বাইতুল্লাহ যিয়ারতের পবিত্র বাসনা
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
বাইতুল্লাহ যিয়ারতের পবিত্র বাসনা
أماني زيارة بيت الله الحرام
< بنغالي >
আলী হাসান তৈয়ব
علي حسن طيب
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
বাইতুল্লাহ যিয়ারতের পবিত্র বাসনা
স্বপ্নের দুয়ারে বায়তুল্লাহ
মানুষ বলতেই তার ভেতর বহু অপ্রসবিত স্বপ্নের গোপন বাস। স্বপ্ন পূরণের তাড়নাই মানুষকে এগিয়ে নেয়। আপনার স্বপ্ন যে কোনো মূল্যে বিলেতে পাড়ি জমানো, ডিভি জয় করে আমেরিকার গর্বিত সিটিজেন হওয়া অথবা হানিমুনে মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ভারত কিংবা ইউরোপের কোনো স্বপ্নরাজ্যে যাওয়া। সাধ ও সাধ্যে কুলায় বলে কত উপলক্ষে কত দেশই তো আপনি ভ্রমণ করেন। জ্বর-সর্দিতেও ছুটে যান সিঙ্গাপুরে। অথচ আপনার ভেতরে কখনও মরু আরবের ওই কালো ঘরের সান্নিধ্য পাওয়ার তাগিদ অনুভব করেন নি। কখনও ইচ্ছে জাগে নি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালামের স্পর্শধন্য মিনা-মুযদালিফা-আরাফার দেখা পেতে। স্বপ্নের দুয়ারে কখনও উদয় হয় নি সাফা-মারওয়া। হায় কত দর্শনীয় স্থানে ছুটে গেছেন যান নি শুধু সেখানে, যেখানে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যেখানে সালাতের অতুলনীয় ফযীলত ঘোষিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র যবানে,
«لا تُشَدُّ الرِّحَالُ إلاَّ إلى ثَلاثَةِ مَسَاجِدَ: اَلْمَسْجِدِ الْحَرَام، وَمَسْجِدِيْ هَذَا، وَالْمَسْجِدِ الأَقْصَى».
“তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোথায়ও (সাওয়াবের আশায়) সফর করা জায়েয নেই: মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ ও মসজিদুল আকসা”।[1]
اَلصَّلاَةُ فِيْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ بِمِائَةِ أَلْفِ صَلاَةٍ وَالصَّلاَةُ فِيْ مَسْجِدِيْ بِأَلْفِ صَلاَةٍ وَالصَّلاَةُ فِيْ بَيْتِ الْمُقَدَّسِ بِخَمْسِمِائَةٍ صَلاَةٍ.
“মসজিদে হারামে এক সালাত এক লাখ সালাতের সমান, আমার মসজিদে (মসজিদে নববী) এক সালাত এক হাজার সালাতের সমান এবং বাইতুল-মুকাদ্দাসে এক সালাত পাঁচশ সালাতের সমান”।[2]
আরেক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«صَلاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلاةٍ فِيمَا سِوَاهُ، إِلا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ»
‘আমার এ মসজিদে এক সালাত আদায় করা মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে এক হাজার সালাত আদায় করার চেয়েও উত্তম”।[3]
চোখ মুদলেই যে দেহের কানাকড়িও দাম নেই তার ভালোবাসা আপনাকে কতটা উতলা করে! প্রিয় জনের দেখা না পেলে কত অস্থির, কত কাতর হন! অথচ আপনি ও তার স্রষ্টা দয়াময় আল্লাহর অন্যতম প্রতীক কা‘বার দর্শন পেতে কখনও কাতর হন নি। একজন মুমিন হিসেবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে?
দরকার ঈমানী আবেগ
যুগটা এখন সঞ্চয়ের। ব্যাংক-বীমা, সমিতিসহ নানা সরকারি-বেসরকারি সংগঠন দেশের সব শ্রেণির মানুষকে সফলভাবে সঞ্চয়মুখী করেছে। দিনমজুর থেকে বিত্তশালী কেউই সঞ্চয় কাঠামোর বাইরে নেই। গ্রামে-শহরে ঘরে ঘরে সঞ্চয়-সমিতির সয়লাব। খুব কম মানুষই আছে, যার ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব নেই কিংবা অন্যূন একটি সমিতিতে সঞ্চয়ী খাতা নেই। কত টার্গেটেই তো সঞ্চয় করা হয়। মেয়ে জন্ম নিতেই শুরু হয় তার বিয়েকালীন খরচের জন্য সঞ্চয়। ছেলে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতেই শুরু হয় তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের অর্থসঞ্চয়। কেউ ব্যবসার জন্য, কেউ চিকিৎসার জন্য আবার কেউ বিদেশ গমনের অভিলাষেও সঞ্চয় করেন। কিন্তু হে ‘লা শরীক’ আল্লাহর কৃপাধন্য বান্দা, হে কালেমার ভালোবাসার দাবীদার, আমাদের কী উদ্যোগ আছে হজের খরচ সংগ্রহের জন্য? যত অভাবই থাক না কেন ভালোবাসা থাকলে মাসে ১০০ করে টাকা সঞ্চয় চাইলে কে না করতে পারে। অনেক ইসলামী ব্যাংকে তো এ টার্গেটে হজ সেভিংস নামে বিশেষ ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।
আহা, সেই আল্লাহ প্রেমিকদের কথা যদি আমরা চিন্তা করতাম, যারা সঞ্চয় বিমুখ যুগের প্রতিনিধি হয়েও শত দারিদ্র্য পাশে ঠেলে বিচিত্র উপায়ে এ লক্ষ্যে টাকা জমিয়েছেন। হজের মাত্র ৫০ হাজার টাকার জন্য যারা মাটির ব্যাংকে দিনের পর দিন টাকা জমিয়েছেন আল্লাহর ঘরের সফর-সম্বল সংগ্রহে, যে দীনহীনরা শেষ অবলম্বনটুকু বেঁচে দিতেও কুণ্ঠিত হননি, যারা জীবন বাজি রেখে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই মরণ সমুদ্র পাড়ি দিতে জাহাজে চড়েছেন। আহা, তাদের নিখাদ সেই মেটো ভালোবাসার কাছে আমাদের ডিজিটাল লৌকিক আল্লাহ প্রেম কত দরিদ্র!
আর নয় বিলম্ব
হে যুবক, ভালোবাসার কত ইতিহাসই তো তুমি জন্ম দাও। কত কিছুই তো কর প্রেয়সীকে পেতে। এর জন্য ঘর, সমাজ, দেশ এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রাখ। শৈশবের প্রাণপ্রিয় বান্ধব, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যাম্পাস, অনেক কষ্টে পাওয়া সাধের চাকরি থেকে নিয়ে কোনো কিছু ত্যাগেই তোমার কুণ্ঠা নেই। বাবা-মায়ের বকাঝকা, শিক্ষক-গুরুজনের শাসন থেকে পুলিশের তাবড়ানি-কত কিছুই না সয়ে যাও অম্লান বদনে। অথচ কী আশ্চর্য দেখ, খোদ এ ভালোবাসার স্রষ্টাকে ভালোবাসার সুযোগ হয়ে ওঠে না। রক্ত-মাংসের ভালোবাসা প্রমাণে কী চেষ্টা আমাদের। অথচ করুণাময় রবের অপার্থিব ভালোবাসা প্রমাণে বিশেষ কোনো চেষ্টা নেই! আল্লাহর ভালোবাসায় নিজের জীবন বাজি রাখার ঈমান সে কোথায়, অন্তত আল্লাহর ঘরের ভালোবাসায় কিছু একটা তো করা যায়। কী ত্যাগ করেছি আমরা বায়তুল্লাহর ভালোবাসায়? সব ভালোবাসাই চায় নগদ পেতে, কেন তবে বায়তুল্লাহর ছায়ায় যেতে অযথা বিলম্ব? বার্ধক্যের অনভিপ্রেত অপেক্ষা?
অথচ সক্ষম ব্যক্তির ওপর বিলম্ব না করে হজ করা জরুরী। কালক্ষেপণ করা মোটেই উচিত নয়। এটা মূলত শিথিলতা ও সময়ের অপচয় মাত্র। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«تَعَجَّلُوا إِلَى الْحَجِّ - يَعْنِي : الْفَرِيضَةَ فَإِنَّ أَحَدَكُمْ لاَ يَدْرِي مَا يَعْرِضُ لَهُ».
“তোমরা অ ফরয হজ আদায় কর। কারণ তোমাদের কেউ জানে না, ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি তার সামনে আসবে”।[4]
উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
«لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ أَبْعَثَ رِجَالًا إلَى هَذِهِ الْأَمْصَارِ فَيَنْظُرُوا كُلَّ مَنْ لَهُ جَدَةٌ وَلَمْ يَحُجَّ فَيَضْرِبُوا عَلَيْهِ الْجِزْيَةَ مَا هُمْ بِمُسْلِمِينَ مَا هُمْ بِمُسْلِمِينَ».
‘আমার ইচ্ছা হয়, এসব শহরে আমি লোক প্রেরণ করি, তারা যেন দেখে কে সামর্থ্যবান হওয়ার পরও হজ করেনি। অতপর তারা তার ওপর জিযিয়া (কর) আরোপ করবে। কারণ, তারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিম নয়”।[5]
উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আরো বলেন,
«لِيَمُتْ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا- يَقُولُهَا ثَلَاثَ مَرَّات-ٍ رَجُلٌ مَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ وَوَجَدَ لِذَلِكَ سَعَةً».
‘ইয়াহূদী হয়ে মারা যাক বা খ্রিস্টান হয়ে -তিনি কথাটি তিনবার বললেন- সেই ব্যক্তি যে আর্থিক স্বচ্ছলতা সত্ত্বেও হজ না করে মারা গেল”।[6]
একান্ত অনুভূতি
মুমিনমাত্রেই তার অন্তরে বাইতুল্লাহ দর্শনের সুপ্ত তামান্না লুকিয়ে থাকে। যাদের প্রতীক্ষার অবসান হয় এবং তামান্না পূরণ হয় তারা তো সৌভাগ্যবানই। যাদের প্রতীক্ষা ফুরোয় না এবং তামান্না অপূর্ণই থেকে যায় তারাও সৌভাগ্যবান। কেন নয় আল্লাহর ঘরের ভালোবাসা তো আল্লাহরই ভালোবাসা।
গত কয়েক বছর ধরেই মনটাকে বলি এবারই তোর ডাক আসবে। খুলে যাবে তোর সৌভাগ্যের স্বর্ণদুয়ার। এবার তুইও হবি কাবার পথের মুসাফির। তারপর সময় ঘনিয়ে আসে। কাফেলার পর কাফেলা ছোটে। সফেদ সেলাইবিহীন পোশাকের মিছিল হৃদয়ে ঝড় তোলে। প্রস্তুতির রমযান-শাওয়াল গিয়ে অপেক্ষার যিলকদ আসে। আসে না আমার যিলহজ। সত্যিই যেটা হবে আমার জন্য হজ বিশিষ্ট।
হজ বিষয়ে কত বলি আর লিখি। এরচেয়েও বেশি থেকে যায় অব্যক্ত। ভেতরে গোপন কান্নারা জোর করে বেরিয়ে আসতে চায়। পত্রিকার জন্য যখন কাবার ছবি গুগলে সার্চ দেই, সহসা কেন যেন বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যাই। জানি এ কান্না মিছে নয়। নয় প্রতিদান-পুরস্কারহীন। কিন্তু পৃথিবীর প্রথম ওই ঘর দেখে চোখ জুড়ানোর মোকাবিলায় তা নয় সান্ত্বনা। কিছুই তো আমার মনের সেই শান্তি এনে দিতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতিধন্য মক্কার ঐশ্বর্যভরা প্রান্তরে পা না রাখা অব্দি এর শান্তি নেই।
ওখানে যেতে কী লাগে? পাসপোর্ট ওই নিয়তে দুই বছর আগেই তো করে রেখেছি। কত লোক ধনী হয়েও তো যেতে পারে না। কত লোক নির্ধন হয়েও তো ইবরাহীমী ডাক[7] শুনে সাড়া দেয়। কত লোক বৃদ্ধ হয়েও দিব্যি
চলে যায়। অসুস্থতা মাড়িয়েও পৌঁছে যায় কত নারী-পুরুষ। শুধু বিজ্ঞ আলেমরাই তো যান না, কত জ্ঞানহীন-প্রাণহীন দেহও তো যায় ওখানে। রহমতের ওই বৃষ্টিমুখে কেবল আমারই যাওয়া হলো না এখনও।
মাবুদ, তুমি তো ডাকে সাড়া দিয়েই থাক[8]। এখনও আসলে সেভাবে ডাকতে পারিনি। পারলে তুমি কেন শুনবে না! আচ্ছা, এবার তাহলে সে তাওফীকটাই দাও- যেভাবে ডাকলে তুমি শুনবে।
﴿ قَالَ إِنَّمَآ أَشۡكُواْ بَثِّي وَحُزۡنِيٓ إِلَى ٱللَّهِ﴾ [يوسف: ٨٦]
“আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৬]
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৯৭
[2] মাজমাউয যাওয়াইদ: ৪/১১
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৯৪
[4] মুসনাদ আহমদ, হাদীস নং ৭৬৮২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৮৮২
[5] ইবন হাজার, আত-তালখীসুল হাবীর: ২/২২৩
[6] বাইহাকী: ৪/৩৩৪
[7] দ্রষ্টব্য : وَأَذِّن فِي ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَجِّ يَأۡتُوكَ رِجَالٗا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٖ يَأۡتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٖ ٢٧ ﴾ [الحج: ٢٧] “আর মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে”। [সূরা আল-হজ, আয়াত: ২৭]
[8] আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ﴿وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ﴾ [غافر: ٦٠] “তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব”। [সূরা গাফির, আয়াত: ৬০]