মাহে রমযান : তাৎপর্য ও কর্তব্য
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
মাহে রমযান : তাৎপর্য ও কর্তব্য
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
2011 - 1432
﴿ شهر رمضان: حِكَم ومهام ﴾
« باللغة البنغالية »
علي حسن طيب
مراجعة: الدكتور محمد منظور إلهي
2011 - 1432
রমযানে সিয়াম সাধনা : কর্তব্য ও তাৎপর্য
সাওম ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। আরবী এ 'সাওম' শব্দটি আমাদের দেশে রোযা নামে সমধিক পরিচিত, যা মূলত ফারসী শব্দ। সাওম অর্থ বিরত থাকা। যেহেতু পানাহার ও যৌন সম্পর্ক সাধারণত প্রবৃত্তির লিপ্সা ও খাহেশাতের লালসাকে উদ্দীপ্ত করে তাই ইসলাম এ সাওমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। কিন্তু সাওমের মূল লক্ষ্য ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করতে হলে, অবশ্যই বৈধ পানাহার ও স্ত্রীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য সব ধরনের পাপাচার ও অপ্রকাশ্য মন্দাচার থেকেও অন্তর ও দেহ তথা সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে রক্ষা করতে হবে। এদিকে ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে)
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ».
'যে ব্যক্তি সাওম পালন করতে গিয়ে মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কথা মত কাজ করা এবং মূর্খতা (সুলভ আচরণ) থেকে বিরত থাকলো না, তার খাদ্য ও পানীয় ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।' [বুখারী : ১৯০৩; আবূ দাউদ : ২৩৬৪]
জীবন ধারণের স্বার্থেই পানাহার সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা সম্ভব নয়। তাই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মাত্র কয়েক ঘন্টা সাওম পালনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার শিশুদেরকে এর আওতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অক্ষম-বৃদ্ধদের জন্য 'ফিদয়া'র অবকাশ রাখা হয়েছে। মুসাফির, অসুস্থ ও সন্তান প্রসব, স্তন্যদান ও ঋতুকালে নারীদের প্রতি লক্ষ্য রেখে উযর দূর হওয়ার পর 'কাযা'র মত বিকল্প রাখা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
﴿ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَٰتٖۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ فَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَهُوَ خَيۡرٞ لَّهُۥۚ وَأَن تَصُومُواْ خَيۡرٞ لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ١٨٤ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٤، ١٨٥]
'নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান। রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।' {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৪-১৮৫}
এদিকে রমযান মাস নির্ধারণের ক্ষেত্রে সৌর পঞ্জিকার স্থলে চন্দ্র পঞ্জিকা গ্রহণ করা হয়েছে। এর সুবিধা হলো, সৌর হিসেবে মৌসুমের পরিবর্তন ও ঋতুর পালাবদল হয় না। তেমনি এর দিন-রাতের আকারেও বিশেষ কোনো পরিবর্তন বা ব্যত্যয় দেখা যায় না। তাই যদি সৌরবর্ষের হিসেবে সাওম পালন করতে হত, তখন যদি কোনো দেশে গ্রীষ্মকালে সাওম পালন করা হত, তাহলে সেখানে সর্বদাই রমযান আসত গ্রীষ্মকালে আর কোথাও শীতকালে রমযান হলে সবসময় শীতকালেই রমযান আসতো। পক্ষান্তরে চন্দ্রমাস এর ব্যতিক্রম। এর মৌসুম বছরে বছরে বদলাতে থাকে আর দিন-রাতের আয়তনও কম-বেশি হয়। এভাবে সাওমের মাস প্রতি দেশে বছর ভেদে প্রতি ঋতুতেই আগমন করে। ফলে সবাই এর মিঠে-কড়া উভয় রূপই উপভোগ করতে পারে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত কিংবা বড় আকারের দিন ও ছোট আকারের দিন প্রভৃতি সব রকম অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে।
ইসলাম ধর্মে সিয়াম সাধনার বিধান রাখা হয়েছে আল্লাহভীতি সৃষ্টি ও তাকওয়া চর্চার উদ্দেশে। কুরআন কারীমে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে- সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ﴾ [البقرة: 183].
'হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।' {সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩}
আর তাকওয়া হলো মনের ওই অবস্থা যার প্রেরণায় পাপের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড বিরাগ ও পুণ্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পশুসূলভ প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সাধারণত দুর্বল ও কমজোর হয়ে পড়ে, তাই রমযানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে স্বতস্ফূর্তভাবে তাকওয়ার হালত বা আল্লাহভীতির অবস্থা তৈরি হয়ে যায়।
এ ছাড়া রমযানুল মুবারকে তারাবীহর সালাতের সৌজন্যে আল-কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত বেড়ে যায়। সাওম পালনের উদ্দেশ্যে অভুক্ত থাকার প্রভাবে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ও কল্যাণকামিতার মানসিকতা প্রবল হয়। সাওম ও নিছক উপবাসের মধ্যে ব্যবধান তৈরির মানসে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জামাআতের সাথে সালাত আদায়ে পুরুষদের এবং মুস্তাহাব ওয়াক্তে উত্তমরূপে সালাত আদায়ে মহিলাদের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। যিকর-ফিকর, আল্লাহর ইয়াদ ও তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা ও ইস্তিগফার, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পাঠ এবং কুরআন তেলাওয়াতের সাথে সাথে যদি মরণ, কবর জীবন ও পরকালের অবশ্যম্ভাবী অবস্থাদির কথাও স্মরণ করা হয় তবে তো সোনায় সোহাগা।
সিনাই পর্বতে তাওরাত আনতে গিয়ে নবী মুসা আলাইহিস সালাম চল্লিশদিন পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত ছিলেন। সায়ির পর্বতে হযরত ঈসার আলাইহিস সালামের ওপর যখন ইনজিল নাযিল হয়, তার আগে তিনিও চল্লিশদিন পর্যন্ত সাওম অবস্থায় কাটান।
তেমনি পবিত্র কুরআন নাযিলের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরার নির্জন গুহায় পুরো একমাস বিশেষভাবে ইবাদতে লিপ্ত থাকেন। অবশেষে সেখানেই সূরা আলাকের শুরুর আয়াতগুলো নাযিল হয়। রহমাতুল্লিল আলামীনের এ ঘটনাটিও সংঘটিত হয়েছে হয়েছে রমযান মাসে। পবিত্র কুরআনে যেমন ইরশাদ হয়েছে,
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ﴾ [البقرة: 185]
'রমযান হলো সেই মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন, আর ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।' {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৫}
মাহে রমযানের যে রাতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সেই রাত্র 'লাইলাতুল (শবে) কদর' নামে অভিহিত। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে একটি পূর্ণ সূরাই নাযিল হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥ ﴾ [القدر: ١- ٥]
'নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি 'লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে 'লাইলাতুল কদর' কী? 'লাইলাতুল কদর' হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।' {সূরা আল-কদর, আয়াত : ০১-০৫}
অপর এক সূরায় এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
﴿حمٓ ١ وَٱلۡكِتَٰبِ ٱلۡمُبِينِ ٢ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣﴾ [الدخان: ١-٣]
'হা-মীম। সুস্পষ্ট কিতাবের কসম! নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।' {সূরা আদ-দুখান, আয়াত : ০১-০৩}
রযমান মাসটি হলো ইবাদতের মওসুম। এ মাসে ইবাদতের গুরুত্ব অনেক বেশি। নানা হাদীসে এ মাসে বিভিন্ন ইবাদতের ছাওয়াব নানাভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন :
ক. এ মাসে একটি উমরা করলে একটি হজ আদায়ের ছাওয়াব হয় এবং তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হজ আদায়ের মর্যাদা রাখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«فَإِنَّ عُمْرَةً فِي رَمَضَانَ تَقْضِي حَجَّةً أَوْ حَجَّةً مَعِي».
'রমযান মাসে উমরা করা আমার সাথে হজ আদায় করার সমতুল্য'। [বুখারী : ১৮৬৩; মুসলিম : ১২৫৬]
উম্মে মা'কাল রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«عُمْرَةٌ فِي رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجَّةً ».
'রমযান মাসে উমরা করা একটি হজের সমান'। [তিরমিযী : ৮৬১]
খ. রমযানে ইবাদতে রাত্রি জাগরণের ফযীলত বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».
'যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকীর প্রত্যাশায় রমযানের রাত্রি জাগরণ করবে তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।' [বুখারী : ৩৭; মুসলিম : ৭৬০; তিরমিযী : ৬১৯]
গ. রমযানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ.
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন, যতটা তিনি অন্য দিনগুলোতে করতেন না।' [মুসলিম : ১১৭৫; তিরমিযী : ৭২৬]
আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
إِنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ.
'রমযানের শেষ দশক এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন এবং তিনি এর রাতগুলোতে নিজে জাগতেন আর পরিবারকেও জাগাতেন।' [বুখারী : ২০২৪; মুসলিম : ১১৭৪; নাসায়ী : ১৬২১]
ঘ. তাছাড়া এ মাসে মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ للهَِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عُتَقَاء فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ وَإِنَّهُ لِكُلِّ مُسْلِمٍ فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ دَعْوَة مُسْتَجَابَة».
'মাহে রমাযানে প্রতিরাত ও দিনের বেলায় বহু মানুষকে আল্লাহ তা'আলা জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে থাকেন এবং প্রতিটি রাত ও দিনের বেলায় প্রত্যেক মুসলিমের দু'আ ও মুনাজাত কবূল করা হয়ে থাকে।' [মুসনাদ আহমদ : ৭৪৫০]
ঙ. যেহেতু রমযান মাসে সবাই রোযা রাখে আর রোযাদারের নেকী অনেক বেশি। স্বয়ং আল্লাহ তাঁর ওপর খুশি হয়ে যান। আল্লাহই তাকে পুরস্কার দেন। আর রোযাদারের জন্য জান্নাতে একটি বিশেষ দরজা বরাদ্দ করা হবে। তাই রোযাদার মাত্রেরই উচিত রমযান মাসে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা।
« إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُون لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ».
'জান্নাতের একটি দরজা আছে। তাকে বলা হয় রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন এই দরজা দিয়ে কেবল রোযাদারগণ প্রবেশ করবেন। তারা ছাড়া এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে রোযাদারগণ কোথায় ? তখন রোযাদারগণ দাঁড়িয়ে যাবেন, তাদেরকে প্রবেশের আদেশ দেওয়া হবে। রোযাদারগণ প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারপর এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।' [বুখারী : ১৮৯৬; মুসলিম : ২৭৬৬]
আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ ، قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ : إِلا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي ، لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ وَلَخُلُوفُ فِيهِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ».
'প্রতিটি আদম সন্তানের নেক কাজের ফল দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আল্লাহ আয্যা ওয়া জাল্লা বলেন, তবে রোযাকে এর মধ্যে গণ্য করা হবে না। কারণ, রোযা কেবল আমারই জন্য। আর আমিই এর প্রতিদান দেব। আমার জন্য সে আহার ও যৌনচাহিদা পরিহার করে। রোযাদারের আনন্দ দু'টি : একটি আনন্দ তার ইফতারের সময়। আরেকটি আনন্দ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আনন্দ। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধির চাইতেও সুগন্ধিময়।' [মুসলিম : ১১৫১; তিরমিযী : ৬৫৯; নাসায়ী : ২১৮৫]
আরেকটি হাদীসে কুদসীতে রয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«قَالَ اللَّهُ : كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ ، وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ ، أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ ، وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ».
'আল্লাহ বলেছেন, রোযা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য; শুধু রোযা ছাড়া। কারণ, তা আমার জন্য। তাই আমিই এর প্রতিদান দেব। রোযা ঢাল স্বরূপ। রোযা রাখার দিন তোমাদের কেউ যেন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করে তাহলে সে যেন বলে আমি রোযাদার। যাঁর হাতে মুহাম্মদের জীবন তাঁর শপথ! অবশ্যই (অনাহারের দরুণ সৃষ্ট) রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও সুগন্ধিময়। রোযাদারের জন্য রয়েছে দু'টি আনন্দের সময় : একটি হলো ইফতারের সময় আর অপরটি (কিয়ামতের দিন) তার প্রভুর সাথে সাক্ষাতের সময়।' [বুখারী : ১৯০৪; মুসলিম : ২৭৬২]
এ মাসের শেষ দশকে ই'তিকাফ করার রয়েছে অনেক গুরুত্ব। ই'তিকাফে বসলে ইবাদতের মওসুম রমযানকে যথার্থভাবে কাজে লাগানো সহজতর হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ই'তিকাফ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ.
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ই'তিকাফ করতেন।' [বুখারী : ২০২৫; মুসলিম : ১১৭১; আবূ দাউদ : ২১০৯] আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। [মুসলিম : ১১৭২]
সুতরাং পবিত্র এ মাসটি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাটানো অর্থাৎ সাওম পালন করা এবং কোনো ইবাদতগাহে একাকী নির্জনে থাকা তথা ই'তিকাফ করা এবং ওহী নাযিলের রাত তথা লাইলাতুল কদরে নির্ঘুম থেকে ইবাদত-বন্দেগী করা ও সিজদানবত থাকা সকল মুসলমানের কর্তব্য, যাতে আমরা নিজেদের ওপর ওই হালত ও অবস্থা সৃষ্টি করতে পারি এই সময়ে যে হালত প্রকাশিত হয়েছিল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর ওপর। যাতে আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত নিয়ামত ও হিদায়াত থেকে আমরা পূর্ণরূপে লাভবান হতে পারি এবং হিদায়াত ও নিআমতের কথা স্মরণ করে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করি। আমরা যেন রমযানকে অর্থ কামাইয়ের মওসুম না বানিয়ে ইবাদতের মওসুম হিসেবেই গ্রহণ করি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে পূর্ণ সাফল্য ও কামিয়াবীর সঙ্গে মাহে রমযান যাপনের তাওফীক দান করুন। আমাদের সকলকে মাহে রমযানে ক্ষমা ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় জায়গা দিন। আমীন। ইয়া রব্বাল আলামীন।