×
এ নিবন্ধে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামী মিডিয়ার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও এর তীব্র প্রয়োজনীয়তার কথা কুরআন-সুন্নাহ ও বাস্তবতার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে।

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

    ইসলামী মিডিয়া প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

    [ বাংলা - bengali - البنغالية ]

    লেখক: আলী হাসান তৈয়ব

    সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    2011- 1432

    ﴿ الإعلام الإسلامي: ضرورته وأهميته ﴾

    « باللغة البنغالية »

    علي حسن طيب

    مراجعة: الدكتور محمد منظور إلهي

    2011 - 1432

    ইসলামী মিডিয়া প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

    আলী হাসান তৈয়ব

    আমরা সবাই জানি বর্তমানে মিডিয়া কিভাবে আমাদের জীবনে স্থান করে নিয়েছে। মিডিয়ার হামলা আর আগ্রাসন থেকে আজ আমরা কেউই নিরাপদ নই। সবার ঘরে ঘরে মিডিয়া ঢুকে পড়েছে। প্রতিটি বাড়িতেই টিভি নামের আধুনিক আবিষ্কার জায়গা করে নিয়েছে। শুধু বাড়িতে কেন, প্রতিটি দোকানে দেখা যাচ্ছে টিভি। শহর বলেন আর গ্রাম বলেন- সর্বত্র আজ আধুনিক মিডিয়া থাবা বিস্তার করেছে। মোবাইল-কম্পিউটার এসে যেন মিডিয়ার পালে আরও হাওয়া দিয়েছে। সবার ঘরে ঘরে ঢোকার পর মিডিয়া ঢুকে পড়েছে এখন সবার পকেটে পকেটে। পৌঁছে গেছে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার হাতে হাতে। আমরা যারা টিভির করাল গ্রাসে আটকা পড়িনি, তারা কিন্তু মোবাইলের এফএম রেডিও আর খবর-কাগজকে উপেক্ষা করতে পারি না। খবরের কাগজ আমরা সবাই পড়ি।

    মিডিয়াগুলো যদি শুধু ন্যায় ও সুন্দরের পথ দেখাতো, অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো, তাহলে আমরা একে সাধুবাদ জানাতাম। আসলে এটিই কিন্তু মিডিয়ার দায়িত্ব। দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখি, মিডিয়া সে দায়িত্ব পালন না করে শুধু মন্দের প্রচারেই অধিক ব্যস্ত। মন্দ আর অসুন্দরের সঙ্গেই তার যত সখ্য। টিভি চ্যালেনগুলোতে কী দেখানো হয়? পাঠক, আপনারাই বলুন এগুলোতে কী দেখেন আপনারা? আমি জানি, আপনারা কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন না। চ্যালেনগুলোতে প্রচারিত হয় শুধু নাটক-সিনেমা আর চরিত্রবিধ্বংসী সব বিজ্ঞাপন। সংবাদ যাও প্রচার হয় তাও দেখা যায় সব নেতিবাচক। তদুপরি তাতে আগ্রহ বেশি ওই নাটক-সিনেমা আর খেলাধুলার জগতের প্রতিই।

    অনেকে আবার টেলিভিশন দেখার উপকারিতাও বয়ান করেন। তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন, আপনারা যেসব উপকারিতা ও ইতিবাচক দিক তুলে ধরেন তার কয়টি আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। নাটক-সিনেমা আমাদের সমাজে খুব কমই ইতিবাচক চিত্র উপহার দিতে পারছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নাকি জ্ঞান অর্জন হয়! জ্ঞান অর্জন হয় বললেই যথেষ্ট নয়। বলতে হবে ভালো না মন্দ জ্ঞান অর্জন হয় তাও। সত্য উচ্চারণ করলে এ কথা না বলে উপায় নেই যে চলচ্চিত্র থেকে মানুষ শুধু মন্দ জ্ঞানটাই নেয়। চলচ্চিত্রে হয়তো ভালো ও উপদেশমূলক দিকও থাকে; কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করে না। গ্রহণ করে কেবল মন্দটা। তাইতো মিডিয়ায় প্রায়ই উচ্চারিত হয় 'ফিল্মি স্টাইলে' হামলা বা ছিনতাই ইত্যাদি। এই শব্দটিই প্রমাণ করে সন্ত্রাসীরা সিনেমা থেকে সবক নেয় বেশি। তরুণ-তরুণীরা সবক নেয় কীভাবে প্রেম করতে হবে আর কীভাবে মা-বাবাকে ফাঁকি দিতে হবে। বর্তমানের নাটক-সিনেমা আর উপন্যাসের কয়টি আছে যা কেবল প্রেম-ভালোবাসা আর পরকীয়া শেখায় না? সব নাটক-সিনেমা আর গানের উপজীব্য সেই একইÑ তথাকথিত প্রেম আর ভালোবাসা।

    প্রশ্ন হলো, আমাদের মিডিয়াগুলোর এ অবস্থা কেন? কারণ মিডিয়াগুলো অনুসরণ করে হিন্দুস্তানি নাটক-সিনেমার। আর হিন্দুস্তানিরা অনুসরণ করে পশ্চিমাদের। পাশ্চাত্যের অনুকরণ এত বেশি করা হয় যে একে কেবল অন্ধ অনুকরণ হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়। তারপর এই মিডিয়াগুলোর অন্ধ অনুকরণ করে আমাদের তরুণ-তরুণীরা। আপনি দেখবেন, ক'দিন পরপরই নানা নামের নানা ডিজাইনের কাপড় পরছে ছেলে-মেয়েরা। এসবই বাজারে নামে মিডিয়ায় তার নমুনা দেখার পর।

    ইদানীং ঈদ এলেই দেখা যায় কত নামের কাপড়। ফ্যাশন হাউজগুলোর অবস্থা এখন পোয়াবারো। এরা নিত্য নতুন কাপড়ের ডিজাইন বাজারে ছাড়ে। মিডিয়ায় যখন যে নাম বেশি উচ্চারিত হয় সে নামেই পোশাক বের করা হয়। গত ফুটবল বিশ্বকাপে একটি অক্টোপাসকে নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় ঝড় উঠেছিল। সেই বিশ্বকাপ নামের বিশ্বপাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাকি শাকিরা নামে একটি নির্লজ্জ মেয়ে গান গেয়েছিল। এবার ঈদে ছোটবোনের কাপড় কিনতে গিয়ে দেখলাম শাকিরা, অক্টোপাস পল, ওয়াকা ওয়াকা, মনপুরা, আনারকলি আরও কত নামে কাপড় বেরিয়েছে।

    এই হলো মিডিয়ার অবস্থা। এমতাবস্থায় যারা ইসলাম নিয়ে ভাবেন, ইসলামের প্রসারই যাদের কাম্য ও কর্ম, তাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। শুধু মিডিয়াকে বকাঝকা করাই তাদের কর্তব্য নয়। তাদের দায়িত্ব সুস্থ মিডিয়া এবং নির্দোষ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা। ইসলাম প্রচারে মিডিয়াকে কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,

    ﴿وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴾

    'আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত?' [1]

    আল্লাহ তা'আলা আরও বলেন,

    ﴿قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾

    'বল, 'এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।'[2]

    নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    لَأَنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلًا وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ

    'আল্লাহ যদি তোমার মাধ্যমে একজনকে হেদায়েত দেন তবে তা লাল উটের চেয়ে উত্তম।'[3]

    তিনি আরও ইরশাদ করেন, بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً

    'তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাক্য হলেও পৌঁছে দাও।'[4]

    উল্লেখিত কুরআনের আয়াত ও হাদিসের আলোকে বলা যায়, প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য নবী-রাসূল, সমাজসংস্কারক ও আল্লাহর পথে একনিষ্ঠভাবে আহ্বানকারী পুণ্যবান ব্যক্তিদের পথ অনুসরণ করা। তাঁদের অনুবর্তিতায় দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে মনে রাখতে হবে, সমকালে মানুষের জীবনযাপনের ধরন বদলেছে। অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়েছে প্রযুক্তির সকল শাখায়। ফলে মানুষের ওপর সরাসরি ছাপ রাখার পদ্ধতিও বদলেছে। বিশ্বজুড়ে ভিন্নতা এসেছে দাওয়াত ও প্রচার কৌশলে।

    আগে সমাজ সংস্কারকগণ বাজারে, মসজিদে ও বিভিন্ন লোক সমাগমস্থলে গিয়ে মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতেন। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে একজন দায়ী (আল্লাহর পথে আহ্বানকারী) ঘরে বসেই রেডিও, টিভি, সিডি, বই ও পত্র-পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে দাওয়াত পৌঁছাতে পারেন কোটি কোটি লোকের দুয়ারে। এটিকে সহজ ও গতিশীল করেছে আন্তর্জাতিক তথ্যবিনিময় মাধ্যম তথা ইন্টারনেট। সন্দেহ নেই আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকার এক চমৎকার মাধ্যম এসব মিডিয়া। মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে আমরা বৃহত্তর অঙ্গনে দীন প্রচার করতে পারি।

    সুতরাং মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার জন্য নানা উপায়ে কাজ করা দরকার। এই উপায়গুলোই আজ মিডিয়া আকারে কাজ করছে। মিডিয়ার মধ্যে রয়েছে দর্শন, শ্রবণ ও পঠন তথা টিভি, রেডিও ও পত্র-পত্রিকাÑ এই তিন ধরনের মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সম্ভাব্য সব মাধ্যম কাজে লাগিয়ে তাঁর দীন প্রচার করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

    ১. সূরা ফুসসিলাত : ৩৩।

    ২. সূরা ইউসূফ : ১০৮।

    ৩. বুখারী : ৩০৭।

    ৪. বুখারী ৩৪৬১।