×
এ প্রবন্ধে জি‘রানার পরিচিতি, জি‘রানা মসজিদ, সেখানকার কূপ, সেখানকার কবরস্থান এবং সেখানে হাজীগণ যেসব ভুল করে থাকেন তার বর্ণনা রয়েছে।

    প্রথমত: জি‘রানার পরিচয়: শব্দটি আরবী الجعرانة ‘‘জীম’’ অক্ষর যের, আইন অক্ষর সকূন ‘‘রা’’ অক্ষরটি তাশদীদ ছাড়া। আবার কখনও প্রথম অক্ষর দু’টি যের ও ‘‘রা’’ কে তাশদীদসহ পড়া হয়। এটি মক্কা ও ত্বায়েফের মধ্যবর্তী একটি স্থান। তবে মক্কা থেকে নিকটতম। বর্তমানেও তা এ নামে প্রসিদ্ধ। এটি হারাম সীমানার বাইরে অবস্থিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানেই হুনাইন যুদ্ধের গণীমতের মাল বণ্টন করেন। এখানে একটি মসজিদ রয়েছে যা ‘‘মসজিদে জি‘রানাহ’ নামে পরিচিত। জি‘রানাহ মক্কার হারাম মসজিদ থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।[1]

    দ্বিতীয়ত: জি‘রানার হাকীকত: হজ ও যিয়ারতকারীগণ সাধারণত সেখানকার মসজিদ, কূপ ও কবরস্থানের উদ্দেশ্যে গিয়ে থাকেন। নিম্নে সেগুলোর রহস্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হলো:

    (১) মসজিদে জি‘রানা: মসজিদটি পবিত্র মক্কা থেকে উত্তর পূর্বাংশে ত্বায়েফ (সায়েল) রোডের দিকে রোড থেকে ৯.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মক্কা বিজয়ের বছর ত্বায়েফ যুদ্ধ থেকে ফিরার পর যিলকদ মাসের বার রাত যখন অবশিষ্ট, মঙ্গলবার দিবাগত রাত যে স্থান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমরার ইহরাম বাঁধেন, মসজিদটি সে স্থানে নির্মিত। বহুবার এটির সংস্কার হয়।

    আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

    «اعْتَمَرَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الجِعْرَانَةِ، حَيْثُ قَسَمَ غَنَائِمَ حُنَيْنٍ»

    “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জি‘রানাহ থেকে ইহরাম বাঁধেন যেখানে তিনি হুনাইন যুদ্ধের গণীমতের মাল বণ্টন করেন।”[2]

    মেহরাশ আল-কাবী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «دَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْجِعْرَانَةِ فَجَاءَ إِلَى الْمَسْجِدِ فَرَكَعَ مَا شَاءَ اللَّهُ، ثُمَّ أَحْرَمَ، ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى رَاحِلَتِهِ فَاسْتَقْبَلَ بَطْنَ سَرِفَ حَتَّى لَقِيَ طَرِيقَ الْمَدِينَةِ فَأَصْبَحَ بِمَكَّةَ كَبَائِتٍ»

    “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জি‘রানাহ প্রবেশ করেন। অতঃপর মসজিদে আগমন করে আল্লাহ যে পরিমাণ তাওফীক দান করেন সালাত আদায় করেন। তারপর ইহরাম বেঁধে স্বীয় সাওয়ারীতে আসন গ্রহণ করেন ও বাতনে সারাফ অভিমুখী হন।”[3]

    (২) জি‘রানাহ কূপ: এটি এমন একটি কূপ, বলা হয় তার পানি অতি মিষ্ট। বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তাঁর হাত মুবারক দ্বারা পানির স্থান নির্ণয় করেন। কথিত আছে যে, তিনি তাঁর বর্শা দ্বারা আঘাত করলে সেখান থেকে পানি বের হতে থাকে। ফলে তিনি তা হতে পান করেন এবং লোকেরাও তৃপ্ত হয়।[4]

    বর্তমানে কূপটি বন্ধ, বাহিরের অন্য পানি একাকার হয়ে তা ব্যবহারের যোগ্যতা নষ্ট হওয়ার কারণে তার পানি পান করা হয় না। যেমন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এর রিপোর্ট এমনই প্রকাশ করা হয়।

    (৩) জি‘রানা কবরস্থান: এটি জি‘রানাবাসীদের কবরস্থান। অন্যান্য কবরস্থান থেকে এর স্বতন্ত্র কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। কোনো কোনো হাজী ধারণা করেন যে, সেখানে হুনাইন যুদ্ধের নিহতদের দাফন করা হয়েছে। মূলতঃ তার কোনো বিশুদ্ধতা নেই। কেননা সে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এ স্থানের দূরত্ব অনেক, অন্য দিকে তা এক উপত্যকার অন্তর্ভুক্ত।

    তৃতীয়ত: কোনো কোনো হাজী দ্বারা এখানে যে সমস্ত বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী কর্ম ঘটে থাকে:

    কতিপয় হাজী জি‘রানায় বেশ কিছু বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী কর্মে লিপ্ত হয়। কারণ হলো, তারা এ স্থানের বিশেষ পবিত্রতা ও পৃথক বৈশিষ্ট্যে বিশ্বাসী। এর ভ্রান্তি সম্পর্কে পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যাতে হাজীগণ সে সমস্ত বিদ‘আত ও কুসংস্কার থেকে সতর্ক হয়। সেখানে যেসব ভুল-ভ্রান্তি ও বিদ‘আত সংঘটিত হয় তার কিছুর প্রতি নিম্নে ইঙ্গিত করা হলো:

    ১। বিশেষ ইবাদতের নিয়তে সে মসজিদ অভিমুখী হওয়া এবং অন্যান্য মসজিদ হতে এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিশ্বাস করা।

    ২। অন্য মসজিদ হতে এ মসজিদের ফযীলত বেশি মনে করা।

    ৩। সেখানে বেশি বেশি দো‘আ করা।

    ৪। তার ভিতরে-বাইরে সম্মিলিতভাবে দো‘আ করা। অথচ এটি এমন আমল যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি, না তাঁর সাহাবীগণ, না তাবে‘ঈগণ করেছেন।

    ৫। তার দেয়ালে লেখা-লেখি করা।

    ৬। তার দেয়ালের বরকত গ্রহণ, দরজা স্পর্শ করা এবং তার ধুলো-বালি গ্রহণ করা।

    ৭। বিভিন্ন আকীদা-বিশ্বাসে মসজিদের বিভিন্ন অংশে লিখিত ম্যাসেজ, কবিতা, চিত্র স্থাপন করা বা পয়সা রাখা।

    ৮। কবরের মৃতদেরকে উসীলা হিসেবে গ্রহণ, তাদের নিকট ফরিয়াদ করা এবং তাদের নিকট সুপারিশ কামনা করা।

    ৯। কবরস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি। যেমন, তাদের কবরের সামনে দীর্ঘক্ষণ দণ্ডায়মান থাকা। বিনয়-নম্রতা প্রকাশ ও নীরবতা অবলম্বন করা। এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, এমন করা শরী‘আতসম্মত আদবের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হলো কবরবাসীদের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ি। যা কবরবাসীদের দ্বারা শির্কে পতিত হওয়ার কারণ ও মাধ্যম।

    ১০। কবরগুলো হতে ধুলা-বালি গ্রহণ ও তা স্পর্শ করা বা তা অন্য জিনিসের সাথে এমন মনে করে মিলানো যে, তা দ্বারা বরকত ও আরোগ্য লাভ হবে।

    ১১। প্রয়োজন পূরণ ও তাদের দ্বারা বিপদাপদ হতে মুক্ত হওয়ার জন্য কবরবাসীদের প্রতি বিভিন্ন ম্যাসেজ লেখা।

    ১২। বরকত পাওয়ার আশায় কবরস্থানের দেয়াল, দরজা ও সেখানকার বিভিন্ন জিনিস স্পর্শ করা।

    ১৩। জি‘রানাহ মসজিদের পানি দ্বারা বরকত গ্রহণ ও আরোগ্যের নিয়ত করা এবং তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এমন বিশ্বাস করা। অথচ তার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। না জি‘রানাহ কূপের তার সাথে কোনো সম্পর্ক রয়েছে; বরং বর্তমানে তা বন্ধ অবস্থায় আছে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

    [1] মু‘জামুল বুলদান: ১/১৪২; আল-কামূসুল মুহীত: ৩৪৩ পৃ.; আন-নেহায়া: ১/২৬৯; তারীখে মক্কা: ১০৫ পৃ. ইত্যাদি।

    [2] সহীহ বুখারী: ৪/৭৩, ৩০৬৬G

    [3] আবু দাউদ: ২/২০৬, ১৯৯৬, আলবানী রহ. সহীহ বলেছেন।

    [4] আল-ফাকেহীর আখবার মক্কা: ৫/৬৯ ইত্যাদি।