেছেন। দশ বছর বয়সে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে এসেছিলেন। তিনি দেখেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে খেতেন ও বসে পান করতেন। তিনিই বর্ণনা করছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: দাঁড়িয়ে খাওয়া কেমন? তিনি বললেন: দাঁড়িয়ে খাওয়া আরো খারাপ আরো নিন্দনীয়।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম মুসলিম রহ. অপর এক হাদীস বর্ণনা করেন:
«لَا يَشْرَبَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ قَائِمًا فَمَنْ نَسِيَ فَلْيَسْتَقِئْ»
“তোমাদের কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে, যে ভুলে গেল সে যেন বমি করে ফেলে দেয়"।[3] দাঁড়িয়ে পান করার এসব নিষেধাজ্ঞা আদবের অন্তর্ভুক্ত এবং স্বাভাবিক হালতে প্রযোজ্য, যেন মানুষ বসে পান করার অভ্যাস গড়ে তুলে। যেমন, খায়বর যুদ্ধ শেষে ক্ষুধা ও ক্লান্তি দূর করার জন্য সাহাবিগণ গাধার গোশত চুলায় চড়ান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করেন কি পাকাও? তারা বলল: গাধার গোস্ত। অতঃপর তিনি বললেন:
«أَهْرِقُوهَا وَاكْسِرُوهَا» فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَوْ نُهَرِيقُهَا وَنَغْسِلُهَا قَالَ: « أَوْ ذَاكَ»
“এগুলো ঢেলে ফেলে দাও এবং পাত্রগুলো ভেঙ্গে ফেল"। এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল, অথবা আমরা গোস্ত ফেলে দিয়ে পাত্র ধুয়ে নেই। তিনি বললেন: “অথবা তাই কর"।[4] যদিও ভাষা কঠোর, কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা আদব শিক্ষা দেয়া ও অভ্যাস গড়ে তুলার অন্তর্ভুক্ত, ওয়াজিব ও অবশ্য করণীয় নয়। ওয়াজিব হলে দ্বিতীয় আদেশে কখনো তিনি পাত্র ধুয়ে ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করতেন না।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন: “দাঁড়িয়ে পান করার চেয়ে বসে পান করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কারণ বসে পান করলে আস্তে আস্তে পানি নিচে অবতরণ করে, কিন্তু দাঁড়িয়ে পান করলে দ্রুত ও চাপ সৃষ্টি করে পানি নিচে নামে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর"। সুবহানাল্লাহ! যার মধ্যে কল্যাণ রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তারই নির্দেশ দিয়েছেন এবং যাতে অনিষ্ট রয়েছে তা থেকেই আমাদেরকে নিষেধ করেছেন।
প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পান করা বৈধ:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবি হাসসান ইবন সাবেতের বোন, কাবশাহ বিনতে সাবেত (উপনাম: উম্মে সাবেত) বর্ণনা করেন:
«دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ فَشَرِبَ مِنْ فِي قِرْبَةٍ مُعَلَّقَةٍ وَهُوَ قَائِمٌ».
“একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট আগমন করেন, অতঃপর তিনি ঝুলন্ত মশকের মুখ থেকে দাঁড়িয়ে পান করনে ..."।[5] এ থেকে প্রমাণ হয় প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পান করা কিংবা মশক থেকে সরাসরি পান করা বৈধ। নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে বিনা প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পান করার ক্ষেত্রে।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«سَقَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ زَمْزَمَ فَشَرِبَ وَهُوَ قَائِمٌ» قَالَ عَاصِمٌ: فَحَلَفَ عِكْرِمَةُ مَا كَانَ يَوْمَئِذٍ إِلَّا عَلَى بَعِيرٍ
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যমযমের পানি পান করিয়েছি, তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করেন"। আসেম বলেন, ইকরিমা শপথ করে বলেন, তিনি তো সেদিন উটের উপরই ছিলেন।[6]
জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ব্যক্তিকে বলেন:
«إِنْ كَانَ عِنْدَكَ مَاءٌ بَاتَ هَذِهِ اللَّيْلَةَ فِي شَنَّةٍ وَإِلَّا كَرَعْنَا».
“যদি তোমার কাছে রাতে রাখা মশকের পানি থাকে ভাল, অন্যথায় আমরা চুমুক দিয়ে পান করে নিব"।[7] এ থেকে প্রমাণ হয় যে, পান করার জন্য যদি ছোট পাত্র না পাওয়া যায়, অথবা সংগ্রহে কষ্ট হয়, অথবা মশকে রাখা অবশিষ্ট পানির সম্পূর্ণ পান করার ইচ্ছা হয়, অথবা এমন কেউ হয় যার ঝুটা ও মুখে দেওয়া মশক থেকে কেউ পান করতে অপছন্দ করবে না, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাহলে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মশক বা পানির বড় পাত্র থেকে সরাসরি পান করা বৈধ। অযথা পাত্র সংগ্রহের জন্য কাউকে কষ্ট দেয়া বা নিজে কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়, নম্রতা ও আল্লাহর প্রতি দাসত্ব প্রকাশ পায়। অনুরূপ পুকুর বা নদী থেকে হাত ও পাত্রের সাহায্য ব্যতীত সরাসরি মুখ দ্বারা পান করাও বৈধ। এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ সময় মশকে রাখা পানি পছন্দ করতেন। কারণ দীর্ঘ সময় মশকে থাকার ফলে পানিতে মিশে থাকা মাটি-বালু ইত্যাদি নিচে নেমে পানি পরিষ্কার হয়ে যায়। এ জন্য মানুষেরা সকালে পান করার জন্য রাতে পানি সংগ্রহ করে রাখত, তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের পানি তালাশ করেছেন। আল্লাহ ভালো জানেন।