×
প্রবন্ধটিতে গান-বাজনার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সবিস্তারে আলোকপাত করা হয়েছে। বর্তমান যুগের গান-বাজনায় যে ধরনের ফাহেশা, অশ্লীলতা, বেলেল্লাপনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে উৎকণ্ঠিত করতে বাধ্য। গান-বাজনা নারীদের জন্য অধিক ফিতনার কারণ, এ বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

    গান-বাজনার ব্যাপারে ইসলামের বিধান

    আখতারুজ্জামান মুহাম্মাদ সুলাইমান

    সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    حكم الغناء في الإسلام

    (باللغة البنغالية)

    أختر الزمان محمد سليمان

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    সূচিপত্র

    ১. গান-বাজনার ক্ষতিকর দিকসমূহ. 4

    ২. শরীরে লোহা প্রবেশ করানোর হাকীকত.. 7

    ৩. বর্তমান জামানায় গান-বাজনা.. 11

    ৪. তথাকথিত ধর্মীয় গান. 12

    ৫. শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বরের দ্বারা মেয়েদের ফিৎনা.. 13

    ৬. গান অন্তরে নিফাকী সৃষ্টি করে... 14

    ৭. গান-বাজনা শ্রবণের প্রতিকার. 16

    ৮. যে সকল গান শ্রবণ করা জায়েয. 18

    সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............

    প্রবন্ধটিতে গান-বাজনার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সবিস্তারে আলোকপাত করা হয়েছে। বর্তমান যুগের গান-বাজনায় যে ধরনের ফাহেশা, অশ্লীলতা, বেলেল্লাপনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে উৎকণ্ঠিত করতে বাধ্য। গান-বাজনা নারীদের জন্য অধিক ফিতনার কারণ, এ বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

    গান-বাজনার ব্যাপারে ইসলামের বিধান

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

    ﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشۡتَرِي لَهۡوَ ٱلۡحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًاۚ﴾ [لقمان: ٦]

    “আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে। আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে।” [সূরা লুকমান, আয়াত: ৬]

    বেশিরভাগ মুফাস্‌সীরগণ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা لَهۡوَ ٱلۡحَدِيثِ বলতে গানকে বুঝিয়েছেন। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, তা হচ্ছে গান। ইমাম হাসান বসরী রহ. বলেন, তা গান ও বাদ্যের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।

    আল্লাহ তা‘আলা শয়তানকে সম্বোধন করে বলেন,

    ﴿وَٱسۡتَفۡزِزۡ مَنِ ٱسۡتَطَعۡتَ مِنۡهُم بِصَوۡتِكَ﴾ [الاسراء: ٦٤]

    “তোমার কন্ঠ দিয়ে তাদের মধ্যে যাকে পারো প্ররোচিত কর।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৬৪]

    গান-বাজনার ক্ষতিকর দিকসমূহ:

    ইসলাম কোনো জিনিসের মধ্যে ক্ষতিকারক কোনো কিছু না থাকলে তাকে হারাম করে নি। গান ও বাজনার মধ্যে নানা ধরনের ক্ষতিকর জিনিস রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. এ সম্বন্ধে বলেন,

    - বাজনা হচ্ছে নফসের মদস্বরূপ। মদ যেমন মানুষের ক্ষতি করে, বাদ্যও মানুষের সেই রকম ক্ষতি করে। যখন গান-বাজনা তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, তখনই তারা শির্কে পতিত হয়। আর তখন তারা ফাহেশা কাজ ও যুলুম করতে উদ্যত হয়। তারা শির্ক করতে থাকে এবং যাদের কতল করা নিষেধ তাদেরকেও কতল করতে থাকে। যিনা করতে থাকে। যারা গান-বাজনা করে তাদের বেশিরভাগের মধ্যেই এই তিনটি দোষ দেখা যায়। তাদের বেশিরভাগই মুখ দিয়ে শিস দেয় ও হাততালি দেয়।

    - শির্কের নিদর্শন: তাদের বেশির ভাগই তাদের শাইখ (পীর) অথবা গায়কদের আল্লাহরই মতোই ভালোবাসে অথবা আরো অধিক।

    - অশ্লীলতা: গান হলো যিনার রাস্তাস্বরূপ। এর কারণেই গানের মজলিসে বেশিরভাগ ফাহেশা তথা অশ্লীল কাজ অনুষ্ঠিত হয়। ষেখানে পুরুষ, বালক, বালিকা ও মহিলা চরম স্বধীন ও লজ্জাহীন হয়ে পড়ে। এভাবে গান শ্রবণ করতে করতে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনে। তখন তাদের জন্য ফাহেশা কাজ করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়, যা মদ্যপানের সমতুল্য কিংবা আরও অধিক।

    - কতল বা হত্যা: অনেক সময় গান শ্রবণ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে একে অপরকে হত্যা করে ফেলে। তখন বলে: তার মধ্যে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, যে জন্য হত্যা করা ছাড়া উপায় ছিল না। তা থেকে বিরত থাকা তার ক্ষমতার বাইরে ছিল। আসলে এ সময়ে মজলিসে শয়তান উপস্থিত হয়। আর যাদের ওপর শয়তান বেশি শক্তিশালী তারা অন্যদের হত্যা করে ফেলে।

    - পথভ্রষ্টতা ও ক্ষতি: গান-বাজনা শ্রবণে অন্তরের কোনো লাভ হয় না, তাতে কোনো উপকারও নেই; বরঞ্চ এতে আছে গোমরাহী এবং ক্ষতি, যা লাভের থেকেও বেশি ক্ষতিকর। যা রূহের জন্য ঐ রকম ক্ষতিকর যেমন মদ শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ফলে যারা সঙ্গীত শ্রবণ করে, তাদের নেশা মদ্যপায়ীর নেশা থেকেও অনেক বেশি হয়। তারা ওতে যে মজা পায়, তা মদ্যপায়ীর থেকেও অনেক বেশি।

    - শয়তান তাদের নিয়ে খেলা করে: তখন এই অবস্থায় তারা আগুনে প্রবেশ করে, কেউ গরম লোহা শরীরের মধ্যে কিংবা জিহ্বায় প্রবেশ করায় অথবা এ জাতীয় কাজ করে। তারা সালাত আদায়ের সময় অথবা কুরআন তিলাওয়াতের সময় এই রকম অবস্থা প্রাপ্ত হয় না। কারণ এগুলো শরী‘আতসম্মত ইবাদত, ঈমানী কাজ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ, যা শয়তানকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর অন্যগুলো ইবাদতের নামে বিদ‘আত। এতে আছে শির্ক ও শয়তানী কাজ, দার্শনিকের কাজ। যাতে শয়তানরা সহজেই আকৃষ্ট হয়।

    শরীরে লোহা প্রবেশ করানোর হাকীকত:

    শরীরের মধ্যে লোহার শলাকা, না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আর না সাহাবীগণ প্রবেশ করাতেন। যদি এ কাজ উত্তমই হত তবে অবশ্যই তারা এতে অগ্রগামী হতেন। বরঞ্চ উহা সূফী পীর ও বিদ‘আতীদের কাজ। আমি তাদেরকে মসজিদে একত্রিত হতে দেখেছি। তাদের সাথে তবলা জাতীয় যন্ত্র দফ ছিল। তারা গান করছিল: আমাদের মদের গ্লাস এনে দাও এবং তা আমাদের পান করাও। আল্লাহর ঘরে বসে মদ জাতীয় দ্রব্যের উচ্চারণ করতে তাদের লজ্জাও হয় না। তারপর উচ্চ আওয়াজে দফ বাজাচ্ছিল এবং উচ্চ আওয়াজে গাইরুল্লাহর নিকট বিপদে উদ্ধার চাচ্ছিল। আর বলছিল: হে দাদা! ... এভাবে শয়তান তাদের ধোকায় নিপতিত করছিল। তারপর আর একজন তার জামা খুলে একটি লোহার শিক হাতে নিয়ে তার পাঁজরের মধ্যে প্রবেশ করাল। তারপর আর একজন উঠে দাঁড়িয়ে কাঁচের একটি গ্লাস ভেঙ্গে তা দাঁত দিয়ে চুর্ণ বিচুর্ণ করছিল। তখন আমি মনে মনে বললাম, এরা যা বলছে তা যদি সত্যিই সহীহ হয় তবে যেন তারা ঐ ইয়াহূদীদের সাথে যুদ্ধ করে যারা আমাদের ভূমি জবর দখল করে রেখেছে আর আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে। এসব কাজ যে সব শয়তানরা সেখানে উপস্থিত হয় তারা তাদের সাহায্য করে। কারণ, ঐ লোকেরা আল্লাহর স্মরণ হতে দূরে রয়েছে। আর যখন তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের নিকট বিপদে উদ্ধার চায়, তখন তারা শির্কের মধ্যে লিপ্ত হয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

    ﴿وَمَن يَعۡشُ عَن ذِكۡرِ ٱلرَّحۡمَٰنِ نُقَيِّضۡ لَهُۥ شَيۡطَٰنٗا فَهُوَ لَهُۥ قَرِينٞ ٣٦ وَإِنَّهُمۡ لَيَصُدُّونَهُمۡ عَنِ ٱلسَّبِيلِ وَيَحۡسَبُونَ أَنَّهُم مُّهۡتَدُونَ ٣٧﴾ [الزخرف: ٣٦، ٣٧]

    “আর যে পরম করুণাময়ের যিকির থেকে বিমুখ থাকে, আমরা তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, ফলে সে এক শয়তানের সঙ্গী হয়ে যায়। আর নিশ্চয় তারাই (শয়তান) মানুষদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়। অথচ মানুষ মনে করে তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৩৬-৩৭]

    আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য শয়তানকে নির্দিষ্ট করে দেন, যাতে তারা আরও গোমরাহ হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ قُلۡ مَن كَانَ فِي ٱلضَّلَٰلَةِ فَلۡيَمۡدُدۡ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ مَدًّاۚ﴾ [مريم: ٧٥]

    “বলুন, যে বিভ্রান্তিতে রয়েছে তাকে পরম করূণাময় প্রচুর অবকাশ দিবেন।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৭৫]

    শয়তান যে তাদের সাহায্য করে, এতে আবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ, সুলাইমান আলাইহিস সালাম রাণী বিলকীসের সিংহাসন উঠিয়ে আনার জন্য এক জিন্নের নিকট সাহায্য চেয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে কুরআনে আছে,

    ﴿ قَالَ عِفۡرِيتٞ مِّنَ ٱلۡجِنِّ أَنَا۠ ءَاتِيكَ بِهِۦ قَبۡلَ أَن تَقُومَ مِن مَّقَامِكَۖ وَإِنِّي عَلَيۡهِ لَقَوِيٌّ أَمِينٞ ٣٩ ﴾ [النمل: ٣٩]

    “এক শক্তিশালী জিন্ন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বেই আমি তা এনে দিব। আমি নিশ্চয় এ ব্যাপারে শক্তিশালী ও আমানতদার।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৩৯]

    যারা হিন্দুস্তানে গিয়েছেন, যেমন ভ্রমনবিদ ইবন বতুতা কিংবা অন্যান্যরা। তারা অগ্নি উপাসকদের লোহার শিক শরীরে প্রবেশ করানো থেকেও বেশি ভয়ংকর ঘটনা দেখেছে, যদিও তারা ছিল কাফের। তাই এ ঘটনা কোনো কারামত বা অলৌকিক ঘটনা নয়। বরঞ্চ তা ঐ সমস্ত শয়তানদের ঘটনা যারা এভাবে একত্রিত হয় গান বাজনার আসরে। দেখা যায়, বেশিরভাগ লোক যারা শরীরে শিক প্রবেশ করায়, তারা নানা ধরনের পাপে লিপ্ত। এমনকি প্রকাশ্যভাবে তারা আল্লাহর সাথে শির্কে লিপ্ত থাকে। কারণ, তারা তাদের মৃত পুর্বপুরুষদের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করে। তাহলে কীভাবে কারামতের অধিকারী অলী আল্লাহ হতে পারে?

    আল্লাহ তা‘আলা ওলীদের সম্বন্ধে বলেন:

    ﴿أَلَآ إِنَّ أَوۡلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢﴾ [يونس: ٦٢]

    “শুনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই, আর তারা পেরেশানও হবে না। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৬২]

    অলী হচ্ছেন ঐ মুমিন বান্দা, যিনি সর্বদা এক আল্লাহর নিকট সাহায্য ভিক্ষা করেন। আর মুত্তাকি হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যিনি আল্লাহর সাথে পাপ ও শির্ক করা থেকে বিরত থাকেন। এ সমস্ত অলীদের জীবনে হঠাৎ করে কোনো কারামত ঘটে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মানুষের দাবী বা লোক দেখানোর জন্য এটা ঘটে না।

    বর্তমান জামানায় গান-বাজনা:

    বর্তমান জামানায় বেশিরভাগ গান হয় বিয়ের মজলিসে অথবা অন্য কোনো উৎসবে, রেডিও ও টেলিভিশনে। এগুলোর বেশিরভাগই ভালোবাসা, মিলনাকাংখা, চুমু, দেখা-সাক্ষাৎ ইত্যাদির ওপরে ভিত্তি করে রচিত। তাতে থাকে মুখের, কপালের এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গের বর্ণনা, যা যুবকদের মনে মিলনাকাংখা জাগিয়ে তোলে আর তাদের অশ্লীল কাজ ও যিনা করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের চরিত্র নষ্ট করে।

    যখন গায়ক গায়িকারা গান বাজনার নামে একত্রিত হয়, তখন ঐ সমস্ত ধন দৌলত ব্যয় হয়, যা সংস্কৃতির নামে জাতীয় তহবিল থেকে চুরি করা হয়। তারপর ঐ ধন দৌলত নিয়ে ইউরোপ আমেরিকা গিয়ে বাড়ি-গাড়ী ইত্যাদি খরিদ করে। তারা তাদের অশ্লীল গান-বাজনা দিয়ে জাতীয় চরিত্র নষ্ট করে দেয়। তাদের অশ্লীল ও নগ্ন ছবি দিয়ে যুবকদের চরিত্র নষ্ট করে। ফলে আল্লাহকে ছেড়ে তারা তাদেরকে ভালোবাসতে থাকে। এমনকি ১৯৬৭ সালে ইয়াহূদীদের সাথে যুদ্ধের সময় রেডিও হতে বলা হচ্ছিল, তোমরা যুদ্ধে অগ্রসর হতে থাক; কারণ তোমাদের সাথে অমুক অমুক গায়িকা আছে। ফলে তারা পাপিষ্ট ইয়াহূদীদের সাথে চরমভাবে বিপর্যস্ত ও পরাজিত হয়। বরঞ্চ তাদের বলা উচিৎ ছিল, তোমরা আল্লাহর সাহায্য নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাক, তিনি তোমাদের সাথে আছেন। এমনকি এক গায়িকা এ ঘোষণা দিয়েছিল যে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্বে তার প্রতি মাসে কায়রোয় যে মাসিক উৎসব হতো, এ বৎসর তা সে তেলআবিবে করবে, যদি তারা জয়যুক্ত হয়। অন্যদিকে আল্লাহর সাহায্যের জন্য ইয়াহূদীরা যুদ্ধের পর বায়তুল মুকাদ্দাসের গোনাহ মোচনের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিল।

    তথাকথিত ধর্মীয় গান:

    এসব ধর্মীয় গান-বাজনার মধ্যেও নানা ধরনের গর্হিত কথা থাকে। যেমন বলা হলো, প্রতি নবীরই একটা নির্দিষ্ট অবস্থান আছে, আর হে মুহাম্মাদ! এ সেই ‘আরশ! একে গ্রহণ কর। এই বাক্যের শেষ কথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা বানান হয়েছে, যার মূল ঠিক নয়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনই ‘আরশ গ্রহণ করবেন না আর তাঁর রবও এ কথা বলবেন না।

    শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বরের দ্বারা মেয়েদের ফিৎনা:

    সাহাবী বারা ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কন্ঠস্বর ছিল মধুর। কোনো কোনো সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে চলার সময় ধর্মীয় গান গাইতেন। একদা যখন তিনি গান গাচ্ছিলেন, আর মহিলারা নিকটে এসে পড়ল, তখন রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: মেয়েদের থেকে সাবধান! ফলে তিনি নিশ্চুপ হয়ে পড়লেন। তার স্বর মেয়েরা শ্রবণ করুক তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেন নি। (হাকেম, হাদীস নং ৫২৭৩)

    যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ভয় পেয়ে থাকেন যে, বাগানে গিয়ে সুর করে কবিতা পড়লে মেয়েদের মধ্যে ফিৎনা হবে, তাহলে বর্তমান জামানায় মহিলারা রেডিও টেলিভিশনে যে ধরনের গান-বাজনা করে তাদের গান-বাজনা শুনলে কী বলতেন? এ ধরনের গায়িকারা বেশিরভাগই নানা ধরনের ফাসিক ও নগ্ন কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে, আর শরীরের নানাবিধ বর্ণনা দিয়ে যে কবিতা পাঠ করে তাতে বিবিধ ধরনের অব্স্থার ও মানসিক ফিতনার উদ্রেক করে। ফলে অন্তরে এমন রোগের সৃষ্টি হয় যা তাদের তাদের লজ্জা শরম বির্সজন দিতে ও বেহায়াপনায় লিপ্ত হতে উৎসাহিত করে। যদি এ গানের সাথে মাতাল করা সুরের মিশ্রণ হয়, তবে তো তাদের বুদ্ধির বিভ্রম ঘটায়। যারা এই গানের নেশায় পড়ে, তাদের তা ঐ রকমই ক্ষতি করে যা মদ পান করার পর হয়ে থাকে।

    গান অন্তরে নিফাকী সৃষ্টি করে:

    ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, গান অন্তরে মুনাফেকী সৃষ্টি করে, যেমন পানি ঘাস সৃষ্টি করে। যিকির অন্তরে ঈমান সৃষ্টি করে, যেমন পানি ফসল উৎপন্ন করে।

    ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, যে ব্যক্তি সব সময় গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে, তার অন্তরে মুনাফেকীও সৃষ্টি হবে, যদিও তার মধ্যে এর অনুভুতি আসবে না। যদি সে মুনাফেকীর হাকীকত বুঝতে পারত, তবে অবশ্যই অন্তরে তার প্রতিফলন দেখতে পেত। কারণ, কোনো বান্দার অন্তরে কোনো অবস্থাতেই গানের মহব্বত ও কুরআনের মহব্বত একত্রে সন্নিবেশিত হতে পারে না। তাদের একটি অন্যটিকে অবশ্যই দুর করে দিবে। কারণ, আমরা দেখতে পাই যে, গান ও কাওয়ালী শ্রবণকারীদের কাছে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা খুবই শক্ত ঠেকে আর ক্বারীগণ যে আয়াতই তিলাওয়াত করুক না কেন, তা দ্বারা ঐসব লোক মোটেই উপকৃত হয় না। ফলে শরীরে কোনো নাড়াচড়া ও অন্তরে কোনো উদ্দীপনা আসে না। আর যখনই তারা গান শ্রবণ করে, তখনই তাদের কন্ঠস্বরে ভয়ের এক প্রভাব সৃষ্টি হয়, অন্তরে এক ভাবের সৃষ্টি হয়, সেটার জন্য রাত্রি জাগরণ করা তাদের নিকট মধুর হয়। ফলে দেখতে পাই তারা গান বাদ্য শ্রবণ করাকে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ অপেক্ষা বেশি প্রধান্য দেয়। বেশিরভাগ লোকই যারা গান ও বাদ্যের ফিৎনায় লিপ্ত আছে, তারা সালাত আদায়ে খুব অলসতা দেখায়। বিশেষ করে জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে।

    ইবন আকীল রহ. যিনি হাম্বলী মাযহাবের একজন বড় আলেম, তিনি বলেন, যদি কোনো গায়িকা (নিজের স্ত্রী ব্যতিত) গান গায় তবে তা শ্রবণ করা হারাম। এ ব্যপারে হাম্বলী মাযহাবে কোনো মতবিরোধ নেই।

    ইবন হাযম রহ. বলেন, মুসলিমদের জন্য কোনো বেগানা মহিলার গান শ্রবণ করে আনন্দ লাভ করা হারাম।

    গান-বাজনা শ্রবণের প্রতিকার:

    রেডিও টেলিভিশন, ভিডিও কিংবা অন্য কোনো স্থানে যে গান হয়, তা শ্রবণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে অশ্লীল গান থেকে, যাতে বাদ্যও বাজানো হয়।

    গান-বাজনা থেকে বিপরীত কাজ হলো আল্লাহর যিকির ও কুরআন তিলাওয়াত করা। বিশেষ করে সূরা আল-বাকারাহ তিলাওয়াত করা।

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

    «إنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الذِيْ يَقْرَأُ فِيْهِ الْبَقَرَةَ»

    “যে বাড়িতে সূরা আল-বাকারাহ তিলাওয়াত করা হয়, সে বাড়ি থেকে শয়তান পালায়ন করে।”[1]

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

    ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧﴾ [يونس: ٥٧]

    “হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদেরর কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৭]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী ও শামায়েল (আখলাক) পাঠ করা এবং সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরামের জীবনীও অধ্যায়ন করা।

    যে সকল গান শ্রবণ করা জায়েয:

    ঈদের গান শ্রবণ করা: এ হাদীসটি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত:

    «دَخَلَ رَسُولُ اللهِ صَلي الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيْهَا وَعِنْدَهَا جَارِيَتَانِ تَضْرِبَانِ بِدَفَّيْنِ (وَفِي رِوَايَةٍ عِنْدِي جَارِيَتَانِ تُغَنِّيَانِ) فَانْتَهَرَهُمَا ابُوْبَكرٍ فَقالَ صَلي الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَعْهُنَّ فَانَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيْدًا وَإنَّ عِيْدَنَا هَذا الْيَوْم» (رواه البخاري)

    “একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘরে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর ঘরে দুই বালিকা দফ বাজাচ্ছিল। অন্য রেওয়ায়েতে আছে গান করছিল। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাদের ধমক দেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাদের গাইতে দাও। কারণ, প্রত্যেক জাতিরই ঈদের দিন আছে। আর আমাদের ঈদ হল আজকের দিন।”[2]

    দফ বাজিয়ে বিয়ে প্রচারের জন্য গান গাওয়া আর তাতে মানুষদের উদ্ধুদ্ধ করা। দলীল: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

    «فَصْلُ ما بَيْنَ الْحَلَالِ وَالْحَرَمِ ضَرْبُ الدَّفِ وَالصَّوْتُ فِي النِّكَاحِ»

    “বিয়ে হারাম বা হালাল হওয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো দফের বাজনা ও শব্দ করে জানিয়ে দেওয়া।”[3] যাতে এর দ্বারা বুঝা যায় যে, সেখানে বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

    কাজ করার সময় ইসলামী কোরাস শ্রবণ করা, যাতে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ঐ গানে যদি দো‘আ থাকে। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নামক সাহাবীর কবিতা আবৃত্তি করতেন। আর সাথীদেরকে খন্দকের যুদ্ধের সময় পরিখা খনন করতে উদ্ধুদ্ধ করতেন এই বলে যে, “হে আল্লাহ কোনোই জীবন নেই আখেরাতের জীবন ব্যতীত। তাই আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করে দিন। তখন আনছার ও মুহাজিনগণ উত্তর দিলেন: আমরাই হচ্ছি ঐ ব্যক্তিবর্গ যারা রাসূলের নিকট বাই‘আত করেছি জিহাদের জন্য, সর্বদাই যতদিন আমরা জীবিত থাকি।”

    আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে নিয়ে যখন খন্দক (গর্ত) খনন করছিলেন, তখন ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন:

    “আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ না করতেন তাহলে আমরা হিদায়াত পেতাম না। আর সিয়ামও পালন করতাম না, আর সালাতও আদায় করতাম না। তাই আমাদের ওপর সাকিনা (শান্তি) নাযিল করুন। আর যখন শত্রুদের মুকাবিলা করব তখন আমাদের মজবুত রাখুন। মুশরিকরা আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে আর যদি তারা কোনো ফিৎনা সৃষ্টি করে, তবে আমরা তা ঠেকাবই।” বারে বারে আবাইনা শব্দটি তারা উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করছিলেন।

    ঐ সমস্ত কবিতা-গান, যাতে আল্লাহর তাওহীদের কথা আছে অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও তার শামায়েল আছে অথবা যাতে জিহাদে উৎসাহিত করা হয় তাতে দৃঢ় থাকতে অথবা চরিত্রকে দৃঢ় করতে উদ্ধুদ্ধ করা হয় অথবা এমন দাওয়াত দেওয়া হয় যাতে মুসলিমদের একে অন্যের প্রতি মহব্বত ও সম্পর্ক সৃষ্টি হয় অথবা যাতে ইসলামের মৌলিক নীতি বা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয় অথবা এই জাতীয় অন্যান্য কথা যা সমাজকে উপকৃত করে দীনি আমলের দিকে কিংবা চরিত্র গঠনের জন্য উৎসাহ প্রদান করে।

    ঈদের সময় ও বিয়ের সময় কেবল মহিলাদের জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে দফ বাজানোর অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। যিকিরের সময় এটার ব্যবহার ইসলাম কখনই দেয় নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিকিরের সময় কখনই তা ব্যবহার করেন নি। তাঁর পরে তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম কখনই তা করেন নি। অথচ ভণ্ড সুফি পীররা তা মুবাহ করেছে নিজেদের জন্য। আর যিকিরের দফ বাজানকে তারা সুন্নাত বানিয়ে নিয়েছে। বস্তুত তা বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

    «ايَّاكُمْ وَمُحْدَثاتِ الْاُمُوْرِ فاِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بدْعَةٍ وكُلُّ بِدْعًةٍ ضَلالَةٍ»

    “তোমরা দীনের মধ্যে নতুন কোনো সংযোজন করা হতে বিরত থাকো। কারণ, প্রতিটি নতুন সংযোজনই বিদ‘আত। আর প্রতিটি বিদ‘আতই গোমরাহী।”[4]

    সমাপ্ত

    [1] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮০।

    [2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৯৩১।

    [3] মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৫৫৪১।

    [4] আবূ দাঊদ, হাদীস নং ৪৬০৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৭১৪৫।