ঈদুল ফিতরের আনন্দ ও আমাদের করণীয়
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
ঈদুল ফিতরের আনন্দ ও আমাদের করণীয়
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
2011 - 1432
﴿ أفراح عيد الفطر ومسؤولياتنا ﴾
« باللغة البنغالية »
الدكتور محمد منظور إلهـي
مراجعة: الدكتور أبو بكر محمد زكريا
2011 - 1432
ঈদুল ফিতরের আনন্দ
ও
আমাদের করণীয়
প্রতি বৎসর দু'দুটি ঈদ উৎসব মুসলমানদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দের ফল্গুধারা। এ দু'টি ঈদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের ব্যপ্তি ও প্রভাব বহুদূর বিস্তৃত মুসলিম মানসে ও জীবনে। পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ উৎসব মুসলিম জাতির প্রতি সত্যিই মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত ও পুরস্কার। মুসলিম উম্মার প্রত্যেক সদস্যের আবেগ, অনুভূতি, ভালবাসা, মমতা ঈদের এ পবিত্র ও অনাবিল আনন্দ উৎসবে একাকার হয়ে যায়। ''নিশ্চয়ই তোমাদের এ জাতি একক একটি জাতি'' মহান আল্লাহর এ ঘোষণার বাস্তবরূপটি চরমভাবে প্রকটিত হয় বিশ্বাবাসীর সামনে।
ঈদ মুসলমানদের জীবনে শুধুমাত্র আনন্দ-উৎসবই নয়, বরং এটি একটি মহান ইবাদাত যার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা খুঁজে পায়, ধনী-গরীব, কলো-সাদা, ছোট-বড়, দেশী-বিদেশী সকল ভেদাভেদ ভুলে যায় এবং সর্বশ্রেণী ও সকল বয়সের নারী-পুরুষ ঈদের জামাতে শামিল হয়ে মহান প্রভুর শুকর আদায়ে নুয়ে পড়ে। ঈদের এ মহান উপলক্ষকে সামনে রেখে আজ আমাদের এ আত্মজিজ্ঞাসা উত্থাপিত হওয়া প্রয়োজন যে, সত্যিই আমাদের ঈদ কি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ হবার কারণ হতে পেরেছে? যে মহান স্রষ্টা তাদেরকে এরকম বিশাল আনন্দ উৎসবের অনুমোদন দিয়েছেন, তারা তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদা তাঁকে স্মরণ রেখেছে? যে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত হিসাবে তারা ঈদ পালন করছে, সে রাসূলের আর সকল সুন্নাতের অনুসরণ কি তারা করছে? আমার বিশ্বাস এসব প্রশ্নের সমাধানের মধ্য দিয়েই আমরা করণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফিরিস্তি পেয়ে যাব।
পাশাপাশি কল্যাণ, বরকত ও আনন্দের এ শুভদিনে আমাদের সে সকল ভাই-বোনদের কথাও স্মরণ করা উচিৎ, মৃত্যু যাদেরকে এ জগত থেকে এমন এক জগতে নিয়ে গিয়েছে, যেখান থেকে ফেরার কোন উপায় নেই। সেখানে তারা পার্থিব জীবনে নিজেদের কৃতকর্মের ফলাফল ভোগ করছে। এ মহান দিবসে আমরা তাদেরকে ভুলে না গিয়ে আমাদের উচিৎ তাদের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা এবং তাদের পথে আমাদেরকেও একদিন পা বাড়াতে হবে - মনে সব সময় এ কথা জাগরুক রাখা।
ঈদ উৎসব পালনকালে সেই সব ভাই-বোনদের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা কঠিন পীড়ায় অসুস্থ হয়ে বাড়ীতে কিংবা হাসপাতালে পড়ে আছে। ব্যথা, যন্ত্রণা ও মানসিক পীড়নে ঈদের আনন্দ তাদের মাটি হয়ে গিয়েছে। আমাদের উচিৎ প্রথমত: আল্লাহ যে সুস্থতা ও নিরাপত্তার অশেষ নিয়ামতের উপর আমাদেরকে রেখেছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা এবং দ্বিতীয়ত: এ সবল রোগাক্রান্তদের আরোগ্য লাভের জন্যে দোয়া করা এবং সম্ভব হলে তাদের শুশ্রষা করা।
আজ আমাদের সে সব ভাই-বোনদের কথাও বিস্মৃত হলে চলবে না, যুদ্ধ যাদেরকে সর্বস্বান্ত করেছে, গৃহহীন করেছে, দেহের রক্ত-বন্যা প্রবাহিত করেছে, বহু নরীকে করেছে বিধবা এবং হাজারো শিশুকে করেছে পিতৃহীন-এতীম; এবং সেই বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকেও, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অমোঘ বিধানে যারা আজ সর্বহারা। আমরা আমাদের সাধ্যানুযায়ী আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে এদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারি এবং আল্লাহ যেন তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন সে দোয়াও করতে পারি।
প্রতি ঈদেই সবাই সাধ্যানুযায়ী নতুন নতুন মডেলের সুন্দর সুন্দর পোষাক ক্রয় করে থাকে। আমরা কি কখনো ভাবি সে-সব ভাই-বোনদের কথা দারিদ্রের কষাঘাতে যাদের জীবন জর্জরিত। নতুন পোষাক কেনা দূরে থাক, পুরানো কোন ভাল পোষাকই তাদের নেই। বরং প্রতিদিনের অন্নের প্রয়োজনীয় যোগানও তাদের নেই। আমরা যারা স্বচছল তারা কি সামান্যতম হাসিও এদের মুখে ফোটাতে পরি না? অথচ মহান আল্লাহ বলেন, ''নিজেদের কল্যাণের জন্য তোমরা যে উত্তম কাজ করে থাকো, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে পাবে...।'' [সূরা আল-বাকারাহ: ১১০]
এ মুবারক রামাদান মাসে আমাদের অনেককেই আল্লাহ সামর্থ্য দিয়েছেন সিয়াম-সাধনা, কিয়ামুল-লাইল পালন, দান-দাক্ষিণ্য ও কুরআন অধ্যায়নের মাধ্যমে তাঁর ইবাদাত পালনের। কিন্তু ইবাদাতের এ ভরা মৌসুমেও আমাদের এমন অনেক ভাই-বোন রয়েছেন পাপের সাগরে যারা আকন্ঠ নিমজ্জিত, স্রষ্টাদ্রোহী কাজে যারা লিপ্ত, পার্থিব জীবনের মরিচিকাসম খেল-তামাশায় মগ্ন হয়ে যারা জীবনের প্রকৃত কর্তব্য ভুলে গিয়েছে। আমরা কি এদেরকে স্রষ্টার সুন্দর সরল পথের দিকে আহবান করেছি? পাপ-সাগর থেকে তাদেরকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছি? তাদের সমানে সত্যের অনুপম আদর্শের গভীর সৌন্দর্যের সঠিক ও বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছি? মহান রাববুল আলামীন সমীপে এদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করেছি?
ঈদুল ফিতর এসব প্রশ্নের সুন্দর জবাব খুঁজে পেতে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। এবারের ঈদুল ফিতরকে তেমনই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ করার পাশাপাশি আমাদের উচিত হবে ঈদের সাথে সংশ্লিষ্ট শরয়ী বিধান মেনে চলা ও শিষ্টচারিতা রক্ষা করা। সংক্ষেপে ঈদের সে শরয়ী বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরছি।
এক. ঈদের আগের দিন সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে ঈদের সালাত আদায় করা পর্যন্ত তাকবীর তথা 'আল্লাহু আকবর'' বলতে থাকা। এ হচ্ছে বিশ্ববাসীর সামনে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা। আল্লাহ তা'আলা বলেন, ''আর যাতে তোমরা সংখ্যাপূর্ণ কর এবং তিনি যে তোমাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন তার জন্য 'আল্লাহ মহান' বলে ঘোষণা দাও এবং যাতে তোমরা শোকর কর।'' [সূরা আল- বাকারাহঃ ১৮৫]
তাকবীরের শব্দগুলো হল: ''আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।'' পুরুষরা মসজিদে, বাজারে ও ঘরে এ তাকবীর ধ্বনি জোরে দিতে থাকবে। আর মহিলারা তাকবীর বলবে আস্তে।
দুই. যাকাতুল ফিতর প্রদান করা, রোযাদারের যে ভুল-বিভ্রান্তি ও পাপ হয়েছে তা মোচন করার জন্য এবং মিসকীনদের খাদ্য যোগানের উদ্দেশ্যে যাকাতুল ফিতর দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে। যাকাতুল ফিতর ঈদের একদিন বা দুইদিন আগেও দেয়া যায়। তবে সালাতুল ঈদের পর পর্যন্ত বিলম্ব করা যাবে না, আগেই আদায় করতে হবে।
তিন. ঈদের দিন সকালে গোসল করা ও সুন্দর পোষাক পরিধান করা এবং ঈদের সালাতে যাওয়ার প্রাক্কালে পুরুষদের খোশবু ব্যবহার করা উত্তম। মেয়েদের জন্যও সুন্নাত হলো পর্দার সাথে ও খোশবু ব্যবহার না করে ঈদগাহে এসে ঈদের আনন্দ ও সালাতে শরীক হওয়া।
চার. ঈদগাহে যাওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত অনুসরণ করে তিনটি বা পাঁচটি করে বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া।
পাঁচ. ঈদের জামাতে শামিল হওয়া এবং পুরো খুতবা শোনা। ইমাম ইবনু তাইমিয়া সহ আরো অনেক মুহাক্কিক আলেমের মতে ঈদের সালাত ওয়াজিব, কোন ওজর ছাড়া ত্যাগ করা যাবে না। এমনকি হায়েযরতা মহিলাগণ পর্যন্ত ঈদগাহে আসবেন এবং সালাতে অংশ না নিয়ে একপ্রান্তে অবস্থান করবেন।
ছয়. রাসূলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ করে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফেরা।
সাত. ঈদের অভিভাদন জানাতে গিয়ে, ''তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়ামিনকা'' অর্থাৎ 'আল্লাহ আমাদের ও আপনার পক্ষ থেকে কবুল করুন' বলা ভাল। এছাড়া সুন্দর সুন্দর দোয়ার মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলি করাতে কোন অসুবিধা নেই। বরং এতে পারস্পারিক সম্পর্ক অনেক মধুর হয়ে উঠে।
আট. ঈদ উৎসবকে উপলক্ষ করে সকল প্রকার পাপাচার ও অশ্লীলতায় নিমজ্জিত হওয়া থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করা।
সর্বশেষে বলবো- সিয়াম সাধানার পবিত্র মাস রামাদানুল মুবারক ছিল মূলত: আমাদের জন্য তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ লাভের মাস, সর্বপ্রকার ইবাদাতে অভ্যস্থ হওয়ার মাস, ঈমান মযবুত করার মাস, প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্রে বিভূষিত হওয়ার মাস, কুরানের মর্ম উপলব্ধি করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআনমুখী হওয়ার মাস, মুসলিম জাতির জেগে উঠার মাস এবং সকল প্রকার অনাহুত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করার মাস।
একটি মাস ধরে আমরা যারা নিজেদেরকে এভাবে প্রস্তুত করেছি, মাসটি অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে যদি তা ভুলে যাই এবং আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য থেকে দুরে সরে যাই, তাহলে তা কুতটুকু সঙ্গত হবে? মূলত: যারা ভাবে যে, রমাদান মাসে ইবাদাত করাই যথেষ্ট, তাদের সে ভাবনা অসঙ্গত ও ভুল। এদিকে ইঙ্গিত করে এক মুসলিম মনিষী বলেছিলেন, ''সে সকল ব্যক্তিবর্গ কতই না মন্দ, যারা রামাদান ছাড়া আল্লাহকে চেনে না।'' তাছাড়া আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ''মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার রবের ইবাদাত করতে থাক''। [সূরা আল-হিজর:৯৯]
উপরোক্ত আলেচনার আলোকে আমরা যদি আমাদের কর্তব্য কাজে তৎপর হতে পারি তাহলেই আমার বিশ্বাস আমাদের ঈদুল ফিতরের এ মহোৎসব অর্থবহ ও সার্থক হবে।