×
এই নিবন্ধে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাষায় শরয়ী পোশাকের গুরুত্ব এবং এর অবর্তমানে নেমে আসা বিপদাপদের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

    পোশাক যখন বিপদের কারণ

    [বাংলা - bengali - البنغالية ]

    লেখক: আলী হাসান তৈয়ব

    সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    2011 - 1432

    ﴿ عندما يكون اللباس سببًا للمصائب ﴾

    « باللغة البنغالية »

    علي حسن طيب

    مراجعة: الدكتور محمد منظور إلهي

    2011 - 1432

    পোশাক যখন বিপদের কারণ

    আলী হাসান তৈয়ব

    মানুষ যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যসব প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে তার অন্যতম পোশাক। মানুষের মতো অন্য প্রাণীরাও খায়, ঘুমায় এবং জৈবিক চাহিদা মেটায়। তারাও তাদের আব্রু ঢাকে। তবে তা প্রকৃতির নিয়মে। প্রাণীরা মানুষের মতো আপন লজ্জাস্থান ঢাকে না ঠিক। তবে আল্লাহ তাআলা জন্মগতভাবেই তাদের লজ্জাস্থান স্থাপন করেছেন কিছুটা আড়ালে। প্রাণীদের মধ্যেও আছে লজ্জার ভূষণ। তাই দেখা যায় পেশাব করার সময় কুকুরের মতো নির্লজ্জ প্রাণীও পা উঁচিয়ে আব্রু ঢাকে। মানুষ তাহলে আব্রু ঢাকায় পশুর চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে কীভাবে? হ্যা, মানুষও লজ্জা নিবারণ করে ঠিক কিন্তু তা পরিশীলিত পোশাক ও আকর্ষণীয় বেশ-ভূষার মাধ্যমে। যে কেউ চাইলেই দেখতে পারে পশুর লজ্জাস্থান। পক্ষান্তরে মানুষের লজ্জাস্থান এতোটা সুরক্ষিত ও আচ্ছাদিত যে তার সম্মতি ছাড়া অন্যের চোখ সেখানে পৌঁছতে অক্ষম।

    মানুষের এই বৈশিষ্ট্যের কথা একেবারে ভুলে গেছে অমুসলিম দুনিয়া। কিন্তু কী বলবো দুঃখের কথা, অমুসলিমদের পর এবার মুসলিম মেয়েরা যেন এ বৈশিষ্ট্য জলাঞ্জলী দিতে বসেছে! মুসলিম রমণীদের পোশাকেও নেই মার্জিত রুচি বা ভদ্রতার লেশ! স্যাটেলাইট প্রযুক্তির যুগে তরুণীদের পোশাকের কথা বলতে গেলে, তাদের লজ্জা নিবারণের নির্লজ্জ কোশেশের চিত্র তুলে ধরলে আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিরাও হয়তো ভাষায় লজ্জার অভাব আছে বলে অভিযোগ তুলবেন। তাই এর বিস্তারিত বিবরণে যাব না। শুধু ইঙ্গিত দেব। ‘আকলমন্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি’।

    যখনই আমি কোনো টেইলার্সের সামনে দিয়ে যাই অবাক হয়ে দেখি সেখানে বড়দের কোনো পোশাক নেই। কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেসই করে বসি, ‘ভাই আপনাদের এখানে কি শুধু ছোট মেয়েদেরই সেলোয়ার-কামিস বানানো হয়’? আমাকে বোকা ভেবে তারা উত্তর দেয়, ‘কেন এগুলো সবই তো বড়দের জামা। আরে ভাই বোঝেন না এ যুগের জামাগুলো তো এমনই।’ ইদানীং মেয়েদের পোশাক দেখলে মনে হয় দেশের সব কাটিং মাস্টারই চোর। আর তাঁত শিল্পীরা সব হাড়কিপটে। নাকি শুধু গায়ের কাপড় কিনতে গিয়েই মেয়েরা অর্থ সংকটে পড়ে? নয়তো কেন এই সংক্ষেপন প্রতিযোগিতা? কার পোশাক কত সংক্ষিপ্ত হতে পারে তা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা?

    মেয়েদের সেলোয়ার-কামিসই শুধু নয়; বলতে গেলে সেলোয়ার-কামিসের প্রায় প্রতিটি অংশই কাপড় বাঁচানোর অশোভন প্রয়াসের নিরব সাক্ষী। ওপর থেকেই বলতে শুরু করি : জামার কলার ছোট হতে শুরু করেছে। পিঠের অর্ধাংশও বলতে গেলে অনাবৃত। হাতা ছোট হতে হতে ফুলহাতা, হাফহাতা থেকে থ্রি কোয়ার্টার ছাড়িয়ে বাহু পর্যন্ত কেটে পড়েছে। কোমরের কাছে এসে তা যেন আরও বেশি উদ্ধমুখী। আর সেলোয়ারের অবস্থাও তথৈবচ। বড় দৃষ্টিকটুভাবে তার কোমরে কাঁচির কামড় লেগেছে। কোমর থেকে ক্রমশ সরু হতে হতে পায়ের গোছায় গিয়ে হঠাতই যেন কাপড়ে টান পড়েছে। তারপর পায়ের গোড়ালীর কাছে এসে আবার তা চিরে দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়েছে। কেউ হয়তো বলবেন, আমি কিভাবে এত সবের খবর রাখি? বলি, মা, বোন বা স্ত্রী তো আমাদেরও আছে। নিকটাত্মীয় যেসব বোনেরা বেপর্দায় চলে তাদেরকে বুঝানোর দায়িত্ব তো আমারই ওপর। আমিই তো তাদের শোধরানোর জন্য এসবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

    মা-বোনরা এতক্ষণে বুঝি আমার ওপর যথেষ্ট চটেছেন। ভাবছেন, লোকটার হলো কী? শুধু মেয়েদের বিরুদ্ধেই কেন তার কলম সরব? দয়া করে আপনারা গোস্বা করবেন না। আমরা- এই পুরুষরাও আজ পোশাক আগ্রাসনের শিকার। অশ্লীলতা আর রুচির বিকারে আমরাও জর্জরিত। ইদানীং ছেলেরাও ঝুঁকেছে টাইট পোশাকের দিকে। মেয়েরা যদি হয় স্বল্প বসনা, ছেলেরা তবে হতে চলেছে টাইট ফ্যাশনপ্রিয়। আপনারা যদি যাত্রা শুরু করে থাকেন পুরুষ হবার পথে, আমরাও তবে হাঁটতে শুরু করেছি আপনাদের পেছনে। আপনাদের চুল হয়ে আসছে ছোট আর আমাদেরটা বড়। নতুনত্বের সন্ধানে আপনারা পরছেন আমাদের প্যান্ট-শার্ট আর আমরা পরছি আপনাদের সেলোয়ার কামিস। ইদানীং ছেলেরা যেসব ওড়নাওয়ালা পাঞ্জাবি পরছে তা তো আপনাদের কামিসেরই অপভ্রষ্ট রূপ। ছেলেদের পাজামাগুলোর প্রতি দেখুন অবিকল মেয়েদের সেলোয়ার!

    ছেলেদের প্যান্টগুলো এত টাইট যে সেটি পরে পেশাব করতে বসা যায় না। এ জন্যই আজ সর্বত্র কমোড টয়লেটের কদর বাড়ছে। নামাজে রুকুতেও যাওয়া যায় না ভালোমতো। বেল্ট মোড়ানো হলেও রুকু অবস্থায় মেরুদণ্ডের বিলীয়মান অংশও তাতে বেরিয়ে পড়ে। আর তাদের গেঞ্জিগুলো যেন হয়ে উঠেছে চারুকলার শিক্ষানবিশদের প্রদর্শনীর গ্যালারি। আপনি গেঞ্জি কিনতে গেলে দেখবেন প্রাণীর ছবি ছাড়া কোনো গেঞ্জিই খুঁজে পাচ্ছেন না। গেঞ্জির হাতাগুলো এতই সরু ও অপ্রশস্ত যে রোগা ও চিকন বাহুর পেশিগুলো পর্যন্ত তাতে ঠিকরে বেরুতে চায়।

    আপনি দেখবেন, ক’দিন পরপরই নানা নামে নানা ডিজাইনের কাপড় পরছে ছেলে-মেয়েরা। এসবই বাজারে নামে মিডিয়ায় তার নমুনা দেখার পর। ইদানীং ঈদ এলেই দেখা যায় কত নামের কাপড়। ফ্যাশন হাউজগুলোর অবস্থা এখন পোয়াবারো। এরা নিত্য নতুন কাপড়ের ডিজাইন বাজারে ছাড়ে। মিডিয়ায় যখন যে নাম বেশি উচ্চারিত হয় সে নামেই পোশাক বের করা হয়। গত ফুটবল বিশ্বকাপে একটি অক্টোপাসকে নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় ঝড় উঠেছিল। সেই বিশ্বকাপ নামের বিশ্বপাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাকি শাকিরা নামে একটি সাদা মেয়ে গান গেয়েছিল। এবার ঈদে ছোট বোনের কাপড় কিনতে গিয়ে দেখলাম শাকিরা, অক্টোপাস, ওয়াকা ওয়াকা, মনপুরা, আনারকলি আরও কত নামের পোশাক।

    আমরা সবাই জানি, বর্তমানে সারা দেশে সবচে আলোচিত বিষয় ইভটিজিং। পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিদিন চোখে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তের ইভটিজিংয়ের খণ্ডচিত্র। ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় নাটোরে প্রাণ হারাতে হলো জাতিগড়ার কারিগর খ্যাত একজন প্রতিবাদী শিক্ষককে। ঘটনার পর দিনই ফরিদপুরে এ কাজে বাধা দিতে গিয়ে বখাটের হাতে প্রাণ হারালেন এক মা। তার পরদিন নওগাঁয় তিনজনকে আহত করা হলো একই কারণে। নড়েচড়ে উঠলো সারা দেশ। শুরু হলো ইভটিজিং বিরোধী নানা কর্ম-তৎপরতা। কোথাও দেখা যাচ্ছে সচেতন জনতা এগিয়ে আসছেন বখাটেদের দমনে, কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, কোথাও খোদ মেয়েরা। টাঙ্গাইলের একটি চমকপ্রদ খবরও চোখে পড়ল। সচিত্র এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বখাটেদের শায়েস্তা করতে মেয়েরা কারাতে শিখছেন। সরকারিভাবেও বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হলো। হাইকোর্ট থেকেও ইভটিজিং প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হলো। এতসব উদ্যোগ-আয়োজনের ব্যর্থতার ষোলকণা পূর্ণ করে রোজই বেড়ে চলেছে ইভটিজিং ভাইরাসের প্রকোপ। কত পন্থায় যে হররোজ ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটছে তার ওপর রীতিমত একটি অভিসন্দর্ভ পর্যন্ত লিখে ফেলা যায়।

    বলছিলাম সমস্যার গোড়ায় হাত দেয়ার কথা। গাছের গোড়া কেটে দিয়ে মিনারেল ওয়াটার কিংবা এরচেয়ে বিশুদ্ধতর পানিও যদি তার মাথায় ঢালা হয়, তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। গাছটি কিন্তু মৃত্যুর পথেই হাঁটবে। নানা মুনী নানা মত দিয়ে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উত্তরোত্তর ইভটিজিং সমস্যা বেড়েই চলেছে। জানি না কাকতালীয় কি-না, যেদিন বোরকা পরাকে কেন্দ্র করে কাউকে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না মর্মে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত রায় দিলো। তারপর থেকে সহসাই যেন ইভটিজিংয়ের ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে চললো। ইভটিজিং শব্দটি ঝড় তুললো প্রতিটি চায়ের টেবিলে। মিডিয়ার সিংহভাগ স্থান দখল করে নিতে লাগলো এই অশুভ শব্দটি।

    সত্যি কথা হলো ইভটিজিংয়ের অধিকাংশ ঘটনার পেছনেই রয়েছে এই অশ্লীল পোশাকের হাত। ইভটিজিং বন্ধ করতে হাজার মত আর শত উদ্যোগ নয় পোশাকে শালীনতা আর রুচিতে মার্জিত বোধের বিকাশই পারে ইভটিজিং প্রতিরোধে সবচে কাযর্কর ভূমিকা রাখতে। প্রথম ঘটনায় দেখুন একজন ধার্মিক ভদ্রলোক কতটা বিরক্ত এই অরুচিকর পোশাকের ওপর। দ্বিতীয় ঘটনায় দেখুন অশ্লীল পোশাক কেমন বিপদ ডেকে আনে। তৃতীয় ঘটনায় দেখুন ইভটিজিং প্রতিরোধে মেয়েদের পোশাকে শালীনতা আনা কত জরুরী। মহিলার এমন উগ্র পোশাকই তো পুরুষদের ডেকে এনেছে তার আশপাশে। মেয়েদের অভব্য পোশাকই তো ছেলেদেরকে নারীদের প্রতি আগ্রহী ও লোলুপ করে।