×
ইসলামে বিবাহ বিধিবদ্ধ করার হিকমত, বৈবাহিক জীবনের প্রতি উৎসাহ দান এবং নারীদের মধ্যে কাদেরকে স্থায়ী অথবা সাময়িকভাবে বিবাহ করা হারাম -এসব বিষয়ে সুন্দর আলোচনা উঠে এসেছে বর্তমান প্রবন্ধে।

    যে সকল মহিলাকে বিবাহ করা হারাম

    ইসমাঈল যাবিহুল্লাহ

    সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    المحرمات من النساء

    (باللغة البنغالية)

    إسماعيل ذبيح الله

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............

    ইসলামে বিবাহ বিধিবদ্ধ করার হিকমত, বৈবাহিক জীবনের প্রতি উৎসাহ দান এবং নারীদের মধ্যে কাদেরকে স্থায়ী অথবা সাময়িকভাবে বিবাহ করা হারাম -এসব বিষয়ে সুন্দর আলোচনা উঠে এসেছে বর্তমান প্রবন্ধে।

    যে সকল মহিলাকে বিবাহ করা হারাম

    আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বংশ পরম্পরায় মানব প্রজন্মকে দুনিয়ায় টিকিয়ে রেখে দুনিয়াকে আবাদ রাখার জন্য বিবাহ বন্ধনকে বৈধ করেছেন। এটাকে আল্লাহ তা‘আলার একটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি ও সিস্টেম। এ ছাড়া বিবাহের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন গঠন করা নবীদেরও সুন্নাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلٗا مِّن قَبۡلِكَ وَجَعَلۡنَا لَهُمۡ أَزۡوَٰجٗا وَذُرِّيَّةٗۚ﴾ [الرعد: ٣٨]

    “নিশ্চয় আমরা আপনার পূর্বে অনেক রাসূলকে প্রেরণ করেছি। আমরা তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করেছি।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ৩৮]

    বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদর্শ। আমাদের জীবনে আমরা কোনো কাজ কীভাবে করব? -রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।

    আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «جَاءَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا فَقَالُوا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّي أُصَلِّي اللَّيْلَ أَبَدًا وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلَا أُفْطِرُ وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلَا أَتَزَوَّجُ أَبَدًا فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ أَنْتُمْ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي».

    “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের বাড়িতে তিনজন লোক আসল। তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করল, তাঁর ইবাদত কেমন ছিল? তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদত সম্পর্কে তাদেরকে জানালে তারা সেটাকে খুবই কম মনে করলেন। তারা বললেন: কোথায় নবী (মর্যাদার দিক থেকে) আর কোথায় আমরা? কারণ, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুর্ব ও পরবর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের একজন বলল: আমি এখন থেকে সর্বদা সারা রাত সালাত আদায় করব। দ্বিতীয়জন বলল: আমি এখন থেকে আজীবন (সাওমে দাহর) সাওম রাখতে থাকব। সাওম ভাঙ্গবো না। তৃতীয়জন বলল: আমি আজীবন নারী সঙ্গ থেকে দূরে থাকব, বিবাহ করব না কখনো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে এসে বললেন: তোমরা এমন সব কথা বলছিলে! জেনে রাখ! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের থেকে আল্লাহকে অনেক বেশি ভয় করি। এতদসত্ত্বেও আমি সাওম পালন করি আবার সাওম ছেড়ে দিই, সালাত আদায় করি, ঘুমাই এবং বিবাহ করি। যে ব্যক্তি আমার এ সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে আমার উম্মত নয়।”[1]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

    «يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاء»

    “হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যকার যে সামর্থবান সে যেন বিবাহ করে। কেননা, তা তার দৃষ্টি নিম্নগামী রাখতে ও লজ্জাস্থানকে হিফাযত করায় সহায়ক হয়। আর যে বিবাহের সামর্থ রাখে না, সে যেন (তার পরিবর্তে) সাওম পালন করে। কেননা তা তার জন্য ঢালস্বরূপ (অনেক অপরাধ থেকে রক্ষা করে)।”[2]

    এবার আসুন! আমরা দেখে নিই কাদেরকে বিবাহ করা বৈধ এবং কাদেরকে বিবাহ করা বৈধ নয়।
    আল্লাহ তা‘আলা এ সম্বন্ধে কুরআন মজীদে বলেন:

    ﴿حُرِّمَتۡ عَلَيۡكُمۡ أُمَّهَٰتُكُمۡ وَبَنَاتُكُمۡ وَأَخَوَٰتُكُمۡ وَعَمَّٰتُكُمۡ وَخَٰلَٰتُكُمۡ وَبَنَاتُ ٱلۡأَخِ وَبَنَاتُ ٱلۡأُخۡتِ وَأُمَّهَٰتُكُمُ ٱلَّٰتِيٓ أَرۡضَعۡنَكُمۡ وَأَخَوَٰتُكُم مِّنَ ٱلرَّضَٰعَةِ وَأُمَّهَٰتُ نِسَآئِكُمۡ وَرَبَٰٓئِبُكُمُ ٱلَّٰتِي فِي حُجُورِكُم مِّن نِّسَآئِكُمُ ٱلَّٰتِي دَخَلۡتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمۡ تَكُونُواْ دَخَلۡتُم بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ وَحَلَٰٓئِلُ أَبۡنَآئِكُمُ ٱلَّذِينَ مِنۡ أَصۡلَٰبِكُمۡ وَأَن تَجۡمَعُواْ بَيۡنَ ٱلۡأُخۡتَيۡنِ إِلَّا مَا قَدۡ سَلَفَۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ٢٣ ۞وَٱلۡمُحۡصَنَٰتُ مِنَ ٱلنِّسَآءِ إِلَّا مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۖ كِتَٰبَ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡۚ وَأُحِلَّ لَكُم مَّا وَرَآءَ ذَٰلِكُمۡ﴾ [النساء: ٢٣، ٢٤]

    “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা,কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে, দুধমাতা, দুধ বোন, শাশুড়ী, দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এমন স্ত্রীর অন্য ঘরের যে কন্যা তোমার লালন পালনে আছে; যদি তাদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত না হয় তাহলে, তাকে বিবাহ করাতে দোষ নেই। এ ছাড়া তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী, ও একত্রে দুই সহদরা বোনকে বিবাহাধীনে রাখা। তবে, আয়াত নাযিলের পুর্বে যা হয়ে গেছে তা আলাদা। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর (শরী‘আতসম্মত পন্থায় প্রাপ্ত) ক্রীতদাসী ব্যতিত বিবাহিতা (যে অন্যের বিবাহাধীনে আছে) মহিলাদেরকেও তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। এদের বাইরে যে কোনো (মুসলিম বা আহলে কিতাব) মহিলাকে তোমাদের জন্য বিবাহ করা বৈধ করা হয়েছে। এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট। [সুরা আন-নিসা, আয়াত: ২৩-২৪]

    যে সমস্ত মহিলাদেরকে বিবাহ করা হারাম তাদেরকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

    • স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ মহিলা: তারা তিন শ্রেণির:

    ক. বংশগত কারণে নিষিদ্ধ: তারা হচ্ছেন-

    ১. মাতা

    ২. দাদী

    ৩. নানী

    ৪. নিজের মেয়ে, ছেলের মেয়ে, মেয়ের মেয়ে যত নিচেই যাক না কেন।

    ৫. আপন বোন, বৈমাত্রেয় বোন ও বৈপিত্রেয় বোন।

    ৬. নিজের ফুফু, পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা ও নানীর ফুফু।

    ৭. নিজের খালা, পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা ও নানীর খালা।

    ৮. আপন ভাই, বৈমাত্রেয় ভাই ও বৈপিত্রেয় ভাই ও তাদের অধঃতন ছেলেদের কন্যা।

    ৯. আপন বোন, বৈমাত্রেয় বোন ও বৈপিত্রেয় বোন ও তাদের অধঃতন মেয়েদের কন্যা।

    খ. দুগ্ধ সম্বন্ধীয় কারণে নিষিদ্ধ:

    বংশগত কারণে যাদেরকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ দুগ্ধ সম্বন্ধের কারণেও তারা নিষিদ্ধ।

    গ. বৈবাহিক সম্বন্ধের কারণে নিষিদ্ধ:

    ১. পিতা, দাদা ও নানা (যতই উপরে যাক না কেন) যাদেরকে বিবাহ করেছেন।

    ২. কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক বা না হোক উক্ত পুরুষের পুত্র-পোত্র বা প্রপৌত্রের সাথে মহিলার বিবাহ নিষিদ্ধ।

    ৩. কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক বা না হোক উক্ত পুরুষের পিতা-দাদা বা নানার সাথে মহিলার বিবাহ নিষিদ্ধ।

    ৪. শাশুড়ী। মহিলার সাথে বিবাহ হলেই তার মাতা ও দাদী বা নানী হারাম হয়ে যাবে। দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক বা না হোক।

    ৫. স্ত্রীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেই তার কন্যা, তার পুত্রের কন্যা ইত্যদি হারাম হয়ে যাবে।

    • সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ মহিলা:

    সাময়িক কারণে কখনো কখনো মহিলাকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ হয়ে থাকে। উক্ত কারণ দূর হয়ে গেলে তাকে বিবাহ করা বৈধ হবে।

    ১. কোনো মহিলাকে বিবাহ করলেই তার আপন বোন, ফুফু, খালাকে বিবাহ করা হারাম গণ্য হবে। তবে, তাকে যখন তালাক দিয়ে দিবে কিংবা স্বামী মারা যাবে এবং সে ইদ্দত শেষ করবে তখন তাকে সে বিবাহ করতে পারবে।

    ২. যে মহিলা অন্যের বিবাহাধীনে ছিল। তাকে স্বামী তালাক দিয়েছে কিংবা মারা গেছে এবং সে ইদ্দত পালন করছে; এমতাবস্থায় তাকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ। ইদ্দত শেষ হয়ে গেলেই বিবাহ করতে পারবে।

    অনেকে জিজ্ঞাসা করে থাকেন যে, খালাতো, মামাতো, ফুফাতো বা চাচাতো বোনকে বিবাহ করা যাবে কিনা?

    তার উত্তর হচ্ছে -আসলে আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াতে যাদের সাথে বিবাহ করা নিষিদ্ধ সকলের কথাই বলে দিয়েছেন। খালাতো, মামাতো, ফুফাতো বা চাচাতো বোন তাদের মধ্যকার কেউ নন। অতএব, তাদেরকে বিবাহ করা বৈধ।

    এমনকি, চাচা মারা গেলে বা তালাক দিয়ে দিলে চাচীকে বিবাহ করার বৈধতাও ইসলাম দিয়েছে, তবে তাদেরকে বিবাহ করবেন কি করবেন না সেটা আপনার ইচ্ছা।

    সমাপ্ত

    [1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৬৩।

    [2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৬৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪০০; আবূ দাঊদ, হাদীস নং ২০৪৬; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৮৪৫; দারেমী, হাদীস নং ২২১১; নাসাঈ, হাদীস নং ২২৪০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৪০২৩।