×
ইলম অর্জনের ব্যাপারে উম্মতের পূর্বসূরীরা কি কি বলেছেন, ইলম অর্জনে ইখলাসের গুরুত্ব কতখানি তা লেখক এ প্রবন্ধে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

 ইলম হাসিল সম্পর্কে পূর্বসুরীদের কিছু বাণী

হিসামুদ্দীন সালীম কিলানী

আলী হাসান তৈয়ব

সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


﴿ أقوال السلف في طلب العلم ﴾

حسام الدين سليم الكيلاني

 ইলম হাসিল সম্পর্কে পূর্বসুরীদের কিছু বাণী

যাবতীয় প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। তাঁর পরিবার, সকল সাহাবী ও ঈমানদার উম্মতের ওপর।

হামদ ও সালাতের পর কথা হলো, এটি তালিবুল ইলম সম্পর্কিত আলোচনার এটি দ্বিতীয় কিস্তি। এতে আমরা পূর্বসুরী বুযুর্গদের ইলম হাসিলের নিয়ত এবং এ ব্যাপারে নিজের অন্তরের সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। কারণ, আমিরুল মু’মিনীন উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

من خلصت نيَّتُه في الحق، ولو على نفسه، كفاه الله ما بينه وبين الناس ، ومن تزين بما ليس فيه شانه الله.

‘যে ব্যক্তি সত্যের পথে তার নিয়তকে খাঁটি করবে, যদিও তা নিজের বিরুদ্ধে হয়, তবে আল্লাহ তার এবং মানুষের মধ্যস্থিত সম্পর্কের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। আর যে নিজেকে ওই জিনিস দ্বারা সুসজ্জিত করবে যা তার ভেতরে নাই, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন।’[1]

এ জন্য আমাদের কর্তব্য হলো ইলম হাসিলে নিজেদের নিয়ত পর্যালোচনা করে দেখা। পূর্বসুরী বুযুর্গদের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। তাঁরা নিজের অন্তরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। নিজের নিয়ত পর্যালোচনা করতেন। যেমন হাসান বছরী রহিমাহুল্লাহ প্রায়ই নিজেকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে বলতেন,

تتكلمين بكلام الصالحين القانتين العابدين ، وتفعلين فعل الفاسقين المنافقين المرائين ، والله ما هذه صفات المخلصين .

‘তুমি নেককার, অনুগত ও ইবাদতগুযারদের মতো কথা বলো আর কাজ করো ফাসেক, মুনাফিক ও লোক দেখানো ব্যক্তিদের? আল্লাহর শপথ, এসব মোটেই মুখলিছ বা খাঁটি ঈমানদের বৈশিষ্ট্য নয়।’[2]

সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলতেন,

كل شئ أظهرته من عملي فلا أعده شيئًا؛ لعجز أمثالنا عن الإخلاص إذا رآه الناس.

‘আমার যেসব আমল আমি প্রকাশ্যে করেছি; সেগুলোকে আমি কিছুই মনে করি না। কারণ, আমাদের মতো লোকদের পক্ষে কেউ দেখে ফেললে সে আমলকে ইখলাসপূর্ণ রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।’[3]

ইউসুফ ইবন হুসাইন রাযী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

أعزّ شيءٍ في الدُّنيا الإخلاصُ ، وكم اجتهد في إسقاطِ الرِّياءِ عَنْ قلبي ، وكأنَّه ينبُتُ فيه على لون آخر .

‘দুনিয়ার মধ্যে সবচে মূল্যবান বিষয় হলো ইখলাস। আমার অন্তর থেকে রিয়া বা লোক দেখানোর মানসিকতা তাড়াতে কত চেষ্টাই না করেছি; কিন্তু সে তাতে নতুন রঙে আবির্ভূত হয়।’[4]

মুতাররিফ ইবন আবদুল্লাহ তাঁর দু‘আয় বলতেন,

اللهمَّ إنِّي أستغفرُكَ ممَّا تُبتُ إليكَ منه ، ثمّ عُدتُ فيه ، وأستغفرُكَ ممَّا جعلتُهُ لكَ على نفسي ، ثمَّ لم أفِ لك به ، وأستغفركَ ممَّا زعمتُ أنِّي أردتُ به وجهَك ، فخالطَ قلبي منه ما قد علمتَ .

‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে ওই কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যা থেকে আমি তাওবা করেছি অতপর আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছি। আমি সেই বিষয়ের জন্য আপনার কাছে মার্জনা প্রার্থনা করছি যা আমার অন্তরে কেবল আপনার জন্যই স্থাপন করেছি অতপর তার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে পারি নি। আমি সেই বিষয়ের জন্যও আপনার কাছে মার্জনা প্রার্থনা করছি, যা কেবল আপনাকেই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছি বলে ধারণা করেছি, অতপর তার সঙ্গে আমার অন্তরে তা মিশে গেছে যা সম্পর্কে আপনি অবগত।’[5]

ফুযাইল ইবন ‘ইয়ায বলতেন,

إذا كان يُسأل الصادقين عن صدقهم، مثل إسماعيل وعيسى عليهما السلام، فكيف بالكاذبين أمثالنا ؟!!

‘আল্লাহ যখন ইসমাঈল ও ঈসা আলাইহিমাস সালামদের মতো মহাসত্যবাদীদেরই তাঁদের (ঈমানের) সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, তখন আমাদের মতো মিথ্যাবাদীদের সাথে তিনি কী আচরণ করবেন?!![6]

আবূ উবাইদা মা‘মার আল-মুছান্না রহিমাহুল্লাহ বলেন,

من أراد أن يأكل الخبز بالعلم فلتبك عليه البواكي .

‘যে ব্যক্তি রুটি খাওয়ার (তথা উদর পূর্তির) উদ্দেশে ইলম শেখে তবে তার জন্য যেন ক্রন্দনকারীরা ক্রন্দন করে।’[7]

হাফেয যাহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

ينبغي للعالم أن يتكلم بنية وحسن قصد ، فإن أعجبه كلامه فليصمت ، وإن أعجبه الصمت فلينطق ، ولا يفتر عن محاسبة نفسه فإنها تحب الظهور والثناء .

‘আলেমের কর্তব্য হলো সৎ উদ্দেশ্যে এবং সঠিক নিয়তে কথা বলা। তার কথা যদি তাকে মুগ্ধ করে তবে তিনি চুপ হয়ে যাবেন। আর যদি নিরবতা তাকে মুগ্ধ করে তবে কথা বলা শুরু করবেন। নিজের নফসের হিসাব নেয়া থেকে বিরাম নাই। কারণ, প্রদর্শন ও প্রশংসাই তার পছন্দ।’[8]

হিশাম দাসতওয়ায়ীর জীবনী লিখতে গিয়ে ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’ গ্রন্থে ‘আওন ইবন আমারা বলেন, আমি হিশাম দাসতওয়ায়ীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,

والله ما أستطيع أن أقول أنِّي ذهبت يومًا قط أطلب الحديث أريد به وجه الله عز وجل .

‘শপথ আল্লাহর, আমি এ কথা বলতে পারব না যে অমুক দিন আমি হাদীস শিখতে গিয়েছি আর তা করেছি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছায়।’[9]

রহিমাহুল্লাহ দাসতওয়ায়ী রহিমাহুল্লাহ- এর এ বাণী সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইমাম যাহাবী বলেন,

والله ولا أنا ، فقد كان السلف يطلبون العلم لله فنبلوا ، وصاروا أئمة يقتدى بهم ، وطلبه قوم منهم أولا لا لله ، وحصلوه ثم استفاقوا ، وحاسبوا أنفسهم ، فجرهم العلم إلى الإخلاص في أثناء الطريق .

‘আল্লাহর শপথ, আমিও পারব না হলফ করে বলতে। কেননা পূর্বসুরী বুযুর্গগণ ইলম হাসিল করতেন একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে। ফলে তাঁরা মহৎ হয়েছেন। হয়েছেন ইমাম ও আদর্শ, মানুষ যাদের অনুসরণ করে। আর তাঁদের কাছ থেকে কিছু লোক ইলম শিখেছেন প্রথমে একমাত্র আল্লাহর জন্য নয়। ইলম শেখার ফলে তারা অনেক এগিয়ে গেছেন। তারপর তাঁরা নিজেরা নিজেদের অন্তরের হিসাব নিয়েছেন। তাই এ পথিমধ্যে এ ইলমই তাঁদেরকে ইখলাস ও আল্লাহনিষ্ঠার দিকে নিয়ে গেছে।’[10]

যেমন ইমাম মুজাহিদ ও অন্য অনেকে বলেন,

طلبنا هذا العلم ، وما لنا فيه كبير نية ، ثم رزق الله النية بعدُ .

‘আমরা এ ইলম শিখেছি, অথচ এতে আমার নিয়ত বড় কিছু ছিল না। অতপর আল্লাহ পরবর্তীতে আমাদেরকে ‘সহীহ নিয়তে’র তাওফীক দান করেছেন।’[11]

আবার কেউ বলেছেন,

طلبنا هذا العلم لغير الله فأبى أن يكون إلا لله .

‘আমরা এ ইলম শিখেছি গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়াও অন্য কারও উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ ইলমই কেবল আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোও জন্যে হাসিল হতে অস্বীকার করেছে।’[12]

এও ভালো। প্রথমে নিয়ম সঠিক না থাকলেও নিয়ত শুদ্ধ করে পরে এই ইলমের প্রসারে আত্মনিয়োগ করা যায়। আবার কেউ কেউ এই ইলম শিখেছে অসৎ উদ্দেশ্যে, নিছক দুনিয়া কামানো এবং প্রশংসা পাবার অভিপ্রায়ে। অতএব তাদের জন্য তা-ই বরাদ্দ করা হয়েছে যার নিয়ত তারা করেছে। যেমন উবাদা ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« مَنْ غَزَا وَهُوَ لاَ يَنْوِى فِى غَزَاتِهِ إِلاَّ عِقَالاً فَلَهُ مَا نَوَى ».

‘যে ব্যক্তি যুদ্ধ করে আর তার যুদ্ধের মাধ্যমে কিছু উটের রশি কিংবা সামান্য সম্পদ লাভের নিয়ত করে, তবে সে শুধু তা-ই পাবে, যার নিয়ত সে করেছে।’[13]

আপনি এই শ্রেণীকে দেখবেন তারা ইলমের আলোয় আলোকিত হয় না। তাদের আত্মায় এ ইলম স্থিতি লাভ করে না। তাদের আমলেও এ ইলমের কোনো বড় প্রতিফল লক্ষিত হয় না। নিশ্চয় তারাই কেবল আলেম যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে।

আরেক শ্রেণী আছে, যারা ইলম পেয়েছে। এবং ইলমের বদৌলতে পদ-পদবীও লাভ করেছে। অতপর তারা যুলম করেছে। ইলমের শর্তাদি পরিহার করেছে। আর কবীরা গুনাহ ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। ধ্বংস তারা। তারা প্রকৃত আলেম নয়!!

এদের কেউ কেউ তার ইলমের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে নি। ফলে তারা হিলা-বাহানা করেছে। শুধু ছাড় ও অবকাশ খুঁজে ফতোয়া দিয়েছে। আর ব্যতিক্রমী ও বিরল হাদীসগুলো বলে বেড়িয়েছে।

এদের কেউ আবার আল্লাহর প্রতি দুঃসাহস দেখিয়েছে। হাদীস বানিয়ে বলেছে। যার ফলে আল্লাহ তার সম্মানহানী ঘটিয়েছেন। তার ইলম বিনাশ হয়ে গেছে। জাহান্নাম হয়েছে তার অবধারিত গন্তব্য।

উপর্যুক্ত সব শ্রেণীই ইলমের একটি বড় অংশ প্রচার করেছেন। সামগ্রিকভাবে তারা এতে প্রাজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্যও অর্জন করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের মধ্যে একদল এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর তা করেছে ইলম ও আমলে ত্রুটির মধ্য দিয়ে। আরেক শ্রেণী তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে, যারা দৃশ্যত: নিজেদের ইলমের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জাহির করেছে কিন্তু তারা সামান্য বিদ্যা ছাড়া কোনোরূপ গভীরতা অর্জন করে নি। এতেই তারা নিজেদের বিদগ্ধ আলেম ভাবতে শুরু করেছে। তাদের মাথায় কখনো কল্পনায়ও উদয় হয় না যে তারা এর দ্বারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে। কারণ, তারা কোনো আদর্শ শিক্ষক পায় নি ইলম অর্জনে যাকে অনুসরণ করবে। এ কারণে তারা এলোমেলোভাবে গড়ে উঠেছে। যেখানে শিক্ষকের উদ্দেশ্য থাকে ভালো কোনো কিতাবের ক্লাস পাওয়া। কদাচিৎ তিনি সেই কিতাব দেখবেন। যা থেকে তিনি কিছু নোট করবেন তবে আর ঘেঁটে দেখবেন না। আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও নাজাত চাই। যেমন কেউ বলেছেন, আমি নিজে আলেম নই; আবার কোনো আলেমকেও দেখি নি।[14]

অনেক পূর্বসুরী বুযুর্গই বলেছেন,

طلبنا العلم لغير الله فأبى إلا أن يكون لله .

‘আমরা ইলম শিখেছি গাইরুল্লাহর জন্য কিন্তু সে অস্বীকার করে বলেছে সে কেবল আল্লাহর জন্যই হতে চায়।’[15]

অন্য একজন বলেন, ‘আমরা এ ইলম শিখেছি, অথচ এতে আমাদের নিয়ত বড় কিছু ছিল না। অতপর আল্লাহ পরবর্তীতে আমাদেরকে ‘সহীহ নিয়তে’র তাওফীক দান করেছেন।’ অর্থাৎ ইলমের সুফল এই ছিল যে তা একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।[16]

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহিমাহুল্লাহ কে বলা হলো,

إن قوماً يكتبون الحديث ، ولا يُرى أثره عليهم ، وليس لهم وقار . فقال : يؤولون في الحديث إلى خير .

‘এক দল লোক আছে যারা হাদীস সংকলন করে অথচ তাদের ওপর এর কোনো প্রভাব দৃষ্টিগোচর হয় না। তাদের কোনো সম্মান বা মর্যাদাও নেই সমাজে। তিনি বললেন, এরা হাদীসের দ্বারা কল্যাণের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।’[17]

হাবীব ইবন আবী ছাবেত বলেন,

طلبنا هذا العلم ، وما لنا فيه نية ، ثم جاءت النيةُ والعملُ بعد .

‘আমরা এ ইলম শিখেছি তখন আমাদের বড় কিছু নিয়ত ছিল না। অতপর আল্লাহ পরবর্তীতে সহীহ নিয়ত এবং আমল যোগ হয়েছে।’[18]

অতএব বান্দার হার মানা উচিত নয়। বরং নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। যদিও এ প্রথম দিকে এই শুদ্ধ করার কাজটিকে কঠিন মনে হবে। সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

ما عالجت شيئاً أشد علىَّ من نيتي.

‘আমি নিয়তে চেয়ে অন্য কিছু দেখি নি যা শুদ্ধ করা এত কঠিন।’[19]

সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’ গ্রন্থে ইবন জুরাইজের জীবনীতে অলীদ ইবন মুসলিম বলেন,

سألت الأوزاعي وسعيد بن عبد العزيز وابن جريج : لمن طلبتم العلم ؟!! كلهم يقول  : لنفسي . غير أنَّ ابن جريج فإنَّه قال : طلبته للناس.

‘আমি আওযাঈ‘, সাঈদ ইবন আবদুল আযীয ও ইবন জুরাইজকে জিজ্ঞেস করলাম কেন আপনারা ইলম শিখেছেন?!! তাঁরা প্রত্যেকেই জবাব দিলেন, আমার নিজের জন্য শিখেছি। তবে ইবন জুরাইজ বললেন, আমি তা শিখেছি মানুষের জন্য।’[20]

এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইমাম যাহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

قلت : ما أحسن الصدق ، واليوم تسأل الفقيه الغبي لمن طلبت العلم ؟!! فيبادر ويقول : طلبته لله ، ويكذب إنَّما طلبه للدنيا ، ويا قلة ما عرف منه .

‘আমি বলি, তাঁরা কতই না সত্যিবাদী ছিলেন! আর আজ আপনি একজন নির্বোধ মুফতিকেও জিজ্ঞেস করবেন কেন আপনি ইলম শিখেছেন? তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেবেন, আমি আল্লাহর জন্য শিখেছি। তিনি মিথ্যা বলছেন। ইলম শিখেছেন তিনি দুনিয়া কামাইয়ের জন্য। তিনি যে মুফতি নামে খ্যাতিমান সে ব্যাপারে পূঁজি তার কতই না স্বল্প![21]

আপনার ওপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক হে যাহাবী। এখন আমরা যে অধঃপাতিত অবস্থায় আছি তা দেখলে না জানি আপনি কী বলতেন?!! আমি যেন তাঁকে এ যুগের ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দিচ্ছি। প্রকৃত আলেমের সংখ্যা স্বল্পতা ও আদর্শ অভিভাবকের অনুপস্থিতির বিবরণ শোনাচ্ছি। যার কারণে আমাদের মধ্যে এমন দঙ্গল, বর্বর বিদ্যাধারীর আবির্ভাব ঘটছে। মিথ্যার বেসাতিই যাদের ধর্ম। আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। আপনার শান্তিকে আরও দীর্ঘ ও সুপরিসর করুন।

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তদীয় সহীহ গ্রন্থে একটি হাদীস সংকলন করেছেন শত নাম্বারে। তিনি বলেন,

حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ أَبِى أُوَيْسٍ قَالَ حَدَّثَنِى مَالِكٌ عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم - يَقُولُ « إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا ، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا ، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا ، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا » .

‘আমার কাছে ইসমাঈল ইবন আবী উ‘আইস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমার কাছে মালেক হিশাম ইবন উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তাঁর বাবা আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ (দুনিয়া থেকে) ইলম উঠিয়ে নেবেন না তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে তা উঠিয়ে নেবার মাধ্যমে। বরং ইলম উঠিয়ে নেবেন তিনি আলেমদের তুলে নেবার মধ্য দিয়ে। এক পর্যায়ে যখন কোনো (প্রকৃত) আলেম জীবিত থাকবেন না তখন লোকেরা অজ্ঞ ও মূর্খদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। অতপর তাদেরকে (শর‘ঈ বিষয় সম্পর্কে) জিজ্ঞেস করা হবে আর না জেনেই তারা ফতোয়া দিতে শুরু করবে। ফলে তারা নিজেরা যেমন গোমরাহ হয়ে যাবে। অন্যদেরও তেমন গোমরাহীর পথে নিয়ে যাবে।’[22]

একই বিষয়ের হাদীস একটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ মুসলিম শরীফেও। ২৬৭৩ নং এ হাদীসে ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ বলেন,  

حَدَّثَنَا حَرْمَلَةُ بْنُ يَحْيَى التُّجِيبِيُّ أَخْبَرَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ وَهْبٍ حَدَّثَنِي أَبُو شُرَيْحٍ أَنَّ أَبَا الْأَسْوَدِ حَدَّثَهُ عَنْ عُرْوَةَ بْنِ الزُّبَيْرِ قَالَ قَالَتْ لِي عَائِشَةُ يَا ابْنَ أُخْتِي بَلَغَنِي أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو مَارٌّ بِنَا إِلَى الْحَجِّ فَالْقَهُ فَسَائِلْهُ فَإِنَّهُ قَدْ حَمَلَ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِلْمًا كَثِيرًا قَالَ فَلَقِيتُهُ فَسَاءَلْتُهُ عَنْ أَشْيَاءَ يَذْكُرُهَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ عُرْوَةُ فَكَانَ فِيمَا ذَكَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْتَزِعُ الْعِلْمَ مِنْ النَّاسِ انْتِزَاعًا وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعُلَمَاءَ فَيَرْفَعُ الْعِلْمَ مَعَهُمْ وَيُبْقِي فِي النَّاسِ رُءُوسًا جُهَّالًا يُفْتُونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَيَضِلُّونَ وَيُضِلُّونَ قَالَ عُرْوَةُ فَلَمَّا حَدَّثْتُ عَائِشَةَ بِذَلِكَ أَعْظَمَتْ ذَلِكَ وَأَنْكَرَتْهُ قَالَتْ أَحَدَّثَكَ أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ هَذَا قَالَ عُرْوَةُ حَتَّى إِذَا كَانَ قَابِلٌ قَالَتْ لَهُ إِنَّ ابْنَ عَمْرٍو قَدْ قَدِمَ فَالْقَهُ ثُمَّ فَاتِحْهُ حَتَّى تَسْأَلَهُ عَنْ الْحَدِيثِ الَّذِي ذَكَرَهُ لَكَ فِي الْعِلْمِ قَالَ فَلَقِيتُهُ فَسَاءَلْتُهُ فَذَكَرَهُ لِي نَحْوَ مَا حَدَّثَنِي بِهِ فِي مَرَّتِهِ الْأُولَى قَالَ عُرْوَةُ فَلَمَّا أَخْبَرْتُهَا بِذَلِكَ قَالَتْ مَا أَحْسَبُهُ إِلَّا قَدْ صَدَقَ أَرَاهُ لَمْ يَزِدْ فِيهِ شَيْئًا وَلَمْ يَنْقُصْ

‘আমাদের কাছে হারামালা ইবন ইয়াহইয়া আত-তুজিবী বর্ণনা করেন, আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবন অহাব সংবাদ দেন, আমার কাছে আবূ শুরাইহ বর্ণনা করেন যে আবুল আসওয়াদ তাঁর কাছে উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা’র ঘটনা বয়ান করেন। উরওয়া বলেন, আমাকে উদ্দেশ করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, হে আমার ভাগিনা, আমাকে একটু জানাবে যে আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা আমাদের নিয়ে হজে যাবেন কি-না। তুমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে এবং বিষয়টা তাঁকে জিজ্ঞেস করবে। তিনি তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক ইলম বহন করেছেন। উরওয়া বলেন, অতপর আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। অতপর তাঁকে এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে আসছিলেন। তিনি যা উল্লেখ করছিলেন তার মধ্যে এই হাদীসটিও ছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে একবারে ইলমকে ছিনিয়ে নেবেন না। বরং আলেমদের উঠিয়ে নেবেন। আর তাঁদের সঙ্গে তাঁদের ইলমও উঠিয়ে নেবেন। অতপর মানুষের মধ্যে শুধু মূর্খ নেতারা অবশিষ্ট থাকবে। এরা ইলম ছাড়াই তাদের ফতোয়া দেবে। ফলে তারা পথভ্রষ্ট হবে এবং লোকদেরও পথভ্রষ্ট বানাবে।

উরওয়া বলেন, আমি যখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এই হাদীসটি শোনালাম, তাঁর কাছে কথাগুলো অনেক ভারি মনে হলো এবং তিনি অস্বীকার করতে চাইলেন। তিনি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি তোমাকে বলেছেন যে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন বলতে শুনেছেন? এমনকি আমি তার সাথে পরবর্তীতে সাক্ষাৎ করলে তিনি বললেন, ইবন উমর তো এখন এসেছে, তার সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে জিজ্ঞেস কর ঐ হাদীসটি সম্পর্কে ইলম সম্পর্কে তিনি তোমাকে যা শুনিয়েছিলেন। উরওয়া বলেন, আমি তখন ইবন উমর এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে এ বিষয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করি, তিনি আমাকে প্রথমবারের মতই হাদীস বর্ণনা করলেন। উরওয়া বলেন, তারপর যখন আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এ সংবাদ দিলাম তখন তিনি বললেন, আমার বিশ্বাস তিনি ঠিকই বলেছেন। আমি তাঁকে দেখছি এতে তিনি কিছু কম করেন নি আবার বেশিও করেন নি।[23]

এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় কিয়ামত যত কাছে আসবে নিষ্ঠাবান মুখলিস আলেমের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাবে। অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন বিদ্বান হয়তো অনেক মিলবে কিন্তু প্রকৃত আলেমের সংখ্যা নগন্য হয়ে যাবে যাদের প্রশংসা করে পবিত্র কুরআনে পূর্বে উল্লেখিত ওই ব্যাক্য উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ ‘নিশ্চয় আলেমরাই আল্লাহকে প্রকৃত অর্থে ভয় করেন’।

অতএব প্রত্যেক আলেম ও তালেবে ইলম ভাইয়ের প্রতি অনুরোধ, আসুন আমরা নিজেদের নিয়তের খবর নেই। নিজেদের আত্মার প্রতি নিজেরা একটু দৃষ্টি দেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে ইখলাস ও নিষ্ঠাবান মুমিন হবার তাওফীক দান করুন। আমীন।


[1]. খালেদ আস-সাবত, ‘আমালুল কুলূব : ১/৬৪।  

[2]. মুনতালাকাতু তালিবিল ইলম : ১/৩৫।

[3]. প্রাগুক্ত।  

[4]. আল- আরবাঈন আন- নাববিয়্যাহ : ১/৩।

[5]. আবূ নাঈম, হুলইয়াতুল আওলিয়া : ২/২০৭।   

[6]. মুনতালাকাতু তালিবিল ইলম : ১/৩৫।   

[7]. প্রাগুক্ত।  

[8]. প্রাগুক্ত।  

[9]. প্রাগুক্ত।

[10]. প্রাগুক্ত।   

[11]. প্রাগুক্ত।

[12]. প্রাগুক্ত।  

[13]. নাসাঈ : ৩১৩৯ ; ইবন হিব্বান : ৪৬৩৮; হাকেম : ২৫২২। [আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহুল জামে‘ : ৬৪০১।]

[14]. সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা : ৭/১৫২-১৫৩।  

[15]. প্রাগুক্ত।  

[16]. প্রাগুক্ত।  

[17]. সিয়ারু ‘আলামিন নুবালা : ৭/১৫২-১৫৩।     

[18]. মুনতালাকাতু তালিবিল ইলম : ১/৪১।    

[19]. প্রাগুক্ত।  

[20]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’ : ৬/৩২৮।  

[21]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’ : ৬/৩২৮।  

[22]. বুখারী : ১০০; তিরমিযী : ২৬৫২।    

[23]. মুসলিম : ৪৮২৯।